Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,সরস্বতী ছবি

সরস্বতী ছবি ও নানারূপে দেবীর সন্ধান ।  বর্ণালী রায়

Reading Time: 8 minutes
 
সামনেই সরস্বতী পূজা।হিন্দুধর্মে দেবী সরস্বতীকে আমরা বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী হিসেবেই চিনে এসেছি।কিন্তু বৈদিক সরস্বতী, তান্ত্রিক সরস্বতীর একদম অন্য রকম ভূমিকার খোঁজ মেলে আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে।সেখানে দেবী কোথাও তেজ,কোথাও জ্ঞান,কোথাও দীপ্তি, কোথাও বাক,কোথাও যুদ্ধের দেবী,কোথাও আবার নদীরূপা।কোথাও তাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ব্রক্ষ্মার সাথে,কোথাও শিবের সাথে,কোথাওবা বিষ্ণু র সাথে।তারপর সেই রূপেরও বিবর্তন ঘটেছে ক্রমাগত।আমরা বারবার পুরাণে বর্নিত প্রতীকী গল্পগুলির অর্ন্তনিহিত অর্থ না বুঝে নানারকম ব্যাখ্যা করে ফেলি।কিন্তু তন্ত্র শাস্ত্র অনুযায়ী পুরুষ হল আধার,আর নারী হল শক্তি।তাই এক একই কাজের জন্য শক্তির নানারূপের প্রকাশ। আদি শক্তি ই ইচ্ছা,ক্রিয়া,জ্ঞান—- যা দূর্গা,লক্ষী,সরস্বতী। আসুন দেবী সরস্বতীকে নানা দিক দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করিঃ-
শৈবাগমতন্ত্রে যাঁকে সিদ্ধবিদ্যা ষোড়শী বিদ্যা বলা হয় সেই ষোড়শী বিদ্যার দেবীকেই সরস্বতী বা বাগেশ্বরী বলা হয়। শৈবাগম সাধকদের নিকট সাধারণভাবে ইনি বাণী, বীণাপানি, বাক্‌দেবী, শুভ্রা, হংসবাহনা প্রভৃতি নামে পরিচিত।
ব্রহ্ম-বৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টিকালে প্রধানা শক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পাঁচভাগে বিভক্ত হন -রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী। সরস্বতী কৃষ্ণ কণ্ঠ হতে উদ্ভুতা। শ্রীকৃষ্ণ এই দেবীকে প্রথমে পূজা করেন। তখন থেকেই এই দেবীর পূজা প্রচলিত হয়। দেবী শ্রীকৃষ্ণ হতে উদ্ভুতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণকেই কামনা করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ সরস্বতীকে নারায়ণ ভজনা করতে বলেন। লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই নারায়ণের স্ত্রী। ভাগবত মতে সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী।পুরাণকারদের মতে, পরমাত্মার মুখ হতে এই দেবীর আবির্ভাব হয়। এই দেবী শুক্লবর্ণা, বীণাধারিণী এবং চন্দ্রে শোভাযুক্তা, ইনি শ্রুতি ও শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠা, কবি এবং বিদ্বানদের ইষ্টদেবতা, এইজন্য এঁর নাম সরস্বতী। সরস্বতী জ্যোতিঃ (প্রঞ্জাজ্যোতিঃ) এবং রসের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
সরস্বতী স, রসবতী। রসো বৈ সঃ অর্থাৎ রসস্বরূপ পরব্রহ্মের তিনি পরম প্রকাশ।
ঋগ্বেদেরই ১৪২ সূক্তে ঋষি দীর্ঘতমা দৃষ্ট ৯ নম্বর মন্ত্রে দেবী সরস্বতীকে ইলা এবং ভারতী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
“শুচির্দেবেষ্পিতা হোত্রা মরুৎসু ভারতী।
ইলা সরস্বতী মহী বর্হিঃ সীদন্তু যঞ্জিয়াঃ ।”
– এই মন্ত্রে ইলা, সরস্বতী, ভারতীকে অগ্নির ত্রিমূর্তি হিসাবে বন্দনা করা হয়েছে। ভারতী স্বর্গস্থ বাক্দেবতা, ইলা পৃথিবীস্থ বাক্দেবতা এবং সরস্বতী অন্তরীক্ষস্থ বাক্দেবতা।
পৌরাণিক সরস্বতী এবং বৈদিক সরস্বতীর সঙ্গে এঁর সাদৃশ্য থাকলেও ধ্যান ও মন্ত্ররহস্য সম্পূর্ণ পৃথক। এই দেবী নানা স্থানে নানাভাবে পূজিত হয়ে থাকেন। দেবীর বহুরূপ, বহুবাহন ও বহুলীলা।
দেবী কখনও দ্বিভূজা, কখনো চতুর্ভুজা আবার প্রয়োজনবোধে কখনো বা ষোড়শভূজা। প্রত্যেক রূপেই মন্ত্র যন্ত্র পৃথক পৃথক। ষোড়শী বিদ্যাদেবীর ষোলটি নাম, ষোল রকমের রূপ। সকলেরই মাথার উপর মন্দিরের মত উঁচু মুকুট। সকলেই ললিত মুদ্রাসনে আসীনা, একটি পা নীচু করে রেখেছেন, একটি পা আসনের দিকে গুটানো। সকলেরই দক্ষিণ হস্ত বক্ষোপরি বরমুদ্রায় স্থাপিত, বামহস্ত মোড়া এবং উঁচুতে তোলা। প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গীই গভীর ভাবের দ্যোতক, বিভিন্ন যোগরহস্যের সঙ্কেত-সূচক।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা – বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা ‘ বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন।
সরস্বতীর অন্যান্য নাম যেমন বিদ্যাদেবী, বীণাপানি, শুভ্রা, শুক্লা, হংসবাহিনী, বাণী, পুস্তকহস্তা, বাগদেবী ইত্যাদি তো আছেই, কিন্তু এছাড়া জৈন ধর্মে বিদ্যাদেবী বলে ১৬ জন দেবীর এক সমষ্টি আছে , তারা হলেন , কালী (দশমহাবিদ্যার নয়), মহাকালী (দশমহাবিদ্যার নয়) ,গৌরী (পার্বতীর রূপ নয়) ,প্রঞ্জপ্তী ,পুরুষদত্তা ভারতী , বৈরাট্যা , মহামানসী , সর্বাস্ত্রমহাজ্বালা , অচ্ছুপ্তা , রোহিণী , বজ্রশৃঙ্খলা , কুলিশাঙ্কুশা , চক্রেশ্বরী , গান্ধারী , মানবী এবং মানসী । এদের বর্ননা হলো –
১. রোহিনী – দেবীর বাহন জলচৌকি। দেবী চতুর্ভুজা। দক্ষিণ ও বাম উভয় হস্তেই চক্র। দেবীর অপর নাম অজিতবালা ।
২. প্রঞ্জপ্তী – দেবীর বাহন হংস। দেবী ষষ্ঠভুজা। তাঁর হাতে অসি, কুঠার, চন্দ্রহাস ও দর্পণ। দেবীর অপর নাম দুরিতারী ।
৩. বজ্রশৃঙ্খলা -দেবীর বাহন হংস। দেবী চতুর্ভুজা। হাতে পারিখ ও বৈষ্ণবাস্ত্র।
৪. কুলিশাঙ্কুশা -দেবীর বাহন অশ্ব। দেবী চতুর্ভুজা। তাঁর ডান হাতে অসি এবং বাম হাতে ভূষণ্ডী। দেবীর অন্যান্য নাম যথাক্রমে মনোবেগা , মনোগুপ্তি , শ্যামা ।
৫. চক্রেশ্বরী -দেবীর বাহন গরুড়। দেবী ষোড়শভূজা। উপরের দক্ষিণ ও বাম হস্তে শতঘ্নী এবং ১০ হাত মুষ্টিবদ্ধ। দুই হাত কোলে স্থিরভাবে পতিত এবং বাকী দুই হাতে বরদানের মুদ্রা।
৬. পুরুষদত্তা ভারতী — দেবীর বাহন হস্তী। দেবীর দক্ষিণ হস্তে চক্র এবং বাম হস্তে শতঘ্নী। এঁর মুখমণ্ডল চতুস্কোণ বিশিষ্ট, পুরুষাকৃতি। দেহের গঠন সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ, কোমর সিংহের মত সরু।
৭. কালী – এই কালী দশমহাবিদ্যার কালী নন। বাহন বৃষ। দেবী চতুর্ভূজা। দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল ও বাম হস্তে শতঘ্নী। দেবীর অপর নাম শান্তি ।
৮. মহাকালী – ইনি তন্ত্রোক্ত দশমহাবিদ্যার মহাকালী নন। দেবীর কোন বাহন নেই। দেবী চতুর্ভুজা। ডান হাতে ষষ্ঠি এবং বাম হাতে শতঘ্নী। দেবীর অপর নাম অজিতা এবং সুরতারকা ।
৯. গৌরী – দেবীর বাহন বৃষ। দেবী চতুর্ভূজা। এঁর দক্ষিণ হস্তে মঙ্গলঘট এবং বাম হস্তে ষষ্ঠি। দেবীর মস্তকের মন্দিরাকৃতি মুকুটের বাম পার্শ্বে চন্দ্র। দেবীর অপর নাম মানসী ও অশোকা ।
১০. গান্ধারী – দেবী চতুর্ভূজা, কোন বাহন নেই। এঁর ডান হাতে পরিখ অর্থাৎ লৌহকণ্টকযুক্ত মুদগর আর বাম হাতে সীরলাঙ্গলাস্ত্র । এর দুই স্থান বাঁকা। মুখ ও মূলাংশ লৌহবদ্ধ, সাধ্য ত্রিহস্ত পরিমিত দীর্ঘ। এই মন্ত্রের কাজ আকর্ষণ ও নিপাতন। এই দেবীর অপর নাম চণ্ডা ।
১১. সর্বাস্ত্রমহাজ্বালা – দেবী অষ্টভূজা। এঁর বাহন বৃষ। দক্ষিণহস্তে অসি, ত্রিশূল, ভল্ল (বর্শা বিশেষ)। কার্য— নিক্ষেপে ছেদন, নিপাতন ও শায়িত করণ। বৈষ্ণবাস্ত্র এবং বাম হস্তে ব্রহ্মশির অস্ত্র, তীর ও পাশ। মস্তকে মন্দিরাকৃতি বিরাট মুকুট। মুকুটের চতুর্দিকে অরণ্য। দেবীর অপর নাম জ্বালামালিনী ও ভৃকুটি ।
১২. মানবী – দেবী চতুর্ভূজা।এঁর বাহন সাপ। দেবীর দুহস্তে দর্পণ, এক হাতে ষষ্ঠি, অপর হাত বরমুদ্রায় স্থাপিত। দেবীর অপর নাম অশোকা ।
১৩. বৈরাট্যা – দেবী চতুর্ভূজা।এঁর বাহন সাপ।এঁর দুহস্তে বৈষ্ণবাস্ত্র ও ভল্ল। দেবীর অপর নাম বৈরোটি ।
১৪. অচ্ছুপ্তা – দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন হংস। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল এবং বাম হস্তে বিজয়ধনু। দেবীর অপর নাম অনন্তবতী অঙ্কশা ।
১৫. মানসী – দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন সিংহ। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল ও কুঠার এবং বাম হস্তে দর্পণ ও বিজয়ধনু। দেবীর অপর নাম কন্দর্পা ।
১৬. মহামানবী — দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন ময়ূর। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল ও বাম হস্তে চক্র। দেবীর অপর নাম নির্বাসী।
ষোড়শী বিদ্যা সরস্বতীর এই ষোল রকমের দিব্যমূর্তি নিয়ে ভক্তের কাছে প্রকট হন। তাই তাঁর ষোড়শী রূপই আমাদের ধ্যানের বিষয় । তাঁর প্রত্যেকটি রূপেরই মন্ত্র যন্ত্র পৃথক পৃথক থাকলেও সব মিলিয়ে তাঁর যে দিব্যস্বরূপ, সরস্বতী বলতে আমরা তাঁকেই বুঝি।
গরুড় পুরাণে আবার সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এই অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তন্ত্র শাস্ত্রমতে সরস্বতী বাগীশ্বরী – অং থেকে ক্ষং পঞ্চাশটি বর্ণে তাঁর দেহ ।সরস্বতী শব্দের দুই অর্থ – একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী। সরস্ + বতী = সরস্বতী, অর্থ জ্যোতির্ময়ী। আবার সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। ঋগ্বেদে আছে ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী’ । সরস্বতী নদীর তীরেই বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উদ্ভব।
ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি – ভূ: ভুব: স্ব:, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী। বিশ্বভূবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে। হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয়, তখন জমাট বাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে। অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি। এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী, তাই তিনি সর্বশুক্লা। তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী, অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক বাগ্দেবী। গতিময় জ্ঞানের জন্যই ঋগ্বেদে তাঁকে নদীরূপা কল্পনা করা হয়েছে, যিনি প্রবাহরূপে কর্মের দ্বারা মহার্ণব বা অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হয়েছেন। কল্যাণময়ী নদীতটে সাম গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতো। তাদের কণ্ঠে উদ্গীত সাম সঙ্গীতের প্রতীকী বীণা দেবীর করকমলে।বেদক্ত বাগদেবী ত্রয়ীমূর্তি — ভূঃ বা ভূলোকে ইলা,ভুবঃ বা অন্তরীক্ষ লোকে সরস্বতী এবং স্বর্গলোকে ভারতী। ভূ ভূর্বঃ স্বঃ এই তিনে মিলে সামগ্রিক জগত। ভূলোকে অগ্নি অন্তরীক্ষ লোকে হিরণ্যদুত্যি ইন্দ্র এবং স্বর্গলোকে সূর্য এই তিনের যে জ্যোতি রাশি তা সরস্বতীরই জ্যোতি । তিনি জ্ঞানময়ী বা চিন্ময়ী রূপ সর্বত্র সর্বব্যাপী।
সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয় করে সাধনা করতে আশ্রমবাসী ঋষিগণ। সেই ভাবটি নিয়েই দেবী ‘পুস্তক হস্তে’, গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও তাঁর সঙ্গে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী। এ মূর্তি অষ্টভূজা – বাণ, কার্মূক, শঙ্খ, চক্র, হল, মুষল, শূল ও ঘন্টা ছিল তাঁর অস্ত্র। তাঁর এই সংহারলীলাতেও কিন্তু জ্ঞানের ভাবটি হানি ঘটেনি, কেননা তিনি ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা’ বলে মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন।
স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহৃত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা।
আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে –
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা
ইত্যাদি। এর অর্থ দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।
ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা।
মাতৃকা সরস্বতী শব্দব্রহ্মাত্মিকা। ‘অ’ থেকে ‘ক্ষ’ পর্যন্ত পঞ্চাশৎ বর্ণে তার শরীর গঠিত, তিনি মন্ত্রময়ী। ভূত শুদ্ধির দ্বারা লব্ধ শরীরের অঙ্গে অঙ্গে বিবধ বর্ণ সহযোগে ঐ মাতৃকা সরস্বতীর বিন্যাসের নামে মাতৃকান্যাস। অঙ্গে অঙ্গে এবং চক্রে চক্রে বিভিন্ন বর্ণের ন্যাস বা স্থাপনের দ্বারা সাধকের শরীরও মন্ত্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। মাতৃকা সরস্বতীর সাথে তার অভেদ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। সমস্ত মন্ত্র তার কাছে তখন চৈতন্যময় রূপে ধরা দেয়। ধ্যান প্রণাম ও স্তবাদিতে দেবতার যেই যেই স্বরূপ বর্ণিত মন্ত্র উচ্চারণ এর সঙ্গে সঙ্গে সেই সেই স্বরূপের দিব্য মহিমা তার অন্তর পটে উদ্ভাসিত হয়। দেবতা প্রাণময় রূপে উদ্ভাসিত হন। দেব মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটে। তবে তার আগে সাধকের নিজের প্রাণের উপরে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
সরস্বতীর বাহন হংস তন্ত্রের দিক থেকে বিচার করলে এর একটা উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য পাওয়া যায়, তন্ত্র ও উপনিষদ শাস্ত্রে ‘হংস’ ই পরমাত্মার লিঙ্গ বা প্রতীক।হংস ই তত্ত্বমসি জ্ঞান। কারণ ‘অহং সঃ’ এই আত্মচৈতন্য সূচক মহাবাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপই ‘হংসঃ’। নিঃশ্বাস গ্রহণকালে হং(অহং) এবং নিঃশ্বাস পরিত্যাগ এর সময় সঃ এই অজপা গায়ত্রী যারা নিত্য সচেতনভাবে জপ করেন হংস মন্ত্রের দৃপ্ত প্রভাবে তারা পরম জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত।’অহং সঃ’ এই জ্ঞান যার আয়ত্তে তাকেই বলা হয় পরমহংস বলা হয় ।
 
তন্ত্রসারে তারাই মহানীল সরস্বতী। মহানীল সরস্বতী বা তারার ধ্যান-
মন্ত্ররূপে উক্ত মন্ত্রটি তন্ত্রসারেও উদ্ধৃত হয়েছে। তন্ত্রসারে তারার আর একটি ধ্যান মন্ত্র—
শ্যামবর্ণাং ত্রিনয়নাং দ্বিভুজাং বরপঙ্কজে।
দধানাং বহুবর্ণাভির্বহুরূপাভিরাবৃতাম্ ৷৷
শক্তিভিঃ স্মেরবদনাং স্মেরমৌক্তিক ভূষণা।
রত্ন পাদুকয়ােস্তপদাম্বুজধুগাং স্মরেৎ ॥
—শ্যামবর্ণা ত্রিনয়না দ্বিভুজা, বরমুদ্রা ও পদ্মধারিণী, চতুর্দিকে বহুবর্ণা।
বহুরূপা শক্তির দ্বারা বেষ্টিতা, হাস্যমুখী মুক্তাভূষিতা, রত্নপাদুকায় পাদদ্বয় স্থাপনকারিণী তারাকে ধ্যান করবে।
বৃহদ্ধর্মপুরাণে তারাকে কেবলমাত্র শ্যামবর্ণা বলা হয়েছে—যান্তরীক্ষে শ্যামবর্ণা সা তারা কালরূপিণী। বীরভূম জেলায় তারাপীঠে ব্ৰহ্মশিলায় ক্ষোদিত তারা মূর্তি দ্বিভুজা সর্পযজ্ঞােপবীতে ভূষিতা—তার বামক্রোড়ে পুত্ররূপী শিব।
অবলীলাক্রমে বাক প্রদান করে বলে দেবী নীল সরস্বতী, রক্ষা করেন বলে তিনি তারা, সুখ মোক্ষদায়িনী অর্থাৎ তিনি তীব্র দুঃখ থেকে ত্রাণ করেন বলেও উগ্র তারা নামে পরিচিত হন।
মাতঙ্গী ও দশমহাবিদ্যার অন্যতমা মাতঙ্গী। তন্ত্রশাস্ত্রে মাতঙ্গী বা মাতঙ্গিনী বিদ্যাদেবী সরস্বতীরূপা।
স্তুত্যানয়া শংকরধম পত্নীং
মাতঙ্গিনীং বাগধিদেবতাম্ ॥
মাতঙ্গিনীর উপাসনায় বাকুসিদ্ধি ঘটে। মাতঙ্গী বিদ্যা সর্বপাপহারিণী মহাবিদ্যা।তন্ত্ররাজতন্ত্রে মাতঙ্গেশ্বরী বা মাতঙ্গিনী বিদ্যা বীণাবাদনরতা—
বাদয়ন্তীং মহাবীণাং স্বসমাঙ্গনাজনৈঃ।। কালিকাপুরাণে মাতঙ্গীই সরস্বতী
মাতঙ্গী তু সরস্বতী।
শ্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রত্নসিংহাসনস্থিতা।
বেদৈৰ্বাহুদরৈসিখেটকপাশাংকুশধরাম্ ॥
-শ্যামবর্ণ, চন্দ্রশেখরা, ত্রিনয়না, রত্নসিংহাসনে উপবিষ্টা বেদরূপী বাহুদণ্ডের।ঘর অসি খেটক পাশ ও অংকুশধারিণী।মাতঙ্গীর চতুর্বাহ চতুর্বেদ। বিদ্যাদেবী সরস্বতীই অন্যতম।
মহাবিদ্যা মাতঙ্গীতে পরিণত হয়েছেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে মাতঙ্গীর বর্ণনা—-
রক্তপদ্মাসনা শ্যামা রক্তবস্ত্র পরি ।
চতুভুজা খচর্মপাশাংকুশ ধরি।
ত্রিলােচনা অধ চলকপালফলকে।
কালিকাপুরাণে মাতঙ্গী উমার অষ্টযােগিনীর অন্যতম। শুম্ভনিশুম্ভবধের নিমিত্ত দেবগণ হিমালয়ে মহামায়ার স্তব করলে দেবী মহামায়া মাতঙ্গমুনির পত্নীরূপে দেবতাদের নিকট আবিভূত হয়ে দেবতাদের নিকট প্রশ্ন করেছিলেন–
মাতবর্ণিমূর্তিভৃত্ব দেবানপৃচ্ছৎ।
মাতঙ্গমুনির পত্নীর বেশ আকার ধারণ করায় তিনি মাতঙ্গী নামে পরিচিত। স্বতন্ত্রতন্ত্রে মাতঙ্গিনীর উৎপত্তি সম্পর্কিত উপাখ্যানে মাতঙ্গমুনি শতসহস্র (এক লক্ষ) বৎসর তপস্যা করলে তার তেজোরাশি মাতঙ্গিনীরূপ ধারণ করে। দেবতেজোরূপা চণ্ডী, ক্যাতায়ন ঋষির তেজে পিরবর্ধিত ক্যাতায়নী, মাতঙ্গমুনির তেজোজাতা মাতঙ্গী এবং দিব্য সরস্বতী একতা প্রাপ্ত হলেন মাতঙ্গী মহাবিদ্যায় । মাতঙ্গী দেবী ও উচ্ছিষ্ট চাণ্ডালিনী অভিন্ন।সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী, শিবারূঢ়া কালী ও রক্তপঙ্কজ মাতঙ্গী একই মহাশক্তির ভিন্ন ভিন্ন রূপ, একই দেবসত্তা—
শিববাপরি স্থিতা দেবী সিংহপৃষ্ঠে কদাচন।
মহিষেষু তথাপুত্র কদাচিদ্রপঙ্কজে ।
উচ্ছিষ্ট চণ্ডালিনীর মত দশমহাবিদ্যার অন্যতমা মাতঙ্গীর মূর্তস্তর উচ্ছিষ্ট মাতঙ্গিনীর বিবরণ আছে কুলার্ণবতন্ত্রে। তন্ত্রোক্ত বর্ণনা–
বীণাবাদ্যবিনােদগীতনিরং নীলাংশুকোদ্ভাসিনীং
বিম্বােষ্ঠীং নবযাবকাদ্রচরণামাকীর্ণকেশাননা।
মৃদ্বঙ্গীং সিতশঙ্কুণ্ডলধরাং মাণিক্যভূযােঙ্খলাং
মাতঙ্গীং প্রণতােহস্মি সুস্মিতমুখীং দেবীং শুকশ্যামলা।
-বীণাবাদ্য ও বিনােদগীতনির নীলবস্ত্রে সমুজ্জল, বিম্বােষ্ঠী, নবযাবকের দ্বারা আদ্র যাঁর চরণ, যাঁর আলুলায়িত কেশ মুখের উপর আকীর্ণ, যিনি কোমলাঙ্গী, শুভ্র শঙ্খনির্মিত কুণ্ডলধারিণী, রত্নালংকারে উজ্জ্বলা, শুকপক্ষীর মত শ্যামলবর্ণা, হাস্যমুখী মাতঙ্গীকে আমি প্রণাম করি।
বীণাবাদ্যগীতনির উচ্ছিষ্ট মাতঙ্গী সরস্বতীর রূপান্তর ছাড়া আর কি ভাবা যেতে পারে।
সাধনমালায় মহাসরস্বতীর বর্ণনা—“নে চ ভগবতীং মহাসরস্বতীমনুচিন্তয়েৎ
শরদিন্দুকরাকারাং সিতকমলােপরি চন্দ্রমণ্ডলস্থাং দক্ষিণ-করেণ বরদাং বামেন
সনালসিতসরােজধরাং স্মােরমুখীমতিকরুণময়াং শ্বেতচন্দনকুসুমবসনধরাং মুক্তাহারাে-
পশােভিতহৃদয়াং নানালংকারবতীং দ্বাদশবর্ষাকৃতিং মুদিতকুচ-
মহাসরস্বতী
মুকুলদস্তুরােরস্তটীং ঘূরদনন্তগভস্তিযূহাবভাসিতলােকয়া।
ততন্তৎপুরতে ভগবতীং প্রজ্ঞাং দক্ষিণতাে মেধাং পশ্চিমতাে মতিং বামতঃ স্মৃতি
এতা: স্বনায়িকাসমানবর্ণাদিকা: সম্মুখমবস্থিশ্চিন্তনীয়া।”
এইভাবে মহাসরস্বতীকে চিন্তা করবে। তিনি শরৎকালীন চন্দ্রকিরণের কান্তিবিশিষ্টা,
-চন্দ্রমণ্ডলে স্থিত শ্বেতপদ্মে আসীনা, বরদাত্রী, বামহস্তে মৃণালসহ শ্বেতপদ্মধারিণী
হাস্যমুখী, অতিকরুণাময়ী, শ্বেতচন্দন শ্বেতকুসুম শ্বেতবস্ত্রধারিণী, বক্ষস্থলে মুক্তা-
হারশােভিতা, নানা অলংকারে ভূষিতা, দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকার আকৃতিবিশিষ্টা,
বক্ষোদেশ মুদিতকুচমুকুলে উদ্ভিন্না, অনন্তকিরণসমূহে ত্রিলােক উদ্ভাসিতকারিণী।।
তার সম্মুখে ভগবতী প্রজ্ঞা, দক্ষিণে মেধা, পশ্চিমে মতি, বামে স্মৃতি । এরা তাঁর সমানবর্ণ। ও আকারবিশিষ্টা—সম্মুখভঙ্গীতে অবস্থিতা—এইভাবে চিন্তা করবে।মার্কণ্ডেয় পুরাণােক্ত চণ্ডীর উপাখ্যানে উত্তরচরিত বা শুম্ভনিশুম্ভবধ।উপাখ্যানের দেবতা মহাসরস্বতী। মহাসরস্বতী ও চণ্ডী এখানে অভিন্ন। মহাসরস্বতী অষ্টভুজা। তার ধ্যানমন্ত্র —
ঘটাশূলহলানি শঙ্খমুষলে চক্রং ধনুঃ সায়কং
হস্তাজৈর্দধতীং ঘনান্তর্বিলচ্ছিতাংশুতুল্যপ্রভা।
গৌরীদেহ সমুবাং ত্রিজগতামাধারভূতাং মহা-
পূর্বমত্র সরস্বতীমনুভজেছুন্তাদিদৈত্যাদিনীম্ ॥
—পদ্মহস্তে ঘণ্টা, শূল, হল, শঙ্খ, মুষল, চক্র ও ধনুর্বাণ ধারিণী, মেঘের মধ্যে প্রকাশিত চন্দ্ৰতুল্যপ্রভাসম্পন্ন, গৌরী দেহ থেকে জাতা, ত্রিজগতের আধার-রূপিণী, শুম্ভ প্রভৃতি দৈত্যঘাতিনী মহাসরস্বতীকে ভজনা করি ।শুম্ভাদি দৈত্যহন্ত্রী চণ্ডীর সঙ্গে অভিন্ন মহাসরস্বতী বৈদিক বৃহন্ত্রী সরস্বতীকে স্মরণ করায়।
লিঙ্গপুরাণে (১৬ অঃ) মহাসরস্বতী বিশ্বরূপা—বিশ্ব তার মাল্য, বিশ্ব তার যজ্ঞােপবীত, বিশ্ব তার উষ্ণীষ, বিশ্ব তার গন্ধ, তিনি বিশ্বের মাতা।
এই মহা-সরস্বতী বন্দনা করেছেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তঃ
বিশ্বমহাপদ্মলীনা ! চিত্তময়ী ! অয়ি জ্যোতিষ্মতী !
মহীয়সী মহাসরস্বতী !
স্বর্গলােকে স্বেচ্ছাসুখে জাগ তুমি গীতে
দেবতার চিতে।
ভূলােকে ভ্রমরগর্ভ শুভ্রনীলপদ্মবিভূষণ।
হংসারূঢ়া-ময়ূর আসন।।
জ্যোতির্ময়ী যে মহাসরস্বতী জ্যোতিদ্বারা ত্রিলােক উদ্ভাসিত করেন তিনি জ্যোতির্ময়ী দিব্য সরস্বতী

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>