Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,সরস্বতী পুজো

সরস্বতী পুজো-র একাল ও সেকাল । শুক্তি চট্টোপাধ্যায়

Reading Time: 4 minutes

-“শোন, আমি বলব ‘বলো সরস্বতী মাইকি’, আর তোরা বলবি ‘জয়’ কেমন?”

-“কেন-কেন? আমরাও বলব ‘বলো সরস্বতী মাইকি’…”

– “না সবাই একসাথে বলতে নেই।”

এই কিচিরমিচির শুনতে শুনতে বড় হওয়া, কারণ বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই সরস্বতী পুজো-র আগে একটি প্রাইমারী স্কুলের বাচ্ছারা তাদের মাস্টারমশাই বা দিদিমনির সাথে ঠাকুর নিয়ে ফিরত স্কুলে। শুনতে খুব মজা লাগত, আর খালি মনে মনে ভাবতাম এরকম যদি আমাদেরও দিন আসত, যদি আমরাও বন্ধুরা এর’ম ঠাকুর আনতে যেতে পারতাম। ইস্‌। মা সরস্বতী ডাক শুনেছিলেন, তবে কিছু পরে।

সব সময়ই সরস্বতী পুজা-র এক আলাদাই মজা থাকে। নির্মল এক আনন্দ। বাড়ির পুজো শেষ করে তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে হবে সেই তাড়া থাকে। কখন স্কুলের মুখটা দেখবে সবাই। আর সব মেয়েদের তো বাসন্তী রঙের শাড়ি must, ঐ একটাই দিন যেদিন মায়ের শাড়ির তাক থেকে একটা শাড়ি মেয়েরা হাতে পায়। এই সুযোগ কি সহজে ছাড়া যায়?

আর ছেলেদের হলুদ পাঞ্জাবী। সাথে ঐ দিন স্কুলের কাজে তাদের জুড়ি মেলা ভার। সাথে চলে  ঘুড়ি ওড়ানো, আর একটা ঘুড়ি কাটলেই “ভো-কাট্টা”। সেদিন আর তাদের পায় কে? সবাই যেন মুক্ত বিহঙ্গ।

আমরা ছিলাম গার্লস স্কুলের ছাত্রী। তাই পুজোর কাজ থেকে শুরু করে আলপনা, অন্য স্কুলে গিয়ে নিমন্ত্রন করা, ঠাকুর আনা সবই আমাদের দায়িত্বের মধ্যে। সাথে থাকতেন দিদিমনিরা। দিদিমনিরা হয়ে উঠতেন ‘দিদি’ একান্ত আপনজন।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের চাঁদমালা আলপনা সব নিজেদের বানিয়ে হাতে হাতে কাজ সারতে হত। এখন সবই রেডিমেড কিনে নিলেই চলে। বাড়ির পুজোয় ঠাকুরের জন্য বানালে, একটা বেশি বানাতাম স্কুলের ঠাকুরের জন্য। দুরু-দুরুবুকে সেটি নিয়ে গেলেও দিতে ভয়। তবু এক বন্ধুর কনুইয়ের গুঁতোয় সাহস করে দিদির হাতে গিয়ে সেটা দিতেই দেখি তা সাদরে গৃহীত হল। সাথে আবার উপরি পাওনা দিদির একগাল হাসি আর আদর। পুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই কিছু ছাত্রছাত্রীকে নির্বাচন করা হত যারা বেশ দু’দিন আগে থেকেই পুজোর বিভিন্ন কাজে লেগে পড়ত। ঠাকুরের চালচিত্র বানানো, নিজেরা হাতেকরে চাঁদমালা তৈরি করা হত, সুন্দর করে ঠাকুরের বেদী আর স্কুল গেটের সামনে আলপনা দেওয়া হত, আর তা হত প্রবল আনন্দ ও উৎসাহের সাথে। প্রতি স্কুলেই ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের কাজ ভাগ করে দেওয়া হত। কিছু ছাত্র-ছাত্রী যেত বিভিন্ন স্কুলে নিমন্ত্রণে। সে এক অন্য মজা। বিশেষত সারাবছর স্কুলের এক নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বেরনোর এক আলাদা রোমাঞ্চ সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যেই থাকত।

আর ঐ নিমন্ত্রন করতে যাওয়াতেই ছিল সবার ঝোঁক। সবাই চাইত যেতে, কিন্তু সুযোগ পেত কয়েকজনই। যারা সিলেক্ট হল তাদের আর দেখে কে! প্রথমত, তারা সবে ১১-এ(একাদশ শ্রেনিতে) উঠেছে, তার উপর এরকম একটা দায়িত্ব। হাব-ভাব, চালচলনই তখন তাদের বদলে গেছে। যাই হোক, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে কার্ড আর ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে তো পরা গেল। এক একটা টিমে ৪-৫ করে ।

এবার প্রশ্ন, কোন স্কুল দিয়ে শুরু করা হবে? কেউ বলে “সামনেরটা দিয়েই শুরু কর্‌”, তো কেউ তা’তে রাজি নয়। তা বেশ মিনিট দশেক জল্পনা-কল্পনার পর সিদ্ধান্ত হল দূরের কোন স্কুল থেকে শুরু হোক, নিমন্ত্রন করতে করতে কাছাকাছির স্কুলগুলোয় আসা যাবে।আর সেগুলো শেষ করে নিজেদের স্কুলে ফিরে আসা যাবে। এবার প্রশ্ন হল, রাস্তাতো চেনেনা অর্ধেকেই। তখন সেই রাস্তা চেনানোর ভার নিল একজন। সে আগে আগে চলেছে, আর তাকে অনুসরণ করছে বাকিরা। সবারই চোখে যেন তার প্রতি সম্ভ্রম ফুটে উঠছে। সেও বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। কিন্তু সেই অবস্থা বেশিক্ষন স্থায়ী হল না। খানিকদূর গিয়ে কোনো একটা তিন বা চার মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে সেই leader রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছেন। ঠিক কোন দিক দিয়ে গেলে যে গন্তব্যে পৌঁছান যাবে সেটা আর ঠাহর করতে পারছেন না। এদিকে বন্ধুদের বড় মুখ করে তিনি বলেছেন, “আরে! চিন্তা করিস না। আমি নিয়ে যাব। ম্যায় হু না।” কিন্তু এইবার তো তিনি পরেছেন মহা ফ্যাসাদে। এদিকে কাউকে জিজ্ঞেসও করা যাচ্ছে না লজ্জায়। সেই কোনকালে হয়ত বাবা বা বাড়ির বড়ো কারুর সাথে এসেছিলেন এই রাস্তায় তাও আবার সন্ধ্যেবেলা। কিন্তু সেই স্মৃতি যে এইভাবে তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তিনি কি করে বুঝবেন? ইতিমধ্যেই বাকিরা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। কতক্ষন আর রাস্তার মাঝখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। একজন বলে উঠল, “কিরে আর কদ্দুর? এই তোর কাছের নমুনা?”

-“আরে এই তো প্রায় এসে গেছি…”

-“ সে তো কখন থেকেই বলছিস, এসে গেছি,এসে গেছি। কিন্তু আর কদ্দুর? এই শোন্‌ তুই কি রাস্তা গুলিয়েছিস? ঠিক করে বল তো…”

অবশেষে leader স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তিনি রাস্তা গুলিয়েছেন। তারপর বাকিদের মধ্যে একজন পরিত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসে এবং এক বিশ্বাসযোগ্য বয়স্ক ভদ্রলোককে ডেকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে গন্তব্য স্থলে পৌঁছানো গেল। তারপর যথারীতি একটু হাসাহাসি, রাগারাগি, অনেকটা মজা, আর সাথে আলুকাবলি বা কারেন্ট নুন খেতে খেতে সব কাজ সমাধা করে প্রচণ্ড খুশিতে আবার স্কুলে ফেরত আসা। এসেই বড়দিকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে, শেষ পিরিয়ডে একবার ক্লাসে উঁকি দিয়েই ছুটির ঘণ্টার সাথে সাথে বাড়ি।

তারপর এলো সেই চির প্রতিক্ষিত দিন, সরস্বতী পুজো। ক্লাস ইলেভেনের স্টুডেন্টদের সেদিন বিশাল দায়িত্ব। কারণ প্রতিবারের মতোই ক্লাস ইলেভেনরাই পুজোর দায়িত্বে থাকে। পুজোর কাজের সাথে সাথে আজ তারা স্কুলের খাওয়া-দাওয়ার পরিবেশনের দায়িত্বেও আছে। শাড়ি বা রঙ্গিন জামা পরে একবার এদিক থেকে ওদিক করছে, আর সে কি ব্যস্ততা। তারই মাঝে, বেশ কয়েকবার কিছু কিছু ভেজিটেবিল চপ উধাও হচ্ছে। কারুর মুখে ভেজিটেবিল চপের গুঁড়ো লেগে আছে। যদিও সেদিন দিদিমনি বা স্যররা দেখেও না দেখার ভান করছেন। কিছুক্ষন পর, যখন ব্যাচ প্রায় শেষের পথে, এমন সময় হঠাৎই একজন মিষ্টির ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকার পর দেখা গেল, মিষ্টি আগের ব্যাচের তুলনায় ট্রে -তে কম। এক দিদিমনি ব্যাপারটা বুঝে একবার মেয়েটির দিকে তাকালেন, কিন্তু মেয়েটি মুখটা কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। দিদিমনি কিছু বললেন না। মুচকি হাসলেন। এবার হয়তো তাঁর নিজেরও স্কুল জীবনের কথা মনে পরে যাচ্ছে…

এখনও সরস্বতী পুজো-র আনন্দে ভাঁটা পরেনি। এটি চিরন্তন। আজও বাচ্ছারা স্কুলে যায়, কলেজে যায়। টিউশনের স্যার-ম্যামদের কাছে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ। সব বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, বা সদ্য গজানো পাখনায় ভর করে ঐ একটা দিন সেই বিশেষ বন্ধুটির চোখে চোখ পরবে সেই আশায় বুক বাঁধে কেউ কেউ।তবে আজকাল আরসেই আনন্দ কোথায়? এই অতিমারীর কিছু আগে থেকেই ঘুড়ি ওড়ানোর চল কমেছে অনেক। সরস্বতী পুজো -র সকালে বাড়ির পুজোর পর আকাশের গায়ে কান পাতলে আর সেই ‘ভো-কাট্টা’ রব শোনা যায় না। হয়তো দু-একটা পেটকাঠি, চাঁদিয়াল ইতি-উতি আকাশের গায়ে গা ভাসায়। কিন্তু সেই উচ্ছাসও আজ বড্ড কম। আর তার উপর এই মহামারী সব আনন্দকে আরোই নষ্ট করেছে। গত দুই বছর বাচ্ছারা এই সব আনন্দ থেকে বঞ্ছিত। বাইরে বেরোতেই ভয় করে, এই বুঝি মৃত্যু এসে থাবা বসাবে গোটা পরিবারের উপর। আর সেই ইলেভেনের ব্যাচগুলো, যারা ভেবেছিল পুজোর দায়িত্ব পাবে, এই নির্মল মজায় একটুখানি গা ভাসাবে, সে আর হল কই?  তবু আশা আছে শীঘ্রই স্কুল খুলবে, “পৃথিবী আবার শান্ত হবে”, আর সেই স্কুল বা কলেজ জীবনের সব আনন্দ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবারও ফিরে পাবে।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>