Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,সরস্বতী রাগ

সরস্বতী রাগ ও দেবী সরস্বতী । সংগ্রামী লাহিড়ী

Reading Time: 4 minutes

সরস্বতী রাগ শিখতে চাওয়া এক শিক্ষার্থীর সঙ্গীত জীবন ও দেবী সরস্বতী পুজোর সাথে সরস্বতী রাগ নিয়ে ওঠে এসেছে নানা গল্প ও জানা অজানা বিষয়।


 

“না না, ওসব আবদার রাখ দেখি? বেসিক রাগগুলোই তো এখনো শিখে উঠতে পারিসনি। কতগুলো বাকি আছে? লিস্ট দেখেছিস?”তানপুরা নিয়ে সামনে বসা কিশোরী ছাত্রীটিকে গুরু এক দাবড়ানি দিলেন। বাইরে কুয়াশামাখা রবিবারের সকাল। গান শেখার দিন। লেপমুড়ি দিয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার সারি। বেশিদিন নয় অবশ্য। জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে এল। পলাশ-শিমূলে আগুন লাগতে আর দেরি নেই। মনে মনে কেমন এক আহ্লাদ, আর কয়েকদিন মাত্র। তারপরেই আমের বোল, কৃষ্ণচূড়ার লাল, সব মিলে পৃথিবীটাই অন্যরকম হয়ে যাবে। সেই সুখস্বপ্নে ভেসেই আবদারটা করে ফেলেছে। কী আবদার? না ‘সরস্বতী’ রাগটি শিখবে।

গুরু কিন্তু কড়া শিক্ষক, লক্ষ্যে অবিচল। একশোটি বেসিক রাগের লিস্ট লিখিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো এক এক করে শিখতে হবে। তবেই শাস্ত্রীয়সংগীতের সমুদ্দুরের তীরে কয়েকটি নুড়ি কুড়োনোর যোগ্যতা অর্জন করা যাবে।

মেয়েটারই মন চঞ্চল, কর্তব্যে স্থির নয়। সারাক্ষণ এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি মারে। রেডিওতে এক গান শুনেছিল, ‘যেও না, যেও না সখি ও পথে যমুনা, মন যদি চুরি যায়,কী হবে জানো না’। সাগিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের সুর, আরতি মুখোপাধ্যায়ের গলা। ছোট্ট একটুকরো তারানা দিয়ে শুরু হয়, গানের শেষে দুগুণ লয়ে তারানা আবার ফিরে আসে। সুর শুনেই মন চুরি গেছে। গুনগুনিয়ে গেয়েই যাচ্ছে। গুরুই বললেন, “এ গান সরস্বতী রাগে বাঁধা।“ সেই থেকে খুব ইচ্ছে, সরস্বতী রাগ শিখবে। ঋষভ থেকে উঠে কেমন সুন্দর কড়ি মধ্যমটি লাগিয়েছেন সাগির খাঁ সাহেব, ‘যেও না যেও না সখি…’ ওপরের দিকে উঠছেন, কোমল নিষাদের ছোঁয়া লাগল আলতো করে। কী অসামান্য ছকভাঙা সুর, মন হারায় তার। তবে আপাতত উৎসাহ চুপসে গেছে। মাথা নিচু করে গানের খাতার পাতা ওল্টাচ্ছে। একশোটা রাগের লিস্ট লেখা আছে খাতার একদম শেষে। সে লিস্টে সরস্বতী নেই!

“পুরিয়া কল্যাণ শেখা হয়েছে?”

“উঁহু” মাথা নিচু করেই জবাব আসে। মোটেই মুখ তুলবে না এখন।

“পুরিয়া, পুরিয়া ধানেশ্রী, এগুলো তো শিখেছিস। কই, দেখি খাতাটা?”

“হুঁ” সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে খাতাটা বাড়িয়ে দেয়। মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছে, আজ সে প্যাঁচার মত মুখ করে গান শিখবে। তার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো দামই নেই যখন…

শুরু হয় পুরিয়া কল্যাণের তালিম। মনটা খারাপ। সেই মনখারাপের রেশ ছড়িয়ে যায় বিলম্বিত বন্দিশে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে যেন, ‘হোবন লাগি সাঁঝ…।’

দিন যায় সুরের খেয়ায় ভেসে। গানের ক্লাসে শুধুই তো গানের তালিম নয়, তার আখ্যান, ইতিহাস, ভূগোল- সবই উঠে আসে কথাবার্তায়, আলোচনায়। সমৃদ্ধ হয় শিষ্য-শিষ্যার দল।

মেয়েটা ততদিনে কিশোরী থেকে তরুণী, তরুণী থেকে যুবতী। রাগের ঝুলি ভরেছে, সাহসও বেড়েছে। নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা বেশ নির্দ্বিধায় জানায়। গুরুর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও আছে যেন।

সেবার সরস্বতী পুজোর আগে গুরু গল্প করছেন গানের ওস্তাদদের বাড়িতে সরস্বতী পুজোর কথা।”স্বয়ং খাঁ  সাহেবের বাড়িতে প্রতি বছর খুব ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো হত।”

“বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব?” সে অবাক।

“অবাক হওয়ার কী হল, শুনি?” বকে দিলেন।”দেবী সরস্বতীর জাত নেই। বিদ্যা, সংগীত, শিল্প-এসব ধর্মচেতনার ঊর্ধ্বে। ডাগর ব্রাদার্সের গলায় ধ্রুপদ বেঁচে রইল। যে ধ্রুপদ কিনা প্রবন্ধগীতি, তাতে হামেশাই দেবদেবীর বন্দনা। নজরুল কত শ্যামাসংগীত লিখলেন। সে যুগের গওহরজান গাইতেন, ‘মেরে হজরতনে মদিনা মে মানায়ে হোলি’। গানের কথাটা একবার খেয়াল করে দেখ দেখি?”

মেয়েটা এ সুযোগ ছাড়ে না, বলে ওঠে, “এই যেমন আমজাদ আলি সরস্বতী পুজোর কনসার্টে সরোদে বাজান সরস্বতী রাগ।” আমজাদ আলি খানের সরস্বতীর গ্রামোফোন রেকর্ড তার বাড়িতে আছে। শুনে শুনে আশ মেটে না।

“মনে করে রেখেছিস দেখছি।” গুরু হাসছেন মিটিমিটি।

আশার আলো দেখা যাচ্ছে যেন। কম লড়তে হয় এমন এক একটা ছকভাঙা রাগের জন্যে? কত সাধ্যসাধনা করে তবেই হংসধ্বনি, রাগেশ্রী, আভোগী, কলাবতী শেখা। এরা নাকি রাগ নয়, সুর!

“তাহলে সুরই শিখব, ভালো লাগে। সরস্বতী পুজোর আগে সরস্বতী রাগ চাইই চাই!” নাছোড়বান্দা এবার।

গুরু এবার আসন ছেড়ে উঠে এসেছেন। চুলগুলো ঘেঁটে দিলেন।

“তানপুরাটা দে দেখি? আরেকবার মিলিয়ে দিই?”

পঞ্চমে মিলল প্রথম তার, জোড়ীর তারে খরজ।

“পঞ্চম আর ঋষভ এ রাগের বাদী আর সম্বাদী। তাদের মধ্যে কড়ি মধ্যম আর ওপরে কোমল নিষাদ বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে। আদতে দক্ষিণ ভারতীয় রাগ। প্রতিমধ্যম মেল। প্রতিমধ্যম জানিস তো? কড়ি মধ্যম।”

“ঐজন্যেই তো সুরটা এত সুন্দর।” মেয়েটা উৎসাহে বলে ফেলে।

“তাই বুঝি? কই, কড়ি মধ্যমের ইমন গাইতে বললে তো খুব কষ্ট, যত ভালো লাগে এসব কূটকচালি রাগ!” সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়েছেন।

“তবে রবিশংকর কিন্তু সেতারে দক্ষিণ ভারতীয় রাগ অনেক বাজিয়েছেন। পরমেশ্বরী, দুৰ্গেশ্বরী, সরস্বতী- এ সব রাগ তাঁর কাছেই শুনেছি।”

“দক্ষিণ ভারতীয় রাগ তাহলে তিনিই প্রথম হিন্দুস্থানি সংগীতে নিয়ে এলেন?”

“প্রথম আনেননি হয়তো। আগেও তো অনেকে গেয়েছেন। যেমন ধর আমানত আলির কথা। মুম্বাইতে থাকতেন। একটু দক্ষিণে গেলেই কর্ণাটক। মুম্বাইতে অনেক দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতের কনফারেন্স হত, সেগুলো শুনতেন। হংসধ্বনি তো আমরা তাঁর কাছেই প্রথম শুনি। তবে রবিশংকরের হাত ধরে দক্ষিণ ভারতের রাগগুলি জনপ্রিয় হয়েছে, এটা ঠিক।”

একটু থেমে আবারও বলেন, “আসলে এই আত্মীকরণ ব্যাপারটা খুব সোজা নয়। কর্ণাটকী সংগীতে গমকের ছড়াছড়ি, আর হিন্দুস্থানি সংগীতে মিড়। রাগের চরিত্রই বদলে যায়। তাই খুব সাবধানে গাইতে হয় কর্ণাটকী মেলের রাগ।”

সুর ছাড়ছেন এবার। বন্দিশ শেখাবেন।

‘অব মোরি পির নেহি জানে, না মানে ধরে এক ন মন কান’

আমার দুঃখের কথা কেউই জানে না, এত করে বলছি, তবু তার কানেই যাচ্ছে না!এক প্রেমিকা বেশ হতাশ হয়েছে। রেগে গেল প্রায়! গান অন্তরায় গেছে, ‘সোচ সকুচ কহুঁ কৌন করে, ঐসো নিপট নাদান!’ ভালোমানুষের মত মুখটি করে আছে দেখ, যেন কিছুই বোঝে না! শৃঙ্গার রসের গান, বিপ্রলব্ধা শৃঙ্গার।

‘সরস্বতী’র সুর গান্ধারকে বর্জন করে রেখাব থেকে লাফ দিয়ে নয়টি শ্রুতি পার হয়ে সোজা কড়ি মধ্যমে উঠছে। পঞ্চমে গিয়ে স্থিতি। ওপরের তারা থেকে নামার সময়ও চমক। কোমল নিষাদ থেকে সোজা গড়িয়ে আসে কড়ি মধ্যমে, মাঝখানে কোথাও থামাথামি নেই। পুরো চলনটিই মিড়ের ওপর, শ্রুতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেন রাজহাঁসের মত ভেসে যায়।

সে কথা বলতেই গুরু বললেন, “ডিসকর্ড স্কেল, বুঝতে পারছিস? আর পাঁচটা পরিচিত সুরের সঙ্গে মেলে না। এমন লাফিয়ে লাফিয়ে এক স্বর থেকে অন্য স্বরে যাতায়াত করলে খুব সহজেই কিন্তু বেসুর হবার সম্ভাবনা।মেয়েটা একটু একটু ধরতে পারছে। কিন্তু মনে ধন্দ, ডিসকর্ড স্কেল? তার মানে সমন্বয়ের অভাব? এ রাগের নাম কিনা সরস্বতী? যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সত্য, সৌন্দর্য, নান্দনিকতা?

প্রশ্ন শুনে খুশি হলেন, “ঠিকই দিকেই যাচ্ছিস। আরেকটু ভাব, চিন্তা কর, তাহলেই দেখতে পাবি স্বয়ং দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান।” 

“কেমন করে?” মেয়েটা সম্মোহিত। 

“তুই তো নিজেই এ রাগের মেলডিতে মুগ্ধ, ঠিক কি না? তার মানে ডিসকর্ড স্কেল থেকে সুখশ্রাব্যতা, অসুন্দর থেকে নান্দনিকতায় উত্তরণ।”

“ঠিকই তো! জটিল চলন থেকেই মেলডি তৈরি হচ্ছে!” সেও যোগ করে। সামনে থেকে যেন একটা পর্দা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।

“হ্যাঁ, একমাত্র দেবী সরস্বতীই এমন আমূল বদলে দিতে পারেন। সংগীতই পারে সাকার অনুভবকে নিরাকারে নিয়ে যেতে। এ হল তূরীয় মার্গের সচ্চিদানন্দ। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার শুনলে যেমনটি হয়, যেন এ পৃথিবীতে আমি আর নেই!” গুরু বলে চলেন। মেয়েটা আস্তে ঘাড় নাড়ে। তার অনুভূতিতে দেবী সরস্বতীর রূপটি যেন ধরা দিচ্ছে রাগের মাধ্যমে। এর শ্রী বা মাধুর্যের থেকেও যেটা বেশি আকর্ষণ করছে, তা হল সাহস। এ রাগের চলন যেন কাউকে তোয়াক্কা করে না, কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রুতিনন্দন। ঠিক দেবীরই মত। প্রথাগত সৌন্দর্য নয়, বরং পাশ্চাত্য ভাস্কর্যের মত খোলামেলা, ঈষৎ কৃশ, দীর্ঘাঙ্গী, শুভ্রবসনা এক সাহসিনী, যিনি অনায়াসে সৌন্দর্য্য, নান্দনিকতার সংজ্ঞা তাঁর মত করে বদলে দিতে পারেন। রাগ আর দেবীমূর্তি চেতনায় মিলেমিশে একাকার। সে অনুভব করতে পারছে, গুরু কেন এতদিন সরস্বতী রাগ শেখাননি। অপরিণত মননে এমন উপলব্ধি যে অধরাই থেকে যেত! সরস্বতীর আসনটি সম্পূর্ণভাবে পাতা না হলে কি দেবীর আবাহন করা যায়?

সঙ্গে রইল সরস্বতী রাগে আরতি মুখোপাধ্যায়ের সম্মোহন ছড়ানো সেই গান, নিজের গলায়।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>