| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৬) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

যতীনদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র কয়েক ফার্লং পথ। কিন্তু এই দূরত্বটুকু লেংচে  লেংচে  আসতে রাতে তার অনেক সময় লাগে । রাতে প্রতিটি পদক্ষেপ পা টিপে টিপে চলতে হয়। দিনের বেলা এত সমস্যা হয় না।

রাতে আসার সময় তাকে পেছন থেকে কেউ ডাকল–’ প্রেম।’

তার শরীরটা শিউরে উঠল।

‘কে? কে?’ 

সাইকেল চালিয়ে তার পেছন পেছন কেউ আসছে।

‘ সর্বা দাদা নাকি?’ প্রেম জিজ্ঞেস করল।

‘ এই রাতে কোথা থেকে এলি?’ আগন্তুক উল্টে জিজ্ঞেস করল।

‘ যতীন দাদার বাড়ি থেকে এলাম।’–- বলব না বলব না করে প্রেম উত্তর দিল।

‘ওহো!’– সর্বা মুখ দিয়ে এমন একটি শব্দ করল যা থেকে সে খুশি হয়েছে না খারাপ পেয়েছে, রাগ করেছে না সহানুভূতি প্রকাশ করছে, কিছুই বুঝতে পারা গেল না।

‘ টাকার খবর এসেছে নাকি?’– সর্বা জিজ্ঞেস করল।

‘ না না কোনো খবর নেই।’– প্রেম উত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেল।’ এখন পর্যন্ত কোনো খবর আসেনি। টাকা আসে কিনা ঠিক নেই। ঘোষণা করার কয়েক মাস হয়ে গেল। কোনো সাড়া শব্দই নেই দেখছি।’

‘ উঠ, সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠ। এইটুকু রাস্তা আমি তোকে এগিয়ে দেব।’ প্রেমের পাশেপাশে হাফ পেডেল  মেরে আসতে থাকা সর্বা বলল।

দেশি মদের উৎকট  একটা গন্ধ এসে প্রেমের নাকে লাগল।

‘ না না লাগবে না।আমি যেতে পারব।’

‘উঠ,উঠ মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যাবি। লেংচে  লেংচে  যেতে থাকলে অনেক দেরি হবে।’

উপায় না পেয়ে প্রেম সর্বার সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠল। বাঁকা ভাবে বসে হাতের লাঠিটা সামনে নেবার পরে সর্বা সাইকেল চালিয়ে দিল।

‘ সরকার পয়সা দেবে বলে ঘোষণা করেছে যখন পাবিই। তবে তোকে আমি একটা কথা বলতে চাইছি।’– সাইকেল চালাতে চালাতে সর্বা তাকে বলল–’ তোরা যখন টাকা পাবি তখন অর্ধেক টাকা সঙ্গে সঙ্গে তোর নামে করিয়ে নিবি। গ্রামীণ ব্যাংকে নিজের নামে একটা একাউন্ট খুলে নিবি। অর্ধেক টাকা তোর প্রাপ্য।এতদিন ধরে অসুস্থ বুড়ো বুড়িকে তুইই তো দেখছিস।’

সর্বা সাধারণভাবে বলা কথাটা হঠাৎ প্রেমের মনে ধাক্কা মারল। সে কিছুটা টালমাটাল হয়ে পড়ল। ক্যারিয়ারটা সে একহাতে জোরে খামচে ধরল।

ওরা প্রেমদের বাড়ির সামনে পৌঁছেছিল। সর্বা সাইকেলটা থামাল।লাঠিটাতে ভর দিয়ে প্রেম সাইকেল থেকে নামল।

যাবার সময় সর্বা তাকে পুনরায় বলে গেল–’ কথাটা ভেবে দেখবি প্রেম, মদ খেয়ে থাকলেও তোকে আমি বাজে কথা বলব না। বুড়োটা অসুস্থ।কখন কী হয় তুই কিছুই বলতে পারবি না। তাই নয় কি? বুড়োর কিছু হলে মাকে দেখতে হবে। তখন টাকা দেখে তোর বোনের জামাই দুটোও এসে পড়বে। ভাগ চাইবে।’

সাইকেলের প‍্যাডেলে ভর দিয়ে সর্বা এগিয়ে গেল। প্রেমই একই জায়গায় শিকড়গজা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সর্বার কথার সে কী  উত্তর দেবে কিছুই বুঝতে পারল না। সর্বা তাঁকে আবার একবার চিৎকার করে বলে গেল–’ প্রেম আমার কথা মনে রাখবি।’

গ্রামের পথটা দিয়ে চলার সময় জ‍্যোৎস্নার মধ্যে সর্বার হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

প্রেম পদূলিমুখ থেকে ঘরের দিকে তাকিয়েছিল।

ফটফটে জ্যোৎস্নায় ঘরের সামনের উঠোনটা দিনের আলোর মতো হয়ে পড়েছিল।

সামনের দিকের বারান্দাটা, ওই যে কাঁঠাল কাঠের পিড়িটা দেখা যাচ্ছে। বাবা বোধহয় ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।এতক্ষণ পর্যন্ত বুড়ো থাকে না।ঠান্ডা পড়েছে।শীত শীত  ভাবটা বোঝা যাচ্ছে।কে? কে ওই কাঁঠালপিড়ি থেকে উঠে আসছে। বাবা এখনও তার পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে নাকি? গেটটা খুলে প্রেম দ্রুত ভিতরে চলে এল।ও মা। মা তখনও তার জন্য বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিল।

‘ মা, বাবা শুয়ে পড়েছে নাকি?’ প্রেম জিজ্ঞেস করেছিল।

‘ শুয়ে পড়েছে।’

‘ মানুষটার সঙ্গে দেখা হল না। আজকে যতীনদাদাদের  বাড়িতে ছিল না ।’

মা তার কথার কোনো উত্তর দেয়নি।

‘চল, তাড়াতাড়ি ভাতটা খেয়ে নে।অনেক দেরি হয়ে গেছে।’– মা দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

ভাত খাবার সময় সে উনুনের বেড়ার ওপারে শোবার ঘরে বাবার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। বুকটা প্রতিদিনের মতো ঘড় ঘড় শব্দ করছিল। শোবার আগের মুহূর্তে কাশি না উঠলে বুড়ো রাতটা ভালোভাবেই ঘুমোতে পারে।

মা তাকে টাকার কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি।এত দেরি করার জন্য তাকে গালিগালাজ করে ভাত খেতে দিয়েছিল।সেও মায়ের সামনে কথাটা উত্থাপন করতে সাহস পাচ্ছিল না।

রাতে বিছানায় শোবার সময় সর্বা বলে যাওয়া কথাগুলি সে ভাবছিল। পাশের গ্রাম থেকে সে মদ খেয়ে এসেছিল। মদের নেশাতেই হোক, সে কিন্তু প্রেমকে যে কথাগুলি শুনিয়ে গেল, তা একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেবার মতো নয়।

মদের নেশায় হলেও সর্বা তাকে ঠিক কথাই বলেছিল।

কিছুক্ষণ পরেই তাকে ক্লান্তি ঘিরে ধরেছিল। সর্বা বলে যাওয়া কথাগুলি ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে খুব ভোরে, চারপাশে আলো না হতেই সে যতীনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। যেতে  তার যেহেতু  সময় লাগে, সেই জন্য সে আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। মানুষটা সকালেই চলে যাবার কথা। সে চলে যাবার আগেই তাকে যেভাবেই হোক পৌঁছাতে হবে। টাকার বিষয়ে একটা সঠিক খবর আনতে হবে।

কাল যতীনের মাকেও প্রথমে সে জিজ্ঞেস করেছিল।

মহিলাটি কিছুই জানেনা। টাকার বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই।’ আমার ছেলেটাই চলে গেল, এখন টাকার কথা চিন্তা করে আমি আর কী করব। সে সব কথা না শুনলেই আমি শান্তিতে থাকতে পারব।’

সকাল নটার সময় মানুষটা যতীনদের বাড়িতে এল।

প্রেম গত রাতের মতো বারান্দায় পা  ঝুলিয়ে বসে মানুষটার আসার পথ চেয়েছিল।

মানুষটা এসেই যাবার জন্য তাড়া লাগিয়ে দিল।

‘ যাই যাই মাসি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুই দেরি করিস না।এখনই গাড়ি চলে আসবে।’

যতীনের মা রাজধানীতে বসবাস করা তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য জিনিসপত্রের পুটলি বেঁধে  তৈরি করতে লাগল।

‘ বেশি জিনিস দিবি না মাসি। নিয়ে যেতে অসুবিধা। খরিচা থাকলে আমাকেও এক বোতলের মতো দিবি । ‘

প্রেম সাহস করে মানুষটার কাছে এগিয়ে গেল। ‘ ‘আমি হেমর দাদা।’– ইতস্তত  করে সে বলল।

মানুষটা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।

‘ রাজধানী থেকে আপনি এসেছেন বলে জানতে পারলাম।’– প্রেম ধীরে ধীরে আরম্ভ করল।’ ভাবলাম, টাকার খবরটা নিয়েই যাই। আপনি কোনো খবর এনে থাকতে পারেন।’

‘ টাকা, কিসের টাকা?’– মানুষটা যেন অবাক হল।

‘না, সরকারে দেব বলে ঘোষণা করা টাকাটা। আমাদের ওদের…’ প্রেম কিছুটা থতমত  খেল। যথেষ্ট সংকোচের সঙ্গে সে কথাগুলি বলল। তার পুনরায় একবার উঠোনের কাছে বকুল গাছের গোড়ার দিকে দৃষ্টি গেল।সকালের রোদে উঠোনটা চকচক করছে।


আরো পড়ুন: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৫) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


‘ ও আচ্ছা, আচ্ছা, সেই টাকার কথা?’ মানুষটা এবার যেন পুরো কথাটা বুঝতে পারলেন।স্পষ্ট কণ্ঠে তিনি বললেন–’ তুমি হেমর দাদা নয় কি? আমি ভুলেই গিয়েছিলাম । হয়ে গেছে ।টাকার কাজটা হয়ে গেছে। আমি নিজেই ফাইলপত্রের কাজগুলি এগিয়ে রেখে এসেছি । ফাইনান্স বিভাগের সইটা বাকি রয়েছে। দুই-একদিনই হয়ে যাবে। গভর্নমেন্টের পলিসি ডিসিশন এইসব হয়ে যাবে। তারপরে টাকাটা ডিসির কাছে এসে যাবে।’

‘ কোনো তারিখ দিয়েছে নাকি?’– প্রেম পুনরায় সংকোচের সঙ্গে বলল।

‘তারিখ ডিসি ঠিক করবে।টাকা এসে গেলেই তারিখ ঠিক করবে। টাকাটা একটা জনসভার আয়োজন করে দেবার কথা ভাবা হয়েছে।শহীদ দিবস টিবস কিছু একটার সঙ্গে তারিখ মিলিয়ে আয়োজন করতে হবে।’

প্রেম কিছুক্ষণ ইতস্তত করে আবার জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা,কতদিন লাগতে পারে?’

‘ হবে, হবে। তাড়াতাড়িই হবে। কোনো চিন্তা করতে হবে না। তারিখটা ঠিক হলেই ডিসি অফিসের মানুষ এসে মিটিঙের  খবর দিয়ে যাবে।

একটা মারুতি ভ্যান এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।

মন্ডলের বড় ছেলেটি কালো চশমা পরে ড্রাইভারের পাশে আগের সিটে বসে ছিল। সে গাড়ি থেকে নামেনি।

‘ মাসি তাড়াতাড়ি কর।’– মানুষটা চেঁচামেচি করছিল–’ গাড়ি এসে গেল। যেতে হবে। দেরি করিস না।’

যতীনের মা কাজের লোকগুলির মাধ্যমে কয়েকটা পুঁটুলি গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল। মন্ডলের বাড়ির কালো চশমা পরা ছেলেটি তখনও গাড়ি থেকে নেমে এল না। তার নামটা কী ছিল? সীমান্ত না কি যেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ সীমান্ত । আগে সে যতীনদার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করত। সামনের বারান্দায় রাখা হাতল লাগানো দীর্ঘ বেঞ্চটিতে সে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত।

মাসিকে বলে মানুষটা ভ্যানের পেছনে উঠে বসেছিল।তার দিকে তাকিয়ে যাবার সময় হাত তুলে বলে গিয়েছিল–’ আসছি।’

প্রেম এবং যতীনের  মা অনেকক্ষণ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

‘ তুই চা খেয়ে যাবি প্রেম।’– যতীনের মা তাকে বলেছিল। সে এই বাড়িতে এলে তাকে কখনও কিছু না খাইয়ে যেতে দিত না। মহিলাটি সত্যিই তাকে স্নেহ করত।’ তুই পেছনের উঠোনে আয়।’– এই কথা বলে মহিলাটি দ্রুত সামনের দরজা বন্ধ করে পেছনে চলে গিয়েছিল।

ঘরটার পাশ দিয়ে ঘুরে ভাঁড়ার ঘেঁষে পেছনের উঠোনে যাবার সময় প্রেম হঠাৎ থেমে গেল।

সেখান থেকে বকুল গাছের নিচটা বড় স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

উঠনের সেই জায়গাতে এখন বকুল গাছের  ঘন ছায়া পড়েছে।

সেই জায়গাটা দেখলে তার মনটা সব সময় অস্থির অস্থির লাগে। বুকটা কেমন করে উঠে। সেই জায়গাতেই, ঠিক সেই জায়গাটিতেই তার ভাই হেম যতীন দাদার সঙ্গে একই সময়ে একসঙ্গে গুলি খেয়ে ঢলে পড়েছিল।

দিনের আলোতে সে উঠোনের সেই জায়গাটা পুনরায় একবার দেখল।

সেখানে এখন তুলসীর চারা একটা রোপণ করা হয়েছে। চারাটার যত্ন নেওয়া হয়। যত্ন পেয়ে চারাটা সতেজ হয়ে উঠেছে। চারা গাছটির গোড়ায় ঘটনাটি ঘটার দিনটিতে একটি প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রথমে প্রত্যেকদিনই জ্বালানো হতো। আজকাল কেবল শনিবারে শনিবারে প্রদীপ জ্বালানো হয়। গতকাল বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকার সময় প্রদীপটা জ্বলছিল।

   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত