| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-১০)

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আমাদের প্রশ্ন হলো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার পূর্ব পর্যন্ত কয়েকশত বছরের ঐতিহ্যে বিকশিত বাংলা ভাষার তুলনায় যেখানে আরবি ফারসি শব্দ বাড়েনি এবং সংস্কৃত শব্দ কমে বেড়েছে বাংলা শব্দ সেই ভাষাকে কোন যুক্তিতে ‘দোভাষী কাব্য’, ‘মিশ্রভাষার কাব্য’, ‘পুঁথি সাহিত্য’, ‘মুসলমানী বাংলা’ বলে খারিজ করে দেয়া হলো? এর জবাব খুঁজতে হবে বাংলা ভাষার উপনিবেশায়নের ইতিহাসে। উনিশ শতকে কলিকাতার আর্যত্ববাদী লেখকগণ নানা আবেগে চালিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুকরণে আর্য সংস্কৃতি ও ধর্মের পুনর্জাগরণের জোশ, ধর্মচর্চার ভাষা সংস্কৃতের প্রতি কওমি মমত্ব ইত্যাদি ভালো ভাবেই কব্জা করে নিয়েছিল তাদেরকে। উনিশ শতকের দৃশ্যপটে মুসলিম লেখকদের এমন কোনো প্রভাবশালী অবস্থান সৃষ্টি হয়নি যে তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মোকাবিলা করবে। উপনিবেশি শাসন অবসানের পর অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে নতুন আবেগ উদ্দীপণার উন্মেষ হয় চল্লিশের দশক থেকে। এর ছাপ আমরা পাই ঐ দশকের সৃজনশীল সাহিত্যের ভাব ও উপাদানের  দেশজ স্বাতন্ত্রে। একই ধরনের উচ্ছ্বাস চিন্তাশীল লেখকদের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। এসব কারণে উপনিবেশি শাসনের অবসানের পর বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য চিহ্নিত করার মত উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি ছিল আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সামনে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জোশে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির স্বাধীনতার প্রশ্নটি সামনে না এনে বরং মুসলিম তমুদ্দনের স্পর্শে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে শুদ্ধ ও ‘ঋদ্ধ’ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। ইসলামী সংস্কৃতির প্রশ্নে এদের অনেকের আবেগ ছিল মৌলবাদী–মূল ইসলাম ও আরবি ভাষার নিরিখে সংস্কৃতি ও ভাষাকে প্রয়োজনমত ‘পরিশুদ্ধ’ করে নেয়া। এদের গোঁড়ামি অতদূর পৌঁছে যে কেউ কেউ আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার মত উদ্ভট ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্রস্তাবও রেখেছিলেন।  ধারণা করা যায় উনিশ শতকে কলিকাতার উচ্চ বর্ণের হিন্দু লেখক-বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের মধ্যে দৃশ্যমান ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রতিক্রিয়া হিসাবে পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের ঐ শ্রেণির লেখকগণ সংস্কৃতের প্রভাব দূর করে আরবি-ফারসির রঙ চড়াতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার গায়ে। বাংলার দেশাত্মা এদের অন্তরে স্থান পায়নি, জায়গা পেয়েছিল প্রথমত পাকিস্তানকেন্দ্রিক ভুল উচ্ছ্বাস ও স্বপ্ন। বঙ্কিমচন্দ্র ও তার ভাবানুসারীরা যেমন ভারতকে পৌরাণিক আদর্শের হিন্দুস্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তেমনি এদেরও মননে-স্বপ্নে ছিল একীভুত মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। এদের বুজপরামর্শ অতটাই বিভ্রান্ত, প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মাশ্রিত যে এ নিয়ে আলাদা আলোচনা আপাতত দাবী রাখে না।

আমার পর্যবেক্ষণের লক্ষ্য পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রগতিশীল বলে পরিচিত সেই সব বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতা যারা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসাবে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান পেয়েছেন। অত্যন্ত বিস্ময়কর যে, এদের কেউ বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃতের আগ্রাসনের ব্যপারে টু শব্দটিও করেন নাই, প্রবীনতম ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়া। একটা সমাজে বুদ্ধিজীবীর দায়িত্বের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো সে সমাজ, রাষ্ট্র বা সংস্কৃতির উপর যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যত্যয় বা আগ্রাসনের প্রতিবাদ করা এবং জনমানুষের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পথের দিশা তুলে ধরা। তারা তা করেননি। বরং অনেকে কলিকাতার লেখকদের ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে বাঙালির মান কথ্যবাংলার রচনাগুলোকে নিম্নমান-এর তকমা লাগিয়ে আলাদা করে রেখেছেন। ডক্টর আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, সৈয়দ আলী আহসান কিংবা মুহম্মদ আবুদল হাইয়ের মত লেখকেরাও কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের অনুসরণে এসব সাহিত্যকে  ‘মিশ্রভাষার কাব্য’, ‘দোভাষী কাব্য’ ‘মুসলমানী সাহিত্য’ ইত্যাদি নামে নিম্নমানের সৃষ্টি হিসাবে চিহ্নিত করেন। ২৪ 

এখানে দ্বিতীয় প্রশ্নটি এসে যায় স্বাভাবিকভাবেই। সেটি হলো ঐতিহ্যিক মান কথ্যবাংলায় প্রায় ১০% সংস্কৃত শব্দের তুলনায় মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলায় প্রায় ৩৫ % সংস্কৃত শব্দ চালিয়ে দেয়া সত্ত্বেও মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলাকে  ‘দোভাষী বাংলা’, ‘মিশ্রবাংলা’, ‘হিন্দু বাংলা’ কিংবা ‘সংস্কৃতবাংলা’ বলা হলো না কেন? বঙ্কিমের রচনা সবাইকে ছাড়িয়ে; ৫০%-এর বেশি শব্দ সংস্কৃত। তা সত্ত্বেও মনে পড়ে না বঙ্কিমের গদ্যকে কেউ সংস্কৃত গদ্য বলেছেন, নিদেনপক্ষে বাংলা বলতে অস্বীকার করেছেন কিংবা অন্তত দোভাষী গদ্য বলেছেন, যদিও বঙ্কিম নিজে এ ভাষাকে বলেছেন ‘সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা’। কেন? এ প্রশ্নের জবাবেই সুপ্ত হয়ে আছে আমাদের বর্তমান নিবন্ধের পর্যবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ফল, যার সাথে জড়িয়ে আছে ভাব ও সংস্কৃতির আধিপত্যর  (Hegemony) বিষয়। এ প্রসঙ্গে হেজেমনির ধারণা সম্পর্কে একটু বলে নেয়া দরকার।

Hegemony শব্দটি গ্রীক Hegemonia থেকে বিবর্তিত হয়েছে, যা গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক একে অপরের উপর আধিপত্য বুঝাত। উৎপাদন ও শ্রেণিসংঘাতের নিরিখে বিশ শতকের আধুনিক মানব সমাজের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই ধারণাটাকে পরিবর্তিত ও বিস্তৃত করেন ইতালীয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনীয় গ্রামসি।২৫  হেজেমনির বাংলা পরিভাষা হিসাবে আমি ভাবাধিপত্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য দুটোই ব্যবহার করেছি। কারণ পরিভাষাটি নতুন হওয়ায় নিয়মিত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ অর্থ আরোপিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি এখানে সম্পন্ন হয়নি বিধায় কোনো একটা একক পরিভাষায় এর প্রকাশ জুতসই হয়ে উঠে না বলে মনে হয়েছে আমার। আমরা ভাবাধিপত্য কথাটা ব্যবহার করতে পারি, যদি ‘ভাব’-এর মধ্যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ধারণা যুগপৎ বুঝার প্রস্তুতি থাকে । যাইহোক, হেজেমনি বা ভাবাধিপত্য বলতে কোনো একটি দলের বা শ্রেণির উপর আরেকটি শক্তিশালী দল বা শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বুঝায়। সাংস্কৃতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় ভাবাধিপত্য বলতে বোঝানো হচ্ছে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একই উদ্দেশ্যমুখি একগুচ্ছ ধারণার আধিপত্য। এই আধিপত্য কায়েম হয় প্রভাবশালী শ্রেণির ধারণা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সাংস্কৃতিক চর্চাকে মহত ও উন্নত হিসাবে দুর্বল শ্রেণিটি কর্তৃক সায় প্রদানের মধ্য দিয়ে। স্বেচ্ছায় প্রদত্ত এই ‘সায়’ও অর্জিত হয় কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যে প্রক্রিয়ার বেশিরভাগটাই সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা সম্পর্কিত তৎপরতার সাথে জড়িত। ভাবাধিপত্যের দ্বিতীয় কাজটা হলো যেকোনো বিকল্প ধারণা প্রকাশকে যেকোন মূল্যে থামিয়ে দেয়া। অর্থাৎ বিকল্প মত বা তত্ত্ব উৎপত্তির রাস্তা অঙ্কুরে নষ্ট করা। আঠারো-উনিশ শতকের বাংলাদেশে ভাবাধিপত্য কায়েমের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল আর সেই আধিপত্য জারি থাকার পরিবেশ বজায় রয়ে গেছে আজকের বাংলাদেশেও। এখানে সেই পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত একটা বিশ্লেষণ দেয়া প্রয়োজন মনে করি। 

১৭৫৭ সালের পলাশি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় আর্থিক, ধর্মীয়, শিক্ষা ব্যবস্থা ও মানুষের শ্রেণিগত অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজরা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল মুসলমানদের নিকট থেকে। দরবারে এবং বাইরে প্রভাবশালী হিন্দুরাও পলাশির ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল। এই দুই কারণে ইংরেজরা উপনিবেশি শাসন সুস্থির ও দীর্ঘায়িত করার কাজে সহযোগী হিসাবে বেছে নেয় উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরকে। এ প্রক্রিয়ায় পরবর্তী চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে উচ্চবর্ণের সংখ্যাল্প একদল হিন্দুর হাতে প্রচুর অর্থ ও  ক্ষমতা দুটোই কুক্ষিগত হয়। এর মধ্যে কলিকাতায় সুচিত হয়েছে ইউরোপের আদলে নগরকেন্দ্রিক জীবন। অর্থ ও ক্ষমতা পাওয়া ঐ উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কলিকাতসহ বড় বড় কেন্দ্রগুলোতে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসাবে আবির্ভূত হয়। তাদেরও মাথার উপরে থাকে ইংরেজ প্রশাসকদল আর গুটিকয়েক হিন্দু ও মুসলমান চাকুরে বা ব্যবসায়ী। এই নয়া মধ্যবিত্তের হাতে ছিল ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যসহ সমাজের বেশিরভাগ তৎপরতার নিয়ন্ত্রণ। ইতিমধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের হাতে তৈরি হয়েছে সংস্কৃতায়িত বাংলা গদ্য। এবং আর্য রাজরাজড়াদের কল্পিত গৌরব এবং দেবদেবীদের বিষয়ে পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে বইপুস্তক রচনার ঝোঁক। এভাবে কলিকাতার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অল্প কিছু লোক পরিণত হন শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎপাদক দলে। এর বিপরীতে ক্ষমতা কঠামোর বাইরে থাকা নিম্নশ্রেণীর বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু পরিণত হয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির নিষ্ক্রিয় ভোক্তায়। এটি ছিল হেজেমনি বা ভাবাধিপত্য কায়েমের আদর্শ পরিস্থিতি, কলিকাতাকেন্দ্রিক বিত্তশালী উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের কর্তৃক সারা দেশের মুসলমানদের ও নিম্ন-শ্রেণির হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জুতসই সময়।  


আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৯)


উনিশ শতকের কলিকাতাকেন্দ্রিক আধিপত্যকামী ব্রাহ্মণরা সংস্কৃতায়িত যে-ভাষা চালু করেছিলেন তাকে মান ধরে অন্য রীতিগুলোর বিচার করতেন তারা। ইতিহাস থেকে আমরা জানি উনিশ শতকের কয়েক দশক পার হয়ে যাওয়ার পর বাঙালি মুসলমানসহ নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু ও বৌদ্ধরা উপায়ন্ত না দেখে এক পর্যায়ে নয়া ধাঁচের বিদ্যালয়ে আর্য-সংস্কৃতি ও ধর্ম নির্ভর পাঠ্যসুচী নিয়েই পড়াশোনা শুরু করে। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠার প্রক্রিয়ায় তারা আর্য সংস্কৃতি ও ধর্মদর্শনের ভাবাধিপত্যের( Hegemony) শিকার হয়। সেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে শুরু করে দেশভাগ পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আর্য বা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও ধর্মকেন্দ্রিক বইপুস্তকের প্রাধান্য বজায় ছিল। এরপর এ ধারার প্রভাব কমে আসে, কিন্তু একেবারে দূর হয়নি। তাছাড়া পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আসলেও প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়া আর্য-সংস্কৃতির প্রভাব জারি আছে আজ পর্যন্ত। এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও ভাবাধিপত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন ডক্টর আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, সৈয়দ আলী আহসান ও মুহম্মদ আবুদল হাইয়েরা। তাদের শিক্ষায় ও মননে বিচারের ভিত্তি ছিল সংস্কৃতায়িত বাংলা। সেই ভিত্তিতে দাড়িয়ে উনিশ শতকের বাঙালির অকৃত্রিম কথ্যবাংলার রচনাকে তাদেরও মনে হয়েছে দোভাষী সাহিত্য বা মুসলমানী সাহিত্য। একই কারণে ৩৫%-এরও বেশি সংস্কৃত শব্দবহুল মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলাকে কিংবা তারও বেশি সংস্কৃতায়িত বঙ্কিম-মধুসূদনের ভাষাকে কখনোই ‘দোভাষী বাংলা’, ‘আর্যায়িত বাংলা’, ‘সংস্কৃত বাংলা’ ‘হিন্দু বাংলা’ মনে হয়নি। এখনো একই জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবেশে শিক্ষা লাভ করে বহু শিক্ষক-লেখক-বুদ্ধিজীবী একই সাংস্কৃতিক ও ভাষিক আধিপত্যের মানসদাসে পরিণত হচ্ছেন, অন্য অনেক বিষয়ের মত প্রমিত বাংলাকেও আঁকড়ে ধরে এর যেকোনো ব্যত্যয়েরই বিরোধিতা করছেন। এটি একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। ফলে উনিশ শতকের শুরুতে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের সূচিত এবং পরবর্তীতে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে পরিপুষ্ট আর্যত্বকেন্দ্রিক জ্ঞানভাষ্যের আওতায় এখনো যারা প্রাতিষ্ঠানিক ও অ-প্রাতিষ্ঠিানিক শিক্ষার বলয় পার হয়ে আসেন তাদের অনেকের মধ্যে আর্যত্বের ধারণার প্রতি দাসসুলভ আনুগত্য থেকে যায়, যা দুর্মর ভাবাধিপত্যেরই অনিবার্য পরিণাম।

ভাবাধিপত্যের (Hegemony) দ্বিতীয় স্বভাব হলো যেকোনো বিকল্প মত বা তত্ত্ব উদ্ভবের প্রক্রিয়াকে গোড়ায় থামিয়ে দেয়া। ভাবাধিপত্যের শিকার লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এর অন্ধ রক্ষক হিসাবে কাজ করে বলে তারাই বিকল্প মত বা তত্ত্বের উদ্ভবে প্রবল বাধা তৈরি করে। আমাদের মধ্যে এই দ্বিতীয় পরিস্থিতিটিও প্রবলভাবে সক্রিয়। আধিপত্যশীল মতের বিকল্প যে-কোন মত বা তত্ত্বকে গোড়াতেই নানা কায়দায় বাতিল করে দেয়ার প্রবণতা যেন আমাদের সহজাত। আর্যত্বকেন্দ্রিক ভাবাধিপত্যের শিকার কারো কারো বেলায় এর প্রভাব এতটাই প্রবল যে. একে রীতিমত অন্ধ ও উগ্র বলে অভিহিত করলেও বেশি বলা হবে না। নদীয়ার কথ্যবাংলার অনুকরণে প্রচলিত তথাকথিত প্রমিত বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের মান কথ্যবাংলায় লেখালেখির প্রস্তাবে এরা মারমুখী হয়ে উঠেন; প্রস্তাব ও সমর্থনকারীদেরকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’, ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘পাকিস্তান আমলে বাংলাভাষার আরবীকরণের উদ্যোগীদের প্রেতাত্মা’ ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক মার্কা লাগিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়ার নোংরা প্রচেষ্টা চালাতেও পিছপা হন না। কিন্তু কখনো জ্ঞানতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের পটভূমিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন না, অন্যদেরকেও করতে দেন না। এদের আচরণ চরমভাবে মৌলবাদী, ধর্মীয় গোঁড়াদের মতই, যার মূলে আছে আর্যত্ববাদী জ্ঞানভাষ্যের নিয়ত সক্রিয় আধিপত্য (Hegemony) থেকে জন্ম নেয়া দাস্যভাব। এবং ভাবাধিপত্যের নিয়মেই এদের আত্মসচেতনতা ও আত্মজাগরণের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ । তাই মায়ের মুখের ভাষাকে সংস্কৃতের উপনিবেশে পরিণত করার ইতিহাসের বেদনা তাদেরকে কখনো স্পর্শ করেনি, এখনো করে না।   

জেমস লঙ যে সাহিত্যকে ‘মুসলমানী বাংলা সাহিত্য’ মার্কায় আলাদা রাখার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন তা ভালোভাবেই কাজে লাগায় সে কালে লেখালেখি ও জ্ঞানচর্চায় জড়িত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। বিপুল সংস্কৃত শব্দবহুল মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃত বাংলাকে তারা মান ভাষা হিসাবে দাঁড় করিয়ে ফেলে। একইভাবে, কথ্যবাংলায় লেখা বইপত্র মুসলমানী সাহিত্য হিসাবে আলাদা ও নিন্মমূল্যে চিহ্নিত করে কোণঠাসা করাও সম্ভব হয়। বিদ্যালয় বা পাঠাগার কোথাও এ জাতীয় বইয়ের ঠাঁই হয় না। এগুলো প্রচলিত থাকে বাঙালি মুসলমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এভাবে বাঙালির মুখের ভাষা লেখন রীতি থেকে চিরতরে নির্বাসিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে সাধারণের পড়ার জন্য মান রচনা হিসাবে বিবেচিত হয় কেবল, বঙ্কিমের ভাষায়, ‘সংস্কৃতানুযায়ী বাংলায়’ লেখা বইপত্র।

এ যাবত বর্ণিত পরিস্থিতিটাকে সংক্ষেপে এবং আরও পরিচ্ছন্নরূপে উপস্থাপন করা যায় এভাবে: বৃটিশ দখলদারিত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে রদবদল অনিবার্য হয়ে উঠে। এই পটভূমিতে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাথে যুক্ত ইংরেজদের অজ্ঞতার কারণে বাংলা সাহিত্যির প্রচলিত ধারাকে পুরা বাদ দেয়া হয় এবং সে ধারায় যুক্ত হিন্দু-মুসিলম-বৌদ্ধ নির্বিশেষে প্রথাগত লেখকরা দৃশপট থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। নতুন বইপত্র রচনার প্রয়োজনে নয়া বাংলা গদ্য লেখার দায়িত্ব দেয়া হয় সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের। তারা তাদের জানাবুঝার ও সক্ষমতার মধ্যে যে বাংলা গদ্য তৈরি করেন তা মূলত মাত্রারিক্তভাবে সংস্কৃতায়িত বাংল। বাংলা না-জানা কিন্তু আরবিতে দক্ষ মোল্লাদেরকে নতুন ধরনের বাংলা গদ্য তৈরির দায়িত্ব দিলে মোল্লারা যেমন আরবি মার্কা বাংলা লেখবে এবং কোরআন-হাদিস-তাফসির ইসলামী জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইসলামী উপাখ্যানের এক জগত নির্মাণ করবে, এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটে–ভালো বাংলা না-জানা সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত ‘মোল্লারা’ বাংলা বইপত্র রচনার দায়িত্ব পেয়ে সংস্কৃতে ঠাসা একটা বাংলা গদ্য তৈয়ার করে এবং নির্মাণ করে আর্য ধর্মাশ্রিত বইপুস্তক ও জ্ঞানচর্চার জগত। তাদের হাতে বিদ্যালয়, মুদ্রণযন্ত্র, স্কুল বুক সোসাইটি, স্কুল সোসাইটি ইত্যাদি থাকার কারণে এই সংস্কৃতায়িত বাংলা ভাষায় লেখা বইপত্রই পড়া হতে থাকে বিদ্যালয়গুলোতে ও সাধারণ পাঠক সমাজে। এর বিপরীতে প্রচলিত ধারার সাহিত্য চর্চা চলছিল মান কথ্যবাংলায়, যাতে সংস্কৃতের সাথে সাথে আরবি ফারসি শব্দও প্রয়োজন মাফিক যুক্ত হয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণরা প্রধানত ধর্মীয় আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরবি ফারসি শব্দকে মুসলমানী প্রভাব হিসাবে চিহ্নিত করে এবং সে ভাষায় রচিত সাহিত্যকে মুসলমানী সাহিত্য, বটতলার পুঁথি ইত্যাদি নানা নাম দিয়ে মূলস্রোতের পড়াশোনার বাইরে ঠেলে দেয়। এ কারণে বাঙালির মান কথ্যবাংলার সাহিত্য কোণঠাসা হয়েই থাকে। অবিশ্বাস্য হলেই সত্যি যে উনিশ শতকের ঐ পরিস্থিতিতে ‘মোল্লা-মার্কা’ একদল সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত লেখোয়ার ধর্মাশ্রিত বইপত্র লেখালেখি প্রচলিত থাকে, অথচ মুদ্রিত বইয়ের জগত ও বিদ্যালয়াদি থেকে নির্বাসিত হয়ে যায় প্রথানুগ সেক্যুলার সাহিত্যের চর্চা। সেগুলো কোনোক্রমে টিকে থাকে তথাকথিত বটতলার পুঁথি আর মৌখিক রীতিতে। বহুযুগ পরে ‘লোক’ সাহিত্য অভিধায় নিচু ও অপ্রয়োজনীয় হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার মধ্য দিয়ে জায়গা পায় মুদ্রিত কাগজে। এ অবস্থার ফলে মুসলমানদের নতুন ধাঁচের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোন করতে হলে প্রচলিত পাঠ্যসূচী মেনে ইংরেজি বইপত্র আর মোল্লামার্কা সংস্কৃত পন্ডিতদের ধর্মাশ্রিত রচনাই পড়তে হতো। তাই বহুদিন এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে ছিল তারা।

এ পরিস্থিতি মুসলমানদের জন্য এতটাই বিপর্যয়কর ছিল যে, এমনকি জেমস লঙও লিখতে বাধ্য হন, “মুসলমানদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যাক লোকই ইংরেজি স্কুলে পড়াশোন করতে ইচ্ছুক। তারা স্যাক্সন জাতীয় লোকদের অনুকরণ করাও পছন্দ করে না। তাহলেও তাদের বেশ বুদ্ধি আছে এবং তারা প্রাচ্যদেশীয় বিষয়সমূহ অধ্যয়ন করতে ভালোবাসে। তাদের যে মানসিক মৃত্যু হয়েছে তা নয়, তারা স্বপ্নগ্রস্ত মাত্র। তাদের জন্য রুচিসম্মত পুস্তক প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।”২৬  মুসলমানরা নতুন বিদ্যায়লগুলোয় পড়াশোনা করতে পারেনি। অন্যদিকে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা অধিকাংশই ছিল প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার বাইরে। তাছাড়া হিন্দু হওয়ার কারণে ধর্মীয় আবেগবশত তাদেরও আর্য-সংস্কৃতি প্রধান পাঠ্যসূচীতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে নি হয়ত। 

তবে আর্থিক ও সামাজিক কারণে এ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেশিদিন দূরে সরে থাকতে পারেনি বাঙালি মুসলমানও। সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে এক পর্যায়ে উপনিবেশি প্রশাসক-আর ব্রাহ্মণ্য শক্তির মিলিতে জোটের কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা। প্রচলিত পাঠ্যসূচী মেনে ইংরেজির অনুকরণে গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, আর অন্যদিকে, আর্য পুরাণ, দেবদেবীর স্তুতিমূলক বইপত্র দিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিষ্ঠানের বাইরের পড়াশোনা শুরু করে বাঙালি মুসলান, নিম্নশ্রেণির বাঙালি হিন্দু ও বৌদ্ধরা। এর ফলে সংস্কৃতায়িত বাংলা ভাষা ও ইংরেজিতে পড়াশোনা করে আর্থিক দারিদ্র কিছুটা মিটাতে সক্ষম হলেও তারা হারায় তাদের ভাষার জগত, মান কথ্যবাংলা এবং উপনিবেশের আগের বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ও সঞ্চয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত