| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: কনে । মোহিত কামাল

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

লেবাননি কবি খলিল জিবরানের একটি উক্তি মনে পড়ল-‘বাচালের কাছে আমি নীরবতা শিখেছি, রাগীর কাছে শিখেছি সহনশীলতা এবং দয়া শিখেছি নির্দয়ের কাছে; কিন্তু আমি আমার এ শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ নই।’ এটা সাদামাটা কোনো কথা নয়। জীবনখোঁড়া শিক্ষাটা এ মুহূর্তে ঝাঁকি দিল ফয়সাল চৌধুরীকে। ভাঙা বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, শীতে কাবু হয়ে ইট ভাঙছেন এক মহিলা। পাশে আছে আট-দশ বছরের এক শিশুকন্যা। কিছুটা দূরে বাড়ি ভাঙার কাজ দেখাশোনা করছেন একজন ভদ্রলোক, সুপারভাইজার। এক দিকে ভাঙা হচ্ছে পুরোনো বাড়ি, আরেক দিকে ইট ভাঙছেন দিনমজুর মহিলাটি। শিশুকন্যাও আছে মায়ের পাশে। বড় বড় ইটের টুকরো মায়ের হাতের নাগালে ছুড়ে দিচ্ছে সে। হঠাৎ একটা ইট ছিটকে গিয়ে লাগল সুপারভাইজারের পায়ে। মুহূর্তে খেপে ওঠেন সুপারভাইজার, ছুটে গিয়ে কষে চড় বসিয়ে দিলেন মেয়েটির গালে। অনেকটা উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল মেয়েটি।

তিনতলা বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন ফয়সাল চৌধুরী। সুপারভাইজারের মুখের বিকৃতি দেখছেন তিনি। লোকটাকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না তাঁর, মনে হচ্ছে অমানুষ, বিকৃত মানুষ। রাগী মুখে এমন ভয়ংকর অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে! বড় হয়ে আছে চোখ, দাঁত খিঁচে আছে, বিকৃত হয়ে গেছে মুখের পেশি, ফুলে উঠছে নাক; রক্তাভ হয়ে গেছে লোকটির মুখ। এ মুহূর্তে শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা একাত্তরে দেখা ইয়াহিয়া খানের ‘তুই জানোয়ার’ ছবিটার কথা মনে পড়ছে। লোকটাকেও জানোয়ার মনে হচ্ছে ফয়সাল চৌধুরীর। অথচ কী আশ্চর্য কান্ড, একটুও কাঁদল না মেয়েটি! নিজেকে সামলে নিয়ে, ডান হাতের কনুই ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। কাপড়ে লাগা ধুলোকণা ঝেড়ে, যেন কিছুই ঘটেনি, এমন ভঙ্গিতে আবার মন দিল কাজে। সরি বলেনি, সরি বলতে হয়-এ ভদ্রতা হয়তো শেখা হয়নি মেয়েটির। চোখ তুলে তাকায়ওনি। ভয়ের কোনো চিহ্নও নেই তার চোখেমুখে। ভুল করে খেসারত দিয়েছে ভুলের, চড় খেয়েছে; এ প্রাপ্যটা সহজে মেনে নিয়েছে সে। মেয়েটিকে চড় দেওয়ার মুহূর্তে একবারমাত্র চমকে উঠেছিলেন দিনমজুর মহিলা। আর একবারও তাকাননি মেয়ের দিকে। তাঁর হাত চলছে সমান তালে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলছেন ছোট-বড় ইটের টুকরো। বাঁ হাতে লাগানো আছে কালো রাবারের কৃত্রিম আঙুল, ডান হাতে চলছে হাতুড়ি। বাঁ হাত দিয়ে পজিশনে রাখছেন ইটের টুকরো, ডান হাতে ছন্দোময় তালে হাতুড়ি ওঠানামা করছে। সুপারভাইজারের রাগ কমছে না, ছুটে আসেন তিনি মহিলার কাছে। ধমক দিয়ে চিৎকার করে বললেন, এই মাগি, ওঠ! তোকে কাজ করতে হবে না, বহু লোক আছে কাজের!

মহিলাটি চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। মগ্ন আছেন নিজের কাজে।

এই, ওঠ্ ! কাজ করতে হবে না তোকে। কথা শুনছিস না? বলে মহিলার দিকে তেড়ে গেলেন সুপারভাইজার।
কাজ থামিয়ে দিল শিশুকন্যা। তার দুহাতের মুঠিতে দুটো ইটের টুকরো-মুঠি শক্ত করে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সুপারভাইজারের দিকে।

হঠাৎ সুপারভাইজারের চোখ পড়ল ক্রোধে জ্বলে ওঠা মেয়েটির ওপর। ও রোষ দেখার সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলেন তিনি। থেমে গেলেও গজগজ করতে লাগল; ক্রোধের সময় কচি মেয়েটির মুখ দেখার সৌভাগ্য হলো ফয়সাল চৌধুরীর-উদ্ধত ফণা তুলে কীভাবে ফুঁসে উঠতে পারে একটি কন্যাশিশু, দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। প্রতিবাদের ভাষা হওয়া উচিত এমনই জোরালো। ক্রোধে অন্ধ হয়ে যায়নি শিশুটি। ভেতরের রোষ ফুটে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। হিংস্র উন্মত্ততায় ফেটে পড়েনি সে। অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়নি। ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রকাশ ঘটেছে শৈল্পিক ঢঙে। এ শিল্পের কাছে পরাভ‚ত হয়েছে খলিল জিবরানের দর্শন। ফয়সাল চৌধুরীর মনে হলো, রাগীর কাছ থেকে সহনশীলতা শিখলেও সব সময় অকৃতজ্ঞ হওয়া যায় না তার প্রতি। নিশ্চিত, শিশুটির মেজাজের শৈল্পিক নিয়ন্ত্রণ দেখে সহনশীলতা শিখতে পারতেন খলিল জিবরান-সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞও হতেন তিনি। এ মুহূর্তে কৃতজ্ঞতা বোধ করছেন ফয়সাল চৌধুরী। মেয়েটির কাছে শুধু সহনশীলতাই শিখলেন না, শিখেছেন ভেতরের ফুঁসে ওঠা রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল। এ জন্য কৃতজ্ঞ তিনি শিশুটির প্রতি। অন্যদিকে আত্মম্ভরী, আস্ফালনকারী সুপারভাইজারের মধ্যে নির্দয় হিংস্র উন্মত্ততার যে আস্ফালন দেখেছেন, সেটি দিয়ে খলিল জিবরানের দর্শন মেনে নিলেন ফয়সাল চৌধুরী। রাগলে কেমন হিংস্র লাগে মানুষকে! কেমন নির্দয় হতে পারে! একটি ছোট শিশুর অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য কেমন চড় বসাতে পারে মানুষ! চড় খেয়ে প্রতিবাদ করেনি শিশুটি। বুঝেছে, ভুল করেছে সে। চড় মেনে নিয়ে স্বাভাবিক ঢঙে কাজ করছিল, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য রুখে দাঁড়িয়েছে সে।

মেয়েটি জানে-মহিলাটি কোনো অন্যায় করেনি। এ দোষে অশোভনভাবে মহিলাকে আক্রমণ করা অন্যায় হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে মেয়েটি। এই যে বোধ, শিশুবয়সের এই যে শিক্ষণ, এ শিক্ষণ পুরো জীবনে অর্জন করেছেন কি না মনে পড়ছে না ফয়সাল চৌধুরীর। সুপারভাইজারের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য! মেয়েটির জন্য অলৌকিক এক মায়ার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ফয়সাল চৌধুরীর মনে। নিচে নেমে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। সুপারভাইজারের নির্দয় আচরণ দেখে মায়া জাগল, দয়া জাগল শিশুটির প্রতি? নাকি নিজস্ব যোগ্যতায় শিশুটি অর্জন করে নিয়েছে এই মায়া! চট করে ফয়সাল চৌধুরীর মনে ঢুকে গেল আরও একটি প্রশ্ন-মহিলা এমন নির্লিপ্ত ছিল কেন? যখন শিশুটিকে আক্রমণ করেছে সুপারভাইজার, সামান্য চমকে উঠেছিল মাত্র। মেয়েটির পাশে দাঁড়ায়নি সে। তবে কি মা-মেয়ের সম্পর্ক না ওদের? নাকি ভোঁতা হয়ে গেছে মায়ের স্নেহের ধার। জীবনযন্ত্রণার ঘা খেতে খেতে কি এভাবে ভোঁতা হয়ে যায় মায়া-মমতার শান? অথচ কী দুর্দমনীয় মেয়েটি-মহিলাকে যখন শাসাচ্ছিল, রুখে দাঁড়িয়েছে সে! শিশুটির চোখ দিয়ে বিচার করে বলা যায়, সম্পর্ক ওদের মা-মেয়েরই।

শোবারঘর থেকে ডাক শুনতে পাচ্ছেন ফয়সাল চৌধুরী। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কী করছ? মেহমান এসেছে বাসায়, ভেতরে এসো!

স্ত্রী জাহেদার ডাক শুনে দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন ফয়সাল চৌধুরী।

ফিসফিস করে জাহেদা বললেন, ছেলেপক্ষ এসেছে! সঙ্গে ছেলেও এসেছে!

বলো কি! এত সকালে কনে দেখতে কি মেয়ের বাড়িতে আসে কেউ!

সকাল কোথায়? এখন প্রায় এগারোটা।

হোক, এটা কি কনে দেখার সময়! ওদের দেখছি সেন্স নেই! প্রথম ইমপালসই নেগেটিভ টোকা দিয়েছে মনে। এ বিয়ে হবে বলে মনে হচ্ছে না।

চট করে নেগেটিভ হয়ে যাও তুমি। তোমার এই বদ স্বভাবটা আর বদলাল না। ওদের কোনো তাড়া থাকতে পারে না? আজ বন্ধের দিন। তোমাকে বাসায় পাওয়া যাবে, মেয়েও থাকবে বাসায়, অসময়ে তাদের আসার পেছনে তো এ ধরনের পজিটিভ ধারণাও কাজ করতে পারে, পারে না?

পারে, তবে বিষয়টা আলাপ করা উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে।

তোমার সঙ্গে করেনি, আমার সঙ্গে আলাপ করেছে। তুমি তখনও ঘুমাচ্ছিলে।

এত সকালে ফোন করে কেউ? না, হবে না। ওদের মিনিমাম সেন্স নেই!

জাহেদা বেগম খেপে উঠছেন। বুঝতে পারছেন না ফয়সাল চৌধুরী। নিজের উপলব্ধির ঘেরাটোপে আটকে আছেন তিনি। জাহেদা বেগম ক্ষোভ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কিচেনের দিকে। আগত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা জরুরি।

স্ত্রীর রাগী মুখ দেখার সুযোগ হয়নি; সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললেও মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি ক্ষুব্ধ মুখটি। কথা বলার সময় মন ছিল বিরক্তির শীর্ষবিন্দুতে! মনে বিরক্তি থাকলে, চোখ দিয়ে তাকালেও দেখার মতো করে দেখা হয় না, দেখা যায় না। যে থাকে সব সময় আশপাশে, মায়া থাকলেও তার দিকে নজর যায় না। কথা বললেও চোখ খুলে দেখার ড্রাইভ আসে না ভেতর থেকে। দেখার মতো করে দেখতে পারে না মনও। এ অভ্যাসের কারণে স্ত্রীর মনের অবস্থা বুঝতে পারেননি ফয়সাল চৌধুরী। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর শোবারঘর থেকে বেরিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে এগোলেন। দরজা ভেজানো, লক করা নেই; বুঝতে পেরে একবার টোকা দিলেন দরজায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন দরজার সামনে। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

রুমে ঢুকে কিছুটা আশ্চর্য হলেন। এখন বেলা এগারোটা সাতাশ মিনিট। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, এদিক-ওদিক দুলতে থাকা পেন্ডুলামটি ঠুক ঠুক করে আঘাত হানছে চোখে। এ সময়ও মেয়ে ঘুমিয়ে আছে, নিজের চোখে দৃশ্যটা দেখতে চাননি।

মেয়ের উদ্দেশে ছোট্ট করে ডাক দিলেন, সাবা!

বাবার ডাক শুনে লেপের ভেতর থেকে মাথা বের করে বাবাকে ঘরে দেখে চট করে লেপ জড়িয়েই উঠে বসল সাবা। অবাক হয়ে তাকাল বাবার দিকে।

তুমি কি জানো, কেউ বাসায় আসবে আজ?

নির্লিপ্তভাবে সাবা জবাব দিল, জানি আব্বু। ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে?

এ সময় আসবে, জানো?

জানি।

আম্মু বলে রেখেছেন আমাকে। বেরোতে নিষেধ করেছেন বাসা থেকে।

এ সময় কেউ কনে দেখতে আসে?

সময়-অসময় তো আমাদের তৈরি। মানুষের প্রয়োজন থাকতে পারে না? প্রয়োজনমতো কোনো উদ্যোগ নেওয়া কি দোষের?

মেয়ের প্রশ্ন শুনে চুপসে গেলেন ফয়সাল চৌধুরী। বুঝতে পারলেন, মেয়ে আর মেয়ের মায়ের মধ্যে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। তার সঙ্গে দূরত্ব হয়ে গেছে দুজনের। এ দূরত্বের কথা টের পাননি এতদিন। কেন টের পেতে হলো এখন? কেন বোঝেননি আগে? নতুন এ বোধের কালো পর্দা সরিয়ে দিল কে? বরপক্ষ? উত্তর নিজেই খুঁজে নিলেন। বরপক্ষের অসময়ে আগমনে বিরক্ত ও বিস্মিত হলেও, কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন তিনি। বরপক্ষের অশোভন কাজ থেকে ভালো কিছু শিখে অকৃতজ্ঞ হওয়া মানায় না। অকৃতজ্ঞতার মোড়ক থেকে কৃতজ্ঞতার গোপন আলো পেয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে যতটুকু সম্ভব ভদ্রতার সঙ্গে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি ফয়সাল চৌধুরী, সাবার বাবা।

তিনজন অতিথি এসেছেন। দুজন পুরুষ, একজন মহিলা।

একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন তিনজন। একজন ইয়াংম্যান, মুখের ত্বক থেকে বেরোচ্ছে গোলাপি জেল্লা; তত লম্বা নয়, বেঁটে। মাথায় পরেছে ক্যাপ। কালো জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে কালো কেডস, মাথায় কালো ক্যাপ। বাসায় কি কেউ ক্যাপ পড়ে আসে! রোদে গেলে, বেড়াতে গেলে, খেলার মাঠে বা সমুদ্রতীরে না-হয় মানিয়ে নেওয়া যায় ক্যাপ। সকালে ক্যাপ পরেছে কেন? ঠিকঠাক আছে সব দিক! স্মার্ট সবাই। ইয়াংম্যানকে আরও বেশি স্মার্ট মনে হচ্ছে। তবে ক্যাপের কারণে কমে গেছে তার স্মার্টনেস। কোনো এক সময় কথাটা বলে দিতে হবে ইয়াংম্যানকে। ভাবতে গিয়ে থেমে গেলেন ফয়সাল চৌধুরী।

শরবতের ট্রে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন জাহেদা বেগম। হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন অতিথিদের সামনে। বরপক্ষের লোকজনকে শরবত খাইয়ে বরণ করে নিতে হয়-এ সংস্কৃতি এখনও লুপ্ত হয়নি। অসময়ে কনেপক্ষের বাড়িতে আসা যাবে-বিশেষ প্রয়োজনে সহজে মেনে নেবে কনেপক্ষ। এ ধারার পরিবর্তন হলেও শরবত খাওয়ানোর অলঙ্ঘনীয় সংস্কৃতির স্থায়িত্ব বিরক্তি তৈরি করল ফয়সাল চৌধুরীর মনে। অন্তরে বিরক্তি, মুখে ক্যাবলার মতো বেমানান হাসি নিয়ে সোফায় বসলেন তিনি। কুশনটা বসার জায়গা থেকে সরিয়ে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, এ সময়ে আপনাদের সাবলীল উপস্থিতিতে খুশি হয়েছি। নিশ্চয় আপন ভেবে এসেছেন এ সময়। ‘এ সময়’ শব্দটিকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। অতল মন মেনে নিতে পারেনি অসময়ে মেহমানের আগমন, বিশেষ করে কনে দেখার মতো ইস্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ফয়সাল চৌধুরীর ভেতরের সত্তা। বাইরেরটা তিনি মেনে নিয়েছেন। অতিথিদের পরিচয় জানা হয়নি। উচিত ছিল তাঁর পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরা; তুলে ধরেননি; হয় সৌজন্যতা জানে না, নয়তো ঘাবড়ে গেছে ওরা। কী ঘটছে, কিছু বুঝতে পারছেন না ফয়সাল চৌধুরী।

জাহেদা বললেন, পরিচিত হয়েছ অতিথিদের সঙ্গে?

ফয়সাল চৌধুরী বললেন, পরিচয় দিয়েছি আমি। ওনাদের পরিচয় পাইনি এখনও।

সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়সী লোকটি বলল, আমি হচ্ছি মুনিমের মামা, আবদুল আলিম। উনি হচ্ছেন, মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার স্ত্রী।

তাহলে ইয়াংম্যানের নাম মুনিম। সে-ই তাহলে ক্যানডিডেট। ফয়সাল চৌধুরী বুঝে গেলেন, ওদের সবকিছুর মধ্যে একটা রাখঢাক ভাব আছে। অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে। আবার ইচ্ছাকৃতভাবেও লুকোতে পারেন তারা।
ফয়সাল চৌধুরী ইয়াংম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার নামই তো মুনিম, তাই না?
জি, আমি মুনিম।

শুধু মুনিম? নাকি আরও অংশ আছে নামের?

জি, আছে। আবদুল মুনিম।

‘আবদুল’ শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নড়ে বসলেন ফয়সাল চৌধুরী। বুঝতে বাকি থাকেনি ‘আবদুল’ শব্দটা লুকোনোর জন্য সক্ষিপ্ত নাম বলেছে মুনিম। আরও কৌত‚হল জাগল ফয়সাল চৌধুরীর মনে। প্রশ্ন করলেন, কোনো টাইটেল নেই?

জি, আছে। আমার পুরো নাম আবদুল মুনিম খান।

‘খান’ও লুকোনোর চেষ্টা করেছিল মুনিম। এটাও বুঝতে পারলেন ফয়সাল চৌধুরী। নাম নিয়ে যার এত লুকোচুরি, আরও কত কিছু গোপন করবে, কে জানে। ভেবে শঙ্কিত হলেন-এমন অস্বচ্ছতার মধ্যে মেয়েকে ঠেলে দিতে পারবেন না তিনি। ভেতরে ভেতরে জেগে উঠল নেগেটিভ মোটিভ। এই মনোভাব নিয়ে চুপ হয়ে গেলেন তিনি।

কিছুক্ষণ পর সাধারণ ড্রেসে বসার ঘরে এল সাবা। সজ্জন মেয়ে হিসেবে সবাইকে উদ্দেশ করে সালাম দিয়ে সোফার খালি সিটে বসে বুঝতে পারল, পাশের জনই হতে পারে ক্যানডিডেট। কনে দেখার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। বাসায় গিয়ে কনে দেখার সনাতন নিয়ম উঠে গেছে বলা হলেও টিকে আছে পুরোনো ঢঙের নতুন রূপ। রূপবদলে এখন কনে দেখা হয় শপিং মলে, চায়নিজ রেস্তোরাঁ বা ফাস্টফুডের দোকানে। ‘আঙুল দেখাও’, ‘হাঁটো খালি পায়ে’, ‘চুল খুলে দেখাও’, ‘কোরআন শরিফের আয়াত মুখস্থ বলে শোনাও’-এমন আবদারের বদলে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার বিষয়টা প্রাধান্য দেওয়া হয় এখন। আগে হয়তো কেউ দেখেননি কাউকে, না-ও থাকতে পারে জানাশোনা, নতুন করে পরিচিত হওয়া যায়, মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠে মানুষের সম্পর্ক, উদ্ধত মনোভাব না-দেখিয়ে খারাপলাগা বিষয় কিংবা অপর পক্ষের ত্রুটিগুলোতে অসন্তোষ প্রকাশ না-করে মার্জিতভাবে মোকাবিলা করা উচিত, রুচিশীল আচরণ করা উচিত। এসব ব্যাপারে ইতিমধ্যে বড়দের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছে সাবা। উচ্চশিক্ষিত সাবা তাই একদম সহজ; স্নায়ুচাপ নেই বললেই চলে। বাবার মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে বুঝতে পারল, অসময়ে মেয়েকে দেখতে আসার বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারেননি তিনি। মনের অসন্তোষ ফুটে আছে বাবার মুখে। অসন্তোষ কাটিয়ে দিতে হবে ভেবে উদ্যোগী হয়ে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সাবা বলল, আমি সাবা। এবার মাস্টার্স শেষ করলাম। এমফিল কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করছি।

মুনিমের মামা সবার সঙ্গে আবারও পরিচয় করিয়ে দিলেন সাবাকে।

মুনিমকে উদ্দেশ করে সাবা প্রশ্ন করল, কী করছেন আপনি?

এতক্ষণে মুখ খুলেছে মুনিম। সহজ হয়ে বলল, এখনও স্টুডেন্ট। পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএস করেছি। পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছি।

সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়েছে সাবা। নিজেকে মোটেও কনে ভাবছে না; ভাবছে, একজন নতুন মানুষ আর এক নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এমন ভঙ্গিতে বলল, কনগ্র্যাচুলেশন ফর স্কলারশিপ।
ওয়েলকাম। জবাব দিল মুনিম।

সাবা এবার প্রশ্ন করল, কোন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছেন?

ইউনিভার্সিটি অব হনলুলু।

এটা তো যুক্তরাষ্ট্রের নাম করা ইউনিভার্সিটি, তাই না?

হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের দিলাওয়ার স্টেটে অ্যাক্রিডেশন কাউন্সিল অব হায়ার এডুকেশন (এসিএইচই) কর্তৃক অনুমোদিত বিশ্বের স্বীকৃত একটি বড় ইউনিভার্সিটি। এসিএইচই হচ্ছে ওয়ালিস ও ফাতুনা কিংডমের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান।

ফুল স্কলারশিপে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ, ফুল স্কলারশিপ পেয়েছি।

ভেরি গুড! অ্যাগেইন কনগ্র্যাচুলেশন টু ইউ।

ফয়সাল চৌধুরী মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আবদুল মুনিম খানের কথা। সাবার স্বতঃস্ফ‚র্ত প্রশ্নের জবাবে, কোথাও কোথাও সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছে। লুকোছাপার মনোভাব নিয়ে করেছে এমনটা? নাকি এমনই সে, বুঝতে পারছেন না। কোথাও বাড়িয়ে বলেছে। জাহির করার টেনডেনসি রয়েছে এ মনোভাবের মধ্যে। ফয়সাল চৌধুরী মাথায় কেবল ছেলেটার ত্রæটিগুলো ঢুকছে। ভালো গুণ চোখে পড়ছে না কেন? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে নিলেন : নামে আনস্মার্ট হলেও দেখতে হ্যান্ডসাম! এমএস করেছে! পিএইচডি করতে যাচ্ছে! বিশাল খুশির খবর! ভালো খবরগুলো মনে দাগ কাটছে না কেন? হঠাৎ মনে হানা দিল নতুন এক চিন্তা-মুনিম খান এখনও স্টুডেন্ট। এটা বরের বড় নেগেটিভ দিক। এ ইস্যুতে ছাড় দিতে পারেন না। বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দিতে পারেন না তিনি।

সবাই চুপচাপ আছে দেখে মুনিমের মামা আবদুল আলিম বললেন, শিগগির ইউএসএ চলে যাবে মুনিম। সঙ্গে ওয়াইফ নিতে পারবে। ওর স্কলারশিপ সাপোর্ট করে ওয়াইফ নেওয়ার বিষয়টা।

‘ওয়াইফ’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল সাবা। ফয়সাল চৌধুরীও কিছুটা টলে উঠলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আবদুল আলিম স্কাড ছুড়ে দিয়েছে। এ স্কাড ধ্বংস করে দেয়নি সাবাকে। জয় করে নিয়েছে সাবার মন। জাহেদা বেগমও বসার ঘরে এসে শুনেছেন ছেলের মামার শেষ কথা। একদম গলে গেছেন তিনি। দিশেহারা হয়ে গেছে তার চিন্তার জগৎ। আবেগের ঘরে জেগে উঠেছে উথালপাতাল ঢেউ। কী করবেন, কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না। সাক্ষাৎ সোনার টুকরো, পারলে ছেলেটির গলায় এখনই মালা পরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে। এখনই গলায় পরিয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে সাবাকে। দেখতে সুন্দর। পৌরুষদীপ্ত গায়ের রং। মেয়ের তুলনায় উচ্চতার সমস্যা আছে-খাটো, এমনটা ভাবতে পারলেন না। ভাবলেন, আর একটু লম্বা হলে ভালো হতো। মেয়ের উচ্চতা হচ্ছে পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। ছেলের হাইট কত? বসে আছে, বোঝা যাচ্ছে না। হাইট জিজ্ঞেস করা অশোভন। অশোভন কাজটা করা উচিত না। এমন ছেলে হাতছাড়া হোক, কিছুতেই চান না তিনি। বিয়ে না-হওয়া পর্যন্ত উদ্বেলিত মনের এ অবস্থা শীতল হবে বলে মনে হচ্ছে না। অস্থির হয়ে কিচেনের দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন। ফিরে এসে বিগলিত গলায় জাহেদা বেগম বললেন, খেয়ে যেতে হবে আপনাদের।

আবদুল আলিম বললেন, না আপা, উঠতে হবে আমাদের। আপনারা রাজি হলে বিয়ের শপিং শুরু করব আমরা। হাতে সময় নেই আমাদের। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি করা ভালো।

ছেলের মামার এ কথার পাল্টা জবাব দিতে পারলেন না জাহেদা বেগম। কেবল উচ্চারণ করলেন, বসেন, বসেন। খেয়ে যেতে হবে, না-খাইয়ে ছাড়ছি না আমি।

আবদুল আলিম হেলান দিয়ে বসেছেন সোফায়। অনেকটা ইজি হয়ে গেছেন তিনি। বুঝে গেছেন, যুদ্ধক্ষেত্র এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রথমে কিছুটা জড়তা থাকলেও, কাটিয়ে উঠেছেন সেই জড়তা। কনে দেখতে এসে নিজেরা হয়েছিলেন পরীক্ষার মুখোমুখি। পরীক্ষায় জয়ী হয়ে গেছেন। এখন পরীক্ষকের ভ‚মিকা গ্রহণ করেছেন। আবদুল আলিম প্রশ্ন করেন সাবাকে, পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো গুণ আছে আপনার?

বিগলিত হেসে সাবা বলল, না, কোনো গুণ নেই। তবে কিছুটা আড্ডাবাজ আমি। ফ্রেন্ডদের সঙ্গে হইচই করে বেড়াতে পছন্দ করি। এটা দোষ না গুণ, জানি না।

মুনিম বলল, ভেরি ইন্টারেস্টিং!

কথা কম বলছে সে। আচমকা দু-একটা কথা বেরিয়ে আসছে তার মুখ থেকে। প্রবণতা আছে ইংরেজি বলার। পিএইচডি করতে যাওয়া স্টুডেন্টের যে ধরনের স্পোকেন পাওয়ার থাকার কথা, উচ্চারণ ও বলার ধরন যত স্মার্ট হওয়ার কথা, ততটা তাকে স্মার্ট মনে হচ্ছে না ফয়সাল চৌধুরীর। আবারও ছেলের নেগেটিভ দিকটা দেখছেন তিনি। ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং’ শব্দটির মধ্যে কী আছে? মেয়ের আড্ডাবাজ বৈশিষ্ট্য কি নেতিবাচকভাবে দেখছে সে? নাকি ইতিবাচকভাবে নিয়েছে? এ রহস্যময়তাও ভালো লাগছে না। অনেক গুণ আছে মেয়ের। কেবল আড্ডাবাজ বৈশিষ্ট্য সেই গুণের সামগ্রিক প্রকাশ না। নিজেকে সংযত রেখে জবাব দিয়েছে সাবা। মেয়ের এ স্বভাব ভালো লেগেছে বাবার।

ফয়সাল চৌধুরী প্রশ্ন করলেন আবদুল মুনিম খানকে-গ্রামের বাড়ি কোথায় আপনাদের? কোথায় সেটেলড?
মুনিম মুখ খোলার আগেই আবদুল আলিম বললেন, গ্রামের বাড়ি মাইজদি। সেটেলড, রামপুরা বনশ্রী।
আবদুল আলিমের অযাচিত জবাব পছন্দ করলেন না ফয়সাল চৌধুরী। ছেলেকে প্রশ্ন করেছেন। ছেলের মুখ থেকে উত্তর শুনতে চেয়েছিলেন। মেয়ের বাবা হয়ে ছোট হয়ে যাননি তিনি। উন্নত ও উদ্ধত গলায় বললেন, মুনিমের কাছ থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম উত্তর।

বাবার গলার স্বর শুনে, চিরচেনা বাবার মনের বিরক্তি টের পেয়ে, পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সাবা প্রশ্ন করল, ভাইবোন ক’জন আপনারা?

এবার মুনিম বলল, আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান।

একমাত্র সন্তান শুনে কিছুটা নড়ে বসলেন ফয়সাল চৌধুরী। গলার স্বর নরম হয়ে গেল। নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কী করেন আপনার বাবা?

আবদুল আলিম আবারও লুফে নিলেন প্রশ্নটি। মুনিমকে জবাব দেওয়ার সুযোগ না-দিয়ে বললেন, ওর বাবা ছিলেন মাইজদির প্রখ্যাত আইনজীবী। দুবছর আগে মারা গেছেন।

ওহ্, সরি! ফয়সাল চৌধুরী এই প্রথমবারের মতো সহনশীল চোখে তাকালেন মুনিমের দিকে। বাবার মৃত্যুর সংবাদ উচ্চারিত হয়েছে এ মুহূর্তে। কিন্তু মুনিমের চোখে বেদনার ছাপ নেই। ছেলের মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠেনি দুঃখবোধ। বাবার মৃত্যুসংবাদে দুঃখবোধ জাগাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বাভাবিক বিষয়টাতেও অস্বাভাবিকতা দেখলেন তিনি। মুখে সরি বললেও সহনশীলতার বদলে বিরক্তি জাগল মনে।

ফয়সাল চৌধুরী সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, তোমরা গল্প করো, আমি উঠছি।

কিছুটা উচ্ছ্বসিত, এমন গলায় আবদুল আলিম বললেন, ঠিক আছে, আপনি যান। আমরা গল্প করছি।

লোকটাকে মনে হলো বাচাল। খলিল জিবরান বাচালের কাছ থেকে নীরবতা শিখেছেন। সেই বাচাল শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞ নন খলিল জিবরান-ঠিকই বলেছেন। এ মুহূর্তে বাচাল আবদুল আলিমের কথার মধ্য থেকেও নীরবতার ভালো দিকটা খুঁজে পেয়েছেন ফয়সাল চৌধুরী। খুঁজে পেয়ে শুধরে নিয়েছেন নিজেকে। পরিস্থিতি এড়িয়ে নিজের শোবারঘরে যাওয়া শ্রেয় মনে করছেন। আবদুল আলিমের প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়েও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন মনে মনে। কারণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, যত সোনার টুকরো ছেলে হোক-এ বিয়েতে মত দেবেন না তিনি। আরও ভাবতে হবে বিয়ে নিয়ে।

ফয়সাল চৌধুরী শেবার ঘরে ঢুকলেন।

বেডসাইড লকারের ওপর আছে একটি গল্পের বই। এ প্রজন্মের তুখোড় গল্পকার মামুন হুসাইনের বালকবেলার কৌশল বইটি হাতে নিয়ে নাড়তে লাগলেন। মামুন হুসাইনের অনুরাগী পাঠক সাবা। বলেছিল, দেখো আব্বু, ভবিষ্যদ্বাণী করছি আমি, মামুন হুসাইন একসময় তার লেখনীশক্তির কারণে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জীবনানন্দ দাশের মতো আবিষ্কৃত হবেন। কী আছে মামুন হুসাইনের বইতে? কেন এমন করে কথা বলেছে সাবা? বইটি উল্টিয়ে পড়া শুরু করেছেন, এমন সময় জাহেদা বেগম ঘরে ঢুকে বললন, কেমন লাগল ছেলেকে?

নির্লিপ্ত গলায় ফয়সাল চৌধুরী বললন, যেমন ছেলে তেমন লেগেছে।

আহা! তা তো বুঝলাম। তোমার কেমন লেগেছে?

‘ভালো লেগেছে’-এটাই তো শুনতে চাচ্ছ, তাই না?

ঘুরিয়ে কথা বোলো না। মেয়ের বিয়ে বলে কথা! সিরিয়াস হও। সিরিয়াসভাবে ভাবো। ওরা তাড়াতাড়ি বিয়ে সেরে ফেলতে চাচ্ছে।

স্ত্রীর মুখের দিকে শীতল চোখ তুলে ফয়সাল চৌধুরী বললেন, বিয়ের ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করা চলবে না। যেখানে তাড়াতাড়ির ব্যাপার থাকে, সেখানে ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’-প্রবাদটা স্মরণ রাখতে হবে। তা ছাড়া সরাসরি বলছি, তুমি অখুশি হবে, তবু বলছি, এ বিয়েতে রাজি নই আমি।

বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হতাশ হয়ে খাটে বসে পড়লেন জাহেদা বেগম।

কী বলছ? এমন ছেলে কি পাবে আর?

ছেলে তোমার পছন্দ হয়েছে, বুঝলাম। সাবার কি পছন্দ হয়েছে? তার মতামত নিয়েছ?

তার সঙ্গে দুদিন আগে কথা হয়েছে। ছেলের বায়োডাটা দেখে পছন্দ করেছে। ছেলে দেখে পছন্দ হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না। তবে ও গল্প করছে অতিথিদের সঙ্গে। হাসিখুশি আছে। দেখে মনে হয়েছে, পছন্দ করেছে।
এটা তোমার ধারণা। এমন ছেলেকে আমার ব্রিলিয়ান্ট সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করতেই পারে না; নিশ্চিত আমি।
তাহলে ডেকে আনি ওকে। জিজ্ঞেস করো মেয়েকে।

আনো।

জাহেদা বেগম ফিরে গেলেন বসার ঘরে। ইশারায় ডেকে তুলে আনলেন সাবাকে।

ফয়সাল চৌধুরী প্রশ্ন করলেন, ছেলে পছন্দ হয়েছে তোমার?

পড়াশোনার বিষয়টা ভালো লেগেছে। দেখতেও সুন্দর। হাইট বোধহয় কম।

খাটের হেলান অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে ফয়সাল চৌধুরী বললেন, দেখেছ?

জাহেদা বেগম রুখে দাঁড়িয়ে বললেন, সবকিছু তো এক শ ভাগ জুটবে না। কিছুটা ছাড় দিতে হবে না?

সাবা বলল, আব্বু, অপছন্দের কথা বলছি না-বলছিলাম হাইটের ঘাটতির কথা।

ঘাটতি দেখা মানে তো অপছন্দ হওয়া! বুঝতে পারছ না তুমি?

সাবা বলল, তোমার পছন্দ হয়নি, আব্বু?

না।

বাবার সরাসরি কথা শুনে দমে গেল সাবা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ছেলের এডুকেশনটা ভালো লাগছে। দেখতে পারো, এগোতে পারো তোমরা।

মেয়ের সম্মতির অর্থ বুঝতে পারলেন ফয়সাল চৌধুরী। শিক্ষাটাকে প্রাধান্য দিচ্ছে মেয়ে। এ ইস্যুতে কি একমত তিনি? মেয়ের কথা শুনে শীতল গলায় বললেন, ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছায় বাধা দেব না আমি। তবে, তাড়াহুড়া করে বিয়ে দেব না তোমাকে। যেখানে তাড়াহুড়ো থাকে, সেখানে গোপন ঝামেলা থাকে। চারপাশ থেকে শেখা এটা আমার অভিজ্ঞতা। আমার অভিজ্ঞতাকে খাটো করে দেখব না। সব খোঁজখবর নেব, জেনেশুনে পাকা কথা দেব।

বাবাকে জড়িয়ে ধরল সাবা। বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল। মেয়ের আচমকা কান্নার এপিসোড দেখে জাহেদা বেগমও কেঁদে উঠলেন। ফয়সাল চৌধুরীর অভিজ্ঞ চোখ ফেটেও নেমে এল আবেগের জল। কেন এ কান্না! মায়ার জগৎ থেকে ছুটে আসে এমন কান্নার ঢল! ভাবলেন ফয়সল চৌধুরী।

 

দুই.

দুপুরের খাবার শেষ হয়েছে। গর্জিয়াস আয়োজন করেছেন জাহেদা বেগম। সবাই তৃপ্ত।

আবদুল আলিম বললেন, আপা, সাবাকে ডাকেন। ওর হাতে আংটি পরিয়ে দিতে চাই আমরা।

জাহেদা বেগম বললেন, আপনাদের আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছি আমরা। আংটি পরাতে পারেন। আমাদেরও পছন্দ হয়েছে ছেলে।

ফয়সাল চৌধুরীর ভেতরটা সায় দিচ্ছে না, আংটি পরানোর ব্যাপারটা এখন হোক, চাচ্ছেন না। না-চাইলেও স্ত্রীর সরাসরি সম্মতির বিপরীত মেরুতে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি। চুপ করে আছেন।

মেয়েপক্ষের সম্মতি পেয়ে এগিয়ে এলেন আবদুল আলিম। ছেলের পকেটে ছিল রিং। মুনিমকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, দাও, সাবাকে পরিয়ে দাও।

পকেট থেকে রিং বের করে মামার হাতে তুলে দিল মুনিম। আবদুল আলিম বললেন, তুমিই পরিয়ে দাও।

নিজেকে অন্য রকম লাগছে সাবার। মনের মধ্যে কী আবেগ ঘুরছে, বুঝতে পারছে না। এত সহজে কেন রাজি হয়ে গেল, তাও জানে না ও। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সাবা। মা বেশ উৎফুল্ল। মায়ের আগ্রহ, উৎফুল্লতা আড়াল থেকে প্রভাবিত করেছে তার মন, বেশ বুঝতে পারে ও। তবে বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে, নির্বাক হয়ে গেছেন তিনি। নিজে থেকে মেনে নেননি। মেয়ের মতামতই প্রাধান্য পেয়েছে এ মুহূর্তে। মেয়ের মতের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন বাবা। বাবার আসল মত এ সম্পর্কের বিরোধী। মেয়েকে নিয়ে বাবার গর্বের শেষ নেই। এ কারণে আরও কোনো উচ্চাশা করে হয়তো বসে আছেন তিনি। ছেলের গ্রামের বাড়ি মাইজদি, ছেলের বাবা আইনজীবী ছিলেন, এ ফ্যাক্টরগুলোও বাবার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ, জানে সাবা। সব সময় বাবা বলতেন, নিজেদের এলাকার ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে খুশি হব। তোমার শ্বশুর যেন কখনও পুলিশ কিংবা উকিল না হয়। পুলিশ কিংবা আইনজীবীর প্রতি বাবার এ নেগেটিভ মনোভাব ঠিক নয়, এটাও জানে সাবা। কিন্তু বাবার এ উপলব্ধি কখনও ভাঙতে চায়নি সে। এ মুহূর্তে সবকিছু বিচার করার উপায় নেই। বিশেষ কোনো প্রফেশনের মানুষ খারাপ হতে পারে, এ থিওরি মানতে নারাজ সাবা। প্রত্যেক প্রফেশনে আছে ভালো-মন্দ। কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয় ঢালাওভাবে। ভুল ভেবেছেন বাবা। বাবার এ ভুল একদিন ভেঙে দিতে হবে। সাবার অনেক ফ্রেন্ড আছে, কেউ জানে না বিষয়টা। জানানো উচিত ছিল। অনেকে মাইন্ড করবে। মাইন্ড করলে কী করা। বাবুর কথা মনে পড়ছে। বাবু অতি মাত্রায় ইন্টারেস্টেড ছিল সাবার প্রতি। বাবুকে জানিয়ে দিয়েছিল, ক্লাসমেটরা হচ্ছে ফ্রেন্ড। ক্লাসমেট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবে না ও। দমে গেছে বাবু। কিন্তু ওর চোখ দেখে বোঝা যায়, ভীষণ ভালোবাসে সে সাবাকে। সাবারও ভালো লাগে বাবুকে। এ ভালোবাসা কখনও সীমা লঙ্ঘন করেনি। এ মুহূর্তে বাবুর কথা মনে পড়ছে।

আংটি হাতে নিয়ে মুনিম এগিয়ে গেল সাবার দিকে। সাবার ডান হাত বাঁ হাত দিয়ে ধরল মুনিম। আংটি পরিয়ে দিল। আবদুল আলিম দোয়া করলেন সাবাকে। বেঁচে থাকো মা। দোয়া করলেন ভাগ্নেকে। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বললেন, সালাম করো। শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করো।

প্রথমে জাহেদা বেগমের পায়ের কাছে বসল মুনিম। পা ছুঁয়ে সালাম করে উঠে যাচ্ছিল। জাহেদা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে উদ্যত হয়েছেন-হাতের সঙ্গে টোকা লেগে মুনিমের মাথা থেকে ক্যাপটি পড়ে গেল নিচে।

চমকে উঠলেন ফয়সাল চৌধুরী।

চমকে উঠলেন জাহেদা বেগম!

হিমালয় চ‚ড়া থেকে দপ করে পাতালে পড়ে যায় সাবা!

মুনিমের মাথায় একটা চকচকে টাক। চারপাশে ঘনকালো চুলের বিপরীতে টাক দেখে দুম করে বুকে কামড় বসে গেল সাবার। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন ফয়সাল চৌধুরী। এক ফুৎকারে বিলীন হয়ে গেছে জাহেদা বেগমের মনের উল্লাস-বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছেন তিনি।

আংটির দিকে তাকাল সাবা। দামি হীরার আংটি থেকে দ্যুতি বেরোচ্ছে। হীরার মধ্যে আছে কার্বন; নির্ভেজাল কার্বন কখনও হীরা, কখনও কয়লা। কার্বনের নিজে নিঃসৃত হওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। কার্বনের সঙ্গে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে তৈরি হয় বিষাক্ত কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড। টাকের সঙ্গে এ মুহূর্তে যুক্ত হয়ে গেছে হীরার মধ্যে লুকোন কার্বন মৌল। তৈরি হয়ে গেছে বিষাক্ত ঝাঁজ। এ ঝাঁজ আঁধার নামিয়ে দিয়েছে চোখে। আঁধারে দাঁড়িয়েও নিয়ন্ত্রণ হারায়নি সাবা। হাসিমুখে বিদায় জানাল সে অতিথিদের। তার বড় চাওয়া ছিল, স্বামীর যেন মাথায় টাক না থাকে। স্বামী যেন উচ্চশিক্ষিত হয়। উচ্চশিক্ষিতের টাক এ মুহূর্তে ঝলসে দিয়েছে চোখ। চোখে জ্বালা নিয়ে হাসিমুখে এবার তাকাল বাবার দিকে। মেয়ের এক্সপ্রেশন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। সকালের দেখা দিনমজুর শিশুকন্যার কথা মনে পড়ল। অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে মেয়েটি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, চোখের দ্যুতিতে পরাজিত করেছিল সুপারভাইজারকে। ফয়সাল চৌধুরীর মনে হচ্ছে, মনের যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেছে সাবাও। ধ্বংসের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে হাসছে সে। অসাধারণ এ হাসি মা-বাবার বুকে ঢুকিয়ে দিল মমতার ঝড়। মমতার এ ঝড়ই হচ্ছে পৃথিবীর শুদ্ধতম ঝড়, বড় শক্তি। এ শক্তির ক্ষয় নেই, লয় নেই।

অতিথিরা চলে যাওয়ার পর জাহেদা বেগম ও সাবাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করলেন ফয়সাল চৌধুরী, তোমরা কি এখনও রাজি এ বিয়েতে?

জাহেদা বেগম জবাব দিলেন, না।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত