‘ঘুম থেকে তুলে মায়ের মৃত্যুর খবরটা হাহাকার করে দিয়েছিল বাড়ির এক দাসী৷ নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী বকুনি দিয়ে তাকে ভর্ত্সনা করে সরিয়ে দিয়েছিলেন৷ বউঠানের আশঙ্কা ছিল, অত রাতে আচমকা এই খবরে কিশোর দেওরের মনে গুরুতর আঘাত লাগতে পারে৷’ সারদা দেবীর কথা৷ শুভেন্দু দাসমুন্সী
১০ মার্চ ১৮৭৫৷ তেরো পেরিয়ে চোদ্দোতে পড়ার আগেই মাতৃহারা হলেন রবীন্দ্রনাথ৷ যে রাত্রে তিনি চলে গেলেন ‘জীবনস্মৃতি’-তে সেই রাতের কথা লিখতে গিয়ে প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ঘুম থেকে তুলে মায়ের মৃত্যুর খবরটা হাহাকার করে দিয়েছিল বাড়ির এক দাসী৷ নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী বকুনি দিয়ে তাকে ভর্ত্সনা করে সরিয়ে দিয়েছিলেন৷ বউঠানের আশঙ্কা ছিল, অত রাতে আচমকা এই খবরে কিশোর দেওরের মনে গুরুতর আঘাত লাগতে পারে৷ ঘরের স্তিমিত প্রদীপের অস্পষ্ট আলোতে কিছুক্ষণের জন্য জেগে উঠে হঠাত্ বুকটা দমে গিয়েছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের৷ ঠিক কী যে হয়েছিল সেটা সে দিন ভালো করে বুঝতেই পারেননি৷ এমনকী পর দিন সকালেও ঘুম থেকে উঠে যখন মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনলেন বা যখন বারান্দায় দেখলেন সুন্দর করে সাজানো খাটের উপর মাকে, তখনও মৃত্যু যে-ভয়ংকর, সেই কথাটার সম্পূর্ণ অর্থও সেই বয়সে বুঝতেই পারেননি তিনি৷ তবে মায়ের ওই নিথর শরীর যখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সদর দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল, ঠিক সেই সময়টাতে বুকের মাঝখানটায় হাহাকার করে উঠল তাঁর৷ মনে হল, এই বাড়ির দরজা দিয়ে চিরজীবনের ঘরকন্নার মধ্যে মা তো আর নিজের আসনটিতে ফিরে এসে বসবেন না৷ সব কাজ সেরে যখন বাড়ি ফিরলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ, বহু দিন পরেও মনে ছিল, তিনি দেখেছিলেন বাবামশায় তখনও ঘরের সামনের বারান্দায় স্তব্ধ হয়ে উপাসনায় বসে আছেন৷
‘জীবনস্মৃতি’ বা ‘ছেলেবেলা’র পাতায় মায়ের কথা তুলনামূলক ভাবে কম থাকলেও, তার মধ্য থেকেই মা-ছেলের সম্পর্কের সুন্দর এক স্মৃতিচিত্র পাওয়া যায়৷ রাত্রে ভয় পেয়ে বা পড়া ফাঁকি দিতে মায়ের কাছে কিশোর রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নেওয়ার কাহিনি যেমন আছে সেখানে, তেমনই রয়েছে মায়ের কাছে কিশোর কবির প্রসাধনের স্নিগ্ধ ছবিও৷ ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় আছে, মায়ের কাছে পড়া-থেকে পালাতে কিশোর কবি হাজির হতেন মিছিমিছি পেট-কামড়ানির কথা নিয়ে৷ মা বেশ বুঝতেও পারতেন যে, এ তাঁর পুত্রের বাড়ির শিক্ষকের কাছে না-পড়তে বসার ছল৷ তাই মনে মনে হেসে ছেলের ওই পেট-কামড়ানির দরকারি খবরটা পেয়েও কোনও দিন এতটুকু উদ্বিগ্ন না হয়ে, শুধু চাকরকে ডেকে সে দিনের মতো ফেরত পাঠাতেন মাস্টারমশাইকে৷ রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে লিখলেন, সেকেলে মায়েরা ছেলেপুলের ওই এক দিনের পড়া নষ্টকে গণ্য করতেন না, কিন্তু এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে ফিরে তো যেতে হতই, তার উপরে জুটত কানমলাও৷
‘ছেলেবেলা’য় আছে ভয় পেয়ে রাত্রে মায়ের কাছে আশ্রয় নেওয়ার কথা৷ রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর এক খুড়ি মা, শুভঙ্করী দেবী, থাকতেন ঠাকুরবাড়িতে৷ সমস্ত ঘরকন্নার কাজও সামলাতেন তিনি আবার সারদা দেবীর সঙ্গে তাসও খেলতেন অবরে-সবরে৷ সন্ধ্যাবেলায় ভূতের ভয় শিরদাঁড়ার উপরে চাপিয়ে ছোট্টো রবি ছুট্টে আসতেন বাইরের ঘর থেকে ভেতর-বাড়িতে মায়ের ঘরে৷ এসেই নাকি এমন উত্পাত জুড়ে দিতেন যে, মা-দিদিমার তাসখেলা উঠত মাথায়৷ হাতের তাস ফেলে দিয়ে মা তাঁর খুড়িমাকে গল্প শোনাতে বলতেন৷ দিদিমার কোল ঘেঁষে সেই দৈত্যপুরীর গল্প রাজকন্যার গল্প শোনার গল্পও তো লিখে গেছেন কবি৷
গল্প-শোনার পরে এল বড়ো হয়ে মাকে গল্প-শোনানোর পালা৷ উপনয়নের পরে বাবামশায়ের সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণে গেলেন কিশোর রবি৷ সেখান থেকে ফিরে ওই ঠাকুর-চাকরের ঘর থেকে তাঁর প্রবেশাধিকার হল মায়ের ঘরের বায়ুসেবনসভায়৷ যা দেখেছিলেন তার সঙ্গে রং চড়িয়ে কত গল্পই না তখন শোনাচ্ছেন তিনি৷ নিজেই লিখেছেন, মায়ের কাছে যশস্বী হওয়ার প্রলোভন ত্যাগ করা কঠিন ছিল আর সেই যশ লাভ করাটাও অত্যন্ত দুরূহ ছিল না৷ গ্রহ নক্ষত্রের খবর থেকে সবে পড়া ছড়া কবিতা সবই অবলীলায় আউড়ে যেতেন মায়ের দরবারে৷ এরই মধ্যে মা এক বার ভারি অসুবিধায় ফেলেছিলেন পুত্রকে৷ সে দিন ঋজুপাঠ থেকে কিশোর রবি বলে চলেছেন টানা, তারই মাঝখানে তিনি গেলেন ভুলে৷ কিন্তু যে-মা পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির অসামান্যতা অনুভব করে আনন্দসম্ভোগ করবার জন্য উত্সুক হয়ে আছেন, তাঁকে ‘ভুলে গেছি’ বলার মতো সাহস তো তাঁর ছিল না৷ ফলে বাল্মীকির রচনা আর তাঁর ব্যাখ্যার মধ্যে ঘটে গেল অসামঞ্জস্য৷ কৌতুক করে বলেছিলেন, স্বর্গ থেকে মহর্ষি বাল্মীকি হয়তো জননীর কাছে খ্যাতিপ্রত্যাশী অর্বাচীন বালকের সেই অপরাধ সকৌতুক স্নেহহাস্যে মার্জনা করেছিলেন, কিন্তু গোল বাঁধালেন মা নিজেই৷ তিনি মনে করে বসলেন, পুত্র যে-অসাধ্যসাধন করেছে তার সেই অসাধ্য-সাধনকর্মের প্রকৃত গুণগ্রাহী তাঁর সংস্কৃতজ্ঞ জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ৷ কনিষ্ঠের আপত্তি সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠের ডাক পড়ল৷ তবে বড়োদাদা তখন অন্য লেখায় ব্যস্ত ছিলেন বলে একটু শুনেই ‘বেশ হয়েছে’ বলেই চলে গেলেন তিনি৷ কিশোর রবীন্দ্রনাথ বাঁচলেন হাঁফ ছেড়ে৷
আর ছিল মায়ের হাতে শৈশবে প্রসাধনের পালা৷ সেজোদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে হিরা সিং নামের এক কানা পালোয়ানের কাছে কুস্তি শেখা শুরু হল কিশোর রবির৷ সকাল হতে না হতেই কুস্তির প্যাঁচ কষে বেশ খানিকটা মাটি মাখামাখি করে শেষকালে একটা জামা গায়ে জড়িয়ে চলে যেতেন ঘরে৷ সকালবেলায় ছেলের ওই মাটি-মাখার ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগেনি মা সারদা দেবীর৷ তাঁর ভয় ছিল ছেলের গায়ের রং মেটে হয়ে যাবে৷ তাই তিনি ছুটির দিনে বাদামবাটা, সর, কমলালেবুর খোসা আরো কত কী দিয়ে ভেতরের বারান্দায় বা ছাদে বসিয়ে করাতেন দলাই মলাই৷ কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন যে ওই ছুটিটার জন্য অস্থির হয়ে থাকত সারাটা সন্তাহ, সে কথাটাও কবি বেশ গুরুত্ব দিয়েই জানিয়েছিলেন, বার্ধক্যে পৌঁছে, নিজের ছেলেবেলার কথা বলতে গিয়ে৷ মায়ের ওই যত্নের ফলে তাঁর ইস্কুলের ছেলেরা নাকি বলাবলি করত, জন্মমাত্র ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের নাকি মদের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হত বলেই তাদের গায়ের রঙে লাগে সাহেবি জেল্লা৷ মায়ের করে দেওয়া সেই দলাইমলাইতে মায়ের আঙুলের ছোঁয়া পেতেন শিশু রবীন্দ্রনাথ৷
অথচ সেই আঙুলে পাওয়া সামান্য একটা আঘাতেই কিনা চলে গেলেন মা৷ মা চলে যাওয়ার অনেক পরে, রবীন্দ্রনাথের মায়ের সেই আঙুলের স্পর্শের কথাই মনে পড়েছে৷ যৌবনে পৌঁছে যখন বসন্ত-প্রভাতে একমুঠো আধফোটা মোটা মোটা বেলফুল চাদরের খুঁটে বেঁধে ‘খ্যাপার মতো’ ঘুরে বেড়াতেন কবি আর সেই নরম কুঁড়িগুলো কপালের উপর বোলাতেন তিনি, তখন মায়ের শুভ্র আঙুলগুলোর স্পর্শের কথাই তো মনে পড়ত তাঁর, সেই রকমই তো বলেছেন তিনি৷ বলেছেন, ‘আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম যে-স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতি দিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে; জগতে তাহার আর অন্ত নাই, তা আমরা ভুলিই আর মনে রাখি৷’
সারদা দেবী যেমন ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের মা, তেমনই তো তিনি শাশুড়ি মাতাও৷ পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী আর বীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রফুল্লময়ী দেবীর আত্মকথায় পাওয়া যাবে সেই শ্বশ্রূমাতা ঠাকুরানি সারদা দেবীর কথা৷ জানা যাবে মহর্ষিদেব বাড়ি ফিরলে তিনি নিজে দেখতেন রান্নাঘরের কাজ আর এক বার নাকি ঠাকুর-এস্টেটের জমিদারির আয় কমে যাওয়ায় দেবেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে বলেছিলেন বাড়ির বউদের রাঁধতে শেখানোর কথা৷ জানা যায়, বাড়ির বউরা নাকি রোগা, তাই বউদের ভারি যত্ন করে তিনি নিজের হাতে এত খাওয়াতেন যে, তাদেরই ফাঁক খুঁজতে হত শাশুড়ির চোখের আড়ালে খাবার উগরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে বলে৷
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তাঁর আত্মকথায় সারদা দেবীর বিবাহের এক আশ্চর্য সংবাদ জানিয়েছিলেন৷ জানিয়েছিলেন, সারদা দেবীর এক কাকা নাকি কলকাতায় এসে শুনেছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথের বড়ো ছেলের জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে৷ অমনি তিনি দেশ থেকে সারদাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন৷ সারদার মা বাড়ি ছিলেন না তখন, গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন৷ বাড়ি ফিরে মেয়েকে দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছেন শুনে তিনি উঠোনের এক কোণে গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলেন মা৷ তার পরে সেখানেই কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেছিলেন তিনি!
বড়ো বাড়ির সমস্ত কাজের মাঝখানে বিরাজিত ছিলেন সারদা দেবী৷ কিন্তু তাঁর সম্পর্কে এক আশ্চর্য অভিযোগ আনলেন তাঁর দৌহিত্রী সরলা দেবী৷ সরলা তাঁর আত্মকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’-এ লিখেছিলেন, মায়ের আদর কী তা জানিনে, মা কখনও চুমু খাননি, গায়ে হাত বোলাননি৷ মাসিদের ধাতেও এ সব ছিল না৷ শুনেছি কর্তা-দিদিমার কাছ থেকেই তাঁরা এই ঔদাসীন্য উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন৷ বড়ো মানুষের মেয়েদের এই ছিল বনেদি পেট্রিশিয়ান চাল৷ গরিবের ঘর থেকে আসা ভাজেরা কিন্ত্ত তাদের প্লিবিয়ান হৃদয় সঙ্গে করে আনতেন৷
ছেলেদের কলমে খুব বেশি উল্লেখ না থাকলেও, যা আছে তার থেকেই ফুটে ওঠে মা-ছেলের সম্পর্কের ছবি৷ মা মারা যাওয়ার বেশ পরে রবীন্দ্রনাথ মাকে নিয়ে তাঁর দেখা একটি সুন্দর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তাঁর ‘শান্তিনিকেতন’ ভাষণমালায়৷ বলেছিলেন, ‘আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি৷ আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন৷ আমার বড়ো বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না৷ কাল রাত্রে আমি স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি৷ গঙ্গার ধারের বাগানবাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন৷ মা আছেন তো আছেন- তাঁর আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না৷ আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম৷ বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার হঠাত্ কী হল জানি নে- আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন৷ তখনই তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম৷ তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ!’ এইখানেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল৷’
আসলে মা-ছেলের এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক৷ মাকে তো সত্যিই সে ভাবে পায়নি ওই বড়ো বাড়ির ছেলেটি৷ হয়তো মা-ও সে ভাবে ততটা পাননি ছেলেকে৷ তবুও সারা জীবন সাহিত্যের আঙিনায় কত রকম মায়ের ছবি তো তৈরি করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ৷ বীরপুরুষের শিশুর কল্পনায় মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরের মা থেকে চোখের বালির পুত্রকে গ্রাস করে থাকা মায়ের কাহিনি৷ মা-কে যখন শিশুপুত্র জিজ্ঞাসা করে ‘এলেম আমি কোথা থেকে’, তার উত্তরে যে-মা তাঁর পুত্রকে বলেন, ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’, সেই মা থেকে গোরা উপন্যাসের আনন্দময়ী৷ আবার ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’-এর কুন্তী থেকে ‘গান্ধারীর আবেদন’-এর গান্ধারী৷ পুরাণের নবায়ন ঘটিয়ে অর্জুনজননী হয়েও কর্ণের কাছে কুন্তীর উপস্থিতি তাঁর মনের যাবতীয় দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে৷ অন্য দিকে কর্তব্যবোধে পুত্রের অন্যায়ের প্রতি নিজের প্রত্যাখ্যানকে স্পষ্ট করে বলার মতো গান্ধারীকেও তো রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে তোলেন তাঁর কাব্যনাট্যে৷ মাতৃরূপকল্পের এই বহুবিচিত্র রূপসৃজনও তো করেন তিনি৷ এটাও কি তাঁর কাছে মা-কে এক অন্য ভাবে পাওয়ার পথই ছিল না?
মায়ের মৃত্যুর বেশ অনেক দিন পরে, মাকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ সুরেশচন্দ্র মজুমদারের ‘আগমনী’ নামের এক বার্ষিকীতে লিখেছিলেন ‘মাতৃবন্দনা’ কবিতাগুচ্ছ৷ তারই এক অংশে তিনি লিখেছিলেন, ‘হে জননি, বসিয়াছ মরণের মহাসিংহাসনে,/ তোমার ভবন আজি বাধাহীন বিপুল ভুবনে৷/ দিনের আলোক হতে চাও তুমি আমাদের মুখে,/ রজনীর অন্ধকারে আমাদের লও টানি বুকে৷/ মোদের উত্সব মাঝে তোমার আনন্দ করে বাস,/ মোদের দুঃখের দিনে শুনি যে তোমার দীর্ঘশ্বাস৷/ মোদের ললাটে আছে তোমার আশিস করতল/ এ কথা নিয়ত স্মরি দেহমন রাখিব নির্মল৷’ নয়নসম্মুখ থেকে মাকে হারিয়ে এক অপরূপ মাতৃমূর্তির সৃজন এ-ও তাঁর ঊর্ধ্বায়ন বা সাবলিমেশনের এক আশ্চর্য নিদর্শন৷ মায়ের উদ্দেশে লেখা ওই কবিতাগুচ্ছেই যে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওগো মা, তোমারি মাঝে, বিশ্বের মা যিনি/ ছিলেন প্রত্যক্ষবেশে জননীরূপিনী/ সেদিন যা কিছু পূজা দিয়েছি তোমায়,/ সে পূজা পড়েছে বিশ্বজননীর পায়ে’৷
কী ভাবে কবিচিত্তে নিজের মা ক্রমশ দেশমাতৃকার কল্পনায় পৌঁছলেন আর কী ভাবে দেশমাতৃকা ক্রমশ বিশ্বজননীর রূপগ্রহণ করেন, সে-ও সৃষ্টির আর এক রহস্য!