ইংরেজী সাহিত্যে বঙ্গদেশের প্রভাব । রানা চক্রবর্তী
সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় সাহিত্যে, অন্ততঃ বঙ্গ সাহিত্যে ইংরেজ প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হলেও, অতীতের ইংরেজী, ফরাসী বা জার্মান সাহিত্যে ভারতের প্রভাব ঠিক কতটা পড়েছিল, সেসব পরিমাপ করবার কোন চেষ্টা করা হয় নি। খুব সম্ভবতঃ আঠারো শতকের দ্বিতীয় দশকেই ‘এ্যারেবিয়ান নাইটসের’ একটি ফরাসী সংস্করণ (Antoine Galland) ইংল্যাণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছিল। ইংরেজদের কাছে সেটি শুধুমাত্র একটি বই নয়, রীতিমত সোনার কাঠি ছিল। ইংল্যাণ্ডের মনোজগতে সেটি এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। প্রাচ্যের ধনদৌলত বিলাস-ব্যসন সম্পর্কিত চমকপ্রদ বর্ণনা সেই প্রথম ইংল্যাণ্ডের সাধারণের হাতে গিয়ে পৌঁছেছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রাচ্যের ঐশ্বর্য ও জীবনযাপন প্রণালী সেখানকার আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। যেহেতু প্রাচ্যের সঙ্গে তখনও পর্যন্ত সাধারণ ইংল্যাণ্ডবাসীদের প্রত্যক্ষ কোন পরিচয় ছিল না, কাজেই রঙ্গীন কল্পনায় ডানা মেলে ইংরেজ লেখককুল উড়তে শুরু করেছিলেন। তখনকার সেই উচ্ছ্বাসে স্যামুয়েল জনসনের ‘রাসেলাস’, জেমস বেকফোর্ডের ‘হিস্ট্রি অব দি ক্যালিফ বাটেক’, আইজ্যাক ডিসরেইলীর ‘মেজনুন এণ্ড লয়লা’, জর্জ মিরিডিথের ‘দি শেডিং অব শাগপার্ট’ রচিত হয়েছিল। এখানেই সমাপ্তি ঘটেনি, শেষে আঠারো শতকের ইংলণ্ডের সাহিত্যে প্রাচ্য কল্পনাবিলাস একটি হুজুগে পরিণত হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে, বাস্তবের সঙ্গে সেই হুজুগের কোন সম্পর্ক ছিল না। এই প্রসঙ্গে ১৭৬০ সালে ‘গোল্ডস্মিথ’ তাঁর ‘সিটিজেন অব দি ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থের ৩৩তম চিঠিতে সেই হুজুগের প্রতি কটাক্ষ করে লিখেছিলেন, “The fictions every day propagated here under the title of Eastern tales and Oriental histories.” অবশ্য তাঁর সেই সমালোচনার পরেও ওই কল্পনাবিলাস বন্ধ হয়নি। এরপরেও টমাস মুরের ‘লালারুখ’, ‘কার্স অব কেহামার’ মত উদ্ভট কল্পনাবৈদগ্ধও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৮১৯ সাল থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে প্রাচ্যের বাস্তবজীবনকে পটভূমি করে ইউরোপে গ্রন্থরচনার চেষ্টার শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে যাঁরা প্রাচ্যকে উপজীব্য করে লেখনী ধারণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সিরিয়া, পারস্য ও ভারতে এসে বাস করেছিলেন, এবং অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত উপলব্ধির চেষ্টাও করেছিলেন। সেই সময়ে টমাস হোপের ‘এ্যানাসটাসিয়াস’, জেমস জাস্টিনিয়ান মোরিয়ের ‘হাজিবাবা অব ইস্পাহান’ যথাক্রমে তুরস্ক ও পারস্যের জীবন; এবং উইলিয়ম ব্রাউনি হকলের ‘পাণ্ডুরং হরি’ গ্রন্থে ভারতীয় ব্রাহ্মণচরিত্রাঙ্কণের প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। ওদিকে আফগান সীমান্তের জনজীবনকে উপজীব্য করে ‘কাজিলবাস’ এবং মেডো টেলরের ‘কনফেসন অব এ ঠগ’ গ্রন্থে ভারতীয় বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করা হয়েছিল। এর আগে ফিল্ডিং ও স্মোলেট যেমন কোন একজন দুঃসাহসী নায়ককে তাঁর নিজের দেশের নানা জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, পুর্বোক্ত গ্রন্থকর্তারাও তাঁদের সেই পথই অবলম্বন করেছিলেন। পারস্য ও ভারতের সঙ্গে সেইসব গ্রন্থকারদের কিঞ্চিৎ সম্পর্ক ছিল, কারণ ওই অঞ্চলের উপরে কর্তৃত্ব স্থাপন নিয়েই ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। বহু ফরাসী ও ইংরেজ কর্মচারীকে সেই সময়ে কূটনৈতিক প্রয়োজনে ওই সব দেশে থাকতে ও সেখানকার মানুষকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে হয়েছিল। ওয়াটারলুর যুদ্ধের পরে এশিয়া মাইনর পেরিয়ে আরও পূর্বদিকে যাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছিল। এর আগে কেবল হারুন-অল-রশিদের পারস্যকে নিয়েই ইউরোপীয়দের উদ্ভট কল্পনাবিলাস চালু ছিল। কিন্তু ওয়াটারলুর পরে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিতে পশ্চিমের দূতেরা এসে উঁকি দিতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের চোখে ছিল দুর্নিবার কৌতূহল, হাতে ছিল মায়াবনবিহারিণী লেখনি, বক্ষপটে ছিল অসমসাহসিকতা। তখন সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে অনেক উপন্যাস লেখা হয়েছিল। কিন্তু এখন আর কেউ সেই উপন্যাসগুলিকে মনে রাখেন নি। এখন ‘মরিয়েরের’ রচনা অতি প্রাচীন কেউ কেউ চকিতে উল্লেখ করেই নিজের জিভ কাটেন। তখনকার কবিদের মধ্যে ‘স্যার এডুইন আর্নল্ড’ এখনো প্রাচীন কারো কারো স্মৃতিপটে চাঞ্চল্য জাগিয়ে তোলেন। কিন্তু তবুও তখন গদ্যের চেয়ে কাব্যক্ষেত্রেই বেশি ফসল উৎপন্ন হয়েছিল। একটা সময়ে ইংল্যাণ্ডের সেই হাওয়া এসে লাগে ভারতের ইংরেজ শাসক-বণিক সম্প্রদায়ের মনেও লেগেছিল। লর্ড ক্লাইভ বা হেস্টিংসের সময়কার ভারতের অশান্ত অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশ সাহিত্য-সৃজনকর্মের অনুকূল ছিল না। আঠারো শতকের শেষের দিকে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি শান্তভাব ধারণ করেছিল। নীলনদের যুদ্ধে নেপোলিয়ন-বাহিনী নেলসনের কাছে পরাজিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাচ্যে ফরাসী আধিপত্যের সম্ভাবনা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের বিজয়চেতনা ভারতস্থ ইংরেজ লেখককুলকে নবতর সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেদিনের রচনায় এজন্যই কোথাও লঘু-চাপল্যের স্থান ছিল না। তাছাড়া ‘স্যার উইলিয়ম জোন্স’ তখন প্রাচ্য সাহিত্য ও ইতিহাসের অমূল্য রত্নরাজি উদ্ধার করে তাঁর স্বদেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মোঘল সম্রাটদের অমিত ঐশ্বর্য সম্পর্কে ইউরোপীয়দের কিছু ধারণা আগেই ছিল, তখন জোন্সের কল্যাণে প্রাক-মোঘল যুগের রত্নসম্ভারের দিকেও ইউরোপীয়দের সশ্রদ্ধ সচকিত দৃষ্টিপাত ঘটেছিল। অবশ্য স্বয়ং হেস্টিংসও সেই ব্যাপারে আগেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের সূচনায় ইংল্যাণ্ডের রোম্যান্টিক-সাহিত্যসৃষ্টির প্রভাব ভারতস্থ ইংরেজ কবিকুলের উপরে পড়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। ‘রেজিনাল্ড হেবার’, ‘জন লিডেন’ প্রভৃতি সেই রোম্যান্টিকতারই পুর্বসূরী ছিলেন। হেবারের উপরে কাউপারের শান্ত-মধুর প্রভাব যেমন লক্ষ্যণীয়, তেমনি লিডেনের উপরে স্কটিশ কবিজনোচিত বলিষ্ঠ দীপ্তি, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায়। কলকাতার নির্জন সন্ধ্যা, ঝিঁঝির ডাক, পেঁচকের কর্কশ চিৎকার, চৌকিদারের নিশি ঘোষণা – এ সবকিছুই হেবারের কাব্যে আত্মীয়-পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।
পলাশীর যুদ্ধের কিছু দিন পরেই ভারতের প্রতি ইংরেজদের প্রথম অত্যুৎসাহী দৃষ্টিপাত ঘটেছিল, সিরাজের পরিত্যক্ত রাজকোষের অর্থ ও দুর্নীতিদুষ্ট ব্যবসায়ের রন্ধ্র পথে কয়েকজন ইংরেজ অফিসার তখন সামান্য অবস্থা থেকে রাতারাতি নবাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। খোদ ইংরেজদের দেশে তাঁদের ‘নাবুব’ বলা হত। ওই সব হঠাৎ নবাবদের বিকৃত রুচি ও ধরাকে সরাজ্ঞান করবার চেষ্টা বিশ্বের সবদেশের মত ইংল্যাণ্ডেও ঘটেছিল। তখন হঠাৎই সেই নবাবদের চালচলন ও বাহ্বাস্ফোটভাব বিলেতের কমেডিয়ান ও নাট্যকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এরপরে ১৭৭২ সালে ‘স্যামুয়েল ফুট’ তাঁর বিখ্যাত নাটক – ‘দি নাবব’ লিখেছিলেন। ফুট তাঁর স্মৃতিকথায় সমসাময়িক ভারত প্রত্যাগত ইংরেজদের আচরণ ও তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের রাজনীতিক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাব সম্পর্কে চমৎকার বিবরণ দিয়ে লিখেছিলেন, “এই সময়ে ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির বহু কর্মচারীর বিরুদ্ধে জনমনে বিক্ষোভ দেখা দেয়, তাঁরা অতিসামান্য পদ আশ্রয় করে নগণ্য অবস্থা থেকে অল্প সময়ের মধ্যে প্রভৃত বিত্তের অধিকারী হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়। জনসাধারণ, বিশেষতঃ অভিজাত মহলের ক্ষোভের আরও কারণ হল যে, ভারতফেরত এইসব ইংরেজ নিছক অর্থের জোরে ও ব্যয়বহুল সমারোহের আয়োজন করে বহু বনেদী পরিবারকে পার্লামেন্টের আসন থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, গ্রামাঞ্চলে আড়ম্বরপুর্ণ প্রাসাদ বানিয়ে বর্ণাঢ্য জীবনযাপন প্রণালীর মধ্য দিয়ে বহু বনেদী ঐতিহ্যময় পরিবারের দীপ্তিকে ম্লান করে দেয়।” ফুট স্বচক্ষে সেই হঠাৎ-নবাবদের জীবনধারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ১৭৭২ সালে তাঁর ‘দি নাবব’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইংল্যাণ্ডে চাঞ্চল্য পড়ে গিয়েছিল। ‘দি নাবব’ নাটকের একটি বিশিষ্ট চরিত্র হল ‘স্যার ম্যাথু মাইট’। নাটকে তাঁর পিতা একজন মাখনওয়ালা। তিনি নিজে ইস্ট ইণ্ডিজে গিয়ে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। নাট্যকার সেই হঠাৎ-বড়লোকটির বিলাসী জীবনযাপন ও ভণ্ডামির প্রতি কটাক্ষ করেছিলেন। ফুটের নাটক প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের সাধারণ মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরে দেখতে দেখতে জনসাধারণের মধ্যে মুখে মুখে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ওই নাটকের প্রধান চরিত্র স্যার ম্যাথু আর কেউ নয়, তিনি অমুক লোক। সেই অমুক ব্যক্তিটি সত্যিই ভারত থেকে প্রভূত অর্থ কামিয়ে ফিরে এসেছিলেন, এবং কাকতালীয়বৎ তাঁর পিতাও একজন মাখনওয়ালাই ছিলেন। এখন নাট্যকার সত্যি তাঁকেই অবলম্বন করে ওই নাটকটি লিখেছিলেন কিনা, সেটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়; কিন্তু তখনকার লোকের মুখ বন্ধ করা শক্ত ছিল। অচিরে সেই ভদ্রলোকের কানেও কথাটা উঠেছিল। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিজনবর্গ নাট্যকারের উপরে ক্ষেপে উঠেছিলেন। তাঁদেরই মধ্যে একজন শেষে একদিন ওক গাছের একটি ডাণ্ডা হাতে করে সটান নাট্যকারের দরজায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। নাট্যকার হিউ ফুট তাঁদের অভিযোগ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন, এবং পরিশেষে তাঁদের জানিয়েছিলেন যে, একজন ব্যঙ্গ-নাট্যকার রূপেই তাঁর জন-পরিচিতি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে যাঁরা অশালীন আচরণ করেছেন, তাঁদের অবলম্বন করে সাধারণভাবে তিনি যদি কোন নাটক লিখে থাকেন, তাহলে অন্যায় কিছুই হয়নি, বরং ইংল্যাণ্ডের জনসাধারণ তাঁর কাছে এই ধরনের সত্যউন্মোচনকর্মই আশা করে থাকেন।
এটা ছিল হেষ্টিংস-পূর্ব যুগের ঘটনা। এর পরেই ভারতে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি, এবং বিলেতের পার্লামেন্টে ‘এডমণ্ড বার্ক’ কর্তৃক কোম্পানির কর্মচারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন-পর্বটি ঘটেছিল। হেস্টিংসের আগে পর্যন্ত ইংরেজী সাহিত্যে ভারতের প্রভাব অত্যন্ত পরোক্ষ ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। আর যেখানে সেই প্রভাব প্রত্যক্ষ ছিল, সেখানেও বাস্তববর্জিত ভাববিলাসিতা প্রশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু এসব থেকে অন্ততঃ একটি বিষয়ের উপলব্ধি সম্যক হতে পারে; সেটা হল যে, তদানীন্তন শিক্ষিত ইংরেজমনে ভারত সম্পর্কিত ধারণা কেমন ছিল সেটা জানতে পারা যায়। উদাহরণ হিসেবে কাউপারের কবিতার নিম্নোক্ত ছত্রটিকে ধরা যেতে পারে –
“The Brahmin kindles on his own bare head
The sacred fire, self-torturing his trade!
His voluntary pains, severe and long
Would give a barbarous air to British song.
No grand inquisitor could worse invent
Than he contrives to suffer, well-content.”
প্রার্থনারত ভারতীয় ব্রাহ্মণদের সৌম্য শান্ত মূর্তি তিনি দেখেছিলেন, এবং সেটার সঙ্গে লণ্ডন শহরকে উপমিত করেছিলেন –
“The villas with which London stands begirt
Like a swarth Indian with his belt of beads.”
‘পোপের’ একটি কবিতায় সতীদাহের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং সেই কবিতাটি থেকে সতীদাহ সম্পর্কে পোপের যে কিছু ধারণা ছিল – সেটা বুঝতেও কোন কষ্ট হয় না। ‘লেডী মেরী মন্টেগু’ পোপের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। পোপ তাঁকে ১৭১৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তারিখের একটি পত্রে জানিয়েছিলেন যে, ‘জন হার্ভে’ ও ‘সারা ডু’ নামক এক প্রেমিক দম্পতি আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় বজ্রাঘাতে মারা গিয়েছেন। তাঁদের সমাধিস্তম্ভের জন্য তিনি দুছত্র কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতায় তিনি ওই প্রেমিক-প্রেমিকার যুগল-মৃত্যুর সঙ্গে সতীদাহের উপমা দিয়েছিলেন –
“When Eastern lovers feed their funeral fire
On the same pile the faithful pair expire.”
ইউরোপের ভারততত্ত্ববিদদের মধ্যে স্যার উইলিয়ম জোন্সের নাম আজও সর্বাগ্রে স্মরণীয়। ১৭৪৬ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল। হ্যারোতে থাকবার সময়েই তিনি আরবী ও হিব্রু আয়ত্ব করেছিলেন। ১৭৮৩ সালে তিনি সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় পৌঁছবার আগেই তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, ইটালীয়ান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ, আরবী, ফার্সী ও তুর্কী ভাষা শিখেছিলেন। আর কলকাতায় পা দিয়েই তিনি সংস্কৃত চর্চা শুরু করেছিলেন, এবং অচিরেই সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৭৮৯ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এশিয়াটিক রিসার্চ’-এর প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল, এবং সেই বছরই তিনি শকুন্তলার ইংরেজী অনুবাদ শেষ করেছিলেন। কলকাতায় আসবার আগেই তিনি আরবী সাহিত্যের ভাব আহরণ করে ইংরেজীতে কিছু কবিতা লিখেছিলেন, পরে কলকাতায় থাকাকালীন তিনি ভারতীয় পুরাণাদি আহরণ ও স্বীকরণ শুরু করেছিলেন। ভারতীয় পুরাণাদির বিভিন্ন চরিত্র তাঁকে বহুবার আকৃষ্ট করেছিল। কামদেব, দুর্গা, ইন্দ্র, ভবানী, সূর্য, লক্ষ্মী, নারায়ণ, সরস্বতী ও গঙ্গাকে অবলম্বন করে তিনি ইংরেজীতে স্তোত্র রচনা করেছিলেন। সূর্যকে অবলম্বন করে তিনি যে কবিতা লিখেছিলেন, তাতে ভারতীয় ভক্তিরস সঞ্জীবিত হয়েছিল –
“Fountain of living light
That o’ver all nature streams
Of this vast microcosm both nerves
Whose swift and subtil beams
Eluding mortal sight,
Pervade, attract, sustain, th’ effulgent whole
Unite, impel, dialate, calcine,
Give to gold its weight and blaze
Dart from the diamond many limid rays
Condense, protrude, transform, concoct, refine
The sparkling daughters of the mine.”
স্যার উইলিয়ম জোন্সের কথায় প্রসঙ্গতঃ ‘মেকলের’ নামও অনিবার্যভাবে চলে আসে। অবশ্য বিপরীত কারণে। ভারতের বহু ক্ষতিসাধনের হোতা মেকলে জোন্সেরই সমসাময়িক ছিলেন। জোন্স যখন ভারতীয় বেদ-পুরাণাদি পাঠ করে ভারত-তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণে রত ছিলেন, মেকলে সেই সময়ে কেবলমাত্র গ্রীক ও ল্যাটিন গ্রন্থ পাঠ করেই নিজের সময় কাটিয়েছিলেন। ভারতকে, তার চিত্তের মহৎ ঐশ্বর্যকে উপলব্ধির কোনো চেষ্টাই তিনি করেন নি। ভারতের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎখাত করে দিয়ে পশ্চিমী শিক্ষার ধারা প্রবর্তনের মূলে তাঁর ভারতপ্রেম কণামাত্রও ছিল না, কিন্তু ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধা পূর্ণমাত্রায় ছিল। বাঙালী জাতি সম্পর্কে তিনি অতি অশোভন মন্তব্য করে বলেছিলেন, “বিদেশী পদাশ্রিত থাকার উপযোগী দৈহিক গঠন ও মানসিক গড়নের দিক থেকে বাঙালীর মত এমন যোগ্য জাতি বিশ্বের আর কোথাও নেই।” ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক ‘স্টকলার’ তাঁর নিজের স্মৃতিকথায় মেকলের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “ভারতের আইন সংশোধনের জন্য নিযুক্ত এক কমিশনের সভাপতি হয়ে তিনি এদেশে আসেন। তিনি নিজেই আমায় বলেছিলেন যে, তাঁর আইনের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। স্বদেশে ওকালতি-জীবনে তিনি মাত্র একবার একজন বৃদ্ধাকে নিজের মক্কেল হিসাবে পেয়েছিলেন। বৃদ্ধার বিরুদ্ধে মোরগ চুরির অভিযোগ ছিল। তাঁর ওকালতির ফলে সেই বৃদ্ধার জেল হয়েছিল।” মেকলে তিন বছর ভারতে ছিলেন। ‘স্টকলার’ লিখেছিলেন, “… his departure was not lamented, for he had done little for the press, and nothing for the society.” ভারত এক বিচিত্র দেশ। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস আন্তরিকভাবে সংস্কৃতচর্চা, পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা, এবং ব্রাহ্মণোচিত বহুবিধ গুণাবলীর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভারতে নিন্দিত হয়েছিলেন। আর মেকলে সেখানে ভারতকে বিন্দুমাত্র ভাল না বেসেও, উল্টে প্রকাশ্যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা সত্ত্বেও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছিলেন।
ভারতাশ্রিত ইংরেজী গ্রন্থের মধ্যে ‘হার্টলি হাউসের’ নাম প্রথমেই স্মর্তব্য। ‘কেমব্রীজ হিস্ট্রি অব ইংলিশ লিটারেচরের’ মতে – “ভারত থেকে ইংল্যাণ্ডের বন্ধুদের জন্য প্রথম মহিলা লিখিত জার্নাল হল এই গ্রন্থটি। ভারতস্থ ইংরেজ সমাজের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে পত্রালাপের আকারে জনৈক মহিলা এই ব্যঙ্গ-গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। তৎকালীন বৃটেনের মধ্যবিত্ত সমাজের কন্যারা ভারতের প্রাচুর্য ও বিলাসবহুল সামাজিক পরিবেশে সহসা নিক্ষিপ্ত হয়ে কী রকম চালে চলতেন, সেসবের বিবরণ এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। বিলেতে থাকাকালীন ইউরোপীয় সংস্কৃতির বিশেষ কিছুই আয়ত্ত করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে ভারতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজ যুবকেরা তাঁদের প্রশংসা ও গুণ-কীর্তনে মোহিত করে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, নবাব-নন্দিনীর মত বিলাসিতা ছাড়া জীবনের আর কোন উদ্দেশ্যের কথাই তাঁরা ভাবতে পারেন নি।” প্রসঙ্গতঃ হার্টলি হাউসের কিছু অংশ তুলে ধরা যাক – “কলকাতায় মেম-সাহেবদের বিবেচনাবোধ বলে কোন কিছুই নেই। এক বেলায় বাজারে গিয়ে চার পাঁচ হাজার পাউণ্ড খরচ করে আসবার কথাও শুনতে পাওয়া যায়। যদি কোন স্বামীকে বলা হয় যে তোমার স্ত্রীকে অমুক দোকানে প্রবেশ করতে দেখলাম, তো স্বামী বেচারীর মুখ তৎক্ষণাৎ ছাই-এর মত ফ্যাকাশে হয়ে যায়।”
শ্রীমতী ‘এমা রবার্টস’ সেকালীন অর্থে এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান হলেও হাফ-কাস্ট ছিলেন না। একপুরুষ আগেই তাঁদের পরিবার ভারতবাসী হয়েছিল। এমা ভারতকে ভালবেসেছিলেন, তাই তাঁর কাব্যে ভারতবাসীর আর্তি প্রকাশিত হয়েছিল, কোথাও উন্নাসিক অনুকম্পা পরোক্ষেও আত্মপ্রকাশ করেনি। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণে’ নীলকর চাষীদের, এবং শ্রীমতী স্টোর ‘আঙ্কল টমস কেবিনে’ নিগ্রো ক্রীতদাসদের দুঃখজর্জর জীবনের মর্মবেদনাকে যে ভাবে প্রকাশ করেছিলেন, শ্রীমতী এমা রবার্টসের একটি কবিতায় ততোধিক নিষ্ঠায় ভারতের সদ্যো-বিধবার দুঃখ মূর্ত হয়ে উঠেছিল বলে দেখা যায়। তিনি সতীদাহ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ভারতীয় রমণীদের সাহচর্যে আসবার সুযোগ তাঁর হয়েছিল, তাই ‘সতীর বিলাপ’ কবিতায় অতি রূঢ় সত্যকে তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। মৃত স্বামীর চিতায় আবদ্ধ অসহায় সতী, সহস্র সামাজিক নাগপাশে আবদ্ধ তাঁর জীবন – কিন্তু তবুও, মৃত্যুই তাঁর একমাত্র নিয়তি জেনেও সেই সতীর কণ্ঠে একবার হলেও বিদ্রোহ উচ্চারিত হয়েছিল।
“Think not accursed priests, that I will lend
My sanction to those most unholy rites,
And though yon funeral pile I may ascend,
It is not that your stern command affrights.
My lofty soul, – it is because these hands
Are all too weak to break my sex’s bands.”
এমা রবার্টস কখনো বঙ্গদেশে বাস করেন নি, উত্তর ভারত তাঁর কর্মকেন্দ্র ছিল। কিন্তু তিনি কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনে এমন সর্বভারতীয় পশ্চাদপট নির্বাচন করেছিলেন যে, এই প্রবন্ধের বিষয়ে তাঁর নামোল্লেখ না করলে সেটা অশোভনীয় হবে।
সেকালের কলকাতাবাসী ইংরেজদের অনেকেই সমসাময়িক নগরজীবনের কথা লিখেছিলেন। কিন্তু ‘হেণ্ডারসন’ সম্ভবতঃ তখন একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি ‘বেঙ্গলী’ ছদ্মনামটি গ্রহণ করেছিলেন। ওই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি নিজেকে বাঙালী বলে পরিচয় দেওয়ার কারণ উল্লেখ করে যা বলেছিলেন, সেটার সঙ্গে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”-র তুলনা চলতে পারে।
সেকালের আরেক অখ্যাত কিন্তু ভারতীয় দৃষ্টিতে মূল্যবান ইংরেজ কবি ছিলেন ‘উইলিয়ম ওয়াটার ফিল্ড’ (১৮৩২-১৯০৭)। ভারতে অবস্থানকালে তিনি ভারত-আত্মার অনুসন্ধান করে দিন কাটিয়েছিলেন। তাঁকে অনায়াসে ইংরেজ বৈষ্ণব-কবি বলা যেতে পারে। ভক্ত বৈষ্ণবের কণ্ঠ থেকে বঙ্গদেশে বিগত যুগে যখন – “কই কৃষ্ণ কোথা কৃষ্ণ, কোথা আমার প্রাণসখা” – উচ্চারিত হয়েছিল; অনুরূপ আবেগ, অনুরূপ আকুতি ওয়াটারফিল্ডের একটি কবিতাতেও ধ্বনিত হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায় ৷ কবিতাটির কিছুটা অংশ নিম্নরূপ –
“Come Krishna from the tyrant proud
How long shall virtue flee?
The lightning loves the evening cloud,
And I love thee.
…
Come Krishna! Leave Vaikuntha’s bower
Do thou our refuse be,
The koel loves the mango flower
And I love thee.
…
Come Krishna! Come my Lord, my own!
From prison set me free
The Chakravaki pines alone
As I for thee.”
তাঁর ঠিক পূর্বগামী ভারতপ্রেমিক কবি ছিলেন ‘ডব্লিউ. এফ. থমসন’ (১৮০৮-১৮৪২)। তাঁর ‘The Jogi’s address to the Ganges’ নামক কবিতাটি তুলনারহিত। এক সন্ন্যাসী পরমার্থের সন্ধানে নিজের ঘর ছেড়ে একদিন পথে বের হয়েছিলেন। তারপরে সারাজীবন ঈশ্বর সন্ধানে কাটিয়ে শেষে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সহসা তিনি মহৎ এক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। গঙ্গার তীরে যেখানেই পবিত্র তীর্থ সেখানেই তিনি স্নান করেছিলেন – কাশী, প্রয়াগ, হরিদ্বার, গঙ্গোত্রী কোন তীর্থস্নান বাদ দেননি। কিন্তু কোথায় সেই দেবতা? কোথায় সেই পরমপুরুষ? তাঁর তো দর্শন তো তিনি পেলেন না!
“Wherever thy sacred wave is drunk
In every haunted spot
I have sought thee till my spirit sunk
For Oh! I found thee not.”
‘থ্যাকারে’ ও ‘কিপলিং’ দু’জনেই ভারতে জন্মেছিলেন। ইংরেজী সাহিত্যে তাঁদের অবদান স্বীকৃত হলেও তাঁদের ভারতপ্রেম সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান রয়েছেন। ‘উইলিয়ম মেকপিস’, যিনি থ্যাকারের ঠাকুর্দা ছিলেন, তিনি আই. সি. এস হয়ে ভারতে এসেছিলেন। ঔপন্যাসিক থ্যাকারের বাল্যকাল কলকাতায় অতিবাহিত হলেও তাঁর কোন রচনায় কিন্তু তৎকালীন কলকাতা বা ভারত তেমন গুরুত্বপূর্ণভাবে উল্লেখিত হয়নি। অবশ্য ‘দি নিউ কামস’-এ পুরানো কলকাতার সাহেবপাড়ার কিছু কাহিনী তিনি শ্লেষাত্মক ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন। অন্যদিকে কিপলিং তো সোজা কথায় ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, পূর্ব-পশ্চিমের মিলন অসম্ভব। সেজন্য তিনি আজও নিন্দিত। কিন্তু কলকাতার উৎপত্তি সম্পর্কে লঘুসুরে তিনি যে কবিতাটি রচনা করেছিলেন, সেটি একালেও সত্যি –
“Chance directed, chance erected, laid and built
On the silt
Palace, hovel – poverty and pride, side by side,
And above the packed and pestilential town
Death looked down.”
ঐশ্বর্য ও দারিদ্র্য, প্রাসাদ ও বস্তির বিচিত্র সহাবস্থান – এই হল কলকাতা; এটাই কলকাতার সেকাল ও একালের অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য। বাঙালীর ঠুনকো সম্ভ্রমবোধে আঘাত দিলেও কিপলিং কিন্তু কোন অসত্য উক্তি করেন নি। এছাড়া অন্য কারণেও কিপলিং স্মরণীয়। মার্কিন লেখক ‘মার্ক টোয়েন’ যে ভারতে এসেছিলেন (১৮৯৬) এবং ভারত সম্পর্কে তাঁর যে কৌতূহল ছিল, সেটার মূলে ছিলেন কিপলিং। এদেশে থাকবার সময়েও কিপলিং নিয়মিতভাবে মার্ককে চিঠি লিখতেন। পরে মার্কিন দেশ ভ্রমণের সময়ে কিপলিং মার্কের নিউইয়র্ক স্টেটের এলমিরার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর কন্যা সুশী আকুল জিজ্ঞাসা নিয়ে তখন কিপলিং-এর কাছে ভারতের গল্প শুনেছিলেন। এই প্রসঙ্গে মার্ক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “No doubt India had been to her an imaginary land up to this time, a fairy land, a dreamland, a land made out of poetry and moonlight for the Arabian Nights to do their gorgeous miracles in; – and doubtless Kipling’s flesh and blood and modern clothes realised it to her for the first time and solidified him.”
তথ্যসূত্র:
১- ঊনিশ শতকের বাংলা গদ্য সাহিত্য: ইংরেজি প্রভাব, অপূর্বকুমার রায়।
২- ইংরেজী সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন, বিমলকৃষ্ণ সরকার।
৩- The Cambridge History Of English Literature.

কনটেন্ট রাইটার, ইতিহাস নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।