| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৯)

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

প্রথমে ইংরেজদের উদ্যোগে, পরে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের সক্রিয় অংশগ্রহণে শিক্ষার যে ব্যবস্থা চালু হয় সেখানে ঐসব বইপত্রই পড়ানো হতো। এটি ছিল নামে সেকুলার, স্বভাবে বৃটিশ-আর্য শিক্ষা ব্যবস্থা। এসব কারণে মুসলমান বহুদিন সেই শিক্ষা প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে ছিল। তাদের পড়াশোনার একমাত্র সুযোগ ছিল স্থানীয় মক্তব মাদ্রাসা হয়ে কলিকাতা মাদ্রাসায়। তা অনেকের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। তা ছাড়া মাদ্রাসায় দেশজ শিক্ষার সুযোগও তখন কমে যায়। সে তুলনায় বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ নেয়া সহজ ছিল। কিন্তু সেখানে ভিন্ন সংস্কৃতি অর্থাৎ উত্তর ভারতীয় আর্য সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধর্মের চর্চা। এবং এর ভাষাও নতুন, রীতিমত কষ্ট করে শিখতে হয়। তাই বহুবছর এ শিক্ষা থেকে দূরেই সরে থাকে মুসলমানরা। এর ফলে আর্থিক সুবিধাদি ও সামাজিক ক্ষমতা কাঠামো থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে এবং ক্রমশ পিছিয়েই পড়তে থাকে।  এক পর্যায়ে এসে উপায়ান্তর না দেখে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাতেই অংশ নিতে পাঠায়।

শুধু বিদ্যালয় নয়, এর বাইরেও পড়ার মালমশলা বলতে ছিল মূলত ঐসব বইপত্র। বিভিন্ন সময়ে ছাপা বইয়ের মধ্যে হিন্দু ধর্ম ও পুরান দেবদেবীর আখ্যান ইত্যাদি বইয়ের প্রাধান্যের উল্লেখ করেছি আমরা একটু আগেই। ১৮২০ সালে ছাপা বইয়ের মধ্যে এ জাতীয় হিন্দু ধর্মাশ্রিত বইয়ের সংখ্যাই বেশি। নাম শুনলেই এসব বইয়ের বিষয়বস্তু ও অভিমুখ আন্দাজ করা যায়। যেমন: করুণা বিধান বিলাস, পদাঙ্ক দূত, বিশ^মঙ্গল, নারদ সংবাদ, গীতগোবিন্দ (সবকটি কৃষ্ণ বিষয়ক), চন্ডী অন্নদামঙ্গল, গদা ভক্তি (শিব-গঙ্গা বিষয়ক), চৈতন্য চরিতামৃত, রসমঞ্জরী পাদবলী, রতিবিলাস, রতিকাল, তোতা ইতিহাস, বত্রিশ সিংহাসন (হিন্দু ধর্মীয় রাজার উপাখ্যান), চানক্য শ্লোক, হিতোপদেশ। এর বাইরে ব্যাকরণ, সঙ্গীত, জ্যোতিষবিদ্যা, চিকিৎিসাশাস্ত্র বিষয়ে অল্প কয়টা বই বের হয়।১৭  ১৮২২ সাল থেকে ২৬ সালের মধ্যে প্রকাশিত ২৭টি বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন জেমস লঙ। এসব বইয়ের মধ্যে প্রায় সবই হিন্দু ধর্মাশ্রিত রচনা। যেমন দিন কৌমুদী: হিন্দু ধর্মমতে বিশেষ বিশেষ দিন পালন করার বিষয়ে,  আনন্দ লহরী:হিন্দু ধর্মের দেবী দূর্গার মাহাত্ম্য বিষযক বিবরণ, তর্পণ: হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মৃত্যুর পর সৎকারের রীতিনীতি , রাধিকা মঙ্গল: রাধার গুণকীর্তন ও রূপ বিবরণ, গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিণী: গঙ্গা বিষয়ে,   পদাঙ্ক দূত: হিন্দু দেবতা শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন নিয়ে, বত্রিশ সিংহাসন: রাজা লোক উপাখ্যানের রাজা বিক্রমাধিত্যের কাহিনি, নারদ সংবাদ: শ্রীকৃষ্ণ সংক্রান্ত শ্লোক নিয়ে রচিত। এই শেষ নয়।  ন্যায় হিন্দু ধর্মদর্শন বিষয়ে রচিত বই। রাধার সহস্র নাম, ভগবতীর সহস্র নাম ও বিষ্ণুর সহস্র নাম বই তিনটি সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর নাম মাহাত্ম্যের বিবরণ। দেবদেবীর সহস্ত্র নাম উল্লেখ করে বই লেখার ধারণা মাথায় আসে সম্ভবত মুসলমানদের আল্লাহ্র শত নামের উল্লেখ থেকে। নলদময়ন্তী: এ বইয়ের বিষবস্তু নল ও দময়ন্তীর প্রেম কাহিনি। কিন্তু সেই কাহিনির পুরোটা জুড়ে দেবতা ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি, যম এদের উপস্থিতি। কলঙ্কভঞ্জন: এ বইটিও শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা।, প্রাণ তোষণ শিরোনামের এ বই হিন্দুদের প্রায়শ্চত্তি বিষয়ে রচিত। সঙ্গীত তরঙ্গিণী হিন্দু ধর্মীয় সঙ্গীত সংক্রান্ত। ২৭টি বইয়ের মধ্যে ১৫টিই সরাসরি হিন্দু ধর্ম বা  দেবদেবী বা পুরাণ সংক্রান্ত। অন্য বইগুলোও হিন্দু ধর্মমতে জগত ও জীবন সম্পর্কিত নানা বিশ্বাস, বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে রচিত। তিনটা বই বাদে সবই হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত। এই তিনের একটি ছিল পঞ্জিকা, আরেকটি সংস্কৃত অভিধান।১৮  জেমস লঙ লিখেছেন “১৮২০ সালে নিম্নোক্ত বিষয়ে ৩০টি বাংলা বই প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ৫টি কৃষ্ণ-বিষয়ক, ২টি বিষ্ণু -সম্পর্কিত, ৪টি দূর্গা-বিষয়ক, ৩টি উপাখ্যান, ৫টি আদিরসাত্মক, এবং একটি করে স্বপ্ন, সঙ্গীত, জ্যোতিষশাস্ত্র, চিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্থ, এবং রামমোহনের অনুবাদ ও পঞ্জিকাসমূহ ( পরিশিষ্ট ঘ দ্রষ্টব্য)। ১৮২২ সাল থেকে ২৬ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ২৮টি গ্রন্থ। এদের মধ্যে তিনটেকে বাদ দিলে বাকী সবই পৌরিণিক কাহিনি অথবা উপন্যাস। এ ধারতেই পুস্তক প্রকাশনার কাজ এগিয়ে চলে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত”।১৯  লঙ ১৮৫০ সালের কথা বললেও  বাস্তবে বাংলা বইপত্র লেখা ও প্রকাশনায় হিন্দু ধর্মাশ্রিত ও পৌরাণিক কাহিনির প্রাধান্য ছিল আরা বহুদিন। ১৮৫৭ সালে বই প্রকাশিত হয় ৩২২টি। লঙের বিবরণ থেকে বোঝা যায় এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি হিন্দু ধর্মাশ্রিত রচনা। বাস্তবে আরো দুইতিন দশক এ অবস্থাই অব্যাহত থাকে, যে পর্যন্ত না মুসলমান লেখকরা মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃতায়িত বাংলা শিখে লিখতে শুরু করে।

তবে খানিকটা দেরিতে হলেও উনিশ শতকের সূচনাতেই লেখালেখিতে সম্পৃক্ত হয় বাঙালি মুসলমান। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পরের সময় থেকে মুসলমান লেখকদের বইপত্র প্রকাশিত হওয়া খবর জানতে পারি আমরা। এ সময়টা ছিল রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে বড়সড়ো পরিবর্তন চলাকালীন মাঝ বরাবর এক যুগ। মুসলিম শাসনামলে যারা অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার ধারক ছিলেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন উত্তরভারতীয় অবাঙালি মুসলমান। এরাই ছিলেন মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতা। অন্যদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও উত্তর ভারত থেকেই আসেন। বিশেষত সেন আমলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহু ব্রাহ্মণ পরিবার বাংলায় বসবাস করতে আসেন। এরপরও অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দু বাংলাদেশে বসতি করেন। এরমধ্যে পার হয়ে গেছে কয়েক শতাব্দি। এই সময়ের মধ্যে তারা বাংলাদেশের জনসমাজ, প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। সে তুলনায় মুসলিম উচ্চবিত্তরা ছিলেন এদেশে নবীন। কেউ কেউ মাত্র কয়েক পুরুষ আগে এদেশে এসেছেন। ভাষায়, আচারআচরণে জীবনযাপনের অভ্যাসে তারা তখনো উত্তরভারতীয় স্বভাব ধরে রাখতেই উৎসাহী। এরা তখন বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে। স্থানীয় যেসব বাঙালি মুসলমান কিছুটা প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন তারাও ঐসব উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের চাপের মুখে নিজস্ব মতামত প্রকাশ ও প্রচারের খুব একটা সুযোগ পেতের না।  উপনিবেশ কায়েম হওয়ার আগে আগে হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের মধ্যে এই ফারাকাও পরবর্তীকালে শিক্ষা শিল্পসাহিত্যে মুসলিমদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।


আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৮)


হিন্দু জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকা উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা বাংলাভাষী হওয়ার কারণে বৃটিশদের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে যখন উৎসাহ উদ্দীপণা নিয়ে সংস্কৃতায়িত বাংলায় শিক্ষাগ্রহণ ও সাহিত্যচর্চায় মন দেয় তখন নিজেদের উর্দু ভাষা ও উত্তরভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকা অবাঙালি মুসলিম সমাজ। কারণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে তাদের রক্তের টান ছিল না। তাছাড়া সদ্য ক্ষমতা হারানোয় ইংরেজদে প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা বোধও ছিল বিচ্ছিন্নতার অন্যতম এক কারণ। এ অবস্থায় উপনিবেশের সূচনায় সাধারণ বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী ছিল প্রকৃত অর্থেই নেতৃত্বহীন, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। একদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগোষ্ঠী নতুন ধাঁচের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে চাকরীবাকরি করছে আর নতুন ধরণের সংস্কৃতায়িত বাংলায় সাহিত্য চর্চা করছে, আর অন্যদিকে নেতৃত্বহীন, দ্বিধান্বিত মুসলিম ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগোষ্ঠী । উনিশ শতকের শুরুর দিকে জমিদারী, ব্যবসাবানিজ্য, রাজকীয় চাকরীবাকরী হারিয়ে তাদের নেতারাও পর্যুদস্ত। এ অবস্থায় সাধারণ বাঙালি মুসলমানরা অনেকটা পুরোনো ধারার জীবন যাপন করছিল। এদের বেশিরভাগই উপনবিশের কেন্দ্রগুলো থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষ। উপনিবেশী ইংরেজদের উদ্যোগে বা উৎসাহে সূচিত নতুন ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগই কলিকাতা, শ্রীরামপুর, চুঁছরা প্রভৃতি উপনিবেশী কেন্দ্রগুলোর আশপাশে খোলা হয়। সাধারণ বাঙালি মুসলিম প্রজারা তখনো এই শিক্ষাব্যবস্থা ও বিদ্যালয়গুলির গন্ডির বাইরে। এইসব সাধারণ মুসলমানদের ঐতিহ্যপন্থী লেখকরা তখনো পুরানো ধারায় সাহিতচর্চা করছিলেন। তাদের ভাষা ছিল সাধারণ বাঙালির কথ্যভাষা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যেটাকে বলেছেন ‘বিষয়ী লোকের ভাষা’; যে ভাষায় আরবী ফারসি ও সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কিন্তু ততদিনে মৃতুঞ্জয়ী সংস্কৃতায়িত বাংলা কলিকাতার ভদ্রলোকদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে যায়। কথ্য বাংলায় সংস্কৃতের পাশাপাশি আরবী ফারসি শব্দ থাকার কারণে তারা পরিকল্পিতভাবেই সে ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার সমস্ত কৌশলই প্রয়োগ করতে থাকে। এরই অংশ হিসাব কলিকাতার লেখিয়েরা কথ্যবাংলায় রচিত এই সব বইপত্রে আরবী ফারসি শব্দ ও বাগবিধির উপস্থিতির অজুহাতে এগুলোকে আরবী ফারসির দোষে দুষ্ট হিসাবে চিহ্নিত করে।  পরে আসল কথ্য বাংলায় লেখা এ সব বইপত্রের ভাষাকে মুসলমানী বাংলা নাম দিয়ে একেবারেই আলাদা করে ফেলা হয়। এ কাজের যৌক্তিকতা  তৈরি হয় দুই দিক থেকে। এক: এরইমধ্যে হিন্দু বাঙালিরা মধ্যযুগীয় রীতির লেখালেখি ছেড়ে ফোর্ট উইলিয়ামের সংস্কৃতায়িত বাংলায় লেখালেখিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে; ফলে তাদের পুরোনো ধারার কাব্যচর্চার ইতি ঘটে। দুই: নতুন ধাঁচের পড়াশোনার বাইরে থাকায় এবং সংস্কৃতায়িত বাংলায় অনভ্যস্ত হওয়ার কারণে সাধারণ মুসলমানরা পুরানো ধারায় কিছু কিছু সাহিত্য চর্চা বজায় রেখে চলছিলা। উনিশ শতকের তৃতীয়ার্ধ্বের শেষ বা চতুর্থ দশকের শুরুতেই আমরা মুসলমান লেখকদের লেখা বইপত্রের খবর পাই। এসময় কাকতালীয়ভাবে, অনেক মুসলমান লেখক যেন বা জোর করে প্রচুর আরবী-ফারসি শব্দ ঢুকিয়ে এমন এক ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন যাকে বাংলা ভাষা না বলে মিশ্র ভাষা বলাই যৌক্তিক। এ যেন মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার ঠিক উল্টোটা, হয়তো এর প্রতিক্রিয়াতেই সৃষ্ট। মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলারীতিতে যেমন খুব বেশি সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার, এ ভাষায়ও তেমনি মাত্রাতিরিক্ত আরবী-ফারসী শব্দের প্রয়োগ। কিন্তু পত্রপত্রিকা, স্কুল, পাঠ্যসূচী নির্ধারণের ক্ষমতা, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি হাতে থাকার কারণে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু বাঙালিরা মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃতায়িত বাংলাকেই আদর্শ বাংলা রীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠত করতে সক্ষম হয়। মুসলমানদের সেই সুযোগ ও সক্ষমতা ছিল না। আবার মাত্রাতিরিক্ত আরবী ফারসি শব্দবহুল মিশ্র ভাষার সংখ্যাল্প কিছু রচনার বৈশিষ্ট চাপিয়ে দেয়া হয় সাধারণের কথ্য ভাষায় লেখা অন্যান্য রচনার উপর। ফলে মুসলমানদের সকল রচনাকেই ঢালাওভাবে আরবী ফারসি দোষে দুষ্ট হিসাবে চিহ্নিত করে নি¤œরুচির সাহিত্য, বটতলার সাহিত্য ইত্যাদি মার্কা লাগিয়ে দেয়া সহজ হয়। এই কথ্যবাংলাকে বলা হয় মুসলমানী বাংলা, আর এভাষায় রচিত সাহিত্যকে বলা হয় মুসলমানী বাংলা সাহিত্য। 

খুব সম্ভবত জেমস লঙ-ই প্রথম ব্যবহার করেন এ পরিভাষাটি। পরে দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনও এই নামটিই ব্যবহার করেন। ক্রমশ তা চালু হয়ে যায়। বাঙালি মুসলমানদের রচিত এসব কাব্যসাহিত্যকে ‘পুঁথি সাহিত্য’, ‘দোভাষী সাহিত্য’, ‘বটতলার বই’ ইত্যাদি নামে আলাদাভাবে নিন্মমানে চিহ্নিত করার পেছনে যৌক্তিক ভিত্তি কতটুকু আমরা নমুনা সহকারে যাচাই করে দেখতে চাই। এক্ষেত্রে মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃতায়িত বাংলা তৈরির আগের বাংলাগদ্যের নমুনাকে মান ধরে দুই শ্রেণির রচনার তুলনা করা যেতে পারে। তবে এমন গদ্যের নমুনা নেয়া দরকার যার মধ্যে ধর্মীয় পরিপাশের্^র কোনো প্রভাব থাকার সম্ভাবনা না থাকে। যেমন বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকদের গদ্যরচনা কিংবা হিন্দু বা ইসলমা ধর্ম সংক্রান্ত কোনো আলোচনার গদ্যে ধর্মীয় প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। তেমনি আদালতের চিঠিপত্রে থাকতে পারে অতিরিক্ত ফারসির প্রভাব।হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কি ব্যবসায়ী এবং আদালত আমির ওমরাহদের ভাষার বাইরে বিষয়ী লোকেরা একরকম ভাষা ব্যবহার করতেন, সেটিই সাধারণ মানুষের কথ্যবাংলা। তা কিন্তু কোনো নিদিষ্ট অঞ্চল বিশেষের ভাষা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে কাজের গদ্য লেখার ও সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে তার একটা মান রূপ দেখা দেয়। সেই ভাষায় পরিমাণ মতো সংস্কৃত আরবী ফারসি মিশে সুললিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্যময় ভাষা হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। আমরা এখানে সেরকম বিষয়ী লোকের পত্রের অংশ বিশেষ তুলে ধরবে। নারায়নপুরের আড়ঙ্গের গোমস্তা নালিশ জানিয়ে চিঠি লিখছে ঢাকার কুঠিকে:

আড়ঙ্গ নারায়নপুরের শ্রীবিন্দুমোহন তাঁতি নালিষ করিলেন জমীদার অন্যায় করিয়া পাট্টা বেসী খাজনা তাতির স্থানে লইতেছে (।) অতএব আরজ তাতি মজকুর আরজী সমেত জাইতেছে () জোনাবে পৌছিয়া আরজ করিবেক (।) তাহাতে গৌর ফরমাইতে হুকুম হইবেক (্) ইহা কদমে আরজ করিলাম। ইতি সন ১৯৯ সন ইং ১৭৯২ তারিখ ১৪ দিজস্বর–২ পৌষ । ২০

চিঠির উদ্ধৃত মূল অংশটিতে ৩৫টি শব্দ আছে। এর মধ্যে শতকরা হিসাবে প্রায় ৫৫% বাংলা, ৩৪% আরবী ফারসি,  ১২%-এর মতো সংস্কৃত বা সংস্কৃতজাত শব্দ।

এবার একটি ব্যক্তিগত চিঠি উদ্ধৃত করা যাক। চাকরি পাওয়ার জন্য তদবিরের চিঠি লিখেছেন কেউ একজন:

“ সন ১১৯৯ সাল (১৭৯২)।

আমী. . . তোমার নিকট জাইতেছিলাম (।) নদীর বন্যাতে পার হইতে পারিলাম না (।)  জাইতে পারিলে সাক্ষাতে সকল কহিথাম (।) শ্রীযুত বাহড় খাঁএর ভাড় বেলপোড়া ইজারা হইয়াছে (।) প্রাণতুল্য দেবী প্রসাদ রায়ের খিদমৎ এক জায়গাতে কিম্বা মহুরির গিরি খাঁ মজকুরের নিকট করিয়া দিতে হইবেক (।) খাঁ মজকুর তোমার বষের মধ্যে বটেন, তোমার আমী পোষ্যের মধ্যে বটি (।) মহুরিরগিরি হয় এর এতমাম হয় ইহা করিয়া দিতে হইবেক…।”২১ 

এ উদ্ধৃতিতে শতকরা হিসাবে প্রায় ৭৯% বাংলা, ৯% সংস্কৃত, ১৩ % আরবী ফারসি। দৃই উদ্ধৃতির গড় করলে দাড়ায়: ৬৯% বাংলা,  আরবি-ফারসি ২১%, ১০% সংস্কৃত বা সংস্কৃতজাত।

এবার সংস্কৃতায়িত বাংলা থেকে উদাহরণ দেয়া যাক:

এইরূপে, আমি, সর্বক্ষণ, তোমার অদ্ভুত মনোহর মূর্ত্তি ও নিরতিশয় প্রীতিপ্রদ অনুষ্ঠান সকল অবিকল প্রত্যক্ষ করিতেছি; কেবল, তোমায় কোলে লইয়া , তোমার লাবন্যময় কোমল কলেবর পরিস্পর্শে, শরীর অমৃতরসে অভিসিক্ত করিতে পারিতেছি না। দৈবযোগে, একদিন, দিবাভাগে আমার নিদ্রাবেশ ঘটিয়াছিল। কেবল, সেই দিন, সেই সময়ে, ক্ষণকালের জন্য, তোমায় পাইয়াছিলাম।  ২২

এখানে বাংলা ৬৫%, ৩৫% সংস্কৃত বা সংস্কৃতজাত, আরবী ফারসি ০%।

“সায়াহ্নকাল উপস্থিত, পশ্চিমগগনে অস্তাচলগত দিনমণির ম্লান কিরণে যে সকল মেঘ কাঞ্চণকান্তি ধারণ করিয়াছিল, তৎসহিত নীলাম্বর প্রতিবিম্ব স্রোতস্বতী জল মধ্যে কম্পিত হইতেছিল; নদী পাড়স্থিত উচ্চ অট্টালিকা এবং দীর্ঘ তুরুবর সকল বিমলাকাশপটে চিত্রবৎ দেখাইতেছিল; দূর্গমধ্যে ময়ূর সারসাদি কলনাদী পক্ষিগণ প্রফুল্লচিত্তে রব করিতেছিল; কোথাও রজনীর উদয়ে নীড়ান্বেষনে ব্যস্ত বিহঙ্গম নীলাম্বরতলে বিনা শব্দে উড়িতেছিল”।২৩ 

 এ উদ্ধৃতিতে বাংলা শব্দ খুঁজেপেতে বের করতে হয়। প্রায়ই সবই সংস্কৃত বা তদ্ভব দশব্দ।

এবার আমরা ‘দোভাষী কাব্য’, ‘মিশ্রভাষার কাব্য’, ‘পুঁথি সাহিত্য’, ‘মুসলমানী বাঙলা’ ইত্যাদি নামে অস্পৃশ্য করে রাখা সাহিত্য থেকে নমুনা তুলে দেই:

কেতাব করিল মর্দ্দ ফারসি জবানে।

ফারসি লোক যারা তার খুশি হাল শুনে॥

বাঙ্গালার লোক সবে নাহি জানে ভেদ।

যে কেহ শুনিল তার দেলে করে খেদ॥

এ খাতেরে ফকিরে হইল সওক।

আফছোছ না করে যেন বাঙ্গালার লোক॥

চলিত বাঙ্গালায় কিচ্ছা করিনু তৈয়ার।

সকলে বুঝিবে ভাই কারণে ইহার॥

আসল বাঙ্গালা সবে বুঝিতে না পারে।

এ খাতেরে না লিখিলাম সোন বেরাদরে॥

এখানে আরবি ফারসি শব্দ মোটের ২৩% প্রায়, সংস্কৃত ২%, বাকী ৭৫% বাঙলা শব্দ। আমরা একটু আগে মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃতায়িত বাংলা তৈয়ারের আগের বাংলা গদ্যকে মান ধরে যে হিসাব পেয়েছিলাম তাতে আরবী ফারসির পরিমাণ ছিল ২১%। এখানে ২% বেড়ে হয়েছে ২৩%। সংস্কৃত শব্দ ছিল ১০%-এর মত। এখানে সংস্কৃত শব্দ মাত্র ২%, কমেছে ৮%। বাংলা শব্দ ৬৯% থেকে বেড়ে দাড়িয়েছি ৭৫%-এ।

অন্যদিকে, মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলায় সংস্কৃত শব্দ ৩৫%, অর্থাৎ উপনিবেশ-পূর্ব মান বাংলা গদ্যের তুলনায় ২৫% সংস্কৃত শব্দ বেড়েছে। আর আরবী ফারসি শব্দ সর্ম্পূণ অন্তর্হিত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত