| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: সিঁদুর । সংঘমিত্রা রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

 

“তোকে একেবারে নববিবাহিত বাঙ্গালী বধূর মতো লাগছে রে এমিলা কে সাজিয়ে দিল তোকে?”

“মিথিলা দিদি সাজিয়ে দিয়েছে মম। নাটকে আমি বউ সেজেছি আর সোমদা বর সেজেছে তুমি তো সবই জানো। সবাই বলেছে  আমাদের অভিনয় নাকি খুব ভালো হয়েছে । কত হাততালি দিল দর্শকরা! তুমি,পাপা কেউ তো গেলে না তাই আমি সেজেগুজে চলে এসেছি তোমাদের দেখাব বলে!”

“কি করে যাব বল এমন সময় পায়ে  ব্যথা  পেলাম  না হলে তোর বাবা না গেলেও আমি যেতাম। বাবাও যেত কিন্তু তার হঠাৎ তার কাজ পড়ে গেল তাই যেতে পারেনি।  কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে!”

“সবাই তাই  বলছিল আমাকে নাকি খুব সুন্দর লাগছে। দেখ লাল রঙের আবীর সিঁথিতে দিয়েছি ওটা নাকি অভিনয়ের সিঁদুর, আর বড় লাল টিপ দেওয়ায়  আমাকে নাকি অসাধারন লাগছিল। তুমিও তো কত সুন্দর তাহলে সিঁথিতে সিঁদুর পড় না কেন তোমাকেও খুব  সুন্দর  লাগত।“

“কি করে সিঁদুর  পড়ি বল আমরা যে ক্রিশ্চান!”

“ও ক্রিশ্চানরা  তো সিঁদুর পড়ে না কিন্তু আমি পড়ব! মামী মানে তোমার ভাইয়ের বউ উনি তো সিঁদুর পড়েন কি সুন্দর লাগে উনাকে দেখতে।“

“ওরা হিন্দু  তাই সিঁদুর পড়ে সব জেনে কেন একথা বলিস বুঝি না। ছাড় এসব কথা তুই  কি করে পড়বি তোর ক্রিশ্চান বর কি তোকে পড়তে দেবে?“

“কি করে পড়ব সময় এলেই দেখতে পাবে!”

“পাগলী কোথাকার যা  মুখে আসে তাই বলে।“

    

এমিলা  একটা মিষ্টি হাসি হেসে নিজের ঘরে চলে যায় । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বার বার দেখতে থাকে। সত্যি লাল পাড় শাড়ি, সিঁথিতে লাল আবীর, নকল শাঁখা,পলা,গয়না এসবে দারুন লাগছিল তাকে। নাটকে সোমরাজ  তার বর সেজেছিল তাকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে। সোমরাজকেও ধুতি,পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছিল। চৌদ্দ বছরের কিশোরী এমিলার এসব খুলে ফেলতে মন চাইছিল না। মনে মনে ঠিক করল সে এভাবেই বউ সেজে থাকবে সারাজীবন।

দার্জিলিং চা বাগানের কেরানী  ডেভিড  গোমেজ। ডেভিডের আদি নিবাস  গোয়াতে ছিল। তার পূর্ব পুরুষেরা ওখানেই থাকতেন। কিন্তু ডেভিডকে দত্তক নিয়েছিলেন তার মাসি এরিনা গোমেজ। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন  আর তার স্বামী এই চা বাগানেই চাকরী করতেন। ডেভিড এখানেই বড় হন লেখাপড়া করে চা বাগানেই চাকরী পান। ভালোবেসে বিয়ে করেন বাঙালি মেয়ে অনামিকা দত্তক। অনামিকার বাবাও চা বাগানেই চাকরি করতেন কিন্তু  ওদের বিয়েটা অনামিকার বাপের বাড়ীর লোকেরা মেনে নেননি। তাই এখনও অনামিকা বাপের বাড়ীর যেতে পারে না। তার বাবা বেঁচে নেই কিন্তু মা, ভাই একটা ক্রিশ্চান ছেলেকে বিয়ে করাটা এত বছরেও মেনে নিতে পারেনি। সেই কারনে  এমিলা  কখনও মামার বাড়ি যেতে পারেনি। তবে একই জায়গায় সবাই থাকে তাই দেখা হয় কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। এমিলা  মাঝে মাঝে ভাবে বাবা যদি ক্রিশ্চান না হয়ে হিন্দু হত তাহলে  হয়ত  মামাবাড়ি যেতে কোন বাঁধাই থাকত না।

অনামিকা একসময় খুব সুন্দরী ছিল এখনও তার রূপ একটুও কমেনি বরং আরও ফুটে উঠেছে। ডেভিড তাঁকে খুব যত্নে রেখেছে। এমিলা মায়ের মতোই সুন্দরী হয়েছে। ক্লাস এইটে পড়া কিশোরী এমিলা বয়সের তুলনায় একটু বেশী বড় সড়  দেখে মনে হয় পূর্ণ যুবতী। কাঁচা হ্লুদের মতো গায়ের রং, ভরাট লম্বাটে মুখ,ভাসা ভাসা চোখ, টিকালো নাক, লম্বা ঘন  চুল  কোমর  অবধি গেছে। কখনও খোলা চুলে কখনও  দুটো বেণী বেঁধে থাকত। এমিলা খুব চটপটে আর প্রানবন্ত মেয়ে, সবসময় হাসিখুশি থাকত, তবে  সহজ সরল মেয়ে ওর মন যখন যা চাইত তাই করত।  ওর দিকে অনেকের চোখ যেত কিন্তু  এমিলার মন প্রান জুড়ে একজনই ছিল সোমরাজ বসু। সোম লম্বা শরীর, চেহারাটা মন্দ নয়  গায়ের রং শ্যামলা। পাশাপাশি কোয়াটারে দুজনেই থাকে। সোমরাজ এমিলার চাইতে দুই বছরের বড় সে ক্লাস টেনে পড়ে। সোমরাজের বাবা সুব্রত বসু চা বাগানের বড়বাবু ছিলেন।  মা সুচনা দেবী গৃহবধূ  সোমরাজ তাদের একমাত্র  সন্তান।

“এই সোমদা আমার সিঁথিতে সুন্দর করে সিঁদুর পরিয়ে দেবে গো!”

“পাগলী কোথাকার কি বলছিস এসব তুই ! এমনি এমনি কেউ কাউকে সিঁদুর পড়াতে  পারে না । সিঁদুর পরাতে হলে বিয়ে করতে হয়!“

“তাহলে চল আমরা বিয়ে করি । আমি লাল বেনারসি পড়ব ,অনেক গয়না পড়ে খুব সুন্দর করে সাজব । কপালে চন্দন ,লাল টিপ পড়ব হিন্দু বাঙালি বউরা যেমন করে বিয়েতে সাজে  আর তুমি ধুতি, পাঞ্জাবী‌ টুপুর  পরে বর সাজবে । তারপর  আমরা সাতপাকে ঘুরব তারপর তুমি আমাকে সুন্দর করে সিঁদুর পরিয়ে দেবে । আমার খুব সাধ তোমার বউ হয়ে সিঁদুর পরে সেজেগুজে থাকব । যেভাবে তোমার মা  মানে  কাকিমা   থাকেন । আমার মা তো এসব কিছু পরে না আমার একটুও ভালো লাগে না।“

“এখন আমরা কি করে বিয়ে করব এমিলা। আমরা এখনও স্কুলে পড়ছি। আমাদের আরও অনেক  পড়াশোনা  করতে হবে।  রোজগার করতে হবে তারপর বিয়ের কথা ভাবতে হবে রে পাগলী!”

“ইস তাহলে তো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভালো নই। তুমি তো খুব ভালো ছাত্র যখন বাইরে পড়তে যাবে সুন্দরী মেয়ে পাবে তখন আমাকে ভুলে যাবে না তো?”

“তোর মতো মিষ্টি মেয়েকে কি ভুলা যায়! তুই আমার মন প্রান জুড়ে রয়েছিস। যখন আমি রোজগার করতে শুরু করব তারপরই আমরা বিয়ে করব। “

“তাও ঠিক রোজগার না করলে খাব কি ? কিন্তু আমার বেশী কিছু চাই না অল্প রোজগার হলেই চলবে। শুধু তোমার সঙ্গে সারা জীবন  কাটাতে চাই। তুমি আমাকে খুব ভালোবাসবে  তো যেভাবে বাবা মাকে ভালবাসে।“

“বাসব রে পাগলী ! এখন চল সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।“

“চল।“

শরৎ  কালের বিকেল। স্কুল ছুটির পর খাওয়া দাওয়া সেরে এমিলা, সোম দুজনেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। এমিলা খুব ভালো সাইকেল চালাতে পারে।  ধীরে ধীরে ওরা  চলে যায় চা বাগানের পিছনের ছোট পাহাড়ি নদীটার পাড়ে। এসময় এদিকে লোকজন খুব একটা আসে না। নদীটার দুই পাড়েই ছোট বড় পাথর ঘেরা। শরৎকালে নদীতে জল কম থাকে দুজনে সাইকেল রেখে বসল গিয়ে পাথরের উপর। ওখানে বসেই এমিলা, সোম এসব কথা বলছিল। সেই ছোট থেকে যখনই সময় পেত দার্জিলিং এর চা বাগানের আশেপাশে ছুটে বেড়াত এমিলা আর সোম।দুজনে খুব ভালো বন্ধু সেই সঙ্গে দুজন দুজনকে ভালোবাসে। প্রতি বছর ওদের বাগানে বিশ্বকর্মা পূজা  খুব বড় করে হয়। সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান হয় দুদিন ব্যাপী। এবার ওখানে যে নাটকটা হবে বলে সিলেক্ট হয়েছিল ওটাতে নববিবাহিত বর বউয়ের পাট ছিল তাই কেউ করতে রাজী হচ্ছিল না। শেষে মিথিলা সোম, এমিলাকে সিলেক্ট করল। মিথিলা সোমের জ্যাঠতুতো  দিদি কলেজে পড়ে। খুব সুন্দর গান গায় কোন ফাংশন হলে সেই সব দেখাশোনা করে। এমিলা,সোমকে মিথিলা খুব ভালবাসে। আর সে জানত এমিলা, সোমই  এই চরিত্র দুটো ভালো ফুটাতে পারবে। দুজনে অভিনয় করছিল খুব ভালো। সবাই ওদের অভিনয় দেখে হাততালি দিয়েছিল। মিথিলা দিদি ওদের বলেছিল, ”তোরা অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা কর মনে হচ্ছে অনেক নাম করতে পারবি। “

“অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা হয় নাকি মিথিলা দিদি?”- এমিলা  বলল।

“কেন যাবে না । কলকাতায় অভিনয় শেখার স্কুল আছে।“

“বেশ তাহলে আমি তাই করব । এই  সোম দা তুমিও শিখবে নাকি অভিনয়।“

“না আমার তেমন ইচ্ছে নেই আমি ডাক্তার হতে চাই বাবা মায়ের তাই ইচ্ছে!”

“তুমি ভালো ছাত্র ডাক্তার হতে পারবে। আমার অভিনয় করাই ভালো।“

“বড় অভিনেত্রী হয়ে গেলে আমাদের ভুলে যাবি না তো!”

এমিলা  হেসে বলেছিল, ”তোমাদের আমি ভুলতে পারি তোমরা আমার মনের ভিতরে বসে আছ।সেখান থেকে কেউ তোমাদের বের করতে পারবে না।“

   “ ঠিক আছে দেখা যাবে ।“

  

 দুই.

সময় বয়ে যায়। সোম মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে সায়েন্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এমিলা  মাধ্যমিক দেবে পড়ার চাপ দুজনেরই কিন্তু তার মধ্যে একটু সময় পেলেই দুজনে সাইকেল নিয়ে কোথা থেকে কোথা চলে যায়। কখনও  পাহাড়ি নদীর ধারে, চা বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে ছুটে বেড়াত দুজনে আর ওদের কত কথা,কত গল্প, কত পরিকল্পনা।  এমনিতে দুজনের কোয়াটার পাশাপাশি দুজন দুজনের ঘরে অবাধ যাতায়াত। এমিলার  পরিবার  ক্রিশ্চান হলেও ওরা সব  পূজো  পার্বণে অংশ গ্রহণ করত । আর সোমের ঘরে কোন পূজো  হলে সবার আগে ছুটে যেত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুচনা  দেবীর  পূজোর আয়োজন করা দেখত।  মাঝে মাঝে এটা ওটা প্রশ্ন করত । “  কাকিমা এটা কি ?” ওটা কি ?” এটা করলে কি হয় ?” সুচনা  দেবী কাজ করতে করতেই ওর প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এমিলা  মনে মনে ভাবত সেও একসময় কাকিমার মতো লাল পাড় শাড়ি পড়ে পূজোর আয়োজন করবে ভক্তি ভরে। কারন সোমের বউ হয়ে সেই এই ঘরে  আসবে।

ওরা যখন ছোট বেলায় ঘুরে বেড়াত তখন ওদের কেউ কিছু না বললেও বড় হওয়ার পর ওদের নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলে। ডেভিড, অনামিকা এসব কথা খুব একটা পাত্তা দেয়না কিন্তু সুব্রত বাবুর  সম্মানে লাগে আজেবাজে কথা শুনে। অনেকে বলছে এমিলার কারনে নাকি সোমের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। সোম লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারবে না।

সুব্রত বাবু  ঘরে এসে সোমকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ”ক্রিশ্চান মেয়েটার সঙ্গে এবার ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে একটু লেখাপড়ায় মন দাও সোম। উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট না করলে তোমার আর ডাক্তারী পড়া হবে না।“

সোমের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ভালো। বাবাকে সে একটু একটু ভয় পায় আবার  নানা আবদারও করে বাবার কাছে। বলল, ”একথা কেন বলছ বাবা আমি তো ছোট থেকেই এমিলার সঙ্গে  ঘুরে বেড়াই। আমরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু।“

“আগের কথা বাদ দাও এখন তোমরা বড় হয়েছ। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে তাছাড়া লোকে নানা কথা বলছে তোমাদের নামে।“

“যার যা খুশী বলুক আমার এমিলার  সঙ্গে কথা না বললে পড়াশোনায় মন বসে না । ও হচ্ছে আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন!”

“কি বললি তুই বেঁচে থাকার অক্সিজেন।“ খুব রেগে যান সুব্রত বাবু। উনার কথা শুনে ছুটে আসেন সুচনা  দেবী।

“কি হয়েছে ছেলেটার উপর এতো রেগে আছ কেন?”

“বুঝাও তোমার ছেলেকে এটা লন্ডন আমেরিকা নয় । এমিলার সাথে ঘুরাফেরা ,কথা বলা  যাতে বন্ধ রাখে। “

“ঠিক আছে তুমি যাও আমি ওকে  বুঝিয়ে বলব । মানুষের কোন কাজ নেই ওদের নিন্দে করা ছাড়া!”

“ওরা যেমন খুশী ভাবে চলাফেরা করবে আর কেউ কিছু বলবে না তা কি করে হয়।“ রেগে বেরিয়ে যান সুব্রত বাবু ।

সুচনা  দেবী বললেন ,” আমি জানি  সোম তোরা একজন আরেকজনকে খুব ভালোবাসিস।“

“এমিলাকে  ছাড়া আমি বাঁচতে পারব  না মা সে যে যাই বলুক না কেন!”

“বেশ তো তুই  নিজের পায়ে দাঁড়ালেই আমি তোদের বিয়ে দিয়ে দেব।“

“কথা দিলে তো তখন আবার বল না যেন ক্রিশ্চান মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে না। তাহলে কিন্তু আমি সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যাব।“

“ওরে পাগলা সে সব কিছু করতে হবে না তোকে আমি তো আছি।“

খুশীতে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল সোম।


আরো পড়ুন: গল্প: অন্য আয়না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


মাঝখানে কেটে গেছে অনেক গুলো বছর ।ঘটে গেছে কত ঘটনা সবকিছু  বদলে গেছে। ছয়ত্রিশ বছরের ক্যান্সার স্পেশালিষ্ট ডাঃ সোমরাজ বসু কলকাতায় এসেছেন কয়েকদিনের জন্য। চারদিকে তার খুব নামডাক হয়েছে। তার বাবা মায়ের ইচ্ছে মতো সোমরাজ  বড় ডাক্তার হয়েছেন তিনি এখন মুম্বাইতে বড় হাসপাতালে কর্মরত। তবে মাঝে মাঝে তাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয় অনুরোধ করে কিছু সময়ের জন্য। তিনি চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় গেলেও কলকাতার ক্যান্সার হাসপাতালে এই প্রথমবার  এলেন। ছয়ত্রিশ বছর বয়সেও  ডাঃ বসু আবিবাহিত। বাবা ,মা বেচে নেই তিনি একাই থাকেন। প্রচুর রোজগার করেন কিন্তু তার অনেকটাই দান করে দিন অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, অসহায় মানুষের উন্নয়নমূলক কাজে। এত বড় ডাক্তার  একেবারে সাধারনভাবে চলাফেরা করেন , নিরামিষ খাবার খান, কেমন একটা বৈরাগ্য  ভাব রয়েছে তার মধ্যে।

এয়ারপোর্ট থেকে নেমে গাড়ীতে বসে ফেলে আসা দিনগুলোর  নানা কথা ভাবছিলেন ডাঃ বসু। মায়ের কথা, বাবার কথা, এমিলার কথা, দার্জিলিং এর চা বাগানের কথা। আজ তার প্রচুর নামডাক,অর্থ হয়েছে কিন্তু অতীতের সবকিছু হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে। ডাক্তারি পড়তে কলকাতায় আসার আগে শেষ বারের মতো দেখা হয়েছিল এমিলার সঙ্গে। তারপর যখন বাড়ীতে যান এমিলাকে  আর দেখতে পাননি । চলে গিয়েছিল এমিলা দার্জিলিং থেকে। কেটে গেছে অনেক বছর তিনি এমিলার খোঁজ পাননি। হয়ত এমিলা অন্য কাউকে বিয়ে করে ছেলে মেয়ে স্বামীকে নিয়ে সুখে সংসার করছে । কিন্তু তিনি এমিলার জায়গায় কাউকে বসাতে পারেননি তাই তিনি বিয়ে করেননি।  সুচনা  দেবী বলেছিলেন তিনি সোম আর এমিলার বিয়ে দেবেন আর এমিলা বলেছিল সে সোমের হাতে সিঁদুর পরে তার বউ হয়ে তার সঙ্গেই সংসার করবে। কিন্তু দুজনের কেউ কথা রাখেনি। এসব কথা  যখন তার মনে হয় একটা চাপা অভিমান অনুভব করেন তিনি।  আবার মনে হয় যাদের উপর অভিমান করবেন তারা দুজনের কেউ তার কাছে কখনও  আর আসবে না।

 

তিন.

সোমরাজ উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর জয়েন্ট এন্ট্রাসে  বসে  এবং  প্রথম বারেই ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে যায়। খুব খুশী সুব্রত বাবু , সুচনা দেবী ,দার্জিলিং এর লোকজন । এমিলার পরিবারের সবাই খুব খুশী আর সবচেয়ে খুশী এমিলা। সে ভবিষ্যতে  ডাক্তারের বউ হবে এটা ভেবেই তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। মেডিকেল কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সোম বাড়ীতে যখন আসে দুজনে সাইকেল নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে চলে যায় পাহাড়ি নদীটার ধারে। এমিলা তখন আনন্দের সাগরে ভাসছে  আবার মনে মনে একটু অভিমানও আছে। সেদিন সে হ্লুদ রঙের চুড়িদার পড়েছিল, লম্বা চুলগুলো খোলা ছিল, পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো তার শরীরে এসে পড়ায় অপূর্ব লাগছিল তাকে। সোম তার উপর থেকে চোখ  সরাতেই পারছিল না।

“এই সোমদা কি দেখছ অমন করে?”

“তোকে দেখছি রে পাগলী!”

“আমাকে কি এই প্রথম দেখলে ? ”

“না আগেও দেখেছি তবে আজ তোকে খুব সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর আগে কখনও লাগেনি।“

“সুন্দর না  ছাই! কলকাতায় মেডিকেল কলেজে আরও কত সুন্দরী পাবে তখন কি তোমার আর এই পাগলীর কথা মনে থাকবে!“

   সোম  মুচকি হেসে বলল, ”হতে পারে এমনটা কলকাতার সুন্দরীদের ঠ্যালায় হয়ত আমি তোকে ভুলে যেতেই পারি।“

   এমিলা অভিমানের সুরে বলল, ”বেশ তাহলে ওদের কাউকে বিয়ে করে তার সঙ্গেই থেকো আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমি এখন যাই।“

এমিলা উঠে চলে যাচ্ছিল সোম তাকে টেনে বসাল। বলল, ”তোকে কি আমি এমনি পাগলী বলি যত বড়ই  হোস না  কেন এখনও ছোটদের মতো  ঝগড়া করার স্বভাব গেল না। আচ্ছা আমি যদি অন্য কাউকে ভালোবাসি তাহলে তোর কেমন লাগবে?“

“আমি  তাকে মেরে ফেলব।“

“কেন?”

“কারন আমি ছাড়া তুমি কাউকে ভালোবাসতে পারবে না আর যদি তাই কর তাহলে আমি মরে যাব।“

“চুপ কর পাগলী!”– বলে এমিলার  মুখটা আলতো ভাবে চেপে ধরেছিল সোম। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর এমিলার ঠোঁটে  প্রথমবার চুমু খায় সোম আর  আর  প্রজাপতির মতো চটপটে মেয়েটা জীবনে প্রথমবার লজ্জা পেয়েছিল। ওরা একজন আরেকজনকে ভালবাসলেও শরীর নিয়ে খেলেনি কখনও। সোম বলল,

“এই চুমুটা ঠোঁটে রেখে দিলাম যখনই অন্য মেয়েরা আমার কাছে আসতে চাইবে  তখনই চুমুটা আমাকে তোর  কথা মনে করিয়ে দেবে।“

“ধ্যাত তুমি যে কি!” – বলে  এমিলা  সাইকেল নিয়ে  ছুটে চলে গিয়েছিল। সোম তাকে অনেক ডাকতে থাকে কিন্তু এমিলা এতো লজ্জা পেয়েছিল আর ফিরে তাকায়নি। এটাই তাদের শেষ দেখা ছিল।

সোম ঘরে এসে নিজের কীর্তির জন্য মনে মনে হাসছিল। এমিলার মিষ্টি ঠোঁটের ছোঁয়া লেগেছে তার ঠোঁটে। হঠাৎ তার কি যে হয়েছিল মনে হচ্ছে দুজনেই বড় হয়ে গেছে। ভাবতে থাকে কবে সে ডাক্তার হবে আর কবে এমিলাকে কাছে পাবে।  না সে মেডিকেল কলেজে পড়তে গেলেও অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে সে কোন সম্পর্ক গড়ে তুলবে না। এমিলার সঙ্গে সে কখনও বিশ্বাসঘাতকটা করবে না।

আর  এদিকে নিজের ঘরে এসে বার বার  নিজের ঠোঁটে সোমের স্পর্শ  অনুভব করে  বিছানায় শুয়ে একা একা  হাসছিল। অনামিকা দেবী ওর এভাবে হাসি দেখে বললেন, ”কি হয়েছে এমিলা এভাবে হাসছিস কেন?”

“কিছু নয় মম এমনি!”

“এমনি আবার কেউ হাসে নাকি লোকে তোকে পাগল বলবে। আচ্ছা ছাড় সোম কাল সকালে চলে যাবে দিদিও সঙ্গে যাবেন চল একবার দেখা করে আসি।“

এমিলার  তখন সোমের সামনে যেতেই লজ্জা হচ্ছিল। বলল,” না তুমি যাও আমি যাব না।“

“বাবা এমনিতে তো দুটিতে গলায় গলায় ভাব আর এখন ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবি না। দেখিস আবার কাল সোম চলে গেলে আবার পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসিস না যেন!”

পরদিন খুব সকালে সোম চলে গিয়েছিল বার বার এমিলার ঘরের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু এমিলা সারারাত সোমের কথা ভাবতে ভাবতে ভোরবেলা ঘুমিয়েছে তাই তখন সে ঘুমেই ছিল। সোম চলে যাবার  পর  মনের দিক থেকে এমিলা একেবারে একা হয়ে গিয়েছিল, মিথিলারও বিয়ে হয়ে গেছে। এমনিতে সে  সবার সঙ্গেই মিশে কিন্তু তখন খুব একটা বাইরে বের হত না। কলেজে যেত আর ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করত।  আর মনে মনে অপেক্ষা করত সোম কবে আসবে। অনেকটা ঘর কুনো হয়ে গিয়েছিল সে। তখন ফোন ছিল না সোম একটা চিঠি লিখেছিল এমিলাকে।  কিন্তু সুব্রত বাবু পিওনকে বলে রেখেছিলেন সোমের কোন চিঠি আসলে আগে উনার হাতে দিতে। কারন তিনি জানতেন সোম এমিলাকে চিঠি লিখবেই।  ছোট বেলায় তিনি এমিলাকে পছন্দ করলেও বড় হওয়ার পর লোকের নানা কথা শুনে এমিলাকে তিনি সহ্য করতেন না। তিনি কিছুতেই চাইতেন না এমিলা সোমের ধারে কাছে যাক। তার ডাক্তার ছেলের  উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সে রকম কাউকেই তার ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ। আর তিনি সোমকে পড়াশোনা ছেড়ে  দার্জিলিং না  আসার কড়া নির্দেশ  দিয়েছিলেন।

সোম যাবার কয়েক মাস পর হঠাৎ মারা যান ডেভিড। অনামিকাকে তার জায়গায় বাগানে একটা চাকরি দেওয়া হয়। অনামিকার বাপের বাড়ীর লোকেরা তখনও তার খোঁজ নেয়নি। কিন্তু ডেভিড মারা যাবার পর তার এক দূর সম্পর্কের ভাই মাইকেল আসে অনামিকার জীবনে। অবশ্য সে অনেক আগে থেকেই ডেভিডের বাড়ি আসত, খুব ভালো বাংলা বলতে পারে সে। মিষ্টি স্বভাবের মাইকেল খুব সহজেই অনামিকার মন জয় করে ফেলে আর অনামিকাও চাইছিল তার শূন্য জীবনে কেউ আসুক। মাইকেল ডিভোর্সি তার নানা ধরনের ব্যবসা আছে। মাইকেল অনামিকাকে বলে, “এখানে থেকে কি হবে অনামিকা এমিলাকে নিয়ে আমার সঙ্গে মুম্বাই চল। আমার বিজনেস পার্টনার হবে রানীর মতো থাকবে!”

“আমারও এখানে থাকতে মন চায় না কিন্তু এমিলা কি দার্জিলিং ছেড়ে যেতে রাজী হবে।“

“ওকে আসল কথা বলার দরকার নেই । বল কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছ।“

অনামিকা সেই কথাই বলল এমিলাকে। সোমের জন্য এমিলার মন ভালো ছিল না  তার উপর বাবাকে হারিয়েছে। সেও  চাইছিল কদিন ঘুরে এলে ভালো হয়। তাই মায়ের প্রস্তাবে সে রাজী হয়ে গেল।

                                    

চার.                                             

দার্জিলিং থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জীবন বদলে যায় এমিলা, অনামিকা দুজনের। মাইকেলের অনেক ধরনের ব্যবসার মধ্যে হোটেল ব্যবসা ছিল। মুম্বাইতে গিয়ে বিয়ে করে অনামিকা, মাইকেল। তারপর হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অনামিকা। সারা রাতভর পার্টি, মাতাল হয়ে নাচানাচি কিছুদিনের মধ্যে এরকম জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলে অনামিকা। বরং ডেভিডকে বিয়ে করে একঘেয়ে ঘরোয়া জীবনের চাইতে এরকম জীবন ভালো লাগছিল তার। এমিলা বুঝতে পেরেছিল সে আর দার্জিলিং আসতে পারবে না আর এসেই কি করবে সোম হয়ত তাকে ভুলেই গেছে। মেডিকেল কলেজে সুন্দরীদের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে সোম। তাই একবারও তার খোঁজ নেয়নি। মাইকেল তাকে কলেজে ভর্তি করে দিলেও সে আর অনামিকা দুজনেই চাইত এমিলা  হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক। মাইকেলের আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আর ওদের নিয়েই তার জগত।

এমিলা কলেজে ভর্তি হলেও তার পড়াশোনায় একটুও মন ছিল না। আস্তে আস্তে সে নিজে থেকেই হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। রাতভর পার্টি করত, সোমকে ভুলে থাকার জন্য নেশা করতে শুরু করে আর সেই কারণে তার গ্রেজুয়েশন হয়নি। আর এই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অনেকে তার সুযোগ নিয়েছে। অবশ্য তাকে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছে মাইকেল আর অনামিকা। মাইকেলের সঙ্গে থেকে থেকে অনামিকা একটা অন্য জগতে চলে গিয়েছিল।

সোম বেশ কিছুদিন পর বাড়ি এসে এমিলার দেখা না পেয়ে মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিল। কাউকে কিছু বলতে পারছিল না আর কেউ তাদের ঠিকানাও জানে না । এরপর সোম লেখাপড়ায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়, এখন সে বড় ডাক্তার, নামী ক্যান্সার স্পেশালিষ্ট। ডাক্তার হবার পরপরই কয়েকদিনের ব্যবধানে তার বাবা মা দুজনেই চলে যান। এরপর সোম মুম্বাইতে  চলে যায় আর পশ্চিমবঙ্গে আসেনি। কিন্তু এমিলার জায়গায় কাউকে বসাতে পারেনি সোম। তাই ছয়ত্রিশ বয়সেও অবিবাহিত।

        হাসপাতালে এসে একটু বিশ্রাম নিয়েই  রোগী দেখতে বেরুলেন ডাঃ  সোমরাজ  বসু। তিনি আসবেন শুনে অনেকেই তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার ছোঁয়া পেলে নাকি অনেকে সুস্থ হয়ে যাবে। ডাঃ বসু ও খুব আন্তরিক ভাবে রোগী দেখতে থাকেন। তার কথা আর আন্তরিক ব্যবহারে খুব ভালো লাগে রোগীদের। কয়েকজনকে দেখার পর ডাঃ পিনাকী সেনগুপ্ত বললেন, ”ডাঃ বসু একজন মহিলা রোগীর একেবারে লাস্ট ষ্টেজ যদি একবার দেখতেন।“

 “কোন মহিলার কথা বলছেন?”

 “কেবিনে আছে, নাম এমিলা, শৈশব কেটেছে দার্জিলিং তারপরে মুম্বাই কলকাতা করে এখন এখানে, কেউ নেই আত্মীয় স্বজন। ওকে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়।“

এমিলা নামটা শুনেই ডাঃ বসুর মনে ভেসে ওঠে একটি চিরচেনা মুখ, তবু যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে বলে “আপনার পরিচিত কেউ?’’

 “অনেকদিন এখানে আছেন, একয়দিনে ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর যেমন পরিচয় ঘটে সেই অর্থে পরিচিতই বলা যায়!” দুজনের মুখেই অনাবিল হাসি ছড়িয়ে পড়ে। 

“ঠিক আছে চলুন দেখে আসি। কোথায় ক্যান্সার উনার?”

“লিভারে।“

“কত বয়স হবে মহিলার ?”

“চৌত্রিশ রিপোর্টে তাই লেখা আছে ।“

“বেশ চলুন।“

ডাঃ বসু কেবিনে ঢুকে যাকে দেখলেন তার সাথে শৈশবের এমিলার কোন মিল নেই। নিজের চোখকেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। এতো বছর পর তিনি এখানে এমিলার দেখা পাবেন ভাবতেই পারেননি। কিন্তু এমিলার একি অবস্থা হয়েছে!  গায়ের টুকটুকে ফর্সা রং তামাটে হয়ে গেছে, রুগ্ন শরীর,চোখ দুটো ভিতরে ঢুকে গেছে। মাথার এত সুন্দর চুল একটাও নেই ন্যাড়া মাথা। বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।

সোমরাজ মুহূর্তেই ডাঃ থেকে প্রেমিকে পরিণত হয়ে গেলেন । এগিয়ে গিয়ে বললেন, “এমিলা!”

“কে?” চোখ খুলে তাকাল এমিলা। প্রথমে চিনতে একটু কষ্ট  হচ্ছিল তার। সোমরাজের চেহারা অনেকটা বদলে গেছে, শরীর অনেকটা ভারী হয়ে গেছে, মাথার চুল অনেকটা কমে গেছে। একটু তাকানোর পর এমিলা তাকে চিনতে পেরে বলল, ”সোম দা তুমি এসেছ। যাই হোক মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতে পেলাম। এবার শান্তিতে মরতে পারব।‘

“কি বলছিস এমিলা! কি করে তোর এমন অবস্থা হল। আমি কত খুঁজেছি তোকে। কোথায় ছিলি এতদিন?”

এমিলা উঠে বসতে চাইল। সোমরাজ তাকে উঠে বসালেন । এমিলা ধীরে ধীরে বলতে থাকে, “মুম্বাইতে ছিলাম অনেকদিন। মা আর মাইকেল আঙ্কেলের সঙ্গে হোটেল ব্যবসায় নেমে পড়ি। নেশা করতে শুরু করি আর ধীরে নর্দমায় নেমে যাই। আমি শুনেছিলাম তুমি বড়  ডাক্তার হয়েছ আমার মতো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাবে না আমি জানতাম। এ জীবনে দুবার বিয়ে হয়েছে কিন্তু কারোর সঙ্গে ছয় মাসও ঘর করতে পারিনি। তোমার জায়গায় আমি কাউকে বসাতে পারিনি।“

“এখানে কি করে এলি?”

 “মা , মাইকেল আঙ্কেল দুজনেই মারা যাবার পর আর ওখানে থাকতে ভালো লাগছিল না একেবারে একা হয়ে পড়ি । ভাবলাম  এ জীবনে তো কোন সাধ পুরন হল না  বাকী জীবনটা একটু অন্যভাবে বাঁচি। তাই ওখানকার সবকিছু বিক্রি করে কলকাতায় চলে আসি। একটা অনাথ আশ্রমে টাকা দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করি। বেশ ভালো লাগছিল ওদের সঙ্গে থাকতে। নেশা করা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিলাম।  কয়েক বছর  ওখানে  থাকি আর ভাবছিলাম বাকি জীবনটা ওদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার কপালে অন্য কিছু লেখা ছিল। বছর খানেক আগে লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়েছে চিকিৎসা করাতে  সর্বসান্ত হয়ে যাই। এখন একেবারে লাস্ট ষ্টেজ কদিন বাঁচব জানি না!”

“তোর কিছু হবে না এমিলা আমি এসে গেছি যেমন করেই হোক আমি তোকে বাঁচাব।“

“তুমি কিছুতেই আমাকে বাঁচাতে পারবে না । আমি জানি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে সোম দা। আমার একটা শেষ ইচ্ছে পূরণ করবে তোমার স্ত্রী শুনলে হয়ত রেগে যাবে।“

“আমি এখনও বিয়ে করিনি রে পাগলী! কি তোর ইচ্ছে বল?”

“আমার খুব সাধ ছিল তোমার হাতে সিঁথিতে সিঁদুর পরব। আমার মাথায় একটুও চুল নেই তাই তুমি আমার সিঁথি বিহীন মাথাতেই সুন্দর করে সিঁদুর পরিয়ে দাও না গো তাহলে একটু শান্তিতে মরতে পারব। বিয়ে দুবার হলেও আমি সিঁদুর পড়তে পারিনি কারন ওরা দুজনেই ক্রিশ্চান ছিল।“

“আমিও যে তোকে সিঁদুর পড়াব বলে এতদিন থেকে বসে আছি রে তুই ছাড়া আর কাউকে মনে জায়গা দিতে পারিনি।“ বলে পিনাকিবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ”আমি সব বুঝেছি ডাঃ বসু। এখনই সিঁদুর আনার ব্যবস্থা করছি। আপনাদের ভালোবাসা দেখে আমার চোখে জল এসে গেল।“

পিনাকিবাবু একটু পরেই সিঁদুর নিয়ে এলেন। সোম এমিলার সিঁথি বিহীন মাথায় সুন্দর করে সিঁদুর পড়িয়ে দিল। দুজনের চোখ বেয়ে জল পড়ছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন পিনাকিবাবু চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন। তিনি আর এখানে থাকতে পারছেন না। সোমরাজের বুকে মাথা রেখে এমিলা ধীরে ধীরে বলল, ”খুব শান্তি পেলাম!”

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটল। সোমরাজ বলল, ”এখন শুয়ে থাক এমিলা।“

সোমরাজের সিঁদুর মাথায় নিয়ে এমিলার বাঁচার সাধ জেগেছে সে আর মরতে চায় না আর ডাঃ সোমরাজ বসুও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যেমন করেই হোক তিনি এমিলাকে বাঁচাবেই!   

এমিলা সোমরাজের দুহাত চেপে ধরে বলল, ”সিঁদুরের বড় জোর সোমদা! আমি এখন বাঁচতে চাই আমাকে তুমি বাঁচাবে তো!”

সোমরাজের চোখে জল এসে যায়। বলে, “আমার সব শক্তি এক করে হলেও আমি তোকে বাঁচাব রে পাগলী!”

  

  

   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত