ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-৪) । জয়তী রায় মুনিয়া
বন্ধুরা, সু স্বাগতম। চিন্তামণির দরবার খুলে গেছে। আজকের বিষয় একটু অন্যরকম। বলা যায়, আমরা যারা সোনার হরিণের পিছনে দৌড়ে চলেছি, কি পাচ্ছি শেষপর্যন্ত?
আসুন। আলোচনায় বসা যাক।
কোনো কাজ কেন করি?
বিভিন্ন মতামত উঠে আসতে পারে, একটি বহুল প্রচারিত মত হল, প্যাশন। অর্থাৎ আবেগ। যে কোনো কাজ করি না কেন, চালিকা শক্তি কিন্তু আবেগ। আবেগ থেকে উৎসারিত এনার্জি। সেই এনার্জি শক্তি জুগিয়ে চলে নিরন্তর। তার ফলে, হাজার বাধা বিপত্তির মধ্যেও কাজ করে চলি। কেউ কেউ ছবি এঁকে চলেন, কেউ গান গাইছে, কেউ লিখছে। সবসময়ই যে সেগুলি প্রফেশন হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে তার কোনো মানে নেই, তবু , কাজটা করছে। অদ্ভুত ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে করে যাচ্ছে। অফিস করে ঘরের কাজ করে সারাদিন প্রচুর ঝামেলা সামলে বসে পড়ছে নিজের আবেগের কাছে নতজানু হয়ে। হয়ত কিছু না কিছু সাংঘাতিক দায়িত্ব আছে, সেটা করতে করতেও এই ধরণের কাজ না করে তাদের ভালো লাগে না। আবার করলেই একটা শান্তি, আনন্দ। মন ভালো থাকে।
এই হল মূল কথা, মন ভালো থাকে। একবার একজন আমায় বলেছিলেন, আপনি যদি না লিখতেন তাহলে সাধারণ এন আর আই হয়ে থাকতেন। নাহ্। কথাটা মানতে পারিনি। লিখতে ভালোবাসি কিন্তু লেখার উপর আমার সুখী হওয়া নির্ভর করছে, এটা মানতে পারি না। মনে রাখতে হবে, যে কোনো কাজ, সাফল্য অথবা ব্যর্থতা দুই ই বহন করে। তৃপ্তি এবং অতৃপ্তি দুটোই থাকবে। যে কাজটাই করি না কেন, সেটি যদি আমার রুজি রোজগার ও হয়, তবুও, ব্যর্থতা , অতৃপ্তি আসতেই পারে। তৃপ্তি- অতৃপ্তি আলো অন্ধকারের মতই সত্য। এখন , সমস্যা হল, যেই মাত্র অতৃপ্তি এলো, ব্যর্থতা এলো, তক্ষুনি মন খারাপ হল। অর্থাৎ, যে কাজ আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা থেকে উৎসারিত ছিল, সেই কাজ থেকে উৎপন্ন হচ্ছে মন খারাপ। হয়ত হার মেনে নিচ্ছি না। হয়ত কাজ ছেড়েও দিচ্ছি না, তবু মন খারাপ লেগে আছে কুয়াশার মত।
বহু সময় এইরকম নেতিবাচক কথা বন্ধুদের কাছে শুনতে পাই। আর ভালো লাগছে না। কারণ স্বরূপ বহু অভিযোগ আদান প্রদান হয়। কিছু ক্ষেত্রে সেগুলি সত্য তো বটেই। সঙ্গত কারণে বঞ্চনা এবং সে থেকে উৎসারিত বিষাদ… মন খারাপ হতেই পারে। ঘটনা দাঁড়াল এই যে, তৃপ্তি: মন ভালো করছে — অতৃপ্তি: মন খারাপ করছে। ফল স্বরূপ, আমি এমন কিছু উক্তি ব্যবহার করছি অথবা ভাবছি, সেখানেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমার মনের জমি।
আরো পড়ুন: ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-৩) । জয়তী রায় মুনিয়া
এই ব্যাপার কিন্তু, বহু বিখ্যাত ব্যক্তির জন্যও সত্য। তারা বরং আরো কষ্টকর এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করেন। প্যাশন বহু ক্ষেত্রে পানিশমেন্ট হয়ে যায়। না পারেন ছেড়ে দিতে আর ধরে রাখতে গিয়ে প্রতিদিন অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। বিখ্যাত লোকেদের গালাগালি ও খেতে হয় প্রচুর। ঈর্ষা মিথ্যা বদনাম তো থাকেই। উল্টে, কোনোদিন যদি তাদেরও এমন কিছু বলতে বাধ্য হতে হয় বা বলেন সেটা ভিতর মনের বহু গভীরে গিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে। আজ না হয় কাল অন্যায়বোধ পীড়া দেবেই। মানুষ যতই ভাবুক, আমার ক্ষমতা আছে, বেশ করেছি। সেটা হয় না। শুভ– অশুভ বোধ মানুষের মধ্যে আছেই। একজন অসৎ মানুষের মধ্যে শুভ বোধের প্রাবল্য কম, তাই তারা হয়ত অক্লেশে অন্যায় করেন, কিন্তু, মনোবিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত যে, কোনো কিছুই বিনষ্ট হয়ে যায় না। অবচেতন মনে গিয়ে জমা হয়। সেইগুলো কিন্তু একদিন বিষবাষ্পের মত মস্তিষ্কে আঘাত করে। যে কারণে, এমন কিছু করতে নেই, যা আমার অবচেতন মনে গিয়ে আবর্জনার সৃষ্টি করবে। ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে, ক্ষমতাবান প্রভুদের কথাই শেষ কথা নয়।
ঘুরে ফিরে সেই আমি। বেদ বারংবার বলেছে , আমি কে সুখী করো। এবার সহজ অঙ্ক হল, সুখী আর সফল কতটা একে অপরের পরিপূরক? সফল হলেই সুখী হবে? নাহ্। তার কোনো মানে নেই। কিন্তু, সুখী মানুষ সফল হলেও হতে পারে। এখন, কেউ ভাবতে পারে, যদি কিছু করতে না ই পারলাম , তাহলে সুখ আসবে কি করে? মুশকিল হল, এইখানে অঙ্ক গোলমাল হয়ে যায়। কিছু তো করতেই হবে। ব্যবসা, লেখা, আঁকা … যাই হোক, এই কিছু করার ক্ষেত্রে প্রাপ্তি নিশ্চিত না ও হতে পারে সেটার জন্য মন প্রস্তুত থাকতে হবে। যেই পেলাম না, অমনি নেতিবাচক চিন্তা শুরু হল… অমুক পেল আমি পেলাম না। সেইসঙ্গে আরো অনেক কুৎসা রটনা। একে অপ্রাপ্তি তার সঙ্গে অপ্রিয় কথা… ফলত … সুখ গেল দূরে সৃষ্টির মান গেল নিচে।
জীবনের মূল লক্ষ্য আমি যেন ভালো থাকি। হতেই পারে পরিস্থিতির শিকার হয়ে লোকসান হয়ে গেল। যতটুকু পাওয়ার পেলাম না। বই লিখলাম, পাঠক নিল না। এই পরিস্থিতি একটাও আমাদের হাতে নেই। যেটা আছে , সেটা হল, আমার মন। সেই মন যেন অতৃপ্ত না থাকে। অসুখী না থাকে। লোকে ব্যর্থতা নিয়ে উপহাস করুক, আমার স্থিতি হেলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা হবে না কারো। স্থিতি স্থির চরিত্রের মুখে একটা ছাপ ফুটে ওঠে। সে ছাপ সুখের ছাপ। পৃথিবীর কোনো ব্যর্থতা সেই সুখ কেড়ে নিতে পারবে না।

জন্ম কলকাতায় হলেও কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে হয় দেশ বিদেশে। কখনো আমেরিকা তো কখনো থাইল্যান্ড কিংবা লন্ডন। আদতে নিজেকে ভ্রামণিক বলতেই ভালবাসেন। মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করা যদি পেশা হয় তাহলে নেশা হলো নানান বিষয়ে লেখালেখি। গল্প,প্রবন্ধ ও পৌরাণিক চরিত্র কথনের আঙিনায় অবাধে বিচরণ করেন তিনি। রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্র বিশ্লেষণে বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন অল্প সময়েই। পেশার চাপ সামলেও কলকাতার বহু নামী পত্রিকায় লেখেন নিয়মিত। এছাড়াও লেখেন নানান ওয়েব পত্রিকায়। প্রকাশিত বই “সুপ্রভাত বন্ধুরা”, “ব্রহ্মকমল”, “দ্রৌপদী” ও “ছয় নারী যুগান্তকারী”। শেষোক্ত বইটি ২০১৯ এর বইমেলায় পত্রভারতীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়ে অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দেশ পত্রিকার অনুগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম দশজনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। টার্মিনাসের তরফে পেয়েছেন পুরস্কার। আমন্ত্রিত অতিথিরূপে সম্মাননা পেয়েছেন ত্রিপুরায় দুই বাংলার সাহিত্য শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন স্কুলে মহাভারত নিয়ে বক্তব্য রাখার ডাক পড়ে মাঝে মাঝেই।
কাজ করেন মূলত মানুষের মন নিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জীবনের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অনুপ্রেরণা দেয় প্রতিনিয়ত।