তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: সে থাকে পাশে । ফাহমিদা বারী
রাত ক’টা বাজে এখন? দেড়টা নাকি দুটো?
সুরভি বিছানায় গা এলানোর পর থেকেই এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে। ঘুমের চৌদ্দগুষ্টির দেখা নেই। অথচ পাশেই অঘোরে ঘুমোচ্ছে সৈকত। মৃদু নাক ডাকছে। দিনদুনিয়ার কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। কী শান্তির ঘুম! সুরভির খুব ঈর্ষা হলো। ইচ্ছে হচ্ছে, একটা খোঁচা মেরে সৈকতের ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয়। পাশেই একজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে, অথচ আরেকজনের ঘুমে কোনোই ব্যঘাত ঘটছে না!
ভাবতে ভাবতে সত্যি সত্যিই সৈকতের বাহুতে কনুই দিয়ে একটা খোঁচা মেরে দিলো সুরভি। দিয়েই বুকটা ধবক করে উঠলো। সৈকত যদি রেগে যায়!
সৈকত ঘুমের মধ্যেইমুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে পাশ ফিরলো।একটু পরেই আবার ওর নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো।
প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস লাগছে সুরভির। বিদ্যুৎ চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। ঘরের জানালার পাল্লা হাট করে খুলে রাখা। কোনো বাতাস আসছে না। কেমন একটা গুমোট অবস্থা! ঝড় বৃষ্টি হবে হয়ত। নাহ, এভাবে বিছানায় পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। সুরভি মশারীর একদিক উঠিয়ে বিছানা থেকে বের হয়ে এলো।
সৈকত ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। ওকে আর খোঁচাখুঁচি করে কাজ নেই। বেডরুমের দরজা আস্তে করে খুলে লাগোয়া বারান্দাটায় এসে বসলো সুরভি। নিস্তব্ধ অসাঢ় বিশ্বচরাচর। একটা প্রাণীরও সাড়াশব্দ নেই। নিশাচর প্রাণীরা সব কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? আজ কি ওদেরও অফডে চলছে?
ইনসমনিয়া কোনোকালেই ছিল না সুরভির। কিন্তু দিনকে দিন ওর এই নির্ঘুম রাত কাটানোটা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
সৈকতের ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। সারাদিন অফিস করে এসে বিছানায় পড়ামাত্রই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমায়। অবশ্য অন্তরঙ্গতার অংশটুকু বাদ দিয়ে। সেই কাজে কোনোরাতেই বিরাম নেই।
সৈকত ঘুমিয়ে পড়ার পর বিছানায় ছটফট করতে করতে সুরভি হাঁপিয়ে ওঠে। অনেক রাতে বহুকষ্টে ঘুমের দেখা মেলে। সকালে ঘুম ভাঙে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে। এই চলছে বেশ কয়েকমাস ধরে।
প্রায় দেড় বছর হলো বিয়ে হয়েছে ওদের। এখনো দুজন দুজনকে ষোলআনা বুঝতে পেরেছে, এই দাবী করতে পারে না। শরীরের খানাখন্দ পেরিয়ে মনের অলিগলি ঘুঁপচিতে ঢুকতে সময় লাগছে। লাগারই কথা, তবু বেহিসাবি অভিমান কোত্থেকে যে এসে জড়ো হয়!
সৈকতকে ওর সমস্যাটার কথা বলতেই এক গাল হেসে বলেছে, ‘দুপুরের ঘুমটা বাদ দাও। রাতে তোমারও তাহলে শান্তির ঘুম হবে!’
যত সব বাজে কথা! সৈকত ওর সমস্যার ধারকাছ দিয়েও গেল না! দুপুরে কোনোকালেই ঘুমের অভ্যাস ছিল না সুরভির। চটজলদি সমাধান বাতলে দেওয়াটা সৈকতের একটা বাতিক। আসল সমস্যা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না সৈকত। নাকি আসলে সুরভির সমস্যা নিয়ে ওর কোনো আগ্রহই নেই?
রাজ্যের ভাবনা এসে ভিড় করছে মাথায়। খুব খারাপ লক্ষণ। আজ মনে হচ্ছে বাকি রাতটুকুও এভাবেই কাটবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুরভি।
আকাশটা মিশমিশে কালো হয়ে আছে। বুকভর্তি বুঝি মেঘ জমে আছে আকাশের। অপেক্ষা করছে কখন অঝোরে ঝরে নিজেকে হালকা করে নিতে পারবে। সেই নিঃসীম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুরভির মনে হলো, ইস! কেউ যদি পাশে এসে বসতো এখন! কত গল্প জমে আছে সুরভির বুকে! সেই গল্পগুলো শোনার জন্য একটি মানুষও কি জেগে নেই?
ঠিক তখনই কিছু একটা হলো।
চারপাশ গুমোট নিস্তব্ধ হয়েই ছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তেই সুরভির মনে হলো, ঠান্ডা হিমেল একটা বাতাস বুঝি বয়ে গেল ওর চারপাশ ঘিরে। অবশ্য সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য। চমকে আশেপাশে তাকালো সুরভি। বাতাসের যদি প্রাণ থেকে থাকে, তাহলে একটু আগেই সেটা ওর সাথে কথা বলেছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে গেছে তাকে।
নিজেকে তিরস্কার করলো সুরভি। ঘুম না আসা তো নিয়মেই দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু তাই বলে মাথাটাও কি একইসাথে খারাপ হতে হবে? বাতাসের কি হাত আছে নাকি যে, স্পর্শ করবে?
কিন্তু ভাবনাটাকে কিছুতেই সরাতে পারছে না। কিছু একটা…সুরভি জানে না কী সেটা, কিন্তু কিছু একটা এই মুহূর্তে সুরভির খুব কাছেই আছে। সেটা বুঝি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললো…এই তো এক্ষুণিই! সুরভির সারাশরীর বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে গেল। কেউ আছে…সুরভি নিশ্চিত এখানে ও একা নয়। ওর পাশে কেউ একজন আছে।
এক ছুটে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো সুরভি। বিছানায় শুয়ে ভালোভাবে মশারি গুঁজে কাঁপতে লাগলো ঠকঠক করে। একবার ইচ্ছে করলো, সৈকতকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সৈকতের ঘুম ভেঙে যেতে পারে ভেবে কাজটা করলো না। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো নিঃসাড় হয়ে।
পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল। সৈকত ডাকাডাকি করে বাসা মাথায় তুলে ফেলেছে।
‘সুরভি এ্যাই সুরভি…এখনো ঘুমাচ্ছো কেন? ওঠো…শিগগির ওঠো! আমার নাস্তা দিতে হবে না? আজ একটা অফিসিয়াল ট্যুর আছে বলেছিলাম তোমাকে। ইস! দেরিই হয়ে গেল! দূর!’
রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে সৈকত অবিরাম কথা বলে যাচ্ছে। সুরভি বহুকষ্টে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুললো। গতরাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, কিছুই এখন আর মনে নেই। শুধু ভয় পাওয়ার পরের অনুভূতিটুকু এখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে যেন। এটা কী হলো ওর সাথে? ভেবেছিল, সকালবেলা সৈকতকে সবকিছু খুলে বলবে। কিন্তু সৈকতের দৌঁড়ঝাঁপ দেখে বুঝতে পারলো, আজ আর সারাদিনে ওর টিকিটারও সন্ধান পাওয়া যাবে না!
সৈকত বের হয়ে যাওয়ার পরে সারাদিন মুহ্যমান হয়ে পড়ে রইলো সুরভি।আজ আর কাজকর্ম কিছু করতে মন চাইছে না। মন আর শরীর জুড়ে কেমন একটা ক্লান্তি। ইচ্ছে করছে সারাদিন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে।
তবু চিন্তার পাখির পায়ে শিকল পরাতেই হলো। কলেজের বন্ধু রিমার ফোন পেয়ে তড়াক করে উঠে পড়লো সুরভী।রিমার ফোন মানে সারাদিনের মৌজ মাস্তি আর লম্বা আড্ডার পরিকল্পনা। হলোও তাই! ফোনটা ধরতেই রিমা ওপাশ থেকে ঝড়ের বেগে বললো, ‘চটপট রেডি হয়ে নে! আজ দিনভর যমুনা ফিউচার পার্ক আমাদের দখলে থাকবে!’
সুরভি হাসতে হাসতে ফোন রাখলো। রিমার কথাবার্তাই এরকম। সবসময়ই ওর হাত যেন ঘোড়া্র জিনে লাগানো থাকে। তবে মেয়েটা বেশ মজার। ওর সাথে কাটানো সময়টা খুব আনন্দেই পার হয়।
ফুরফুরে মেজাজে রেডি হতে শুরু করলো সুরভি। বহুদিন পরে আজ শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে। যদিও জানে, রিমা জীবনেও শাড়ি পরবে না। রিমার মতে, শাড়ি নাকি অকাজের পোষাক। যাদের খেয়েদেয়ে হাতে অফুরন্ত সময় থাকে, তারাই শাড়ি পরে!
রিমা যা বলে বলুক, আজ শাড়িই পরবে সুরভি। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে নীল এণ্ডি সিল্কের দারুণ একটা শাড়ি গিফট করেছে সৈকত। ইচ্ছে ছিল, এই শাড়িটা পরে ওর সাথেই বেড়াতে যাবে। কিন্তু সৈকতের হাতে সময় থাকলে তো! ইদানিং ছুটির দিনগুলোতেও বাসায় কাজ করতে শুরু করেছে। সারাদিন মাকড়সার মতো ল্যাপটপের সাথে লেগে থাকে। সুরভির জন্য বরাদ্দকৃত সময় এখন বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
অকারণে জমে ওঠা মনের বাষ্পকে মুছতে মুছতে সাজগোজের পেছনে সময় দেয় সুরভি। নীল একরঙ্গা শাড়ির সাথে সবুজ হলুদ কমলার একটা মাল্টিকালার ব্লাউজ পরে নিলো।খুব যত্ন নিয়ে মেকআপ করলো বেশ অনেকদিন পর। মনটা ফুরফুরে লাগছে। গতকাল রাতের ঘটনাটা মন থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে। কী না কী হয়েছিল, সে সেটাকেই টানতে টানতে কত্ত বড় বানিয়ে ফেলেছে! এখন মনে পড়তেই কেমন হাসি পাচ্ছে!
উবার ডেকে যমুনা ফিউচার পার্কে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। রিমা ওকে আড়ং এর আউটলেটের আশেপাশে থাকতে বলেছে। সুরভি আশেপাশের পুরো জায়গাটা চক্কর কাটলো। রিমার দেখা মিললো না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন করতে যাবে এমন সময়েই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। রিমাই ফোন করেছে।
‘সুরভি…সরিরে…কী একটা ঘটনা যে ঘটে গেল! বাসা থেকে বের হতে যাবো এমন সময়ই এক্সিডেন্ট! আমার ছোটভাইটার মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসে এই এতক্ষণে তোকে ফোন দেওয়ার সময় পেলাম। আজ আর যেতে পারবো না রে!…’
সুরভি ফোনটা বন্ধ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালো। সকালের গুমোট অস্থিরতাটা আবার ফিরে আসছে একটু একটু করে। মন জুড়ে ভর করছে বিষণ্নতা আর একাকীত্ব। কী চমৎকার একটা দিন কাটাবে ভেবেছিল আর কী হয়ে গেল!
মোবাইল ফোনের কনট্যাক্ট লিস্টে সৈকতের নাম্বারটা বের করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। একটা ফোন দিবে সৈকতকে? কাজ ফাঁকি দিয়ে চলে আসতে বলবে আজকে? ইচ্ছেটা মনের মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগলো অনেকক্ষণ। তবে ফোনটা দিলো না শেষমেষ। একবার কাজের মাঝখানে ফোন দেওয়াতে সৈকত ভীষণ রাগ করেছিল। সেইদিনের কথাটা মনে পড়ে গেল।
কিন্তু এখন কীভাবে সময় কাটবে ভেবে পাচ্ছে না কিছুতেই!প্রথমে ইচ্ছে করছিল বাসায় চলে যেতে। সেই ইচ্ছেটাও বাতিল করে দিয়ে একটা সিনেমার টিকিট কেটে ফেললো সুরভি।চুলোয় যাক সবার ব্যস্ততা! সুরভি আজ নিজের সাথেই সময় কাটাবে!
জেদের বশে কোন ছবির টিকিট কেটেছে দেখেওনি ভালো করে।সিনেমাহলে ঢুকে মেজাজ আরেকদফা খারাপ হলো। পুরো হল প্রায় অর্ধেকের বেশি ফাঁকা। ইতিউতি দু’চারজন ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে বসে আছে।কয়েকজোড়া কপোত কপোতী চোখে পড়লো। খুব কায়দামত সিট বাগিয়ে পরষ্পরকে নিয়ে ব্যস্ত তারা। আলোতে সেই ব্যস্ততায় যথেষ্টই বিঘ্ন ঘটছে। বোঝাই যাচ্ছে, সিনেমা হলের বাতি নিভে গেলে ওসব জায়গায় অন্য সিনেমা শুরু হয়ে যাবে।
সুরভি অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে পপকর্ণে কামড় দিতে থাকে। সেও নিরিবিলি একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসেছে। ফাঁকা সিনেমাহল, প্রত্যেকে খেয়ালখুশিমত বসে পড়েছে। না চাইতেও বার বার কপোত কপোতীগুলোর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে সুরভির।কী এমন ক্ষতি হতো, যদি ওর পাশেও এমন ভালোবাসার কেউ থাকতো?
একটু পরেই সিনেমা হলের বাতি নিভে গেল। সুরভি সিনেমা দেখায় মন দিতে চাইলো। কিন্তু দিতে পারলো না। অজান্তেই চোখ চলে গেল পাশের সিটে। নিজের শরীরে খুব আলতো একটা ছোঁয়া যেন অনুভব করলো সুরভি। চমকে উঠলোমনে মনে। প্রায় নির্জন সিনেমাহলে দুষ্ট প্রকৃতির কারো টার্গেটে পরিণত হলো না তো? ভাবনাটা খুবই সময়োচিত। একা তরুণী দেখলেই কত জনের মনে কত কী ইচ্ছা কিলবিলিয়ে ওঠে!
কিন্তু নাহ! পাশে তো কেউ নেই! পেছনে তাকালো একবার ঝট করে। উহুঁ! পেছনের সিটেও কেউ বসে নেই! তাহলে কার স্পর্শ অনুভব করছে সুরভি? কেন মনে হচ্ছে ওর পাশে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে আছে কেউ? আর…সে যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে! একদৃষ্টিতে!
শরীরটা একেবারে শিউরে উঠলো সুরভির। গতকাল রাত থেকে এসব কী হচ্ছে ওর সাথে? কে ওকে সঙ্গ দিচ্ছে? যখনই মনের মধ্যে একাকীত্বটা প্রবল হয়ে উঠছে, তখনই কেউ যেন চুপিসারে সঙ্গ দিচ্ছে ওকে! অথবা বলা যায় ওর ইচ্ছেটাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে! দূর এমনও কি হয় নাকি? কিন্তু কাল রাত থেকে পর পর দুটো ঘটনাই বলে দিচ্ছে, ঠিক এমনটাই হচ্ছে ওর সাথে।
এই তো এখনো কারো উপস্থিতি অনুভর করে চলেছে সুরভি। পাশে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে, সেই জনা একেবারে নির্নিমেষে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতেও বুঝি ভুলে গেছে সে!
আর এক দণ্ডও সেখানে বসে থাকলো না সুরভি। অনেকগুলো বিস্মিত বিরক্ত মুখের সামনে দিয়ে দ্রুতপায়ে বের হয়ে এলো সিনেমাহল থেকে। শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে বের হতে হতে উবারে কল দিলো। স্থিরভাবে দাঁড়াতে পারছে না সুরভি। এক্ষুণি বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে!
বাসায় ফিরেও ভয়ে ভয়ে সময় কাটতে লাগলো। ছোট্ট একটা আওয়াজেও চমকে চমকে উঠতে লাগলো। বারকয়েক সৈকতের নাম্বারে ফোন দেওয়া হয়ে গেছে। কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও সৈকত ফোন ধরেনি। শেষবার ফোন ধরে বিরক্তি মেশানো গলায় বলেছে, ‘আহ্! এখন ফোন দিয়েছো কেন? জরুরি মিটিং এ আছি। পরে কথা বলবো!’
সুরভির কথা না শুনেই ফোন কেটে দিয়েছে সৈকত। বিমূঢ় মুখে বসে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে পানি পড়েছে টপ টপ করে। আশ্চর্য! নতুন বিয়ে করা বউকে কেউ এত অবহেলা করে? আজ যাকে ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই তার হাতেই কোনো সময় নেই ওকে দেওয়ার মতো!অভিমান জমা হয়ে বুকের ভেতরে গাঢ় পর্দা এঁটেসেটে বসে। নিজেকে কখনো আর এভাবে খেলো করবে না সৈকতের কাছে!
সেদিন রাতে আর অহেতুক ঝুঁকি নিতে গেল না সুরভি। ঘুম আসবে না জেনেও প্রাণপনে সেঁটে থেকেছে বিছানার সাথে। একবারের জন্যও বারান্দায় যাওয়ার চেষ্টা করেনি।
সৈকত যথারীতি বাসায় ফিরে একগাদা কাজের ফিরিস্তি শুনিয়েছে। সুরভি চুপচাপ শুনে গেছে। কোনো প্রশ্ন করেনি। সে কেন তাকে ফোন দিয়েছিল, এই কথা একবারও জিজ্ঞেস করেনি সৈকত। সুরভিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি।
রাত্রে বিছানায় গিয়েই সৈকত ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে সুরভির ওপরে। সুরভি মাথাধরার অযুহাতে পাশ ফিরে শুয়েছে। না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছে, ক্ষুব্ধ সৈকত আহত অপমানিত বাঘের মতোই ফোঁসফোঁস করছে। মুখের খাবারকে ফিরিয়ে নিলে বাঘের যেমনটা লাগে, সৈকতের মনোভাবটাও এখন ঠিক সেইরকম।
সুরভি অপেক্ষা করতে লাগলো কিছু একটা শক্ত কথা শোনার। তা অবশ্য শোনা গেল না। কিছুক্ষণ পরে ভোঁসভোঁস নাকডাকার আওয়াজ শোনা গেল। অন্যদিনের চেয়ে আজ যেন একটু বেশিই জোরে হচ্ছে আওয়াজটা।
বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝোড়ো বাতাস বইছে। সেদিকে আনমনে তাকিয়ে থেকে সুরভির মনেও কিছু একটা যেন বিদ্যুৎচমকের মতো উঁকি দিয়ে গেল। একটা মুখ…সেই মুখ একজন কিশোরের। নির্বিবাদী শান্ত গোবেচারা একটি মুখ। সেই মুখে রাগ ক্ষোভ অপমান কোনো কিছুরই ছায়া পড়ে না। শুধু ভালোবাসার ছায়া সেই মুখ কিছুতেই লুকোতে পারে না।
ঝোড়ো বাতাসটা বেড়েছে। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসেরা এদিক ওদিকে ছুটে যাচ্ছে। সুরভির মন তখন অন্য কোথাও চলে গেছে। একটা টিনের চালাদেওয়া ইটের গাঁথুনির স্কুলঘর। টিনের চালায় জোর বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। সুরভি ভয়ে কাঁদছে। একটু দূরে বসে আছে একটি ছেলে। বয়স পনেরো ষোল বছর। চৌদ্দ বছরের কিশোরী সুরভির সারাশরীর ভয়ে রোমাঞ্চিত। এই স্কুলঘরে তারা দুজন মাত্র প্রাণী। আর কোথাও কেউ নেই। ছেলেটা তার কোনো ক্ষতি করবে না তো? এভাবে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে কী দেখছে ছেলেটা?
ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে সুরভি। মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে সে বেশ কিছুদিন গ্রামে ওর নানা-নানীর কাছে ছিল। সুরভির মা তখন শহরে থেকে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া নিজের গ্রাজুয়েশন শেষ করছে। সুরভির নানা গ্রামের প্রভাবশালী অর্থবান মানুষ। দশজন তার কথাকে আলাদা গুরুত্ব দেয়।
ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার ঝগড়া দেখে বড় হওয়া সুরভি কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলতো সবকিছুতে। সহজে কোনোকিছু বুঝতে পারতো না। গ্রামের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েও অন্য সবার চেয়ে সবকিছুতেই কেমন যেন পিছিয়ে পড়তো সবসময়।
সেদিন ছিল বর্ষাকালের একটি দিন।
গ্রামের বাদলাদিনের তোড়জোড়ই অন্যরকম। এক ক্লাস শেষ হতে না হতেই সব ছেলেমেয়ে একে একে বের হয়ে গেল স্কুল থেকে। আকাশে ঘন করে মেঘ করেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ছেলেমেয়ের মন আর স্কুলে পড়ে নেই। শিক্ষকরাও ফাঁকতালে ফাঁকি মারার ফন্দিফিকির করছে।
সুরভি মন দিয়ে নিজের হোমওয়ার্ক করছিল। স্কুলঘর কখন ফাঁকা হয়ে গেছে, টেরও পায়নি সে। যখন টের পেয়েছে, তখন নিজেকে আবিষ্কার করেছে একদম একা। শুধু বছর দুয়েকের বড় একটা ছেলে একটু দূরে বসে একদৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করছে।
সুরভিকে ভয়ে কাঁপতে দেখে ছেলেটা বলে, ‘তুমি একা বসে আছো দেখে আমি বসলাম তোমার কাছে। ভয়ের কিছু নাই। বৃষ্টি থামলে বাড়ি যাইও। আমারে দেখে ভয় পাইছো? আমি চলে যাবো?’
ততক্ষণে সুরভির ভয় কেটে গেছে। আর যাই হোক, ছেলেটার মনে কোনো বদ মতলব নেই। সুরভি দু’পাশে মাথা নাড়ায়। ছেলেটা থাকাতে এখন যেন কিছুটা সাহস পাচ্ছে। ছেলেটা আবার বলে, ‘আমার নাম সাগর। আমি এই গ্রামেরই ছেলে। ক্লাস টেনে পড়ি।’
দুজনের মধ্যে এটুকুই কথাবার্তা হয় সেদিন। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে সুরভি দ্রুতপায়ে বাড়ি রওয়ানা দেয়। পেছনে না ফিরেও বুঝতে পারে, ছেলেটা তার পিছে পিছে আসছে।
সেদিনের পর থেকে প্রায়ই পথেঘাটে সাগরের সাথে দেখা হয়ে যেত সুরভির। একটু যেন ঘন ঘনই। কেউ না বলে দিলেও সুরভির বুঝতে অসুবিধা হয় না, সাগরের চোখেমুখে মিশে আছে ভালোবাসার জলছাপ।
এরপরে স্কুলের অনেকেই কীভাবে কীভাবে যেন সুরভি আর সাগরের এই একাকী অবস্থানের খবরটা জেনে যায়। গ্রামের ছেলেপুলে খুব দুষ্ট প্রকৃতির হয়। সুরভি আর সাগরকে জড়িয়ে নানারকম আজেবাজে ছড়াও তৈরি করে কেউ কেউ। সেসব ছড়া মুখে মুখে চর্চিত ও সমাদৃত হতে থাকে।ধীরে ধীরে একসময় সুরভির নানার কানেও অনেক কথা ভেসে আসে।
সারাগাঁয়ে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে যাওয়ার আগেই সুরভির নানা পুরো গাঁয়ের মুখ বন্ধ করে দেয়। কীভাবে সেটা কখনোই সুরভি জানতে পারে না। শুধু সেদিনের পর থেকে ভালোবাসার জলছাপ আঁকা কোনো মুখের সাথে পথেঘাটে আর হুটহাট দেখা হয় না সুরভির। ইতিউতি চেয়ে দেখেছে মাঝে মাঝে। মনে মনে সেও কি খুঁজেছে কখনো? আজ এতদিন পরে সেটা অবশ্য আর মনে করতে পারে না।
সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে পরদিন অনেকটা বেলায় ঘুম ভাঙে সুরভির। সারাগায়ে জ্বর, মুখেচোখে অদ্ভুত উদ্ভ্রান্ততা। সৈকতের মতো নিরাসক্ত মানুষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস না করে পারে না, ‘কী হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন?’
সুরভি কিছুই বলতে পারে না। অবিশ্বাস্য অনুভূতিটা নিজেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। সৈকতকে কীভাবে বিশ্বাস করাবে? অযথা হাসির পাত্র করতে মন চায় না নিজেকে।
কিন্তু এরপর থেকে নিজের তীব্র গোপন কোনো ইচ্ছায় অদৃশ্য কেউ একজন ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।পাশে থেকে সুরভির হাতে হাত মেলায়। নিজের ইচ্ছেঘুড়িটার লাটাই হাতে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সুরভি… সেই কোনো একজন সেটাকে উড়িয়ে দেয় মুক্ত আকাশে।
ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে সুরভি। চারপাশে অদৃশ্য বলয়ের উপস্থিতি অনুভব করতে করতে বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যকার সামান্যতম পার্থক্যটুকুও আর অনুভব করতে পারে না একসময়। সৈকত নিজের ব্যস্ততাকে পাশে সরিয়ে রেখে এক সময় বাধ্য হয় সুরভির দিকে দৃষ্টি ফেরাতে।
সেদিন আর নিজেকে সামলাতে পারে না সুরভি। একটুখানি স্নেহের পরশেই ঝর ঝর করে বলে ফেলে মনের এতদিনের লুকিয়ে রাখা প্রতিটা কথা। নিজের আশেপাশে অনুভূত হওয়া অন্য আরেকজনের অস্তিত্বের কথা। স্কুলের সেই ফাঁকা ঘর, অঝোর বৃষ্টি, ভালোবাসামাখানো একটি কিশোরের মুখ…কোনোকিছুই বাদ দেয় না।
সৈকত কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সুরভির দিকে। তারপর হঠাৎ হা হা করে হেসে ওঠে প্রচণ্ড শব্দে। হাসির দমকে বুঝি দমই বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয় সৈকতের। হাসতে হাসতে বলে, ‘আচ্ছা…তাহলে তোমার মনে হচ্ছে, কেউ তোমার মনের ইচ্ছের কথা বুঝতে পেরে সেটাকে সত্যিতে পরিণত করছে? সেই ব্যক্তিটি আবার তোমার প্রাক্তন প্রেমকাংখী একজন কিশোর! হা হা হা…তা সুরভি, তোমার সেই কিশোরের বয়স বেড়েছে তো? নাকি এখনো সে সেই আগের বালকটিই রয়ে গেছে? এদিকে তোমার বয়স তো এখন সাতাশ বছর! একজন কিশোর ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাচ্ছো… ব্যাপারটা কি ভালো হচ্ছে?’
সুরভি বুঝতে পারে, মজা করছে সৈকত। ওর এই তীব্র ভয়মেশানো অনুভূতি কোনো ঢেউই তুলতে পারেনি সৈকতের মনের শক্ত বালুভূমিতে। পুরোটাই মস্ত এক হাসির খোরাক জুগিয়েছে মাত্র।
সুরভির দুঃখভারাক্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সৈকত হাসি চাপতে চাপতে বলে, ‘রাতে ঘুমাতে পারছো না। সেজন্য আজেবাজে স্বপ্ন দেখছো। নানারকম হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। এর বেশি কিছু নয়। আজ রাতে ঘুমের ঔষধ খাও। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। রাতে ঘুম ভালো হলে একাকীত্বও বোধ করবে না, আর তোমার সেই কিশোর প্রেমিকও পাশে এসে হাত ধরার চেষ্টা করবে না! হা হা হা…’
সৈকত অতি ভীষণ পাষণ্ডের মতো ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো।সুরভির মনে হলো, এই মানুষটা কি সত্যিই ওকে ভালোবাসে? যদি ভালোই বাসতো তাহলে এমন নিষ্ঠুরের মতো কি মজা করতে পারতো?তাহলে এই একসাথে থাকা, এক বাসায় বসবাস, এক বিছানা ভাগাভাগি করে ঘুমানো…এসবের প্রয়োজনটা কোথায়? যে ভালোবাসে না, কেয়ার করে না… তার সাথে কেন জীবনটাকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে? এই জীবনে তার উপস্থিতিরই বা কী এমন প্রয়োজন! পাশে না থাকলেই বা কতটুকু অভাব অনুভূত হবে? তার থাকাটা কি খুব জরুরি?
সুরভি ঘর বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। সৈকত কখন বেরিয়ে গেছে ও জানতে পারেনি।
পাশে রাখা সুরভির মোবাইল ফোনটা তারস্বরে বেজে চলেছে। একজন পুলিশ অফিসার ফোনটা করেছেন। মাইক্রোবাসের সাথে সংঘর্ষে একটি প্রাইভেট কারের দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাইভেট কারের আরোহী ঘটনাস্থলেই মারা গেছে।তার প্যান্টের পকেটে রাখা ফোন থেকে ‘ওয়াইফ’ লেখা নাম্বারটাতে কল দিয়েছেন তিনি। রিং হচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে ফোনটা কেউ রিসিভ করছে না।
সুরভি আজ বহুদিন পরে প্রাণভরে ঘুমাচ্ছে।
গত কয়েকদিনের ঘুমকে আজ বুঝি একদিনেই পুষিয়ে দিবে!ফোনের আওয়াজ ওর কানে ঢুকছে না।
সুরভির চারপাশে কে যেন মিষ্টিমধুর কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রিয় কোনো সুবাস। কতদিন এমন শান্তিতে ঘুমায় না সুরভি! আশেপাশে কেউ তীক্ষ্ণ সযত্ন নজর রাখছে, সুরভির ঘুমটা যাতে না ভাঙে।
ঘুমাক সুরভি। ছায়ার মতো ওর পাশেই আছে সেই জন…
গল্পকার,
রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল নিয়ে পড়ে এখন নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।