Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,সৌরভের

প্রাচীন সৌরভের ফিরে আসা । শওকত হোসেন

Reading Time: 6 minutes

গন্ধসারের ইতিহাস জাদু চর্চার অনিবার্য অংশ ভেষজ ওষুধের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। বিভিন্ন ধরনের টুকটাক রোগবালাইয়ের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য কাজেও ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলার উপায় যোগানোর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল এটা। বেশিরভাগ প্রাচীন সংস্কৃতিতে মানুষ বিভিন্ন গাছপালার জাদুকরী শক্তিতে বিশ্বাস করে এসেছে। হাজার হাজার বছর ধরে গুল্ম, লতা ইত্যাদি ওষুধ এবং খাবারের পাশাপাশি আচার পালনেও ব্যবহৃত হয়েছে। ভেষজ ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরাও বিভিন্ন সমাধিতে গুল্মের উপস্থিতি ওষুধ বাদে এসবের ক্ষমতার পক্ষেই সাক্ষী দেয়। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল গাছপালার মনের অস্তিত্বে তার বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। 

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আদি সংস্কৃতিতে তেল এবং সুগন্ধি হিসাবে সুরভিত গাছপালা ধর্মীয় ও চিকিৎসার উপকরণ ছিল। এছাড়া, সুরভি ও সুগন্ধি তেলের ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত ছিল প্রায় সর্বজনীন রেওয়াজ। ধর্মীয় আচারে সুগন্ধি পোড়ানোর মাধ্যমে দৈহিক ও আত্মিক, পার্থিব ও ঐশ্বরিক জগতের মাঝে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হতো। ইংরেজি পারফিউম কথাটা এসেছে লাতিন ‘পার’ অর্থাৎ ‘মাধ্যম’ এবং ফিউম, মানে ‘ধোঁয়া’ থেকে। সুগন্ধির ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে স্বর্গের সাথে সংযোগ স্থাপন করার বিশ্বাস সর্বজনীন ছিল। 

দেবদেবীরা মন্দিরের  ধোঁয়া ও সৌরভের ভেতর মিশে থাকেন বলে প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো। এছাড়া, ধ্যানে গভীরতা সৃষ্টি এবং আত্মাকে পবিত্র করে তোলার পাশাপাশি অভিজাত জাদুচর্চায় সূক্ষ্মভাবে নতুন কিছু যোগ করার জন্যেও সুগন্ধির ব্যবহার হতো। আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ১৫০০ শতক নাগাদ মিশরীয়দের ওষুধি গাছ ব্যবহারের সবচেয়ে পুরোনো লিখিত প্যাপিরাসের রেকর্ড পাওয়া গেছে। বিভিন্ন গাছের ভৌত বর্ণনার পাশাপাশি পাণ্ডুলিপিতে এ সম্পর্কিত জাদু এবং মন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। এখানে সুগন্ধি ও সৌরভের কাজে পরিশোধিত তেল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ওষুধি গাছ থেকে তৈরি অসংখ্য সুরভিত তেল ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করো হতো। একইভাবে মিশরীয় পুরুতরা প্রায়শই একাধারে চিকিৎসক ও সুগন্ধি প্রস্তুতকারীর ভূমিকা পালন করেছেন। মৃতদেহে মলম মাখানোর কাজে নিপুণ ছিলেন যারা, তারা তাদের এই অভিজ্ঞতাকে  ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও একে মরুভূমির কর্কশ, ক্ষতিকর জলবায়ু থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন মিশ্রণ আবিষ্কার করে জীবিকা অর্জনের কাজে ব্যবহার করেছেন।

পারস্য সভ্যতায়ও তেলহীন সৌরভের ব্যবহার ছিল।

বরাবরের মূল্যবান পণ্য গন্ধসারকে দেবতাদের সৌরভ ভাবা  হতো এবং মন্দিরের আচারের পাশাপাশি সৌরভের মুল উপাদান হিসাবে কাজে লাগানো হতো। সুরভিত তেল বেশ উচ্চমূল্যের হওয়ায় এগুলো ব্যবহার রাজ পরিবার ও উচ্চবিত্তের এখতিয়ারে সীমিত ছিল। এইসব তেল প্রায়ই একাধারে প্রায়োগিক ও চমৎকার চেহারার বিভিন্ন জিনিসে তৈরি বিচিত্র বোতলে তুলে রাখা হতো। এইসব পাত্রের কোনও কোনওটা  মুখ বন্ধ করার হাজার হাজার বছর পর প্রত্নতাত্ত্বিকরা খোলার সময় পর্যন্ত সুবাস ধরে রেখেছে। 

খৃস্টপূর্ব ১২৪০ অব্দের দিকে হিব্রুরা মিশর ছাড়ার সময় সাথে করে পারফিউম তৈরির বিদ্যা ও চর্চা ইসরায়েলে নিয়ে যায়। তাদের মন্দিরে দুই ধরনের বেদী ছিল: একটা পশু বলীর জন্যে, অন্যটি সৌরভের জন্যে। ব্যাবিলনবাসীরাও সুরিভিত গাছ ব্যবহার করতো এবং বিভিন্ন দেশে এই জাতীয় গাছের প্রধান যোগানদারে পরিণত হয়েছিল। ব্যাবিলনবাসী ও সুমেরিয়রা উপাস্যদের জন্যে সিডার কাঠ, সাইপ্রেস, মার্টল, এবং পাইন গাছের কদর করতো। অ্যাসিরিয়রা ধর্মীয় আচারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ব্যবহারের বেলায়ও সুগন্ধির অনুরাগী ছিল। মেসোপোটেমিয়ার গুল্ম ইত্যাদি সংগ্রহের সময় অনুষ্ঠান ও বিশেষ মন্ত্র উচচারণ করতো। খৃস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকে মাইসিনিয়রা উপাস্যদের সম্মান জানাতে এবং কবরের কাঠের জন্যেও সুরভিত তেল ব্যবহার করেছে। গোটা প্রাচীন কাল জুড়ে এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে তথ্য প্রবাহিত হয়েছে, এবং খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক নাগাদ ইউরোপ, মধ্য প্রাচ্য, ভারত ও এশিয়ার ভেতর গুল্ম,, মসলা এবং তেলের রমরমা বাণিজ্য চলছিল। 

বেদ (আনু.,খৃস্টপূর্ব ১৫০০) নামে পরিচিত প্রাচীন ভারতীয় রচনায় দারুচিনি, এলাচি, আদা, মন্তকি চন্দন কাঠ বিভিন্ন  সুগন্ধি সম্পর্কে তথ্যসহ প্রকৃতির স্তূতি গাওয়া হয়েছে। অতীতের মতো আজও ভারতে বিভিন্ন গুল্ম নিয়ে কাজ করা পবিত্র ভাবা হয়। এটাই এক পর্যায়ে আয়ুর্বেদীয় ওষুধে হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পবিত্র সংস্কৃত ভাষা থেকে এই নামটি এসেছে: আয়ুর মানে ‘জীবন’ এবং বেদ মানে ‘জ্ঞান’। একে চিকিৎসার প্রাচীনতম পদ্ধতি বলে বিশ্বাস করা হয়। খৃস্টপূর্ব ৭০০ শতকের দিকে চরকা রচিত এবং আজকের দিনেও ব্যাপকভাবে পঠিত চরকা সংহিতা আনুমানিক ৩৫০ টি গাছের বর্ণনা দিয়েছে। চিকিৎসার পাশাপাশি ভারতের ধর্মীয় আচারের ক্ষেত্রে তেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পুজারীদের আত্মিক দুষণ থেকে পবিত্র করে তোলার কাজে সুরভিত তেল ব্যবহার করা হয়। মৃতদেহকে চিতার জন্যে তৈরি করার সময় মৃতদেহকে চন্দন কাঠে ও হলুদ দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। দশম শতকের মধ্যপ্রাচ্যীয় চিকিৎসক ইবনে সিনাকে (৯৮০-১০৩৭) প্রায়ই পাতন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হলেও সিন্ধু উপত্যকা থেকে উদ্ধার করা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আনুমনিক খৃস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকেই এখানে পাতনের মাধ্যমে সুগন্ধি গাছ থেকে তেল উৎপাদনের প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয়েছিল। 

প্রাচীন রোমানরা সুগন্ধী তৈরির প্রক্রিয়া ভালো মতো নথিবদ্ধ করে রেখেছিল, যা পরে ইউরোপে সুগন্ধীর পুনরুজ্জীবনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

লতা-গুল্ম ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধপথ্যেরও অপরিহার্য উপাদান ছিল। আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে ‘দ্য ইয়েলো এম্পেরর’স ক্লাসিক অভ ইন্টারনাল মেডিসিন’ শিরোনামের একটি টেক্সটে এর উল্লেখ মেলে। চিকিৎসার এই পদ্ধতি চীনা লোকজ ওষুধ থেকে ভিন্ন, এখানে ধর্মীয় আচারে সুগন্ধি ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য রক্ষার কাজেও গুল্ম ব্যবহার করা হয়েছে। পঞ্চম শতকের  বৌদ্ধ সাধুরা সফরের সময় সাথে করে আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসা বিদ্যা চালান করায় চীনা ভেষজবিদরা জাপান ও কোরিয়ার অনুশীলনকে প্রভাবিত করেন। ফিনিশিয় বণিকরা পুব থেকে পশ্চিমে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে গ্রিক ও রোমানদের কাছে সুরভিত সম্ভার বয়ে আনায়, ভূমধ্য সাগরীয় এলাকায় সুরভিত তেল বাণিজ্য জমজমাট ছিল। এখান থেকে সুগন্ধির পশ্চিমমুখী যাত্রাও শুরু হয়েছিল। 

গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডটাস (আনু., খৃস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২৫) এবং পিথাগোরিয় দার্শনিক ডেমোক্রেটাস (জন্ম আনু., খৃস্টপূর্ব ৪৬০) মিশর সফর শেষে সেখানে দেখা সৌরভ তৈরির বিদ্যা বাইরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন। গ্রিকদের ভেতর সুগন্ধির জনপ্রিয়তা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বিভিন্ন গুল্ম ও তেলের চিকিৎসা গুণের বিষয়টি সর্বজনীন বিদ্যায় পরিণত হয়। মিশরীয়দের বিপরীতে গ্রিকরা সমাজের সকল স্তরে সুগন্ধি তেল ব্যবহার করতো। গ্রিকরা গাছপালা থেকে বের করা যেকোনও কিছুরই অধ্যাত্মিক গুণ থাকার বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন ভোজ সভায় উপাস্যদের ভক্তি দেখাতে বিভিন্ন সৌরভ ব্যবহার করতো এবং তাদের প্রসন্ন করার লক্ষ্যে শরীরে সুরভিত তেল মাখাতো। গ্রিক চিকিৎসক ও উদ্ভিদবিদ পেদানিয়াস দিওকোরিদেস (আনু., ৪০-৯০ খৃস্টাব্দ) ইউরোপের প্রথম ভেষজ পাণ্ডুলিপি দে ম্যাতেরিয়া মেদিকা সঙ্কলিত করেন। এটি সতেরো শতক অবধি একটি প্রধান আকর গ্রন্থের কাজ দিয়েছে। প্রাচীন রোমানরা চিকিৎসা ও সৌরভের কাজে গ্রিক উদ্ভিদ বিদ্যাকে কাজে লাগায়। পাশাপাশি, তারা নিজেদের শরীর থেকে শুরু করে কাপড়চোপড়, বাড়িঘর থেকে শুরু করে সাধারণের জমায়েতের স্থান সুরিভত করে রাখতো। 

বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগণ তাদের সংস্কৃতিকে ওষুধপত্রের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত করে দেশীয় গাছপালা সম্পর্কে বিশেষ উপলব্ধি গড়ে তোলে। তাদের ইউক্যালিপ্টাস ও  চা-গাছের চিকিৎসার ব্যবহার এখন দুনিয়াব্যাপী। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায়  প্রাচীন মায়া, ইনকা এবং অ্যাজটেক জাতির ধর্মীয় আচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ভেষজ ঐতিহ্য ছিল। অ্যাজটেক, মায়া, এবং স্প্যানিশ সংস্কৃতির বেশ কিছু রীতি আধুনিক মেহিকোর ভেষজ ওষুধ বিজ্ঞানে্ও বিকাশ লাভ করেছে। রিও গ্রান্দের উত্তরে আদিবাসী আমেরিকানরা চিকিৎসা ও ধর্মীয় আচারে গাছ ব্যবহার করেছে। নতুন বিশ্বে থিতু হওয়া ইউরোপিয় বসতিস্থাপনকারীরা এইসব আচারের কিছু কিছু গ্রহণ করে। এছাড়া আফ্রিকা থেকে আগত দাসদের সাথে করে নিয়ে আসা ভেষজ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য এর সাথে মিশে গেছে । পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আমদানী করা ইয়োরুবার প্রভাব আজও ভিন্ন পরিচয় বজায় রাখা এক সমৃদ্ধ আফ্রো-ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতি ও ভেষজ ওষুধের ধারা সৃষ্টি করে। 

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপ অন্ধকার যুগে পতিত হলে সৌরভের ব্যবহারে ভাটা পড়ে। বিপত্তি থেকে রেহাই পেতে বহু চিকিৎসক এবং অন্যান্য জ্ঞানী লোকজন কন্সট্যান্টিনোপলে (বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল) পাড়ি জমান এবং তাদের সাথে জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডারও নিয়ে আসেন। ইউরোপিয় সভ্যতা পিছু হটার সাথে সাথে হিপোকেতেস, দিওসকোরিদেস এবং অন্যান্যের রচনা অনূদিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গাছপালা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। দশম শতকের চিকিৎসক ইবনে সিনা গাছের নির্যাস থেকে অত্তো বা আতর, অর্থাৎ ফুলের তেলÑএক্ষেত্রে গোলাপ জল তৈরি করেন। ইউরোপিয় সংস্কৃতি ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে আসার সাথে সাথে সুগন্ধির চর্চা মুরদের হাত ধরে মধ্য প্রাচ্য থেকে স্পেন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্রুসেড পরবর্তী সময়ে গোটা মহাদেশ জুড়ে আরবের সুগন্ধির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে ওঠে। তেরো শতক নাগাদ আবারও মধ্য প্রাচ্য এবং ইউরোপের ভেতর বিকাশমান বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 

ক্রসেডের সময় আরব থেকে সুগন্ধী নিয়ে ফেরে ইউরোপীয়রা। আবার রেনেসাঁ যুগে সৌরভের পুনরুত্থান ঘটে।

ষোল শতকের মাঝামাঝি সুগন্ধি প্রবলভাবে আবার ইউরোপে ফিরে আসে। ফ্রান্সে প্রাচীন রোমের মতো সুগন্ধি ব্যবহার হতে থাকে: ব্যক্তিগত পর্যায়ে, বাড়িঘরে, এবং প্রকাশ্য ফোয়ারায়। স্থানীয় গাছপালা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে ইউরোপিয়রা ল্যাভেণ্ডার, রোজমেরি, এবং সেজ তেলের পাতন শুরু করে। গন্ধসার দেহের দুর্গন্ধ আড়াল করার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হলেও এসব চিকিৎসার কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে। জুনিপার, লরেল, এবং পাইন প্লেগসহ নানা ধরনের অসুখের মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। ইংল্যান্ডে চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ ভেজষবিদ নিকোলাস কালপেপার (১৬১৬-১৬৫৪) তার মহান ভেষজ বিজ্ঞান গ্রন্থ দ্য ইংলিশ ফিজিশিয়ান প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটির একটি সংস্করণই ছিল ১৭০০দশকে বিভিন্ন আমেরিকান উপনিবেশে প্রকাশিত প্রথম ভেষজ বিদ্যার গ্রন্থ। 

ইউরোপ সুগন্ধী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও ভারতবর্ষ ও চীনে সুগন্ধীর ব্যবহার অব্যাহত ছিল প্রাচীন কাল থেকেই।

কিছু সময়ের জন্যে উভয় সঙ্কটে পড়ে ভেষজ গাছপালার ব্যবহার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে: একদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উদীয়মান চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তথাকথিত অশিক্ষিতদের হাত থেকে ভেষজ বিদ্যা ছিনিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল; অন্যদিকে ক্রিশ্চান গির্জা সাধারণ মানুষের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে তাদের ব্যক্তিগত সাজসজ্জা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। পরিণামে সুগন্ধির ব্যবহার, এমনকি তেল এবং মলম কাছে রাখাও ডাইনী শনাক্তের একটা উপায়ে পরিণত হয়। সংস্কৃতি ফের পিছু হটে। ১৭৬০ থেকে ১৮২০ সাল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় থাকা গ্রেট ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের আমলে কোনও নারীর সুগন্ধি বা আরক ব্যবহারকে ব্যভিচার ও বিশ্বাসঘাতকতা বলেই মনে করা হতো এবং তাকে ডাইনীর জন্যে প্রযোজ্য শাস্তি’পেতে হতো। 

ভারতবর্ষের সুগন্ধির ইতিাহাস পাওয়া যায় সুলতান গিয়াস-উদ-দিনের নি’মাততনামা গ্রন্থে।

অবশেষে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে ভেষজ ও সুগন্ধির প্রত্যাবর্তন ঘটে। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থ গন্ধসারের জায়গা দখল করে নিতে শুরু করে। বিশ শতক নাগাদ সুগন্ধি ও প্রসাধনীতে মূলত সস্তা ও সহজে উৎপাদন সম্ভব কৃত্রিম সৌরভ ব্যবহার করা হয়েছে। অদ্ভুতভাবেই জনৈক ফরাসি রসায়নবিদ রেনে-মরিস গ্যাটেফসে ১৯২০-র দশকের দিকে গন্ধসারের ব্যবহারের পুজনর্জাগরণের পেছনে ছিলেন। ল্যাবরেটরিতে হাত পুড়িয়ে ফেলার পর তিনি হাতের কাছে থাকা শিশিটাই খামচে ধরেছিলেন, ঘটনাক্রমে সেটা ছিল ল্যাভেন্ডার তেলের শিশি। তেলের চকিত উপশমের ক্ষমতায় কৌতূহলী হয়ে জীবনের বাকি সময় তিনি গন্ধসারের গবেষণার পেছনেই ব্যয় করেন। নিজের উদ্ভাবনের নাম রাখেন অ্যারোমাথেরাপি। 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>