| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১২) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কিসসা ৪

রেলগাড়ির যাচ্ছি এবার, আবার যাবো, দোলাতে দুলতে দুলতে রাতের ঘুম গাঢ় হয়। মাথার কাছে জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া এসে চুলে ঢেউ খেলিয়ে যায়। গভীর ঘুমের মধ্যে কত নাম না জানা স্টেশন পেরিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে প্ল্যাটফর্মের ওপরে টিমটিমে হলুদ আলো ছাড়া তাদের আর কোনও প্রাণ নেই।  থাকতে হয় তাই থাকা। তাদের বুকের ওপর দিয়ে চলে যায় রাতের রেলগাড়ি। একপাশে কামরার দরজায় একা স্টেশন মাষ্টার দাঁড়িয়ে থাকে। রাতের শেষ মেল ট্রেন চলে গেলে সাইকেল নিয়ে একটু দূরের কলোনীতে ফিরে যাবে।

       কিন্তু সব স্টেশন কিছু এমন নিস্তব্ধ অভিমানে বসে থাকে না। রাতের ধ্যানমগ্ন গাম্ভীর্যকে বিদ্রূপে উড়িয়ে দিয়ে কোনও স্টেশন অত্যধিক আলো ঝলমলে হয়ে থাকে। তার প্ল্যাটফর্মে টানা করোগেটেড টিনের শেডের তলায় দুমুখো বেঞ্চি। বড় হুইলার স্টল। চায়ের ফেরিওয়ালা ছাড়াও কেক বিস্কুট পেস্ট্রি প্যটিসের দোকান। সেখানে রেলগাড়ি যেন বিশেষ অতিথি। থেমে থাকে কিছুক্ষণ।  আমার ঘুম ভেঙে যায়। কে যেন এই স্টেশনে নামবে। সে বার্থের তলা থেকে টেনে বার করছে তার বাক্স বেডিং। ব্যস্ততা তুঙ্গে। যেন যাত্রাটা মিথ্যে। গন্তব্যে পৌঁছনোটাই আসল।  ঘুম ভেঙে উঠে বসি। নতুন যাত্রী উঠে আসে।

    এক পৌষের ঠাণ্ডায় বাবা আমাকে নিয়ে উঠেছে এক রাতের গাড়িতে।  দাদি আর নেই। সব্বাই পৌঁছে গেছে চক্রধরপুর।  শুধু আমি আর বাবা পরে যাচ্ছি। বাবা আমাকে নামিয়ে দেবে স্টেশনে। মামা আসবে নিতে। বাবা যাবে চাইবাসা। দুদিন পর আসবে।

     ঘুমের মধ্যে মন খারাপ। বাবা ডাকছে। গুগুল ওঠ। এসে গেছে। তোকে নামতে হবে। ঘুম চোখে উঠে বসি। নামব। কিন্তু বাবা ? বাবাকে ছেড়ে নেমে যাবো ?

গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হাত নাড়ছে বাবা। মন খারাপ করছিস কেন ? আমি ত পরশুই চলে আসব !

  নেমে গেছি। বাবা সেই কবে রাতের রেলগাড়ি চেপে চলে গেছে ! কোথায় গন্তব্য কে জানে ?

  যেদিন দুপুরবেলা হঠাৎ রাজ্যের ঘুম চোখে নামে, সেদিন সাঁঝবেলায় ঘুম ভেঙে উঠে বসি, সঙ্গে একরাশ মন খারাপ। জানলার ল্যাম্প পোস্ট দিয়ে আসা মরা হলুদ আলো বিছানায় এসে পড়ে। মনে হয়, একদিন অন্ধকার থেকে যাবে এমনই স্থবির হয়ে। উঠে দাঁড়াবে না। আলোর সুইচে হাত পড়বেনা।

    দুপুরের ঘুম তাই আমার একটুও ভালো লাগেনা। যদি এমন ঘুমিয়ে পড়ি ? যে সন্ধ্যে হয়ে গেলো ? কিংবা হয়ত রাত হয়ে গেলো ? ঘুম ভাঙল না ?

  একটা সব হারানোর স্টেশন সবসময় হাতছানি দেয়। দ্রুত রেলগাড়ি ছোটে।  ঝাপসা আলোর মালা সরে সরে চলে যায়। জানা হয়না কোন স্টেশন পেরিয়ে গেলো।  বেশ বড় ছিল ত! তবে কি ওইখানে কারোর নামার ছিলো না? গন্তব্য নয় কারোর? এমন সরে যাওয়া আলোর ফাঁকে ফাঁকে কামরার মধ্যে ফিরে চাই। আমার চারিদিকে আমারই প্রিয়জন।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১১) । অনিন্দিতা মণ্ডল


    সেবার চলেছি কাশ্মীর। তখন আট। ট্রেনে উঠে দুদিন ধরে যাওয়া হবে পাঠানকোট। ভারী আনন্দ আমাদের। ভাইবোনেরা মশগুল। দু দুটো রাত ট্রেনে ! কি মজা ! একটা চলন্ত ঘরবাড়ি আমাদের। আসলে তখন ত জানিই না, ঘরবাড়ি সত্যিই চলন্ত ! আজ যেখানে আছি কাল সেখানে নেই। থাকতেই পারি না।

এও জানিনা যে সবার গন্তব্য আলাদা। কে যে কখন নেমে যাবে আগে থেকে বলা যায় না। কখনো জানান দিয়ে শোরগোল তুলে কুলির মাথায় বাক্স প্যাঁটরা চাপিয়ে কেউ নামে। কেউ আবার অলক্ষে চুপচাপ চাঁদভাঙা জ্যোৎস্নায় নেমে পড়ে অখ্যাত স্টেশনে। পড়ে থাকে তার সব সম্পদ। হঠাৎ জানলা দিয়ে দেখতে পাই চরাচর ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্নায় একলা মানুষ কী আনন্দে মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে।

এমন একবার হলো। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ওই লোকটা ট্রেন সিগন্যালে থামতেই নেমে গেলো কেন? এখানে ত স্টেশন নেই ? মা বলল, ওর বাড়িটা হয়ত এখান থেকে কাছে হয়। স্টেশন থেকে দূর। তাই এখানেই নেমে পড়েছে। আমি তাও বললাম, ওর ভয় ত করছে না মোটেই ? কেমন দুহাত তুলে লাফাতে লাফাতে চলেছে। মা হাসল। অনেক দিনের পরে ও হয়ত ওর মা বাবাকে দেখতে পাবে। তাই ভয় নেই আর। আনন্দে পথ চলছে।

গন্তব্য তাই আছেই। কেউ বাক্স বয়ে নিয়ে যেতে ভালোবাসে। অর্জিত ধন। কেউ বা প্রিয়জনের কাছে ফেরার তাগিদে অমনি দিকশূন্য নেমে পড়ে।

একটাই প্রশ্ন থেকে যায়। প্রিয়জন অপেক্ষায় আছে ত ?

সব পথই যে সরলরেখায় চলবে এমন কথা নেই। কোনও কোনও পথ ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় ফিরে আসে। বৃত্তাকার ত শুধু পৃথিবীই নয়, মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সব গ্রহ তারারাই ত বৃত্তাকার। সম্ভবত একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে খেতে ওরা গোল হয়ে যায়। ঠিক যেমন ময়দার গুলি হাতে পাকালে গোল হয়। তাহলে পৃথিবীর সব পথই বা গোল গোল ঘুরবে না কেন ?

   হাওড়া স্টেশনে এসে যখন ট্যাক্সি কূলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে আমাদের ভেতরে ঠেলে দিতো তখন ভয় পেতাম। কত অজস্র মানুষ ! কত কিসিমের লোকজন ! আমি হারিয়ে যাবো। কি হবে? বাবা প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চিতে বসিয়ে সামনে মালপত্র রেখেছে। কে নাকি চেনা লোক আসছে। একটু দেখা করবে। বাবা মাকে হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় ভ্যাঁ করে কাঁদতে যাবো, এমন সময়ে পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন, ওমা ! কি বোকা মেয়ে ত? কাঁদছ কেন? সত্যিই বোকারাই কি চিরকাল কাঁদে? চালাক যারা তারা দূরে দাঁড়িয়ে কান্নাটা দেখে উপভোগ করে। নিশ্চয় করে। নয়ত এত এত করুণ বীভৎস রসের গল্প লেখাই হতো না! আমি চালাক হতে শিখিনি তখনও। বললাম আমার মা? দিদি আর ভাই ছিল। বাবাও। ভদ্রলোক আমার কাঁপা গলার কথায় মিষ্টি হেসে বললেন, ওই ত তোমার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ওই দেখো তোমার দিদি ওর চশমার মধ্যে দিয়ে হাঁ করে সবাইকে দেখছে। তোমার ভাই মায়ের কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। তোমাকে তোমার বাবা এই মালপত্র পাহারা দিতে বলেছেন। কেমন ত? আমি অবাক। এই লোকটা জাদুকর। নিশ্চয়। কি করে জানলো এত কিছু ? বড় বড় চোখে দেখছি। বলা ত যায় না ! ম্যাজিক কার্পেটে করে হয়ত আমার চোখের সামনে দিয়েই উড়ে গেলো। কিন্তু লোকটা বসে থাকে। বলে, বাবা এখনই আসবে। চুপ করে বোসো।  আমি দেখতে পাই,  ভীষণ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা লাল আর সোনালী রঙা ইঞ্জিন ঢুকতে থাকে। লোকটা বলে, চেয়ে দেখো, ঠিক যেন একটা রয়্যাল ঈগল। আমি আবিষ্ট হয়ে পড়ি। ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ঈগল ডানা মেলবে হয়ত। আর তখনই প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত তৎপরতা। ট্রেন ঢুকে গেছে। ট্রেন ঢুকে গেছে। বাবা কূলির মাথায় বোঝা তুলতে থাকে। মা দিদি আর ভাইকে নিয়ে আমার পাশে এসে বসে। আমি মায়ের শাড়ির আঁচলটা আঁকড়ে ধরি। মা হাসে। কি হলো? মা আমাদের যদি ট্রেনে উঠতে দেরি হয়ে যায় ? ট্রেনটা যদি আরো দূরে চলে যায়? মা আবার হাসে। ধ্যূত। হাওড়া স্টেশন থেকে আরো দূরে কি করে যাবে? এখান থেকেই ট্রেন সব দূরে দূরে যায়। আবার ফিরে আসে। আমরা ঠিক উঠব।

আমি ভাবি। হাওড়া তবে সেই গোল গোল ঘুরতে থাকা পথের যোগবিন্দু? বাবা ডাকে। উঠে এসো।

আমি যাবার সময় পাশে তাকাই। সেই লোকটা কোথায় গেলো ? যে জাদুকর আমায় চেনে? মাকে বাবাকে জানে? তার ম্যাজিক কার্পেট উড়িয়ে সে এই এত লোকের চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেলো? আমি দেখতে পেলাম না? আমার অভিমান হয়। তারপর ট্রেনে উঠে জানলার ধারে বসি। বাইরে চোখ মেলে আকাশে খুঁজি। ওই কি ম্যাজিক কার্পেট উড়ে যাচ্ছে? নিশ্চয় ওটাই। আমার মুখে হাসি ভাসে। মা জিজ্ঞেস করে, হাসছিস কেন রে? আমি বলি, জানো আমরা এখন রয়্যাল ঈগলে চেপেছি। একটু পরেই ও উড়বে।

মা হেসে মাথার চুল ঘেঁটে দেয়। বলে, শুধু মাথামুন্ডু। আর রূপকথা পড়তে হবেনা। আমি মাকে চুপিচুপি বলি। না সত্যি ! আজ জাদুকর এসেছিল! আমার পাশে বসে বলে গেছে ! মা অদ্ভুতভাবে হাসে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত