Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,স্ত্রী

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৯) । রোহিণী ধর্মপাল

Reading Time: 4 minutes
দ্রৌপদীর চোখ যেন একটু একটু ঝাপসা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছেন তিনি। সময় আর নেই। কিন্তু শুধু কি সেইজন্যই ?  নাকি ভীমের কথা ভেবে? 
মধ্যম পাণ্ডব।   ভীম। তাঁর কথা মনে পড়লেই দ্রৌপদীর মনটা ভিজে আসে। অর্জুনের পর যদি কেউ তাঁর যোগ্য পাণিপ্রার্থী হয়ে থাকে সেই স্বয়ংবরের দিনটিতে, তবে সেই মানুষটি ভীম ছাড়া আর কে! অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার পর যখন তিনি তাঁর ফুলেতে সোনাতে সাজানো মালাটি পরিয়ে দিচ্ছিলেন গলায়, তখনই তো কোলাহল শুরু হয়ে গেছিল। পরাজিত রাজাদের। তাঁর কানে কিছু আসেনি অবশ্য। আসবেই বা কী করে! তিনি তখন আশ্চর্য এক সমুদ্রের গভীরে ডুবে যাচ্ছিলেন। কী অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছিল তাঁর শরীরে! সারা শরীরের রোম খাড়া হয়ে উঠছিল! আনন্দে না প্রেমে না কামে, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বোধহয় সব অনুভূতি মিলেমিশে গেছিল। অথচ অর্জুন তো চোখ পর্যন্ত তোলেন নি। পরে তাঁর অনেকবার মনে হয়েছে যে সেইদিন স্বয়ংবর সভার প্রতিটি পুরুষ তাঁকে মনে মনে কামনা করে উত্তেজিত হয়েছে, লালার্ত হয়েছে; অর্জুন বাদে। লক্ষ্যভেদ করার ইচ্ছেটিই একমাত্র প্রবল হয়ে উঠেছিল অর্জুনের কাছে। তাঁর সমস্ত মন তীক্ষ্ণ একাগ্র হয়ে উঠেছিল ওই ঘুরন্ত মাছের ছায়াটির ছবিতে।
নিজেকে দ্রৌপদী অনেকবার প্রশ্ন করেছেন। পাঁচ ভাইকেই বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোনও রকম বাইরের চাপ তাঁর ওপর প্রভাব ফেলেছিল কি আদৌ? তিনি তো অর্জুনে বিহ্বল হয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে যখন উঠে দাঁড়ালেন অর্জুন, কয়েক মুহূর্তের জন্য ওই বিরাট সভা যেন নীরব হয়ে গেছিল। তাঁর হৃদস্পন্দন ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়ে দ্বিগুণ বেগে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছিল। ওই বলিষ্ঠ শরীর, চওড়া কাঁধ, লম্বা দুই হাত আর কালো রঙ!! উফফ্! তাঁর যেন পাগল পাগল লাগছিল উদ্বেগে। পারবে তো? লক্ষ্যভেদ করতে? এ যদি ব্যর্থ হয়? সেই সময়ে আর কোনও দিকে তাঁর মন ছিল না। এমনকী যখন রাজারা সবাই মিলে আক্রমণ করল, তখনও তিনি শুধু ওই কালো চেহারাটিই দেখে যাচ্ছিলেন। সব শান্ত হয়ে যাওয়ার পর পাঁচজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে হেঁটে হেঁটেই গেলেন। তখনও তো জানেন না এই পাঁচভাইই আসলে পাঁচ পাণ্ডব। লক্ষ্যভেদ করা বামুনটিই তাঁর আর বাবা দ্রুপদের কাঙ্খিত সেই অর্জুন! কল্পনাও করেন নি তখনও যে এই পাঁচ জনকেই তিনি বিয়ে করবেন। কিন্তু যখন না জেনেই কুন্তী কুঁড়েঘরের ভেতর থেকে বলেছিলেন, যা এনেছ, ভাগ করে নাও, তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে চমকে উঠেছিলেন। আর চমকে উঠে চোখ তুলে দেখেছিলেন অর্জুন ছাড়া বাকি চারজন পুরুষই মুগ্ধ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
যদিও পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্ট আর  লালসাভরা দৃষ্টি, দুয়ের সঙ্গেই তিনি পরিচিত। তিনি জানতেন, তাঁর পদ্মপলাশের মতো চোখ, অল্প কোঁকড়ানো, ঢেউয়ের মতো জঘন পর্যন্ত আছড়ে পড়া চুল, সুবর্তুল পীন দুই স্তন আর কালো রঙে আটকে যেত পুরুষের মন। যেমন মাকড়সার আঠালো জালে আটকে যায় পোকা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে জেনেও পোকারা ছুটে মরতেই যায়। স্বয়ংবর সভাতে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে তাঁরও সেই অবস্থাই হয়েছিল। কিন্তু নিজের মনের দিকে তাকিয়ে দ্রৌপদী অবাক হয়েছিলেন, যখন মায়ের কথা শুনে চার ভাই চমকালেন, তিনিও তো চমকে উঠে চার ভাইয়ের দিকে দেখলেন, তখনই তাঁর মনেও হাল্কা মুগ্ধতার একটা রেশ তৈরি হল যেন। তাই তো যখন বাবার থেকে জানলেন যে যুধিষ্ঠির চাইছেন যে তাঁদের পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বিয়ে হোক, তিনি একটুও আপত্তি জানান নি। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর নিজের মধ্যেও মহা আগ্রহ জেগেছে। কেমন হবে তাঁর জীবন! পাঁচ পাঁচজন স্বামী সামলানো তো সহজ নয়! নিঃসন্দেহে তৃতীয় পাণ্ডবের প্রতি আশ্চর্য এক অনুভব তাঁর মধ্যে চিরকাল ছিল। যে অনুভবকে বিরহ আর দূরত্ব আরও তীব্রতর করে তুলেছিল। তবে আকর্ষণ আর প্রেম বাকি চার ভাইয়ের প্রতি তো কম ছিল না। যুধিষ্ঠিরের তিনি প্রধান মহিষী। সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। সমস্ত রাজকোষের দায়িত্ব তাঁর। সবার ওপরে তিনি। সম্রাজ্ঞী হওয়ার দৃপ্ততা তাঁকে আরও ব্যক্তিত্বময়ী করে তুলত। ভীমের মতো অমিত বলশালী যখন তাঁর সামনে অসহায়ের মতো নিজেকে সমর্পণ করত, তখন আরেকরকম আনন্দ তাঁকে ভরিয়ে তুলত । নকুলের মতো অপরূপ রূপবান পুরুষ যখন তাঁর রূপের আগুনে পুড়তে থাকত, সেই দহন দেখতে তাঁর ভালো লাগত। সহদেবের মতো প্রাজ্ঞ যখন সমস্ত বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করত, তখন নিজের জ্ঞান নিয়ে, প্রজ্ঞা নিয়ে গর্ব তৈরি হতো।
 কৃষ্ণা দ্রৌপদী। এমন এক মেয়ে, যাকে সহজে ধরা যায় না। বোঝা যায় না। একজন পুরুষ সেই মেয়ের গভীর ব্যক্তিত্ব, অপার্থিব সৌন্দর্য, তীব্র কামোন্মত্ততা, অপ্রতিরোধ্য সাহস, অপরিসীম সহিষ্ণুতা, অগাধ প্রেমের আধার হতেই পারে না। তাই দ্রৌপদীর জীবনে পাঁচে মিলে আসলে এক। তাই তিনি যুধিষ্ঠিরের মহারাণী, ভীমের একান্ত ভালোবাসার জন, নকুল ও সহদেবের মাতৃপ্রতিম। শুধু অর্জুনের কাছে তিনি কাম ও প্রেমের আকুতিতে ভরা বিশুদ্ধ প্রেমিকা। যার কাছে তিনি সবথেকে বেশি অবহেলা পেলেন সারাটা জীবন।
বনবাস পর্বে একটি মাত্র কারণেই দ্রৌপদী খুশি হয়েছিলেন। পাঁচ দিন ধরে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের পর তাঁর মনেও প্রশ্ন উঠেছিল বইকী। তিনি কার সঙ্গে মিলিত হবেন? কিভাবে? পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী হলেও পাঁচ ভাইকে এক রাতে তো আহ্বান জানাবেন  না তিনি! এই প্রশ্ন তো মাকেও জিজ্ঞেস করতে পারছিলেন না তিনি। কেমন করে দিনগুলি কাটাবেন? রাতগুলি? যদিও তিনি মনে মনে অর্জুনকেই কামনা করছিলেন। অর্জুন। স্বয়ংবর সভাতে লক্ষ্যভেদের শর্ত পূরণ অনুযায়ী অর্জুনই তো তাঁর প্রথম স্বামী। মনের সমর্পণের দিক থেকেও তো তাই। অর্জুনের দেহটিকে ভেবে ঘন ঘন রোমাঞ্চ হচ্ছিল তাঁর। নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে কল্পনা করছিলেন ওই পরিপুষ্ট কালো বলিষ্ঠ দুই হাতের বাঁধনে। নিজের রসালো নরম ঠোঁটে অনুভব করছিলেন তপ্ত পুরুষালী ঠোঁটের ছোঁয়া। নিজেই যুক্তি দিয়েছিলেন নিজেকে। অর্জুনকেই প্রথম পাবেন তিনি। বাবা নিশ্চয়ই তেমন ব্যবস্থাই করবেন। যুধিষ্ঠিরেরও তো এতে কোনও আপত্তিই থাকতে পারে না। তিনি যদি নিজের আগেই ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার বিয়ে, এমনকী তাঁদের  সন্তানের জন্মও সানন্দে মেনে নিতে পেরে থাকেন, তবে অর্জুনের ক্ষেত্রেও মানতে না পারার কথাই নয়!
অথচ একেবারেই তেমন হল না! এই যে অর্জুনকে পেলেন না প্রথমেই, সেই হাহাকার যেন তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল চিরকালের জন্য! সে বেদন কখনও বুঝতে দেন নি তিনি কাউকে। তাঁর শরীরের প্রতিটি রোম পর্যন্ত বিদ্রোহ করেছিল, যখন যুধিষ্ঠির তাঁর দেহ পিষে দিচ্ছিলেন। যুধিষ্ঠির বুঝতেই পারেন নি তাঁর অসহযোগ। কারণ দ্রৌপদীর শরীর তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। শুরু থেকেই। দ্রৌপদীকে প্রথম দেখার পর থেকেই। দ্রৌপদী কী ভাবছেন, তা নিয়ে কিছুই এসে যায় নি তাঁর।  তাই তো নারদ এসে পরামর্শটি দেওয়ামাত্র তিনি লুফে নিয়েছিলেন।
পাঞ্চাল রাজ্যে মহা ধূমধাম করে বিয়ে সম্পন্ন হলে দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব হস্তিনাপুরে এলেন। ধৃতরাষ্ট্র সবার  সামনেই যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “তোমরা অর্ধেক রাজ্য নাও। খাণ্ডবপ্রস্থ তোমাদের দিলাম। বউমাকে নিয়ে সেখানে সুখে বাস করো”। সেদিনও দ্রৌপদী ভয়ানক অবাক হয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র এ কেমন সিদ্ধান্ত নিলেন! আদর করে কেউ অরণ্যে ভরা, পতিত জমিতে পাঠায়! আর ভীষ্ম! কোনও রকম প্রতিবাদ করলেন না! সেই শুরুর দিনটি থেকে ভীষ্ম দ্রৌপদীর কাছে দুর্বোধ্য এক ব্যক্তিত্ব। পাণ্ডবদের প্রথম থেকে অতিরিক্ত স্নেহ দিয়ে, পক্ষপাতিত্ব করে দুর্যোধনের আরও শত্রু করে তুলেছেন। অথচ একটার পর একটা অন্যায়ের কোনও প্রতিবাদ করেন নি!
পঞ্চ স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী দ্রৌপদী এলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। সেই পতিত জায়গাটিকেই পাঁচভাই স্বর্গের মতো সুন্দর বানিয়ে ফেললেন দ্রুত। নাম দিলেন ইন্দ্রপ্রস্থ। খণ্ডহর অনুর্বর জমি হয়ে উঠল সুজলাসুফলা। সেখানেই একদিন নারদ এসে প্রস্তাব দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। যেন দ্রৌপদী পর পর একেক পাণ্ডবের স্ত্রী হয়। বড় জনের স্ত্রী থাকার সময় ছোটভাইদের তিনি গুরুজন হবেন। ছোটভাইয়ের স্ত্রী হওয়ার সময় বড় ভাইয়ের স্নেহের পাত্রী হবেন। এক এক ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে একেকজনের কাছেই থাকবেন। সেই সময় অন্য কোনও ভাই তাঁদের একসঙ্গে দেখলে তাঁকে বারো বছর ব্রহ্মচারী হয়ে বাইরে চলে যেতে হবে। এই নিয়ম অনুসারে তাঁকে প্রথমেই থাকতে হল যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে। সুদীর্ঘ একটি বছর! বারো মাস! শুধু তাই নয়। কিছুদিনের মধ্যেই এমন একটি ঘটনা ঘটল যে অর্জুনকে, তাঁর অর্জুনকেই বারো বছরের জন্য বনবাসে চলে যেতে হল!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>