আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট
১.
‘আলোক সীমিত কিন্ত্ত অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলাচল করে। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এ তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানী ক্রিষ্টেনসন রোমার। তিনি লক্ষ্য করছিলেন, বৃহষ্পতি যত দূরে থাকে, তার চাঁদগুলির গ্রহণও তত দেরীতে দেখা যায়। তাঁর যুক্তি ছিল, এর কারণ- আমরা যখন দূরে অবস্থান করি তখন বৃহষ্পতির চাঁদগুলি থেকে আলোক আমাদের কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে।’
অনন্ত সাধন স্যারের ক্লাস এজন্য আমার বেশি ভাল লাগে। সারা স্কুলের ভেতর ওনার পড়ানো সত্যি আলাদা। ফিজিক্স ক্লাসে ক্লাসের পড়ার পাশে আরো কত কি যে পড়ান! মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে স্টিফেন হকিন্সের লেখার অনুবাদ সব কিনে নিয়ে আসেন। সেখান থেকেও নানা কিছু বাড়তি পড়ান। স্যার বলেছেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সাথে দেন-দরবার করছেন যেন আসছে ডিসেম্বর নাগাদ স্কুলে আমরা একটা টেলিস্কোপ কিনতে পারি। যে টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদ, মঙ্গল, বুধ, বৃহষ্পতি, শুক্র কি শনির বলয় দেখা যাবে। ডিসেম্বর আসতে আসতে আমরা টেনে উঠে যাব। টেলিস্কোপ কিনবার কথা শোনার পর থেকে রাতে আমার উত্তেজনায় ঘুম হয় না। পেপারে যেমন পড়া যায় যে ঢাকার ছেলে-মেয়েরা টেলিস্কোপে ধূমকেতু দেখছে কি চন্দ্রগ্রহণ দেখছে, আমরা… শোলাবুনিয়ার স্কুলের ছেলেরাও তেমনটা দেখতে পারব?
‘একটা প্রশ্ন ছিল স্যার!’
নিজাম হাত তোলার সাথে আমার কেমন ভয় ভয় লাগতে থাকে। গতবছর মাদ্রাসা থেকে ও এসেছে। মাদ্রাসা থেকে শওকতও এসেছে। কিন্ত্ত শওকত নিজামের মত না। সে দেয়াল পত্রিকায় কবিতা লেখে, গুনগুন করে গান গায়, আমার মত অনন্ত সাধন স্যারের ক্লাসের জন্য পাগল থাকে। কিন্ত্ত নিজাম? বলতে গেলে প্রত্যেক দিন বিজ্ঞান ক্লাসে হাত তুলে দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন শুরু করবে, ‘কিন্ত্ত স্যার- মেঘ ত’ আল্লাহ বানিয়েছে? মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল আমিনের অনুগ্রহ ছাড়া ত’ একটা গাছের পাতাও হয় না?’
অনন্ত স্যার বিব্রত মুখে চুপ করে থাকেন। খানিকক্ষণ শোনেন। কোন পাল্টা উত্তর করেন না। তারপর বলেন, ‘শোন- সামনে তোমাদের পরীক্ষা। এখনো অনেক সিলেবাস বাকি। চলো, আবার পড়া শুরু করি।’
নিজামকে সত্যি আমার কেমন ভয় ভয় করে। আজকাল ওর সাথে চার/পাঁচটি ছেলে খুব ঘুর ঘুর করে। ক্লাসের ছেলে তারা প্রত্যেকে। লিয়াকত, শফি, আজমল, হারুণ। দু’দিন আগে টিফিন পিরিয়ডে নিজাম আমাকে ডাক দিয়ে হাসলো, ‘কিরে পাভেল? তোর চাচাতো বোণকে ত’ কাস্টডিতে নিয়েছে। ৫৭ নং ধারায়।’
আমি কিছু বলি না। আম্মা বলেছে ক্লাসে যারা এমন কথা বলবে, তাদের সাথে যেন কখনো পাল্টা উত্তর না করি! নীলা আপাকে পুলিশ নিয়েছে। বাগেরহাটে থানায় চালান দিয়েছে। চাচা-চাচী বাগেরহাটে থাকেন। নীলা আপা সেখানে কলেজে পড়েন। আমাদের বাসায় ছুটিতে এসেছিলেন। চাচা ওনাকে মেট্রিকে জিপিএ-৫ পাবার পর একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন। নীলা আপার দেখাদেখি আমি আজ সাত মাস হয় ফেসবুক ব্যবহার করছি। আপুর কাছ থেকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর, গণজাগরণ মঞ্চ, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান, মুক্তবুদ্ধির সংগ্রাম এসব শব্দ শিখেছি। আব্বা আম্মা ত’ ফেসবুক ব্যবহার করে না। সত্যি বলতে অনন্ত সাধন স্যারের পর নীলা আপা আমার দ্বিতীয় শিক্ষক। তা’ নীলা আপা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে দ্বিতীয় দিন পোস্ট করেছিলেন বেগম রোকেয়ার ছবি সহ একটি উদ্ধৃতি। পুরুষের ভেতর থেকে সব অবতার বা নবী হয়েছে বলে তারা মেয়েদের অধীন করে রেখেছে। এ থেকে বোঝা যায় ঈশ্বর জিনিষটা আসলে ফাঁকি। তৃতীয় দিনে সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় কড়া নাড়লো পুলিশ, ‘এটা সেলিম সাহেবের বাসা?’
আব্বা তখন মাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন।
‘জ্বি।’
‘আপনার বাসায় নাশিদা নওরীন নীলা নামে কেউ আছে?’
‘জ্বি। আমার ভাতিঝি। কেন?’
‘ওনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।’
‘কেন? তাঁর অপরাধ?’
‘ উনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে পোস্ট করেছেন। আমাদের কাছে অভিযোগ আছে।’
‘আপনাদের কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। নীলার বয়স মাত্র কুড়ি। একটা বিশ বছর বয়সের মেয়ে কি এমন করতে পারে যে তাকে আপনারা গ্রেপ্তার করতে এসেছেন? আমিও সরকারের ফুডে চাকরি করি। আমার বাসায় আপনারা—’
‘চেঁচিয়ে লাভ কি? ভাতিজিকে সামলাতে পারেন না? দিনদিন সব শাহবাগী নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। তাদের সহীহ পথে রাখতে পারেন না?’
নীলা আপা নিজে ততক্ষণে বসার ঘরে চলে এসেছেন। খানিকটা লম্বা আর ছিপছিপে নীলা আপা। চুল ছেলেদের মতো ছাঁটা। মুখে খানিকটা ব্রণ। দূর থেকে দেখলে ছেলেদের মতো মনে হবে। দারুণ ব্যাডমিন্টন আর ভলিবল খেলেন।
‘কি হয়েছে?’
‘আপনার বিরুদ্ধে ধারা-৫৭তে অভিযোগ আছে।’
‘কি অভিযোগ?’
‘কি অভিযোগ?’
পুলিশ অফিসার এবার কয়েকটি প্রিন্ট-আউট বের করেন। নীলা আপা বেগম রোকেয়ার ছবি সহ উদ্ধৃতি দেখে হাসতে থাকেন, ‘তাহলে আমাকে এ্যারেস্ট করার আগে পাঠ্যপুস্তকে যারা রোকেয়ার ছবি বা সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাপে, তাদের আগে এ্যারেস্ট করেন।’
‘শুধু এটা না। আরো আছে।’
পুলিশ অফিসার আরো কিছু প্রিন্ট-আউট বের করেন। দাঁড়িপাল্লা ধমাধম, নাস্তিকের বিশ্বাস সহ বেশ কিছু ছদ্মনামী ব্লগারের লেখার শেয়ার দিয়েছেন নীলা আপা।
‘চাচা- আপনি ভয় পাবেন না। আমি হাজত যাচ্ছি। এদের সাথে যুক্তির কথা বলে লাভ কি?’
নীলা আপাকে খুব বড়দের মতো মনে হচ্ছে। আব্বা-আম্মার বয়স বরং যেন কমে গেছে! তারা হাহাকার করছেন, চোখের পানি ফেলছেন।
‘তোর চাচাতো বোন ত’ আল্লাহ-রসুল নিয়ে বাজে বাজে স্ট্যাটাস দেয়। দেখতেও তেমন। ঢ্যাঙ্গা, পুরুষের মত চেহারা! নাস্তিক। আর তোর মা ত’ কপালে হিন্দু মহিলাদের মত বড় বড় লাল টিপ পরে, না?’
আমি উত্তর করি না।
‘তোর নিজের নামটাও ত’ খ্রিষ্টানি নাম। পাভেল- পাভেল নামের মানে কি? আর পাভেল নাম রাখলে তার সাথে আবার কেরদানি মুসলমান আরেফীন টা যোগ করলি কেন? পাভেল হকিন্স রাখলে চলতো ভাল- ঐ পঙ্গু বেটাটার মত!’
এতক্ষণ সব সহ্য হচ্ছিলো। কিন্ত্ত অনন্ত স্যারের মুখে শুনে শুনে স্টিফেন হকিন্সকে আমার মনে হয় হকিন্স যেন আস্ত ঈশ্বর! যে মানুষটা ছায়াপথ, নীহারিকা, কৃষ্ঞগহ্বর কি ঐ দূরের অনন্ত নক্ষত্রবীথি সব কিছু নিয়ে এত ভেবেছেন!
‘খবরদার –জানিস হকিন্স নিজে ঈশ্বরের মত একজন মানুষ?’
‘বাহ বাহ- অনন্ত সাধন বিশ্বাস স্যার দেখি মুসলমানের ছেলেকে আল্লাহর বদলে ঈশ্বর নাম জপায়! রাম নাম জপবি কবে রে? তোরা ত’ আবার বাম! তোর চাচাতো বোন নাস্তিক মহিলা ব্লগার!’
এমন নিজাম আজকাল প্রত্যেক বিজ্ঞান ক্লাসে একটা হুজ্জত পাকায়। অনন্ত সাধন স্যার নিজামের হাত তোলা দেখেও থামলেন না। পড়া চালিয়ে যেতে থাকলেন।
‘আলোক বিস্তার সম্বন্ধে সঠিক তত্ত্ব ১৮৬৫ সালের আগে আবিষ্কৃত হয় নি। সে সময় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস্ ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুত এবং চুম্বক বিষয়ক প্রচলিত আংশিক তত্ত্বগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হন।’
‘স্যার- আমার কিন্ত্ত একটা প্রশ্ন ছিল!’
অনন্ত সাধন স্যার এবার থামলেন।
‘বলো কি প্রশ্ন। তাড়াতাড়ি বলো।’
‘স্যার- এসব যা যা আপনি পড়ান… মহাকাশ, চুম্বক, বিদ্যুত- সব ত’ আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতের তৌফিকে সৃষ্টি, না?’
অনন্ত সাধন ঠোঁট কামড়ান। পুরু চশমার পাওয়ারের নিচ দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘শোন- এ প্রশ্ন তোমরা ফিফথ পিরিয়ডে করলে ত’ হয়। যখন হুজুর আসবেন তোমাদের পড়াতে।’
‘কেন স্যার? এখন কেন করা যাবে না? বিজ্ঞান ত’ আল কোরআন আর আল কোরআন বিজ্ঞান। এ বিষয়ে আপনার কি কোন সন্দেহ আছে?’
‘দ্যাখো কোরান-হাদিস ভালভাবে বোঝার জন্য ত’ ফিফথ পিরিয়ড আছে। এখন-’
‘না- স্যার- আমার প্রশ্ন এড়ান কেন? মুসলমানের এক আল্লাহ, এক কোরান আর হযরত মোহাম্মদ সাল্লুল্লাহে আলায় উস সালাম তাঁর প্রেরিত পুরুষ। এটা তৌহিদ। এ আসমান-জমিন, চাঁদ-সূরুয, নদ-নদী, পাহাড়-সমুদ্র সব তাঁর হাতে সৃষ্টি। সারা জাহান তাঁকে সিজদা করছে। আল্লাহর কোন শরিক হয় না। আমাদের কালী-লক্ষী-সরস্বতী এসব হয় না। মাটির পুতুল হয় না যাদের হাত-পা ভেঙ্গে দিলে প্রতিবাদও করতে পারে না।’
অনন্ত সাধন স্যার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ঠিক আছে। আর মাত্র পনেরো দিন পরে তোমাদের পরীক্ষা-’
‘পরীক্ষার কথা বলবেন না। দিনের পর দিন আউট বুক থেকে পড়ান। ঐ সব হকিন্স-টকিন্সের গাঞ্জা!’
‘মানে?’
‘মানে নাস্তিক্যবাদের প্রচার চালাচ্ছেন। আপনার দেখাদেখি এ ক্লাসে মুসলিম ছাত্ররা এখন আল্লাহকে ঈশ্বর ডাকে, তারা কিবলা মানে না কিন্ত্ত বিগ ব্যাং মানে!’
এবার অনন্ত সাধন স্যার ক্ষেপে যান। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে এ স্কুলে তিনি এসেছিলেন। তেরো বছর ধরে পড়াচ্ছেন। তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক। এ স্কুলের বেশ কয়েকটি কৃষ্ঞচূড়া, অশোক, কদম, রাধাচূড়া, জারুল গাছ তাঁর হাতে লাগানো। স্কুলের একমাত্র পাঠাগারটি স্কুল পরিচালনা কমিটির সাথে তার অক্লান্ত দেন-দরবারের ফসল। তিল তিল করে জমানো টাকায় কেনা পাঠাগারের বুক শেলফ, বড় বড় পৃথিবীর গ্লোব থেকে শুরু করে সব কিছু। ঢাকা ছোটেন প্রতি মাসে পাঠাগারের জন্য এটা সেটা কিনতে। বিয়ে ত’ করলেন সেদিন! একটা চার বছরের মেয়ে আছে তার। ঈশ্বরকণা নাম। স্যার শ্যামলা কিন্ত্ত বউদি একদম ধবধবে সাদা। মেয়েটি মা’র মত ফুটফুটে। গোলাপী সাদা বল প্রিন্টের একটি ফ্রক পরিয়ে স্যার তাকে মাঝে মাঝে স্কুলে আনেন।
‘ঈশ্বরকণা- কেমন আছো?’
‘ভা-লো!’ ঈশ্বরকণা হাসে।
‘চকলেট খাবে?’
‘কাবো- দাও!’ ঈশ্বরকণা তার নাদুস নুদুস গোল গোল দু’টো হাত বাড়িয়ে দেয়।
নিজামের একের পর এক কুযুক্তিতে অস্থির হয়ে এবার অনন্ত স্যার বললেন, ‘তুমি এখন থামবে? ক্লাসের ত্রিশ মিনিট সময় খেয়ে ফেলেছো?’
‘মানে স্যার আল্লাহ-রসুলের কথা তোলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে আপনার সময় যায়? আমাদের আল্লাহ রসুলকে আপনি অপমান করেন কোন্ সাহসে?’
‘মানে? আমি কখন অপমান করলাম? কথা ত’ সব তুমি বলছো। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্ত্ত হেড স্যারের কাছে কমপ্লেন দেব।’
‘তা’ ত’ দেবেন। হেড স্যারও ত’ আপনার মত হিন্দু। রাম আর বামেরা মিলে সব স্কুলে নাস্তিকতা ছড়াচ্ছেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে গান-বাজনা বেলেল্লাপনা! কোন্ সাহসে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে আল্লাহ রসুলকে নিয়ে বাজে কথা বলেন?’
‘তুমি- তুমি কি বলছো এসব?’
নিজামের দেখাদেখি ওর চার স্যাঙ্গাত এবার কুকুরের ডাক দেওয়া শুরু করে।
‘থামবে তোমরা?’
স্যার ডাস্টারের বাড়ি দেন টেবিলে ক্লাস কন্ট্রোলে আনার জন্য। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে ‘নীহারিকা বিজ্ঞান চক্রে’র নামে স্কুলের সায়েন্স ক্লাবের এ ক্লাসে আমরা যে ক’জন স্যারের প্রিয় ছাত্র আছি, কেউ কিছু বলতে পারি না। আমাদের চোখের পলক ফেলার আগে সব ঘটনা হুড়মুড়িয়ে ঘটতে থাকে। নিজামের চার স্যাঙ্গাতের দু’জন ছুটে যায় স্কুলের ঘন্টা বাজাতে আর দু’জন স্কুল গেট পার হয়ে ছুটে যায়। ওদের সাথে স্কুলের দু’জন পিওন রমিজ আর উবায়দুল কোথায় যাচ্ছে?
বেলা প্রায় একটার মতো বেজে আসছে। তৃতীয় ক্লাসের সময় শেষ।
‘ধু-র! ক্লাসটা ঠিক মতো পড়ানো গেল না। আগামীকাল রুটিনে না থাকলেও একটা বাড়তি ক্লাস নেবো তোমাদের- সকাল নয়টার দিকে। দশটায় ত’ শুরু হয়? তার আগে এক ঘন্টা!’
এটুকু বলে অনন্ত সাধন স্যার তাঁর রোল কল করার খাতা, চক-ডাস্টার নিয়ে বের হতে না হতে আমাদের কাণে আসে একটি ঘোষণা:
‘অত্র এলাকার সকল ঈমানদার মুসলমান নর-নারীর প্রতি একটি ঘোষণা! গত প্রায় দেড় যুগ ধরিয়া দু’জন হিন্দু মালাউন শিক্ষক যথাক্রমে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকুরি নিয়া শোলাবুনিয়া সরকারী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে নাস্তিকতা ও হিন্দুয়ানী মতবাদের প্রচার করিতেছে। নাউযুবিল্লাহ্! হিন্দু শিক্ষকেরা ক্লাসে আল্লাহ্ ও আমাদের প্রাণের নবীকে নিয়া কটুক্তি করে, বিদ্রুপ করে আর আমরা দিনের পর দিন তাহা সহ্য করিতেছি।
আজ শোলাবুনিয়ার স্কুল হিন্দু ও নাস্তেকদের হাত থেকে রক্ষা করিবার দায়িত্ব অত্র অঞ্চলের প্রতিটি ঈমানদার নর-নারীর। স্কুল রক্ষা করিতে প্রত্যেক মুসলমান স্কুলে চলিয়া আসুন!’
২.
এখনো টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ে নি। ব্যাগ থেকে টিফিন বের করে খাব কি তার আগে দেখি দুদ্দাড় করে মাথায় টুপি পরা কিম্বা টুপি পরতে পরতে, হাতে লাঠি-সোটা নিয়ে ছুটে আসছে শ’য় শ’য় মানুষ। স্কুলের গেট ঠেলে ধাক্কিয়ে ঢুকছে হাজার হাজার পুরুষ এমনকি মহিলা। অথচ, আমাদের বালক বিদ্যালয়ে এর আগে কখনো কোন মহিলা ঢোকে নি। হাজার দেড়েক মুসল্লী স্কুলের মাঠের ঘাস পাড়িয়ে ছুটে এলো হেড টিচারের রুমে। আমরা ভয় ভয় মুখে, হেড টিচারের রুমের সামনে গেলাম। জানালার ফাঁক থেকে দেখি হেড স্যার দরদর করে ঘামছেন। দু’হাত জোড় করে বলছেন, ‘আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। অনন্ত সাধন আজ তেরো বছর এ স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। আর বিজ্ঞান ক্লাসে ত’…’
‘বিজ্ঞান ক্লাসে কি? আল্লাহ রসুলের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবে? নাস্তিকতা প্রচার করবে? হিন্দুয়ানী শিখাবে?’
‘তা’ কেন শিখাবে? বিজ্ঞান ক্লাসে সে বিজ্ঞানের পড়া পড়ায়।’
‘রাখেন অনিল বাবু! ঐসব বাবুগিরি আপনাদের ভারত গিয়ে করেন। এটা মুসলমানের দেশ। আমাদের আল্লাহ-নবী নিয়ে কটুক্তি করবেন আর আমরা সহ্য করবো তা’ হবে না। কে কোথায় আছিস?’
স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান সালিশকারীর ভূমিকায়। কিছুদিন থেকে শুনছিলাম ওনার ফুপাতো বোনকে প্রধান শিক্ষক আর শ্যালককে সহকারী প্রধান শিক্ষকের ভূমিকায় আনতে চাচ্ছেন। লোকাল এমপিও স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওলানা খন্দকার রব সাহেবের পক্ষে। এমপি সাহেব নাকি কিছুদিন আগে স্কুল কমিটিতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছেন কিন্ত্ত বেয়াড়া অনিল কান্তি সরকার স্যার নাকি মুখের উপর বলেছেন এলাকার মাফিয়া গডফাদারের পাপের টাকা দিয়ে তিনি সারস্বত সাধনা হতে দিতে পারেন না।
‘ঐ কি সরস্বতী সাধনা না কি ওসব হবে না এখানে, বুঝলা তুমি ঠ্যাটা মাস্টার?’
স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান দাঁত-মুখ ভেংচি কাটে। স্কুলের দু’জন পিওন এবার সবার সামনে চলে আসে। আমাদের চোখের সামনে তারা হেড স্যার আর এ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যারের দু’গালে দু’টো দু’টো চারটা চড় মারে।
এবার বিষ্ফারিত আমাদের চোখের সামনে দিয়ে রাস্তার অচেনা অনেকগুলো মানুষ এসে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে হেড স্যার আর এ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যারের জামার কলার ধরে চেপে ঠেলা দিয়ে ক্লাস থেকে ধাক্কা দিয়ে স্কুলের মাঠে নামায়। এরপর শুরু হয় বেদম পিটানি। যেন সাপ পিটাচ্ছে কেউ! স্যারদের জামা-প্যান্ট ছিঁড়ে যাচ্ছে। নাক-মুখ বেয়ে রক্ত নামছে। ভুগোল স্যার মানে আরিফ স্যার সামনে দৌড়ে গেলেন।
‘ল নিজের হাতে তুলে নেবেন না! পুলিশকে আসতে দিন। দরকারে আদালতে পাঠান। তবু ওনরা দু’জন শিক্ষক মানুষ- ওনাদের সাথে এমন করেন না।’
আরিফ স্যার সামনে আসায় আমরা মনে একটু জোর পেতে থাকি। ‘নীহারিকা বিজ্ঞান চক্রে’র আমরা ক’জন সামনে ছুটি, ‘স্যারদের এভাবে মেরেন না।’
‘থাম শালা কাফেরের বাচ্চা! ঐটার চাচাতো বোণ ত’ সেদিন আল্লাহ-রসুলের অপমান করায় হাজতে গেছে! বেশ্যা মাগী কোথাকার!’
উত্তেজিত জনতা এবার আমাদের ন/দশ জনের দিকেও তেড়ে আসে। সে তাড়নার চেয়ে কাণে ধক ধক করে বাজতে থাকে অনুপস্থিত নীলা আপাকে লক্ষ্য করে ‘বেশ্যা মাগী’ শব্দ দু’টো। গত বছর পহেলা বৈশাখে নীলা আপা সাদা শাড়ি লাল পাড় পরে সেজেছিল। সে ছবিতে এমন ছেলেদের মত ছাঁটা চুল, পাজামা-ফতুয়া-কোটি পরা না। কেমন অন্যরকম দেখতে! চুলে বেলীর মালা পরা। নীলা আপা বেশ্যা মাগী? আমি কাঁদতে শুরু করি। মাথার উপর থেকে জুন মাসের আকাশ সহসা অনেকটা বৃষ্টি নামিয়ে দেয়। প্রথমে টিপ টিপ আর তারপর অনেকটা ধারায়। আর সে বৃষ্টির ভেতর ঝাপসা হয়ে আসা চোখে দেখি ছেঁড়া জামা, জামার নিচে সাদা গেঞ্জি হাঁ করে বের হয়ে এসেছে অবস্থায় হেড স্যার আর এ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার দু’জনকে ধাক্কা দিয়ে ভ্যানে ঠেলে তুলছে পুলিশ।
৩.
প্রথমে নীলা আপা আর তারপর অনিল স্যার আর অনন্ত সাধন স্যারের হাল দেখে বাসা থেকে ভয়ে আমাকে ক’মাসের জন্য ঢাকায় পাঠানো হলো। সবার চেয়ে বড় চাচার বাসায়। ক’মাস ঘরে থেকে খুব পড়লাম। এলাকায় এর ভেতরে আমার বড় ফুপুর ছেলের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছিল শিবিরের ছেলেরা। সব মিলিয়ে বাসায় খুব ভয়ে ছিল প্রত্যেকে। তবে, সামনে পরীক্ষা। এখন ত’ এলাকায় ফিরতে হবে। ঢাকায় বড় চাচার বাসায় রাতে আমার ঘুম হতো না ভাল করে। ঘুমের ভেতর দেখতাম অনন্ত স্যারকে কারা কিল-ঘুষি মারছে! আমি বিজ্ঞানে সবসময় ক্লাসের ভেতর সেরা নম্বর পেয়েছি। হেড স্যার আর অনন্ত স্যার দু’জনের চাকরি নাকি চলে গেছে। দু’জনে জেল খাটছেন। সেদিন বিকেলে থানা হাজতে যাবার পর স্থানীয় এমপি সাহেবও নাকি সবার সামনে ওনাদের দু’জনের গালে চড় মেরেছেন। ‘শালা’ বলে কাণ ধরিয়ে নিল ডাউন করিয়ে রেখেছেন। আর নীলা আপা এখনো ছাড়া পান নি। মাঝে মাঝে স্বপ্নে অনন্ত স্যারকে দেখি। স্যারের হাতে একটি লম্বা টেলিস্কোপ।
‘পাভেল- ঐ যে শনির বলয়!’
স্যারের কাছে গিয়ে ঝুঁকে আমিও টেলিস্কোপের ভেতর থেকে আকাশের দিকে চোখ রাখি।গলা থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হয়। বড় চাচী ছুটে আসে।
‘ঘুম আসছে না? না বোবায় পেয়েছে? উফ্! পরের ছেলে এভাবে দিনের পর দিন ঘরে রাখলে পরে বড় কোন অসুখ হলে আমাদের দোষ হবে।’
‘স্যরি চাচী।’
গায়ে কাঁথা জড়িয়ে কাত হয়ে ফিরি।
পরের দিন সকালে বড় চাচা সব শুনে আমার জন্য কি কি ট্যাবলেটের ব্যবস্থা করেন। তিন বেলা পড়ার পর হাল্কা গরম দুধের সাথে খেতে হয়। আমি এক বেলা খেলাম কি আর এক বেলা ওষুধ জানালা থেকে ফেলে দি। সারা দুপুর অঙ্ক করি। দুপুরে ঘুম হয় না বলে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। তখন প্রচণ্ড বড় আর ঝকঝকে একটা বাস আসে আমার কাছে। বাসটা আমাকে নিয়ে শোলাবুনিয়া ছোটে। শোলাবুনিয়া নামতে না নামতে আমি নীলা আপাকে দেখি। শোলাবুনিয়া উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের সামনে কৃষ্ঞচূড়া ঝরে পড়া পথে আমি নীলা আপার পাশে হাঁটছি। শাড়ি পরেছেন নীলা আপা। চুলে বেলী ফুলের মালা। আর কোথা থেকে যেন একা একা এদিকে ছুটে আসছে ঈশ্বরকণা। ফুটফুটে গোল দু’টো হাতে ঘটি হাতা গোলাপী সাদা বল প্রিন্টের জামা।
‘ঈশ্বরকণা- চকলেট খাবে?’
‘পাবেল দা- আমাকে চকলেট দাও। নীলা দিদি-’
‘আমার কেন কোন বোন হলো না নীলা আপা? না বড় বোন না ছোট বোন!’
‘কেন? আমি আছি- ঈশ্বরকণা আছে!’
‘কিন্ত্ত কেউ যদি তোমরা না থাকো নীলা আপা? তোমরা যদি সব হারিয়ে যাও?’
‘বোকা-’
আমি এক হাতে ঝুঁকে ঈশ্বরকণাকে চকলেট আর এক হাতে নীলা আপাকে স্টিফেন হকিন্সের একটি ছবি দিতে গিয়ে কেমন মাথায় ধাক্কা লাগে! তাকিয়ে দেখি খাট থেকে ঘুমের ঘোরে মেঝেতে পড়ে গেছি।
কবি,কথাসাহিত্যিক