| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

হন্ডুরাস অনুবাদ গল্প: ধ্বংসের মাঝখানে মারিয়া । এউখেনিয়া রামোস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Maria Eugenia Ramos

মারিয়া এউখেনিয়া রামোস হন্ডুরাসের সাহিত্যে বিংশ শতকের তর্ক সাপেক্ষে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বর্ষীয়ান এই সাহিত্যিক ১৯৭৮ সাল থেকে সে দেশ এবং লাতিন দুনিয়ায় বেশ কিছু পুরষ্কারে ভূষিত হয়ে চলেছেন। বাংলা ভাষায় এই প্রথমবার হন্ডুরাসের কোন সাহিত্যিকের কাজ অনুবাদ করা হল।


গাছের তলার পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরটাকে চাঁদের আলোয় ঝাপসা লাগছিল। উত্তর দিকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে হওয়া যুদ্ধের কোলাহলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছোট জঙ্গলটা যেন এক বাধ্যতামূলক শান্তিতে ডুবে ছিল। যেভাবে জলের ভেতর জাহাজ ডুবে থাকে। যেন হঠাত করেই বর্মে ডুবে থাকা কোলাহল ছায়ায় বিস্ফোরিত হল। যেন আরাম পাইন গাছের ডাল থেকে ঝুলতে ঝুলতে হঠাত ছিটকে পড়ল। গাছেদের ভেজা শিকড়ে আশ্রয় খুঁজে ফেরা প্রেতাত্মাদের দূরে ছিটকে দিল। রাজা পিটারের অনুরাগী একদল পরাজিত গেরিলা যোদ্ধা, ধুলোমাখা অস্ত্র আর ছেঁড়া পতাকা কাঁধে, সিংহাসনের প্রধান উত্তরাধিকারী যুবরাজ মাইকেলকে সঙ্গে করে পথ দেখিয়ে স্বদেশের মাটিতে ফিরে এল। কুঁড়েঘরটা আগে পরিত্যক্ত ছিল। লোকজন ওখানে আটকে গিয়েছিল। নিজেরা ছোটখাট গোপন এক বৈঠক সেরে নিল। কিছুক্ষণ পরে ছোটখাট বাহিনী ফের যাত্রা শুরু করল। কিন্তু দলের চারজন ঘোড়সওয়ার ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। তারপর হাতের মশাল জ্বালাল। যিনি বয়স্ক ছিলেন, তিনি একজন উঁচু পদের অভিজাত শ্রেণির মানুষ, পোশাক দেখেই বোঝা যায়। তরোয়ালের হাতলের পিছন দিক দিয়ে নড়বড়ে কড়া ভেঙে ফেললেন। সামান্য ঠেলা দিতেই দরজাটা হাল ছেড়ে দিল। মশালের আলোয় দেখা গেল সবার সামনে কুঁড়েঘরের বিবর্ণ দেওয়াল নির্লজ্জের মত হাট করে উন্মুক্ত হয়ে গেল। ঘরের ছাদ থেকে বাদুড়ের মত ঝুলছিল নিস্তব্ধতা। দুজন সৈনিক এগিয়ে গিয়ে শতচ্ছিন্ন বিছানার চাদর ধরে সজোরে নাড়া দিল। বিছানা, একটা টেবিল, দুটো ভাঙা বেঞ্চ, একটা কাঠের আলমারি, একটা পুরনো সিন্দুক… গোটা ঘরটায় আসবাব বলতে এই ছিল। ছেঁড়া জাজিম, ধুলোভরা চাদর দূরে পড়ে রইল। সেই জায়গায় রাজকীয় চিহ্ন আঁকা এক পুরু ভারী কম্বল পেতে বয়স্ক মানুষটি সম্ভ্রমের স্বরে বলে উঠলেন- ঘুমান, মহামান্য! আমি আর আমার সৈনিকেরা বাইরে জেগে থাকব আপনার পাহারায়। যুবরাজ অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কোমর থেকে তরোয়াল খুলে রাখলেন। তারপর সদ্য পাতা বিছানায় পোশাক পরেই শুয়ে পড়লেন। অভিজাত মানুষটির এক ইঙ্গিতে সৈনিকেরা দেওয়ালের এক গর্তে জ্বলন্ত মশাল গুঁজে রেখে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।  

বেশ কয়েক ঘন্টা পরে যুবরাজ ঘুম ভেঙে উঠে অনুভব করলেন যে ঘরে তিনি একা নেই। কিন্তু চারদিকে চেয়ে ঘরে কাউকে দেখতে পেলেন না। মশাল তখন প্রায় নিবে এসেছে। সারা ঘরে নিবু নিবু আলো আর মেঝে ছাই ভরা। যুবরাজের মন খুব তিক্ত লাগল। তাঁর নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছিল। সঙ্গে আর কেউ নেই শুধু সেই তিনজন বিশ্বস্ত অনুগামী ছাড়া। এই দীন নোংরা কুঁড়েঘরে তারা অপেক্ষা করছে তাদের দেয়া সেই প্রতিশ্রুতিগুলি আবার পূরণ করবার লক্ষ্যে। মেঝেয় পরা ছাইয়ের স্তূপের দিকে অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে রইলেন। হঠাত ছাইয়ের উপরে দুটো হালকা পায়ের ছাপ ফুটে উঠল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। নির্ভয়ে (ভয় পাবার কোন কারণ নেই সেজন্য) যুবরাজ হাঁটু মুড়ে বসলেন। পা দুটো চিমনির দিকটায় এগিয়ে গেল। প্রতিটা পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলো যে যার জায়গায় ফিরে যাচ্ছিল। সবকিছু সাজানো গোছানো ও চকচকে হয়ে গেল। যেমনটা কল্পনা করা গিয়েছিল ঠিক তেমনই,… আবছা আলোয় এক তরুণী নারীর চেহারা ধীরে ধীরে ফুটে উঠল। যেন ছাইয়ের মাঝখানে সে ভাসছে। মেয়েটা বিছানার কাছে এল। যুবরাজের ঠিক পাশে এসে বসল। যুবরাজ হাত বাড়িয়ে নরম চুলের স্পর্শ অনুভব করতে চাইলেন। ঘোড়ার পিঠের কর্কশ জিনের চাইতে সে স্পর্শ এত আলাদা। মুখে হাত বুলিয়ে আদর করলেন। সেই শীতল ভেজা ঠোঁটের উপর কয়েক মুহূর্ত থেমে রইলেন। শেষমেশ ঘাড় দিয়ে নামিয়ে আনলেন ঠোঁট। শরীরের প্রতি আকর্ষণ যুবরাজকে ভুলিয়ে দিয়েছিল ভয়ের কথা। ক্লান্তির কথা। মেয়েটার কানে কানে কিছু বললেন তিনি।
ভোর হয়ে এসেছিল। খড়ের বিছানার উপরে ছাইসুন্দরীর চোখ খোলা ছিল। সে তার কাপড়ের পুতুল আঁকড়ে ছিল। তার দিকে পিঠ করে যুবরাজ ঘুমাচ্ছিলেন। শীত তাদের চারপাশ থেকে দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর কখনও সখনও জানলার শার্সির ফাঁকে ফ্যাকাশে আঙুল বেয়ে ঢুকে পড়ছিল। হঠাত দরজা খুলে গেল এবং একটা কুকুর সেই ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। খেলনার মত তার আকার। এটা খেলনাই। তবে জ্যান্ত খেলনা।

ছাইসুন্দরীর মনে পড়ল দুঃস্বপ্নের কথা যা ছোট থেকে তার সঙ্গী। একাকীত্বের নিষ্করুণ ভূত যারা বারে বারে নানা রূপে তাকে কষ্ট দিয়ে এসেছে। ঘরের মাঝখানে কুকুরটা আটকে গেছিল। যতই চেষ্টা করুক না কেন, ছাইসুন্দরী নিজের চোখ আর বুজতে পারে না। কুকুরটা চিৎকার করতে শুরু করেছে। কিন্তু তার ডাক শুধু ছাইসুন্দরীর কানে পৌঁছচ্ছে। এরকম যে হবে মেয়েটা তা জানত। নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছে। সেই নিষ্ঠুর দাঁতগুলো এখন তাকে আঁচড়াবে। সেই পাতলা জিভ তার রক্ত চাটবে। এদিকে সদ্য মৃত যুবরাজের শরীর ছাইয়ের ভিতর কবর দেয়া হয়েছে। সে দুঃখ থেকে সদ্য মুক্তি পেয়েছে এখন মেয়েটি, কিন্তু ওর জন্য এই জিভের কোন সহানুভূতি থাকবে না। মেয়েটা জানে এই কাজ কতখানি বৃথা করল সে! ক্লান্ত গলায় যুবরাজকে ডাকে ছাইসুন্দরী। একটু শব্দ দিয়েই তো তিনি ওকে বাঁচিয়ে দিতে পারেন। কাছে অন্য আর একজন মানুষের উপস্থিতি অনুভব করেই তো মেয়েটার দুঃস্বপ্ন থেমে যেতে পারে। চিরকালের মত সে ফিরে যেতে পারে ধ্বংসের দুনিয়ায়। কিন্তু যুবরাজ ঘুমিয়ে আছেন। কেবল ওঁর নিজের লোকজনেরা এলেই তিনি জাগতে পারেন। ততক্ষণের জন্য মেঝের উপর শুধু মেয়েটার ছেঁড়া পুতুল। কিন্তু সেটা ওকে ততটা অস্থির করে না। যুবরাজ যখন ঘোড়ার উপর চড়বেন তখন ভুলেই যাবেন সে রাতে কী হয়েছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত