হাছান মঞ্জিল, স্হাপিত ১৯৬৭। বাড়ির ফটকে বড় করে সিমেন্ট দিয়ে লেখা। দু-তিন হাত সামনে একটা কোমর সমান উঁচু দেয়ালের গা জুড়ে হরেক রকম পোস্টার। পোস্টার গুলো নিতান্ত সাধারণ, রঙের তেমন বাহুল্য নেই। নীল, সাদা অথবা হলদেটে কাগজের উপরে সাদা কালো ছাপার অক্ষরে লেখা ‘সুন্দর ও দ্রুত হাতের লেখা ‘, ‘লিঙ্কন একাডেমি ‘, ‘রয়েল ছাত্র হোষ্টেল’, অর্শ রোগ নিরাময়’, ‘ মা হোমিও হল’, হাজারিবাগ কাজী অফিসইত্যাদি । একটু দূরে শম্পা জেনারেল স্টোরে মাঝ বয়সি দাড়িওয়ালা একটা লোক কাউন্টারে ডিম, রুটি, চকলেটের বয়াম সরিয়ে ঝাড়পোঁছ করছে। একটা বাড়ির গ্যারাজের মধ্যে এক ফালি জায়গায় কোনোও মতে তিনটি টেবিল আর চারটাচেয়ার ফেলে গড়ে ওঠা মা ভেরাইটিজ স্টোরে খিচুড়ির ডেকচির ঢাকনা তুলেহাসিমুখে কাষ্টমারের প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে অল্প বয়সী একটা ছেলে।পাশেই তামান্না ফার্মেসীর সিড়ির উপরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে একটাকুকুর।কাউন্টারে বসা লোকটা খবরের কাগজ মেলে বসেছে, কোনও খরিদদার নেই। ‘একটুআগেই চলে এলাম নাকি?’ মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখে নজরুল। অনেক দিন ধরেইনজরুল হাতে ঘড়ি পরেনা। অবশ্য অনেকেই মোবাইল আসার পরে হাতে ঘড়ি পরা ছেড়েদিয়েছে । নজরুলের ঘড়ি না পরার কারনটা যদিও ভিন্ন। তার ছোট খালা সেবারইন্দোনেশিয়া থেকে একটা স্পোর্টস ওয়াচ এনে দিয়েছিলো। খুউব পছন্দ হয়েছিলঘড়িটা নজরুলের, দিনের প্রায় সবসময় ঘড়িটা তার হাতে থাকতো। তার বন্ধুদেরমধ্যে আর কারো হাতে তখনও পর্যন্ত বিদেশী ঘড়ি ওঠেনি। ওদের হাতে সস্তা কালোবেল্টের ক্যাসিও ঘড়ি দেখলেই সে ইচ্ছা করে বেশ ডাট নিয়ে প্রয়োজনের বেশী হাতনাড়িয়ে কথা বলতো। সেই ঘড়িটা জানালা দিয়ে চোর নিয়ে গেল। তারপর অনেকটাঅভিমান করেই আর ঘড়ি কেনা হয়নি তার।
সকাল সাড়ে নয়টা বাজে, তবে এ এলাকার লোকজনের আয়েসী জীবন দেখে মনে হচ্ছে সবে ঘুম ভেঙেছে। নজরুল এদিক ওদিক তাকায়, তাকে অফিস থেকে জুবিলী জেনারেল স্টোরে রহিম নামের একজনের সাথে দেখাকরতে বলা হয়েছে। রহিম সাহেব তাকে সাথে করে হাসান জুবায়ের খানের বাসায় নিয়েযাওয়ার কথা। হাসান জুবায়ের খান সাহেবই হাছান মঞ্জিলের বর্তমান মালিক। ‘কিন্তু জুবিলী জেনেরেল স্টোর টা কোথায়?’ এদিক ওদিক তাকায় নজরুল, খানিকটাদূরে আরও একটা খাবারের দোকান, কুঁড়েঘড় হোটেল।এইএক কান্ত, হোটেল আর রেস্টুরেন্টের মধ্যে পার্থক্যটা অনেকেই বোঝেনা।কু্ঁড়েঘর দোকানটা বেশ চলতি, নজরুল উঁকি মেরে দেখে বেশ কয়েকজন কাস্টমার দোকানের ভিতরে পাতা টেবিলগুলোদখল করে বসে আছে, বাইরেও কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে।আর দোকানটা মোটেও কুঁড়েঘর নয়, দিব্যি পাকা দালান।দোকানের বাইরে ফুটপাতে বিশাল লোহার তাওয়ায় একটাছেলে অনবরত পরাটা ভাজছে,হরদম অর্ডার আসছে ভিতর থেকে। নজরুল বাইরে দাঁড়িয়েই দুটো পরাটা, একটা ডাল আরএকটা ডিম ভাজা অর্ডার দেয়। দোকানের বেশীরভাগ কাস্টমার রঙিন পাজামা -পাঞ্জাবি পরা কম বয়সী ছেলে, তাদের সবার মাথায় বাহারি কাজ করা সাদা টুপি। আশে পাশে কোথাও হয়তো মাদ্রাসা আছে। দোকানের ভিতর থেকে একটা বেয়ারা একটাখালি সিটের ব্যবস্হা করে নজরুলকে ডাক দেয়,’ভাইয়া আপনের নাস্তা’। খেতে খেতেনজরুল খেয়াল করে ক্যাশে বসা লোকটি দেখতে বেশ তেল তেলে আর হাসিখুশি মেজাজের। মাথার চুলে তেল দিয়ে সিঁথি কেটে আচরানো, গায়ে প্রিন্টেড লিলেন কাপড়ের শার্ট, পরনে ডেনিমের প্যান্ট আর হাতে মস্ত সিলভার কালারের ঘড়ি। কাস্টমারদেরমধ্যে সে যে বেশ জনপ্রিয় সেটা বোঝা যাচ্ছে। সবার সাথেই সে হেসে হেসে কথাবলছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে এফ এম রেডিওতে বাজতে থাকা গানের তালে তালে মাথানাড়াচ্ছে। একটা নতুন গান শুরু হলে কাস্টমারদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘শামিম ভাই, সিনামার গান?’ শামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।এ মুহুর্তে যেগানটি বাজছে নজরুল সেটার কথা গুলো বুঝতে চেষ্টা করে। গানটি নজরুল প্রথমবারের মত শুনছে, ‘ মেয়ে তোর কোকড়া কোকড়া চুলে যেন সমুদ্রের ঢেউ খেলে, সেইঢেউ খেলা দেখিতে আমার ভাল্লাগে,/ তোর গোলাপ গোলাপ ঠোঁটে যখন মিষ্টি হাসিওঠে, সেই হাসি দেখিতে আমার ভাল্লাগে’ ইত্যাদি। নজরুলের কাছে গানের কথাগুলোসুবিধার লাগে না তবে বেশ বিটের গান, উত্তেজক।আজকাল সবকিছুতেই উত্তেজনা রাজনীতি, খেলা ,গান … পরাটা চিবাতে চিবাতে ভাবে নজরুল। দোকানে খেতে আসা কম বয়সীছেলেদের দু’একজন রেডিওর সাথে থেকে থেকে ভাল্লাগে বলে গলা মিলাচ্ছে, কেউকেউ টেবিলে তবলা বাজানোর মত করে তাল দিচ্ছে। নজরুল হাত ধুয়ে কাউন্টারে বিলদিতে আসলে শামিম মাথা নাড়িয়ে বেশ দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে, ‘ চুলেরবিষয়ে গান, বোঝলেন’। নজরুল হাসি চেপে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায়। দোকান থেকেবের হয়ে আসার সময় যে ছেলটা পরাটা ভাজছে তাকে জুবলী জেনারেল স্টোরের কথা জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটি রাস্তার উল্টো দিকে একটা ভাঙ্গারির দোকান দেখিয়ে দেয়। নজরুল অবিশ্বাসের চোখে বহুকালের ধুলোয় আচ্ছন্ন ভাঙারির দোকানের সাইনবোর্ডে জুবিলী জেনারেল স্টোর নামটি দেখতে পায়। এমন একটা দোকানের নাম জুবিলী কে রাখলো, কেনই বা রাখলো নজরুল ভেবে পায়না। নিজেকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই সে বলে ওঠে, ‘ভাঙ্গারির দোকান সেটা আবার ভ্যারাইটিজ স্টোর! একেই বলে ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম…”
রহিম নামের লোকটি দোকানের ভিতরেই ছিলো।নজরুল নিজের পরিচয় দিতেই লম্বা, ভাঙাচোরা চেহারার লোকটা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে নজরুলকে সালাম দেয়। নজরুলকে বসার জন্য একটা টুল এগিয়ে দিয়ে লুঙ্গির কোঁচর থেকে একটা বাটন ফোন বের করে কাউকে ফোন দেয়। নজরুল সামনের রাস্তায় তাকিয়ে থাকে।এরই মধ্যে রাস্তায় রিক্সার জ্যাম লেগে গিয়েছে। আশে পাশে বেশ অনেকগুলো হাইরাইজড বিল্ডিং। কিছুদিন আগেও এ এলাকায় সারি সারি টেনারী ছিলো। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা এখানে লড়ি, ট্রাক আর শ্রমিকদের ভিড় লেগে থাকতো। বাতাসে চামড়ার গন্ধ ছড়িয়ে যেত বহুদুর।এখন অবশ্য চামড়ার গন্ধ পেতে হলে আরও ভিতরে যেতে হবে। নজরুলের মনে পরে, মাস দুই তিন আগে একটা দাপ্তরিক কাগজ বের করার জন্য তুলাগাছ তলা রোডে কাউন্সেলর অফিসে তার যেতে হয়েছিল। সেদিন মেইন রোডে জ্যাম থাকায় রিকসাওয়ালা ট্যানারির মোড় কাঁচাবাজারের পিছন দিয়ে একটা গলির ভিতর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।সে কি আর সাধারন গলিরে বাবা! গলির পেটের মধ্যে গলি, তারপর তস্য গলি। একটা সাইকেল রিক্সা ঢুকলে একজন মানুষও পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেনা।মনে হচ্ছিলো রাস্তা না কারো বাড়ির উঠোন, বারান্দা ভেদ করে এগুচ্ছি।তাও দিনের বেলা বলে রক্ষা,রাত হলে নিরিবিলি এসব গলিতে গা ছমছম ভয় লাগতো।
রহিম জানায় খান সাহেব একটায় নজরুলকে নিয়ে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন। এখনও হাতে প্রায় তিন – সাড়ে তিন ঘন্টাসময়। নজরুলের অফিস বনানীতে। এখন বনানী গেলে কোনো কাজ হবেনা, যেতে এক – দেড়ঘন্টা আসতেও তাই কাজেই যাওয়া আসাই সার হবে। অগত্যা নজরুল আশে পাশের এলাকাএকটা চক্কর দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। একটু এগুলেই একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চোখে পরে। সেটাকে পাশ রেখে ভিতরে যে গলিটা গিয়েছে সেটার ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও, সমস্ত দেকান পাটের ঝাপ ফেলা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশেছোট টং-দোকানে চা বিক্রি হচ্ছে। ঠিক তার উল্টো দিকে মিউনিসিপালিটির ময়লার ভ্যান দাঁড় করিয়ে চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে চুমুক দিচ্ছে ক্লিনারের দল। তাদেরটুকরো টুকরো গল্পের ভাজে আয়েসি চুমুকের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ শব্দ গা ঢাকা দিচ্ছে।ভ্যানের গা ঘেষে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দুটো কুকুরের দিকে দু’টুকরোকেক ছুড়ে দেয় ওদেরই একজন, কুকুর দুটো দৌড়ে আসে। নজরুল কি মনে করে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢুকে পরে। সকাল হলেও বেশ কয়েকজন রোগী ভিতরে৷ এত্তসকালে এখানে কি করে এরা? হয়তো গ্লুকোজ খেয়ে অপেক্ষা করছে রক্তের নমুনাদেওয়ার জন্য। খালি পেটে আর কি কি পরীক্ষা করতে হয়? যার যা খুশি করুক, নিজের মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে নজরুল একটা খালি চেয়ারে বসে পরে চোখ বন্ধ করে, একটু ঝিমুনি এসে যায়। এসির বাতাসে এতক্ষণ আরাম লাগলেও এখন একটু শীতশীত বোধ হয় নজরুলের, কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না। পাশেই চাপা স্বরে কেউ একজন ধমকাচ্ছে কাউকে, ” কি দরকার, কি, কেন তাকে খবর দিতে হইবো অহন?’ জবাবে একটা মেয়ে কন্ঠ বলে ওঠে, ‘ ও আমাদের ছোড বইন, ভাইজান, আব্বার ছোড মাইয়া, আব্বায় মইরা যাইতাছে, হেয় একবার দেখতো না?” পুরুষ কন্ঠটি ফেরবলে,” না, আব্বায় অরে দেখতে চায় নাইক্কা। অক্খন আইলে হগ্গল সম্পত্তির মধ্যে ভাগ বসাইবো, মাগার আমি হেইডা হইতে দিতাম না। মহিলা কন্ঠ আবার বলে, “ক্যানভাইজান, আফনে হক্ক মত আমগো চাইয়া বেশী পাইবেন, আমরা বাল বাচ্চা লইয়া সংসার করি, আমগোর হাতে টাকা পয়সা না থাকলে শ্বউর বাড়িত দাম থাহেনা। আমগো হক্ক মারবেন ক্যান।” ” পলাইয়া আম্মার গহনা লইয়া জসিমেরলগে ভাগোনের সময় হক্কের কতা মনে আছিল না? আমি এইসব…” পুরুষ কন্ঠের কথাশেষ হবার আগেই কাউন্টার থেকে নার্সের কন্ঠ ভেসে আসে, ” ডায়ালাইসিস এরনওয়াবুর তালুকদারের অ্যাটেনডেন্ট…”। এবার মহিলা কন্ঠ কাঁদো কাঁদো স্বরেবলে, ” আমগো এত তাড়তাড়ি ডাকতাছে ক্যান, আব্বায় বুজি …হায় আল্লাহ “। নজরুল চোখ খুলে ছাপা কাপড়েরবোরখা পড়া একজন মহিলাকে নার্সের সাথে করিডোর ধরে এগিয়ে যেতে দেখে। কিন্তুএত লোকের ভীড়ে পুরুষ লেকটি কে সেটা বের করা কঠিন। এতক্ষনে দরজার সামনে, কাউন্টারের সামনে বেশ ভীড় জমে উঠেছে।সামনের দেয়ালে লটকে থাকা টেলিভিশনের স্ক্রিনে সময় সকাল এগারোটা পঞ্চাশ।
নজরুল ফের জুবিলী জেনারেল স্টোরের উদ্দেশ্যে বের হয়। নজরুল ফেরার পথে খেয়াল করে সামনেই তালুকদার ভিলা নামকএকটা লাল গেইটওয়ালা বিল্ডিং।কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে সে। লালগেটের মাঝ বরাবর পকেট খুলে দারোয়ান গলা বের করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ঠিক তখনই “চাচা সরেন ” বলে দারোয়ানের পাশ কাটিয়ে স্কুল ড্রেস পরা একটা কিশোরী মেয়ে পীঠে ব্যাগ আর সামনে দুই বেনী ঝুলিয়ে বের হয়েরিক্সার জন্য দাঁড়ায়। নজরুল সেখানে আর না দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে।নজরুলের মনে একটা প্রশ্ন উদয় হয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালুকদার ভদ্রলোককি এই বাড়িরই লোক,নয়তো? হাঁটতে হাঁটতে আবার সে হাছান মঞ্জিলের কাছে এসেপরে। হাতে যেহেতু সময় আছে নজরুল হাছান মঞ্জিলের চারপাশটা ঘুরে দেখারসিদ্ধান্ত নেয়। হাছান মঞ্জিলের দেয়াল ধরে কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে একটা গলিপেয়ে গেল নজরুল।গলির মুখে কয়েকটি চার- পাঁচতলা বিল্ডিং। নজরুলের খুব মনেধরে বিল্ডিং গুলো। এরপর আরও কিছুটা গেলে হাছান মঞ্জিলের বাউন্ডারি দেয়ালটা আবার পেয়ে যায়সে। এপাশের দেয়ালের মাঝে লোহার গরাদ দেয়া একটা জানালা দেখে থমকে দাঁড়ায়। জানালাটির জীর্ণদশা। একপাশের কাঠের ফ্রেম সমেত একটাগরাদ ভেঙে ঝুলে আছে। এইসব পুরানো বাড়ির নিজস্ব কত গল্প থাকে। হয়তো এইজানালার ফাঁক গলে হাত বাড়িয়ে কত শিশু আইসক্রিম, হাওয়াই মিঠাই কিনেখেয়েছে, হয়তো কোনও কিশোর, বাবা- মায়ের নজর এড়িয়ে বন্ধুদের থেকে ভিডিওক্যাসেট আনিয়ে নিয়েছে, হয়তো কোন উদাস দুপুরে কোনও তরুনী তার প্রেমিকের মুখএক ঝলক দেখবে বলে জানালার গরাদ ধরে অপেক্ষায় থেকেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। সেইবাড়ি আজ বিক্রি হবে ডেভেলপার কম্পানির কাছে। খান সাহেবের কাছে মোটা টাকারলোভনীয় অফার নিয়ে এসেছে নজরুল তার কোম্পানির পক্ষ থেকে। নজরুলের দুঃসাহসনেই এমন একটি বাড়ি কেনার তবে সে মনে মনে খুব চায় কেউ যদি তাকে এমন একটাবাড়ি ভালোবেসে দিয়ে দিত! প্রায় রাতেই নজরুল সেই কাল্পনিক দাতার সাথে কথাবলে। বিশেষ করে যেদিন যেদিন সে কোনও পুরানো বাড়ির সাইট ভিজিট এ আসে। এরকমএকটা বাড়ি পেলে সে কোনও দিনও ভাঙতে দিত না। লম্বা বারান্দায় নয়ন তারা, মাধবীলতার ঝাড় ঝুলিয়ে দিত, ছাদে অনেকগুলো পায়রার ঘড় বানিয়ে দিত, মা -বাবা, ভাই বোনদের নিয়ে জমজমাট করে থাকতো আরও কত কি! ‘ বাড়ি ভাড়া, একতলায়এক রুম জানুয়ারী মাস থেকে ভাড়া হবে। ভাড়া আলোচনা সাপেক্ষ।যোগাযোগ : ০২-৯৭২৫৬৭’ একপাল্লার একটি লোহার গেটের শিকের সাথে ঝুলানো একটা টিনের নোটিশদেখে নিমিশে পড়ে ফেলে নজরুল। গেটটা খোলা থাকায় ভিতরে দেখার চেষ্টা করলেসরু গলির ভিতরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়না সে। নজরুল, খান সাহেবেরসাথে কল্পনায় কথোপকথন চালিয়ে যায়-
– তা নজরুল সাব, আপনে একা থাকবেন নাকি পরিবার সহ
– পরিবার সহ স্যার। আমার বাবা, মা আর ছোট দুই ভাই বোন
– আপনে শাদী করেন নাই?
– না স্যার। বেতন যা পাই তাতে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে ঢাকা বাসা নিয়ে থাকা সম্ভব না স্যার।
– আচ্ছা, ভালো, মা – বাবা’র কথা চিন্তায় থাকন ভালো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত স্যার?
– দেখতেই তো পাইতেছেন আমি আর আমার বেগম এইবাড়িতে থাকি। আপনে এই বাড়িতে থাকতে চাইলে নীচ তলা আর তিন তলা লইয়া থাকবেন।দোতালা আমার। ভাড়া দিতে হইবো না মাগার আমগোর দুইজনোর খাওয়ন দাওয়ন আপনে ব্যবস্হা করবেন।পারবেন না?
– পারবো স্যার। আমার মায়ের হাতের রান্না বেশ ভালো, তাছাড়া আমি নিজেও প্রফেশনাল রান্নার কোর্স করা।
– ভালো। তয় দেইখেন বাসাডারে আবার বাবুর্চিখানা বানাইয়া ফেইলেন না…
পাশ থেকে একটা এম্বুলেন্স সাই করে বের হয়ে যেতে যেতে নজরুলের ভাবনায় জ্যোতিচিহ্ন বসায়।এই দিক দিয়ে একটা রাস্তা হাজারিবাগ বাজারে গিয়ে মিশেছে। এ রাস্তাটাও বেশ জনবহুল।
নজরুল হাছান মঞ্জিলের এইপাশটা ভালোকরে দেখার চেষ্টা করে। মোবাইলে কম্পাস অন করে দিক ঠিক করে নেয়। ঠিকই ধরেছেসে এটা বাড়ির উত্তর দিক। এদিকের দেয়াল ফুঁড়ে কয়েকটা জায়গায় পাকুড় গাছশিকড় ছড়িয়েছে। দেয়াল থেকে মেইন বিল্ডিং অব্দি বাগান। নিম, কামরাঙা, কাঠবাদাম, নারকেল গাছ গলাগলি করে বেড়ে উঠে জায়গাটিকে ছায়াময় করে রেখেছেতবেপুরো বাড়িতে অযত্নের ছাপ বেশ স্পষ্ট।
নজরুল বাজারের রাস্তা ধরে আনমনে এগুতে থাকলে রাস্তার পাশের একটা ভাতের হোটেলেধুয়া ওঠা ভাতের গামলায় চোখ আটকে যায়। একটা ছেলে একটা ভিজে গামছা দিয়ে ভাতের গামলাটাকে ঢেকে দিলো। পাশেই একটা মসজিদ। নামাজের সময় নয় বলেমসজিদের পাশে অস্হায়ী ফল ওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসে পরেছে। তাদের ঝুড়িতেপেয়ারা, পেপে, ছফেদা, জলপাই, আমলকির ছোট বড় স্তুপ। শুধু একপাশে একজনেরঝুড়িতে হলুদ মাখানো নোনা ইলিশ।এদের ছেড়ে এগিয়ে যায় নজরুল। নজরুলের নাকেযেন গরম ভাতের ঘ্রান ভেসে আসে। এমন এক প্লেট গরম ভাতে নোনা ইলিশের ভর্তাহলে ইশ কি দারুন হয়! নজরুল শব্দ করে জিভের জল টেনে নেয়। মনে মনে সে নোনাইলিশের ভর্তা বানাতে লেগে যায়।নোনা ইলিশের মাঝ থেকে দুটো টুকরো নিয়েভালো করে ধুয়ে লবন ছাড়িয়ে নিতে হবে। এরপর অল্প হলুদ মেখে সময় নিয়ে কড়াকরে সরষের তেলে ভেজে নিতে হবে, লবন দেয়া যাবেনা। মাছ ভাজার তেলে পিয়াজ কুচি, রসুন কুচি, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ মচমচে করে ভেজে নিয়ে পাশে সরিয়ে রাখব ঠান্ডাহওয়ার জন্য। এবার সাবধানে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে সবকিছু হাতে ডলে মিশিয়েনিলেই হলো। নজরুল মনে করার চেষ্টা করে এমন ভর্তা সে শেষ কবে খেয়েছে। তাওতো মেরে কেটে সাত আট বৎসরের কম হবে না। ছোট খালা বানিয়ে খাইয়েছিলো। ছোটখালাও বিদেশ চলে গেল!
হাসান মঞ্জিলের সামনে এসে নজরুল রহিমকে ফোন দেয়। রহিম ফোনের ওপাশ থেকে তাকে অপেক্ষা করতে বলে। হাছান মঞ্জিলের দিকে তাকিয়েনজরুলনিজেকেই প্রশ্ন করে এই খান সাহেব লোকটা কেমন কে জানে? সে তার শরিকদের হক্কবুঝিয়ে দিচ্ছে তো? তার কি বোন আছে? তারা কি বিদেশে থাকে? নজরুল নিজেরঅভিজ্ঞতায় দেখেছে ঢাকা শহরে যাদের বাড়ি নেই তারা ঢাকায় থাকে, আর যাদেরবাড়ি আছে তারা সেই সব ছেড়ে বিদেশে পরে থাকে। মানুষের কি এক অদ্ভুত আচরন!নজরুল ফের তার পুরানো ভাবনায় ফিরে আসে, হাছান মঞ্জিল, ১৯৬৭ লেখাটা বেশকয়েকবার ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে পড়ে। লেখাটা তার মনে দাগ কেটেছে।বাড়িটাকে কেন্দ্র করে তার ভাবনারা আবর্তিত হতে থাকে:বাড়িটা মাত্র সাতান্ন বৎসর পুরানো , মাত্র দুই জেনারেশনের লোকজনবাড়িটিতে থেকেছে, এরমধ্যেই বাড়িটি ধুলায় মিশে যাবে! হয়তো আগামী তিন – চারবৎসর পরে তার কম্পানির করা নতুন ডিজাইনের নতুন বাড়িতে নতুন সব লোকজন থাকবেযাদের সাথে এ বাড়ির নাড়ির কোনও যোগাযোগ থাকবেনা। খান সাহেবরা একটা বা দুইটাফ্ল্যাট নিয়ে নিজের বাড়িতে পরবাসী হয়ে থাকবেন। বাড়িটার নামও হয়তো পাল্টেযাবে, কোম্পানির নাম যোগ হবে। হয়তো কোনও একটি বাহারি নামের সাথে যোগ হবেস্টেট, টাওয়ার, ভ্যালি,গার্ডেনের মত কিছু অপ্রয়োজনীয় শব্দ। আজকাল মানুষবড্ড অস্হির। আগে মানুষ একটা কাপড় না ছেঁড়া পর্যন্ত ফেলতো না; একটা বাড়িবাসের অযোগ্য হবার আগ পর্যন্ত মেরামত করে চালিয়ে নিত। বাড়ির নকশা হত বাড়িরসদস্যদের প্রয়োজন অনুযায়ী। আর এখন এক- দুইবার পরার পরেই যে কোনও কাপড়েরপ্রতি আকর্ষন হারিয়ে যায়,বাড়ির নকশা হয় কমার্শিয়াল ভ্যালুর বিবেচনায়। নজরুল দেয়ালে হাত বুলায়, বাড়িটার জন্য নজরুলের মনটা খারাপ হতে শুরু করে।হঠাৎই কয়েকটি প্রশ্ন তার মনে উদয় হয়, সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছাবাড়ির কি মৃত্যু হয় ,কিম্বামানুষের পরিচয়ের? ধরাযাক ,কেউহাসানমঞ্জিলের ঠিকানায় চিঠি পাঠালো এখন থেকে পাঁচ বছর পরে তখন পোস্ট অফিসের লোক কোথায় খুঁজবে সেই ঠিকানা?চিঠিটারই বা কোথায় ঠাঁই হবে?এসব ভিলা, মঞ্জিল শব্দগুলো কি সত্যিই হারিয়ে যাবে আমাদের ঠিকানাগুলো থেকে…’
হাছান মঞ্জিল, স্হাপিত ১৯৬৭। বাড়ির ফটকে বড় করেসিমেন্ট দিয়ে লেখা। দু-তিন হাত সামনে একটাকোমর সমান উঁচু দেয়ালের গা জুড়ে হরেক রকম পোস্টার। পোস্টার গুলো নিতান্ত সাধারণ, রঙের তেমন বাহুল্য নেই। নীল, সাদা অথবা হলদেটে কাগজের উপরে সাদা কালোছাপার অক্ষরে লেখা ‘সুন্দর ও দ্রুত হাতের লেখা ‘, ‘লিঙ্কন একাডেমি ‘, ‘রয়েল ছাত্র হোষ্টেল’, অর্শ রোগ নিরাময়’, ‘ মা হোমিও হল’, হাজারিবাগ কাজীঅফিসইত্যাদি । একটু দূরে শম্পা জেনারেল স্টোরে মাঝ বয়সি দাড়িওয়ালাএকটা লোক কাউন্টারে ডিম, রুটি, চকলেটের বয়াম সরিয়ে ঝাড়পোঁছ করছে। একটাবাড়ির গ্যারাজের মধ্যে এক ফালি জায়গায় কোনোও মতে তিনটি টেবিল আর চারটাচেয়ার ফেলে গড়ে ওঠা মা ভেরাইটিজ স্টোরে খিচুড়ির ডেকচির ঢাকনা তুলেহাসিমুখে কাষ্টমারের প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে অল্প বয়সী একটা ছেলে।পাশেই তামান্না ফার্মেসীর সিড়ির উপরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে একটাকুকুর।কাউন্টারে বসা লোকটা খবরের কাগজ মেলে বসেছে, কোনও খরিদদার নেই। ‘একটুআগেই চলে এলাম নাকি?’ মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখে নজরুল। অনেক দিন ধরেইনজরুল হাতে ঘড়ি পরেনা। অবশ্য অনেকেই মোবাইল আসার পরে হাতে ঘড়ি পরা ছেড়েদিয়েছে । নজরুলের ঘড়ি না পরার কারনটা যদিও ভিন্ন। তার ছোট খালা সেবারইন্দোনেশিয়া থেকে একটা স্পোর্টস ওয়াচ এনে দিয়েছিলো। খুউব পছন্দ হয়েছিলঘড়িটা নজরুলের, দিনের প্রায় সবসময় ঘড়িটা তার হাতে থাকতো। তার বন্ধুদেরমধ্যে আর কারো হাতে তখনও পর্যন্ত বিদেশী ঘড়ি ওঠেনি। ওদের হাতে সস্তা কালোবেল্টের ক্যাসিও ঘড়ি দেখলেই সে ইচ্ছা করে বেশ ডাট নিয়ে প্রয়োজনের বেশী হাতনাড়িয়ে কথা বলতো। সেই ঘড়িটা জানালা দিয়ে চোর নিয়ে গেল। তারপর অনেকটাঅভিমান করেই আর ঘড়ি কেনা হয়নি তার।
সকাল সাড়ে নয়টা বাজে, তবে এ এলাকারলোকজনের আয়েসী জীবন দেখে মনে হচ্ছে সবে ঘুম ভেঙেছে। নজরুল এদিক ওদিক তাকায়, তাকে অফিস থেকে জুবিলী জেনারেল স্টোরে রহিম নামের একজনের সাথে দেখাকরতে বলা হয়েছে। রহিম সাহেব তাকে সাথে করে হাসান জুবায়ের খানের বাসায় নিয়েযাওয়ার কথা। হাসান জুবায়ের খান সাহেবই হাছান মঞ্জিলের বর্তমান মালিক। ‘কিন্তু জুবিলী জেনেরেল স্টোর টা কোথায়?’ এদিক ওদিক তাকায় নজরুল, খানিকটাদূরে আরও একটা খাবারের দোকান, কুঁড়েঘড় হোটেল।এইএক কান্ত, হোটেল আর রেস্টুরেন্টের মধ্যে পার্থক্যটা অনেকেই বোঝেনা।কু্ঁড়েঘর দোকানটা বেশ চলতি, নজরুল উঁকি মেরে দেখে বেশ কয়েকজন কাস্টমার দোকানের ভিতরে পাতা টেবিলগুলোদখল করে বসে আছে, বাইরেও কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে।আর দোকানটা মোটেও কুঁড়েঘর নয়, দিব্যি পাকা দালান।দোকানের বাইরে ফুটপাতে বিশাল লোহার তাওয়ায় একটাছেলে অনবরত পরাটা ভাজছে,হরদম অর্ডার আসছে ভিতর থেকে। নজরুল বাইরে দাঁড়িয়েই দুটো পরাটা, একটা ডাল আরএকটা ডিম ভাজা অর্ডার দেয়। দোকানের বেশীরভাগ কাস্টমার রঙিন পাজামা -পাঞ্জাবি পরা কম বয়সী ছেলে, তাদের সবার মাথায় বাহারি কাজ করা সাদা টুপি। আশে পাশে কোথাও হয়তো মাদ্রাসা আছে। দোকানের ভিতর থেকে একটা বেয়ারা একটাখালি সিটের ব্যবস্হা করে নজরুলকে ডাক দেয়,’ভাইয়া আপনের নাস্তা’। খেতে খেতেনজরুল খেয়াল করে ক্যাশে বসা লোকটি দেখতে বেশ তেল তেলে আরহাসিখুশি মেজাজের। মাথার চুলে তেল দিয়ে সিঁথি কেটে আচরানো, গায়ে প্রিন্টেড লিলেন কাপড়েরশার্ট, পরনে ডেনিমের প্যান্ট আর হাতে মস্ত সিলভার কালারের ঘড়ি। কাস্টমারদেরমধ্যে সে যে বেশ জনপ্রিয় সেটা বোঝা যাচ্ছে। সবার সাথেই সে হেসে হেসে কথাবলছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে এফ এম রেডিওতে বাজতে থাকা গানের তালে তালে মাথানাড়াচ্ছে। একটা নতুন গান শুরু হলে কাস্টমারদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘শামিম ভাই, সিনামার গান?’ শামিম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।এ মুহুর্তে যেগানটি বাজছে নজরুল সেটার কথা গুলো বুঝতে চেষ্টা করে। গানটি নজরুল প্রথমবারের মত শুনছে, ‘ মেয়ে তোর কোকড়া কোকড়া চুলে যেন সমুদ্রের ঢেউ খেলে, সেইঢেউ খেলা দেখিতে আমার ভাল্লাগে,/ তোর গোলাপ গোলাপ ঠোঁটে যখন মিষ্টি হাসিওঠে, সেই হাসি দেখিতে আমার ভাল্লাগে’ ইত্যাদি। নজরুলের কাছে গানের কথাগুলোসুবিধার লাগে না তবে বেশ বিটের গান, উত্তেজক।আজকাল সবকিছুতেই উত্তেজনা রাজনীতি, খেলা ,গান … পরাটা চিবাতে চিবাতে ভাবে নজরুল। দোকানে খেতে আসা কম বয়সীছেলেদের দু’একজন রেডিওর সাথে থেকে থেকে ভাল্লাগে বলে গলা মিলাচ্ছে, কেউকেউ টেবিলে তবলা বাজানোর মত করে তাল দিচ্ছে। নজরুল হাত ধুয়ে কাউন্টারে বিলদিতে আসলে শামিম মাথা নাড়িয়ে বেশ দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে, ‘ চুলেরবিষয়ে গান, বোঝলেন’। নজরুল হাসি চেপে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায়। দোকান থেকেবের হয়ে আসার সময় যে ছেলটা পরাটা ভাজছে তাকে জুবলী জেনারেল স্টোরের কথাজিজ্ঞেস করতেই ছেলেটি রাস্তার উল্টো দিকে একটা ভাঙ্গারির দোকান দেখিয়েদেয়। নজরুল অবিশ্বাসের চোখে বহুকালের ধুলোয় আচ্ছন্ন ভাঙারির দোকানেরসাইনবোর্ডে জুবিলী জেনারেল স্টোর নামটি দেখতে পায়। এমন একটা দোকানের নামজুবিলী কে রাখলো, কেনইবা রাখলোনজরুল ভেবে পায়না। নিজেকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই সে বলে ওঠে, ‘ভাঙ্গারির দোকান সেটা আবার ভ্যারাইটিজ স্টোর! একেই বলে ছাল নাই কুত্তারবাঘা নাম…”
রহিম নামের লোকটি দোকানের ভিতরেই ছিলো।নজরুল নিজের পরিচয় দিতেইলম্বা, ভাঙাচোরা চেহারার লোকটা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে নজরুলকেসালাম দেয়। নজরুলকে বসার জন্য একটা টুল এগিয়ে দিয়ে লুঙ্গির কোঁচর থেকেএকটা বাটন ফোন বের করে কাউকে ফোন দেয়। নজরুল সামনের রাস্তায় তাকিয়ে থাকে।এরই মধ্যে রাস্তায় রিক্সার জ্যাম লেগে গিয়েছে। আশে পাশে বেশ অনেকগুলো হাইরাইজড বিল্ডিং। কিছুদিন আগেও এ এলাকায় সারি সারি টেনারী ছিলো। রাতদিনচব্বিশ ঘণ্টা এখানে লড়ি, ট্রাক আর শ্রমিকদের ভীড় লেগে থাকতো। বাতাসেচামড়ার গন্ধ ছড়িয়ে যেত বহুদুর।এখন অবশ্য চামড়ার গন্ধ পেতে হলে আরও ভিতরেযেতে হবে। নজরুলের মনে পরে, মাস দুই তিন আগে একটা দাপ্তরিক কাগজ বের করারজন্য তুলাগাছ তলা রোডে কাউন্সেলর অফিসে তার যেতে হয়েছিল। সেদিন মেইন রোডেজ্যাম থাকায় রিকসাওয়ালা ট্যানারির মোড় কাঁচাবাজারের পিছন দিয়ে একটা গলিরভিতর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।সে কি আর সাধারন গলিরে বাবা! গলির পেটের মধ্যেগলি, তারপর তস্য গলি। একটা সাইকেল রিক্সা ঢুকলে একজন মানুষও পাশ কাটিয়েযেতে পারবেনা।মনে হচ্ছিলো রাস্তা না কারো বাড়ির উঠোন, বারান্দা ভেদ করে এগুচ্ছি।তাও দিনের বেলা বলে রক্ষা,রাত হলে নিরিবিলি এসব গলিতে গা ছমছম ভয় লাগতো।
রহিম জানায় খান সাহেব একটায় নজরুলকেনিয়ে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন। এখনও হাতে প্রায় তিন – সাড়ে তিন ঘন্টাসময়। নজরুলের অফিস বনানীতে। এখন বনানী গেলে কোনো কাজ হবেনা, যেতে এক – দেড়ঘন্টা আসতেও তাই কাজেই যাওয়া আসাই সার হবে। অগত্যা নজরুল আশে পাশের এলাকাএকটা চক্কর দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। একটু এগুলেই একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চোখে পরে। সেটাকে পাশ রেখে ভিতরে যে গলিটা গিয়েছে সেটার ঘুমভাঙ্গেনি এখনও, সমস্ত দেকান পাটের ঝাপ ফেলা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশেছোট টং-দোকানে চা বিক্রি হচ্ছে। ঠিক তার উল্টো দিকে মিউনিসিপালিটির ময়লার ভ্যান দাঁড় করিয়ে চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে চুমুক দিচ্ছে ক্লিনারের দল। তাদেরটুকরো টুকরো গল্পের ভাজে আয়েসি চুমুকের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ শব্দ গা ঢাকা দিচ্ছে।ভ্যানের গা ঘেষে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দুটো কুকুরের দিকে দু’টুকরোকেক ছুড়ে দেয় ওদেরই একজন, কুকুর দুটো দৌড়ে আসে। নজরুল কি মনে করেডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢুকে পরে। সকাল হলেও বেশ কয়েকজন রোগী ভিতরে৷ এত্তসকালে এখানে কি করে এরা? হয়তো গ্লুকোজ খেয়ে অপেক্ষা করছে রক্তের নমুনাদেওয়ার জন্য। খালি পেটে আর কি কি পরীক্ষা করতে হয়? যার যা খুশি করুক, নিজের মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে নজরুল একটা খালি চেয়ারে বসে পরে চোখ বন্ধকরে, একটু ঝিমুনি এসে যায়। এসির বাতাসে এতক্ষণ আরাম লাগলেও এখন একটু শীতশীত বোধ হয় নজরুলের, কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না। পাশেই চাপা স্বরে কেউ একজন ধমকাচ্ছে কাউকে, ” কি দরকার, কি, কেন তাকে খবর দিতে হইবো অহন?’ জবাবে একটা মেয়ে কন্ঠ বলে ওঠে, ‘ ও আমাদের ছোড বইন, ভাইজান, আব্বার ছোডমাইয়া, আব্বায় মইরা যাইতাছে, হেয় একবার দেখতো না?” পুরুষ কন্ঠটি ফেরবলে,” না, আব্বায় অরে দেখতে চায় নাইক্কা। অক্খন আইলে হগ্গল সম্পত্তির মধ্যেভাগ বসাইবো, মাগার আমি হেইডা হইতে দিতাম না। মহিলা কন্ঠ আবার বলে, “ক্যানভাইজান, আফনে হক্ক মত আমগো চাইয়া বেশী পাইবেন, আমরা বাল বাচ্চা লইয়াসংসার করি, আমগোর হাতে টাকা পয়সা না থাকলে শ্বউর বাড়িত দাম থাহেনা। আমগো হক্ক মারবেন ক্যান।” ” পলাইয়া আম্মার গহনা লইয়া জসিমেরলগে ভাগোনের সময় হক্কের কতা মনে আছিল না? আমি এইসব…” পুরুষ কন্ঠের কথাশেষ হবার আগেই কাউন্টার থেকে নার্সের কন্ঠ ভেসে আসে, ” ডায়ালাইসিস এরনওয়াবুর তালুকদারের অ্যাটেনডেন্ট…”। এবার মহিলা কন্ঠ কাঁদো কাঁদো স্বরেবলে, ” আমগো এত তাড়তাড়ি ডাকতাছে ক্যান, আব্বায় বুজি …হায় আল্লাহ “। নজরুল চোখ খুলে ছাপা কাপড়েরবোরখা পড়া একজন মহিলাকে নার্সের সাথে করিডোর ধরে এগিয়ে যেতে দেখে। কিন্তুএত লোকের ভীড়ে পুরুষ লেকটি কে সেটা বের করা কঠিন। এতক্ষনে দরজার সামনে, কাউন্টারের সামনে বেশ ভীড় জমে উঠেছে।সামনের দেয়ালে লটকে থাকা টেলিভিশনেরস্ক্রিনে সময় সকাল এগারোটা পঞ্চাশ।
নজরুল ফেরজুবিলী জেনারেল স্টোরেরউদ্দেশ্যে বের হয়। নজরুল ফেরার পথে খেয়াল করে সামনেই তালুকদার ভিলা নামকএকটা লাল গেইটওয়ালা বিল্ডিং।কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে সে। লালগেটের মাঝ বরাবর পকেট খুলে দারোয়ান গলা বের করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তারদিকে তাকায়। ঠিক তখনই “চাচা সরেন ” বলে দারোয়ানের পাশ কাটিয়ে স্কুল ড্রেসপরা একটা কিশোরী মেয়ে পীঠে ব্যাগ আর সামনে দুই বেনী ঝুলিয়ে বের হয়েরিক্সার জন্য দাঁড়ায়। নজরুল সেখানে আর না দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে।নজরুলের মনে একটা প্রশ্ন উদয় হয়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালুকদার ভদ্রলোককি এই বাড়িরই লোক,নয়তো? হাঁটতে হাঁটতে আবার সে হাছান মঞ্জিলের কাছে এসেপরে। হাতে যেহেতু সময় আছে নজরুল হাছান মঞ্জিলের চারপাশটা ঘুরে দেখারসিদ্ধান্ত নেয়। হাছান মঞ্জিলের দেয়াল ধরে কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে একটা গলিপেয়ে গেল নজরুল।গলির মুখে কয়েকটি চার- পাঁচতলা বিল্ডিং। নজরুলের খুব মনেধরে বিল্ডিং গুলো। এরপর আরও কিছুটা গেলে হাছান মঞ্জিলের বাউন্ডারি দেয়ালটা আবার পেয়ে যায়সে। এপাশেরদেয়ালের মাঝে লোহার গরাদ দেয়া একটা জানালাদেখে থমকে দাঁড়ায়। জানালাটির জীর্ণদশা। একপাশের কাঠের ফ্রেম সমেত একটাগরাদ ভেঙে ঝুলে আছে। এইসব পুরানো বাড়ির নিজস্ব কত গল্প থাকে। হয়তো এইজানালার ফাঁক গলে হাত বাড়িয়ে কত শিশু আইসক্রিম, হাওয়াই মিঠাই কিনেখেয়েছে, হয়তো কোনও কিশোর, বাবা- মায়ের নজর এড়িয়ে বন্ধুদের থেকে ভিডিওক্যাসেট আনিয়ে নিয়েছে, হয়তো কোন উদাস দুপুরে কোনও তরুনী তার প্রেমিকের মুখএক ঝলক দেখবে বলে জানালার গরাদ ধরে অপেক্ষায় থেকেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। সেইবাড়ি আজ বিক্রি হবে ডেভেলপার কম্পানির কাছে। খান সাহেবের কাছে মোটা টাকারলোভনীয় অফার নিয়ে এসেছে নজরুল তার কোম্পানির পক্ষ থেকে। নজরুলের দুঃসাহসনেই এমন একটি বাড়ি কেনার তবে সে মনে মনে খুব চায় কেউ যদি তাকে এমন একটাবাড়ি ভালোবেসে দিয়ে দিত! প্রায় রাতেই নজরুল সেই কাল্পনিক দাতার সাথে কথাবলে। বিশেষ করে যেদিন যেদিন সে কোনও পুরানো বাড়ির সাইট ভিজিট এ আসে। এরকমএকটা বাড়ি পেলে সে কোনও দিনও ভাঙতে দিত না। লম্বা বারান্দায় নয়ন তারা, মাধবীলতার ঝাড় ঝুলিয়ে দিত, ছাদে অনেকগুলো পায়রার ঘড় বানিয়ে দিত, মা -বাবা, ভাই বোনদের নিয়ে জমজমাট করে থাকতো আরও কত কি! ‘ বাড়ি ভাড়া, একতলায়এক রুম জানুয়ারী মাস থেকে ভাড়া হবে। ভাড়া আলোচনা সাপেক্ষ।যোগাযোগ : ০২-৯৭২৫৬৭’ একপাল্লার একটি লোহার গেটের শিকের সাথে ঝুলানো একটা টিনের নোটিশদেখে নিমিশে পড়ে ফেলে নজরুল। গেটটা খোলা থাকায় ভিতরে দেখার চেষ্টা করলেসরু গলির ভিতরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়না সে। নজরুল, খান সাহেবেরসাথে কল্পনায় কথোপকথন চালিয়ে যায়-
– তা নজরুল সাব, আপনে একা থাকবেন নাকি পরিবার সহ
– পরিবার সহ স্যার। আমার বাবা, মা আর ছোট দুই ভাই বোন
– আপনে শাদী করেন নাই?
– না স্যার। বেতন যা পাই তাতে বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে ঢাকা বাসা নিয়ে থাকা সম্ভব না স্যার।
– আচ্ছা, ভালো, মা – বাবা’র কথা চিন্তায় থাকন ভালো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত স্যার?
– দেখতেই তো পাইতেছেন আমি আর আমার বেগম এইবাড়িতে থাকি। আপনে এই বাড়িতে থাকতে চাইলে নীচ তলা আর তিন তলা লইয়া থাকবেন।দোতালা আমার। ভাড়া দিতে হইবো না মাগার আমগোর দুইজনোর খাওয়ন দাওয়ন আপনে ব্যবস্হা করবেন।পারবেন না?
– পারবো স্যার। আমার মায়ের হাতের রান্না বেশ ভালো, তাছাড়া আমি নিজেও প্রফেশনাল রান্নার কোর্স করা।
– ভালো। তয় দেইখেন বাসাডারে আবার বাবুর্চিখানা বানাইয়া ফেইলেন না…
পাশ থেকে একটা এম্বুলেন্স সাই করে বের হয়ে যেতে যেতে নজরুলের ভাবনায় জ্যোতিচিহ্ন বসায়।এই দিক দিয়ে একটা রাস্তা হাজারিবাগ বাজারে গিয়ে মিশেছে। এ রাস্তাটাও বেশ জনবহুল।
নজরুল হাছান মঞ্জিলের এইপাশটা ভালোকরে দেখার চেষ্টা করে। মোবাইলে কম্পাস অন করে দিক ঠিক করে নেয়। ঠিকই ধরেছেসে এটা বাড়ির উত্তর দিক। এদিকের দেয়াল ফুঁড়ে কয়েকটা জায়গায় পাকুড় গাছশিকড় ছড়িয়েছে। দেয়াল থেকে মেইন বিল্ডিং অব্দি বাগান। নিম, কামরাঙা, কাঠবাদাম, নারকেল গাছ গলাগলি করে বেড়ে উঠে জায়গাটিকে ছায়াময় করে রেখেছেতবেপুরো বাড়িতে অযত্নের ছাপ বেশ স্পষ্ট।
নজরুল বাজারের রাস্তা ধরে আনমনে এগুতে থাকলে রাস্তার পাশের একটা ভাতের হোটেলেধুয়া ওঠা ভাতের গামলায় চোখ আটকে যায়। একটা ছেলে একটা ভিজে গামছা দিয়ে ভাতের গামলাটাকে ঢেকে দিলো। পাশেই একটা মসজিদ। নামাজের সময় নয় বলেমসজিদের পাশে অস্হায়ী ফল ওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসে পরেছে। তাদের ঝুড়িতেপেয়ারা, পেপে, ছফেদা, জলপাই, আমলকির ছোট বড় স্তুপ। শুধু একপাশে একজনেরঝুড়িতে হলুদ মাখানো নোনা ইলিশ।এদের ছেড়ে এগিয়ে যায় নজরুল। নজরুলের নাকেযেন গরম ভাতের ঘ্রান ভেসে আসে। এমন এক প্লেট গরম ভাতে নোনা ইলিশের ভর্তাহলে ইশ কি দারুন হয়! নজরুল শব্দ করে জিভের জল টেনে নেয়। মনে মনে সে নোনাইলিশের ভর্তা বানাতে লেগে যায়।নোনা ইলিশের মাঝ থেকে দুটো টুকরো নিয়েভালো করে ধুয়ে লবন ছাড়িয়ে নিতে হবে। এরপর অল্প হলুদ মেখে সময় নিয়ে কড়াকরে সরষের তেলে ভেজে নিতে হবে, লবন দেয়া যাবেনা। মাছ ভাজার তেলে পিয়াজ কুচি, রসুন কুচি, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ মচমচে করে ভেজে নিয়ে পাশে সরিয়ে রাখব ঠান্ডাহওয়ার জন্য। এবার সাবধানে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে সবকিছু হাতে ডলে মিশিয়েনিলেই হলো। নজরুল মনে করার চেষ্টা করে এমন ভর্তা সে শেষ কবে খেয়েছে। তাওতো মেরে কেটে সাত আট বৎসরের কম হবে না। ছোট খালা বানিয়ে খাইয়েছিলো। ছোটখালাও বিদেশ চলে গেল!
হাসান মঞ্জিলের সামনে এসে নজরুল রহিমকে ফোন দেয়। রহিম ফোনের ওপাশ থেকে তাকে অপেক্ষা করতে বলে। হাছান মঞ্জিলের দিকে তাকিয়েনজরুলনিজেকেই প্রশ্ন করে এই খান সাহেব লোকটা কেমন কে জানে? সে তার শরিকদের হক্কবুঝিয়ে দিচ্ছে তো? তার কি বোন আছে? তারা কি বিদেশে থাকে? নজরুল নিজেরঅভিজ্ঞতায় দেখেছে ঢাকা শহরে যাদের বাড়ি নেই তারা ঢাকায় থাকে, আর যাদেরবাড়ি আছে তারা সেই সব ছেড়ে বিদেশে পরে থাকে। মানুষের কি এক অদ্ভুত আচরন!নজরুল ফের তার পুরানো ভাবনায় ফিরে আসে, হাছান মঞ্জিল, ১৯৬৭ লেখাটা বেশকয়েকবার ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে পড়ে। লেখাটা তার মনে দাগ কেটেছে।বাড়িটাকে কেন্দ্র করে তার ভাবনারা আবর্তিত হতে থাকে:বাড়িটা মাত্র সাতান্ন বৎসর পুরানো , মাত্র দুই জেনারেশনের লোকজনবাড়িটিতে থেকেছে, এরমধ্যেই বাড়িটি ধুলায় মিশে যাবে! হয়তো আগামী তিন – চারবৎসর পরে তার কম্পানির করা নতুন ডিজাইনের নতুন বাড়িতে নতুন সব লোকজন থাকবেযাদের সাথে এ বাড়ির নাড়ির কোনও যোগাযোগ থাকবেনা। খান সাহেবরা একটা বা দুইটাফ্ল্যাট নিয়ে নিজের বাড়িতে পরবাসী হয়ে থাকবেন। বাড়িটার নামও হয়তো পাল্টেযাবে, কোম্পানির নাম যোগ হবে। হয়তো কোনও একটি বাহারি নামের সাথে যোগ হবেস্টেট, টাওয়ার, ভ্যালি,গার্ডেনের মত কিছু অপ্রয়োজনীয় শব্দ। আজকাল মানুষবড্ড অস্হির। আগে মানুষ একটা কাপড় না ছেঁড়া পর্যন্ত ফেলতো না; একটা বাড়িবাসের অযোগ্য হবার আগ পর্যন্ত মেরামত করে চালিয়ে নিত। বাড়ির নকশা হত বাড়ির সদস্যদের প্রয়োজন অনুযায়ী। আর এখন এক- দুইবার পরার পরেই যে কোনও কাপড়েরপ্রতি আকর্ষন হারিয়ে যায়,বাড়ির নকশা হয় কমার্শিয়াল ভ্যালুর বিবেচনায়। নজরুল দেয়ালে হাত বুলায়, বাড়িটার জন্য নজরুলের মনটা খারাপ হতে শুরু করে।হঠাৎই কয়েকটি প্রশ্ন তার মনে উদয় হয়, সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা বাড়ির কি মৃত্যু হয় ,কিম্বা মানুষের পরিচয়ের? ধরাযাক ,কেউ হাছান মঞ্জিলের ঠিকানায় চিঠি পাঠালো এখন থেকে পাঁচ বছর পরে তখন পোস্ট অফিসের লোক কোথায় খুঁজবে সেই ঠিকানা?চিঠিটারই বা কোথায় ঠাঁই হবে?এসব ভিলা, মঞ্জিল শব্দগুলো কি সত্যিই হারিয়ে যাবে আমাদের ঠিকানাগুলো থেকে…’
সায়মা আরজু’র পড়াশুনা ইংরেজি সাহিত্যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েে। ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকার কারনে ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং ডিজএ্যাবিলিটি বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও তার লেখা বেশ ক’টি ছোট গল্প পাঠক নন্দিত। ব্যাক্তি জীবনে তিনি শিক্ষকতা ও গবেষনার কাজে জড়িত।