ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২২) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের গানের দিদিমনি সুলতাদির গানের টিউশানির ক্লাসে যেতাম আমরা। মাঝে মাঝে রেডিওতে তার গানের প্রোগ্রাম থাকত। সুলতাদির স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম ছিল। তাতে হাত দেবার ইচ্ছে হত আমাদের। কিন্তু সুলতাদি ওটা আমাদের কোনদিন একটু ছুঁয়ে দেখতেও দেননি। তার জন্য ছোটবেলায় ভারী দুঃখ ছিল।
স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল ফল করার পর বাবা বললেন, “কী নেবে?”
আমি বললাম, “যা চাইব তাই দেবে তো?”
আমার সেই বর প্রার্থনার সূত্র ধরে বাড়িতে এলো ঝকঝকে এক তরুনী হারমোনিয়াম। আর আমি সুলতাদি হয়ে গেলাম।কাউকে ওটাতে হাত দিতে দিতাম না।
প্রথম প্রথম সেটির খুব যত্ন হয়েছিল। মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া নরম তোয়ালেতে তার গা মুছিয়ে বাক্সে ঢোকাতাম। বাজানোর থেকে বেশি নজর ছিল কেউ সেটাতে হাত দিয়েছে কিনা, সেই পাহারাদারিতে। বেশিদিন অবশ্য সেই অবাধ সুখ ভোগ করা যায়নি। কেননা বয়ঃপ্রাপ্ত হতেই হারমোনিয়ামটি অবাধ চলাফেরার লাইসেন্স পেলেন।
ছোটবোন গান শিখতে শুরু করায় ওকে নিয়মিত ওই হারমোনিয়ামে অভ্যাস করতে দিতে হল।পাড়ায় ওই একটিই স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম থাকায়, বাবার বদান্যতায় ক্লাবের যেকোন অনুষ্ঠানে সেটিকে নিয়ে যাওয়া আরম্ভ হল।তারপর পাড়াতুতো যেকোন বিয়ের বাসরেও তিনি নেমন্তন্ন পেতে শুরু করলেন। কিছু পরে আরো দু’একটি স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম পাড়ায় আসায় আমারটার চাহিদা কমেছিল।তবে ততদিনে আমি বুঝে গেছি ওটি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।সমষ্ঠির প্রয়োজনে ওকে ছেড়ে দিতেই হবে।
হারমোনিয়ামের অনেক গল্প আছে। ছোটবেলায় দেখতাম কপালে তিলক কেটে, গেরুয়া পোশাকে কয়েকজন কৃষ্ণ নাম করে চাল,ডাল,আনাজ,পয়সা সংগ্রহ করছেন। তাদের গলার ঝোলানো দড়িতে ঢাকা খোলা হারমোনিয়ামে বাজছে, “হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।”
মনে হত হারমোনিয়ামের ঢাকাটা কোথায় গেল?ওটা কি ওঁরা বাড়িতে রেখে এসেছেন?আসলে ওঁদের মতই সেই হারমোনিয়ামের জীর্ণ শীর্ণ চেহারাটা চোখে লাগত।কষ্ট পেতাম মনে মনে।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তখন আমরা খুবই ছোট।রথের দিনে রথ বার করে বড়দের দেওয়া দর্শনীর পয়সায়, মায়েদের বানিয়ে দেওয়া খিচুড়ির ফিস্টি করি।ভাবতাম ওঁদের কী মজা। কেমন ওই জড়ো করা আনাজে,চালে,পয়সায় রোজ রোজ খিচুড়ি খান।
পরে ট্রেনের কামরায় দীর্ঘদিন নিত্য যাতায়াতের সূত্রে দেখতাম এক অন্ধ ভিক্ষুককে তাঁর স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে গান গাইতে গাইতে ভিক্ষা করতে। সেই স্ত্রীর গলায় ঝুলত ছোটখাটো চেহারার এক হারমোনিয়াম।
কখনও গাইতেন “আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা, আমি যে পথ চিনিনা।”
কখনও “তুমি আমার সকাল বেলার সুর।”
দিব্যি মিষ্টি সুরেলা গলা।সকাল বেলায় ট্রেনের কামরা তার গানের মাধুরীতে ভরে যেত।আমি ভাবতাম উনি এভাবে না গান করে বাড়ি বসে গান শিখিয়ে উপার্জন করলেই পারতেন।পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারতাম।সেই লাখ কথার এক কথা,
“গেঁয়ো যোগী ভিখ্ পায়না”।
ওনাদের হারমোনিয়ামটা ছিল খুব ছোট্ট।জানিনা অর্ডার দিয়ে বানানো কিনা। সেই মহিলার মুখ আমার আজো মনে আছে।হারমোনিয়ামের ভার আর অন্ধ স্বামীর ভার দুই কাঁধে নিয়ে গানের সুর তুলছেন হাতের যন্ত্রে।পাথরের মত ওই মুখটিতে নীরব বেদনা আর ভালোবাসা মাখামাখি হয়ে আছে।হয়ত উনিই ছিলেন ওই মানুষটির একমাত্র শিক্ষার্থী।
আমাদের শহরের সবচেয়ে বড় মেয়েদের স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার।বিশাল সেই খোলামেলা স্কুলটির কয়েকটি বৈশিষ্ঠ্য ছিল।খেলা করার বড় বড় দুটি মাঠ, সরস্বতীর গোলালো কারুকার্যমন্ডিত মন্দির, ফোয়ারা, মেয়েদের ব্যবহারের দুটি স্কুলবাস, আর অবশ্যই একটি গানের ঘর। বিরাট লম্বা ঘরটিতে একপাশে একটি পিয়ানো,আমাদের সময়ে সেটি খারাপ হয়ে পড়েছিল।একজোড়া ডুগী তবলা আর জার্মান রিডের একটি প্রাচীন হারমোনিয়াম।
হারমোনিয়ামের ঠিক ওপরেই ছিল একটি ভেলভেটের জীর্ণ ঢাকা। তার নীল রঙের আভিজাত্যের আড়ালে হয়ত চাপা পড়ে থাকত দীর্ঘদিনের পুরনো অনেক মলিনতা, অনেক আনন্দ উচ্ছ্বাস!স্কুলের যেকোন অনুষ্ঠানে ওটি বাজিয়েই গান করা হত কিনা। সেইসব ভাগ্যবতীদের দলে আমার নাম থাকলেও হারমোনিয়াম বাজিয়ে লিড দেওয়ার মত বিদ্যে অর্জিত হয়নি কোনদিন। তাই যারা ওটি বাজাত,তাদের মনে মনে একটু সমীহ মিশ্রিত ঈর্ষা করতাম।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।