Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,হারমোনিয়াম

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

হারমোনিয়াম

ভোরে উঠে গলা সাধলে গলা ভালো হয় , এমন একটা ভয়ংকর কথা কে যে বাজারে চালু করেছে? সে যে বিশ্বের নিদ্রাকাতর মানুষদের একজন বড়সড় শত্রু একথা বলাই বাহুল্য।

তবে, হারমোনিয়ামের সঙ্গে ওই গলা সাধা মানুষদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল যে, সেকথা বোঝা যায়। গান শেখা মানেই সকালে বা বিকেলে টানা একটা সময় ধরে ‘সা রে গা মা পা ধা নি’র সঙ্গীত সাধনা। তা কী হারমোনিয়াম ছাড়া হয়?

নিখুঁত ভাবে গলা সেধে, গানে যে সবাই উৎরে যেত তা তো নয়।বরং অনেক ক্ষেত্রে একটা ভুল ভাল ধারণা জন্মাত যে “আমি নিষ্ঠা ভরে  রোজ রেওয়াজ করি। অতএব আমি একজন বড় গাইয়ে।”

কিন্তু গান ব্যাপারটা যে ভারী অদ্ভুত!কারো সারাজীবন সাধনা করেও কিছুই হয়না। আবার কেউ কেউ বিনা রেওয়াজেই স্বাভাবিক গায়ক হিসেবে নাম করে ফেলে। তবে সব কিছুর মূলে থেকে যায় একটি হারমোনিয়াম। সেসময় গায়ক বা গায়িকা বলতে হারমোনিয়ামের বেলো টানা একটা হাত মনে পড়ে যে। শ্রদ্ধেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় , সুচিত্রা মিত্র, কার নাম আগে করব?

   আগে বেশিরভাগ বাঙালি বাড়িতেই উত্তরাধীকারসূত্রে একটি হারমোনিয়াম থাকত। কেউ না কেউ সেটা বাজিয়ে গান শিখত। বিবাহ উপযোগী মেয়েদের পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থিত করে সগর্বে জানানো হত আমার মেয়ে গান গায়।পাত্রপক্ষের নজর অবশ্যই আরো উঁচু মগডালে।পাওনা গন্ডা বুঝে নিতে নিতে তাঁরা গানের পরীক্ষার্থীকে ভাল ভাল মন্তব্য করে অক্লেশে পাস করিয়ে দিতেন।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,হারমোনিয়াম

আমাদের বাড়ির হারমোনিয়ামের গল্পটা ভা্রী অদ্ভুত। ট্রেনের কামরায় পড়েছিল বাক্সটা। আমাদের দাদু ভাল কীর্তন গাইতেন। কোন এক আসরে গান করে একটু বেশি রাতেই ফিরছিলেন তিনি। সামান্য আয়ে তার সংসার সামলে হারমোনিয়াম কেনার মত সামর্থ্য ছিলনা। নিজের স্টেশনে নামার আগে ফাঁকা কামরায়   হারমোনিয়ামের বাক্সটা ওনার নজরে পড়ে ।অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন। হারমোনিয়াম বাড়ি নিয়ে এসে থানায় জানিয়েছিলেন। কেউ দাবী করতে না আসায় ওটা ঈশ্বরের দান হিসেবে নিজের কাছে রেখে দেন। সেই থেকে ওটা আমাদের কাছেই রয়ে গিয়েছে।আর আমরা সবাই ওটাতে হাত মকশো করেছি।


আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২০) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


মনে আছে দাদুর বন্ধুরা এসেছেন।গরমের দিনে খোলা বারান্দায় সতরঞ্চি পেতে আসর হয়েছে।দাদু একটার পর একটা কীর্তন গেয়ে চলেছেন ওই হারমোনিয়াম বাজিয়ে। দাদুর বন্ধু সুন্দর দাদু, দাদুর পরে গাইতে বসে মিঠে গলায় ভজন শুনিয়েছেন। রাত বাড়লে মা বা কাকিমা এসে ঘুমন্ত আমাদের তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,হারমোনিয়াম

তখন সর্বত্র হারমোনিয়াম। আমাদের তল্লাটে যাত্রার দল এলে আমরা যাত্রা দেখতে ও বাজনা শুনতে যেতাম। তিনবার কাঁসর ঘন্টা বাজানোর পর যাত্রা শুরু হত।মাঝের সময়টায় জগঝম্প বাজনার মধ্যে আকর্ষণ জন্মাত হারমোনিয়াম।বাড়ি ফিরে আমাদের এক দিদি নিজেদের হারমোনিয়ামে ওই সুর-লহরি বাজানোর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ঘোষণা করেছিল ‘এই হারমোনিয়ামটা একেবারে বাজে,তাই বাজছে না।”    

সেই বিখ্যাত প্রবাদ, “নাচতে না জানলে উঠোনের দোষ!”

আমাদের দেশের বাড়ির রান্নার ঠাকুর গোপালের কথা মনে পড়ল।ও সন্ধে হলেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ত।কিন্তু সন্ধেবেলায় গানের আসর বসলে ও সব কাজ সেরে রেডি হয়ে থাকত। ‘হারমুনি’ তে, গান শুনবে বলে।

ওর বাড়ি ছিল গ্রামে।সেই দেশে মাঝেমাঝে ছুটি নিয়ে যেত ও।শীতকালে দশদিনের ছুটিতে কুড়িদিন কাটিয়ে ফেরার সময় খেঁজুরের গুড়, গুড়ের পাটালি,মুড়ির মোয়া, নারকেলের তক্তি ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসত।একদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমি গাইছি, “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে…”

ও আমার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল,তারপর বলল, “হারমুনিতে যে গানটা বেঁধেছ, সেটা কিন্তু আমাদের গান।শিখিয়ে দেবে?আমি দেশে গিয়ে সবাইকে শোনাব।”

আমি বললাম, “তোমাদের গান? মানে?”

“ওই যে পৌষ মাস,পাকা ফসল,…এতো আমাদেরই গান।”

ওর হারমোনিয়ামের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে আমি ওকে হারমোনিয়াম বাজাতে শেখাই।তারপর ও “হরেকৃষ্ণ,হরেকৃষ্ণ…” সুর করে বাজিয়ে গাইত,আর আমার ঠাকুমা মাথা নেড়ে নেড়ে শুনতেন।আমাদের সাধারন হারমোনিয়াম অন্ততঃ ওই একটা মানুষের নিখাদ ভালোবাসা পেয়েছিল।

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>