অভিজাত মুসলমানের মনস্তত্ত্ব এবং ভারত বিভাজন
মুহাম্মদ তানিম নওশাদ
এক
১৯৪৭ সালে স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজিত হয় এবং তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে হিন্দু, মুসলমান এবং ইংরেজরা পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করেন। এই তিন পক্ষের সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভারত বিভাজন প্রশ্নে তাদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। সময়টা ছিল উপনিবেশবাদের কালবেলা। দীর্ঘ উপনিবেশবিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলন আর দুটি মহাযুদ্ধ উপনিবেশিক শক্তিদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। তাই উপনিবেশিক শক্তির মতো ব্রিটেনও তার উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হলো; কিন্তু ভারতকে বিভাজিত কেন করা হলো সেই প্রশ্নে শুধু ব্রিটেনকে একা দায়ী করা যায় না। অনেকে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের এক্ষেত্রে দায়ী করেন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। এর পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি অভিজাত মুসলমানদেরও এই বিভাজনের পেছনে কিছু দায় আছে,যা অস্বীকার করা যায় না। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে লেখক বিবিধ সূত্রে মূলত এই বিভাজনের আকাঙ্ক্ষার পেছনে অভিজাত মুসলমানের মনস্তত্ত্বের ঐতিহাসিক অনুসন্ধান করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
দুই
অনেকে মনে করেন যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এসেছে দীর্ঘ উপনিবেশবিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলন থেকে। এটি যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে, প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) না বাধলে এবং উপনিবেশিক শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে না পড়লে ভারতবর্ষ কবে স্বাধীন হতো তা বলা দুষ্কর। কারণ ওই মহাযুদ্ধগুলোতে ব্রিটেন বিজয়ী হলেও তার উপনিবেশগুলোকে কব্জার মধ্যে রাখার সামরিক ও আর্থিক সামর্থ্য আর তার ছিল না। বরং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ব্রিটেনের পক্ষে নিজের ঘর সামলানোই কঠিন হয়ে পড়ল। চরম অর্থনৈতিক সংকট ও প্রবল বেকারত্বে ব্রিটিশ অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। ল্যারি কলিন্স ও ডমিনিক লাপিয়ের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটেনের বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,
The cost of their victory, however, had almost vanquished the British. Britain’s industry was crippled, her exchequer bankrupt, her once haughty pound sterling surviving only on injections of American and Canadian dollars, her Treasury unable to pay the staggering debt she’d run up to finance the war. Foundries and factories were closing everywhere. Over two million Britons were unemployed. Coal production was lower than it had been a decade earlier and, as a result, everyday, some part of Britain was without electric power for hours. (১)
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এই বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেবার কারণ এই যে, ভারতবর্ষের মতো প্রায় মহাদেশের সমান আয়তনের একটি ভূভাগ তার স্বাধীনতার জন্য যে পথে হেঁটেছে, তা ব্রিটেনের মত একটি পরিপক্ক রাজনৈতিক খেলোয়াড়কে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এখানে হিন্দুদের মধ্যে হাজার বছর ধরে বিরাজিত ছিল বর্ণাশ্রমের ভয়াবহ বিষ। মুসলমান, হিন্দু, শিখ এবং আদিবাসীরা একে অপরকে বন্ধু ভাবতে পারেনি। এমনকি যখন এখানে স্বাধীনতার ডাক উঠল সেই স্বদেশী আন্দোলন ছিল চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক; দেবী কালীর পূজা না করে আন্দোলনরত কর্মীরা মাঠে-ময়দানে নামতেন না। ফলে মুসলমানসহ অন্য অহিন্দুদের জন্য এর অর্গল ছিল বন্ধ। অনুশীলন ও যুগান্তরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নিষ্ঠাবান ও বিপ্লবী হিন্দুদের জন্যই গড়ে উঠেছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং দলিতদের স্বার্থ নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। বরং তারা তাদের মানুষ বলেই কখনো গণনা করেনি। অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত মুসলমানদেরও সাধারণ মুসলমানদের বিশেষত কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। নিসার আলী তিতুমীরের (১৭৮২-১৮৩১) আন্দোলন, হাজী শরীয়তউল্লাহর (১৭৮১-১৮৪০) ফারায়েজী আন্দোলন কিংবা নূরুলদীনের (সঠিক জন্ম-মৃত্যুর কাল জানা যায়নি) কৃষক বিদ্রোহ কোনো উচ্চবর্গের আন্দোলন ছিল না।এ আন্দোলনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দূরে থাক, অভিজাত মুসলমানরা সেভাবে তেমন সমর্থনও করেননি। অনেকে বরং বিরোধীতাই করেছেন।
তিন
এ কথা সত্য যে, ইসলামের মূল ডিসকোর্সে মানুষের মধ্যে কোন উঁচু-নিচু ভেদাভেদ নেই, আভিজাত্যের কোনো বালাই নেই। স্রষ্টার কাছে তার প্রতিটি সৃষ্টি সমান। আর ভারতে আগমনকারী প্রথম যুগের মুসলমানরাও তাই কোনো ভেদনীতি মেনে চলতেন না। যে কারণে ইসলাম সহজেই ভারতবর্ষে বিস্তার লাভ করতে পেরেছে। এমনকি চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত হিন্দু ধর্মের মধ্যকার জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বৈরিতা নিরসনে এবং যে কারণে শেখ ফরিদ (১১৭৯-১২৬৬), নামদেব (১২৭০-১৩৫০), রামানন্দ (আ: ১৩০০-১৩৮০), কবীর (১৩৯৮-১৪৪৮ বা ১৪৪০-১৫১৮), ধন্যা (১৪১৫-মৃত্যু অজ্ঞাত), রবিদাস (১৪৫০-১৫২০), চৈতন্য (১৪৮৬-আ. ১৫৩৩), ভগৎপিপা (১৪২৫-আনুমানিক খৃষ্টীয় ১৫ শতকের শুরুতে) প্রমুখ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ভক্তিবাদীদের আবির্ভাব ঘটেছিল, তাদেরও চিন্তার এক বড় নিয়ামক ছিল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ইসলামের একত্ববাদ বা তাওহীদ, যাকে অদ্বৈতবাদও অনেকে বলে থাকেন, ভারতের বিভক্ত সমাজকে অনেকটাই সমন্বিত করতে পেরেছিল। আর সুফিবাদিরা সেটাকে কেন্দ্র করেই সারা ভারতবর্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভক্তি আন্দোলনে জোয়ার আনতে পেরেছিলেন।(২) এর ফলে ধর্মগুলোতে সমন্বয়বাদী ধারারও সূত্রপাত ঘটে। ভক্তি আন্দোলনের ধারাগুলোতেও তা পরিলক্ষিত হয়। ড. গৌরী সেন লিখেছেন, ‘মুসলমান ধর্মের সংস্পর্শে এসে ভক্তিধর্ম যে কিছু নতুন প্রেরণা লাভ করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রথমত নবাগত মুসলমানদের মধ্যে জাতিভেদের সংকীর্ণতা ছিল না। এই উদারতার সুযোগ নিয়ে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির অনেক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করা সহজ হয়েছিল। মধ্যযুগের ভক্তিধর্ম ইসলামের উদারতা গ্রহণ করেছে।’ (৩)
অবশ্য বিমলানন্দ শাসমল স্বামী বিবেকানন্দর বরাতে লিখেছেন যে, দলিত ও অস্পৃশ্যরা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।(৪) এর কারণ হিন্দু জাতিভেদ প্রথার নিষ্পেষণে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। তাহলে ভারতজুড়ে মুসলমানদের মধ্যে নব্য অভিজাততন্ত্রের আগমন কীভাবে ঘটল? এর উত্তরটা এভাবে দেওয়া যায় যে, ভারতে সুলতানী ও মোঘলযুগে যে ভিনদেশি মুসলমানরা প্রধানত মধ্য এশিয়া, তুরস্ক ও আফগানিস্তান থেকে এদেশে এসেছিলেন, তাদের উত্তরসূরি ও উত্তর-পুরুষরা ভারতের ক্ষমতা ও সম্পদ বলয়ের মধ্যে থাকার কারণে স্থানীয়দের তুলনায় নিজেদের উচ্চতর ও গরিমাময় মনে করতে থাকেন। প্রথম জমানার ভারতে আগমনকারী মুসলমান এবং ইসলাম প্রচারকারী সুফিরা যেরকম উদার ও সাম্যবাদী ছিলেন, তারা তা ছিলেন না। তাদের সংস্পর্শে আসা সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী ও তাদের অনেক উত্তরপুরুষ পরবর্তীতে সুলতান ও মোঘলদের সংস্পর্শে আসার এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করার সুবাদে নিজেদের অভিজাত মনে করতে থাকেন। অনেকে মনে করেন মুসলমানদের ʻআশরাফ’ ও ʻআতরাফে’র এই বিভাজন হিন্দুদের বর্ণাশ্রম প্রথার সংস্পর্শে আসার কুফল। এই ধারণার সঙ্গে আমি কিছুটা একমত হলেও সম্পূর্ণরূপে একমত নই। কারণ প্রথম যুগের মুসলমানরাও হিন্দুদের বর্ণাশ্রম প্রথা দেখে এসেছেন। আবার তাদের উত্তর পুরুষরাও সবাই নিজেদের অভিজাত মনে করেননি। তাহলে এদের অনেকের ক্ষেত্রে তা ঘটল কেন? উত্তর হলো এর ভেতর কায়েমী স্বার্থ হাসিলের আকাঙ্ক্ষা সুপ্ত রয়েছে, যা সবার মধ্যে ছিল না। অভিজাততন্ত্র সম্পদের সিংহভাগ নিজের আয়ত্তে রাখতে চায়, ফলে সে নিজেকে গরিমাময় করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের করে তোলে তার ʻঅপর’। এই জায়গায় মুসলমান ও হিন্দু এলিটদের মধ্যে শ্রেণিগত কোনো পার্থক্য নেই, তারা দুই-ই সামন্ততান্ত্রিক। পার্থক্য কেবল এখানে যে, হিন্দু অভিজাতদের মতো তারা সাধারণ মুসলমানকে অস্পৃশ্য মনে করত না এবং অনেক ধনী ও অভিজাত মুসলমান অনেক দরিদ্র ও আভিজাত্যের বিচারে নিচ ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে দ্বিধা করেননি, যেটি হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথায় সেকালে ছিল অসম্ভব, যদি না প্রবল সাহসী কেউ সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করে থাকতেন।
চার
হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের বড় অংশ ছিল উচ্চবর্ণের। ফলে ইংরেজ আমলেও গোষ্ঠীগত স্বার্থের জায়গায় তারা ও তাদের মুসলমান প্রতিপক্ষ সমান্তরাল জায়গাতেই অবস্থান করেছিলেন। দুই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তারাই ছিলেন শিক্ষিত এবং শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্যও ছিল সমাজের উঁচুতলায় অবস্থান ও বিত্ত-বৈভব আয়ত্ব করা। বিমলানন্দ শাসমল লিখেছেন, ‘শিক্ষিত সমাজের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কী করে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করা যায়, যাতে স্বাধীনতা লাভের পর সমাজের সব প্রকার সুখ-সুবিধা তাদের ও তাদের বংশধরদের একচেটিয়া অধিকারে আনতে পারে। দেশের নিচের তলার মানুষের জন্য এদের কিছু করণীয় ছিল না। তাদেরও এ বিষয়ে কখনো কিছু করতে বলা হয়নি। তাদের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতা ছিল না- তারা সংগঠিত হতে পারেনি। ওদিকে নিচের তলার সাধারণ মানুষের মধ্যে হিন্দুদের যে অবস্থা ছিল মুসলমানদেরও তাই ছিল।’ (৫)
মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্রের দাবিটি মূলত ছিল অভিজাত মুসলমানদের, শুধু ইংরেজ আমলের শেষ দিকে পূর্ববঙ্গের কৃষক সমাজের বড় এক অংশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি তোলেন। মুসলিম লীগের উত্থানও একই কারণে হয়েছিল- সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করতে। বিমলানন্দ শাসমল সেকথাই এভাবে বলছেন, ‘… কিন্তু বিবাদ বাধল হিন্দু শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে মুসলমান শিক্ষিত সমাজের। সাধারণ মুসলমান সম্বন্ধে মুসলমান শিক্ষিত সমাজের যে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল তা নয় এবং সে দিক দিয়ে শিক্ষিত হিন্দু সমাজ ও শিক্ষিত মুসলমান সমাজের বিশেষ কোন প্রভেদ ছিল না; কিন্তু মুসলমান শিক্ষিত সমাজ বুঝতে পারল হিন্দু শিক্ষিত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও চক্রান্তে পারদর্শিতার কাছে তাদের ভবিষ্যৎও অন্ধকারেই থাকবে। তারা হিন্দু শিক্ষিত সমাজের কাছে চাকরি-বাকরি ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা লাভের বেলায় এঁটে উঠতে পারবে না। মুসলিম শিক্ষিত সমাজের স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন করল ঢাকায়।’ (৬)
অন্যদিকে অভিজাত মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যকার ব্যবধান বাড়ানো অনেকটাই ইংরেজদের দ্বিভাজন নীতির (Divide and Rule policy) অংশ ছিল। আর এক্ষেত্রে তারা হিন্দুদের পক্ষেই কাজ করেছে। কারণ বোঝাটাও কঠিন নয়। ইংরেজ ক্ষমতা দখল করেছে মুসলমানদের হাত থেকে, ফলে মুসলমানদের সে পক্ষে টানতে পারবে না। অন্যদিকে হিন্দুকে সে কাছে না টানলে এত বড় ভারতবর্ষ অল্প ক’জন ইংরেজদের দিয়ে পরিচালনা করা যাবে না। আর মুসলমান একসময় ক্ষমতা দখল করেছিল হিন্দুর কাছ থেকে। ফলে হিন্দুকে মুসলমানের বিরুদ্ধে উস্কানিতে ইংরেজের বেগ পেতে হয়নি। আর আগে থেকেই এই দুই জাতির মধ্যে যে ধর্ম ও সংস্কৃতিজাত বিভাজন ছিল, ইংরেজদের ওইসব কাজের জন্য সেগুলো ছিল যথেষ্ট। ল্যারি কলিন্স ও ডমিনিক লাপিয়ের লিখেছেন,
The root of the problem was the age old antagonism between India’s 300 million Hindus and 100 million Moslems. Sustained by tradition, by antipathetic religions, by economic differences, subtly exacerbated through the years by Britain’s own policy of Divide and Rule, their conflict had reached boiling point.(৭)
পাঁচ
এর বাইরেও মুসলমানদের মধ্যকার সম্ভ্রান্ত ও সাধারণের মধ্যকার দূরত্বও মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে একাট্টা হতে দেয়নি। মূলত মুসলিম লীগের গোষ্ঠীতান্ত্রিক চেতনার এবং কিছু অভিজাত ব্যক্তির কর্তৃত্বের বাইরে এসে সাধারণ মুসলমানসহ বঙ্গ অঞ্চলের বিশেষত সাধারণ কৃষক ও শ্রমজীবীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬), শওকত আলী (১৯১৮-১৯৭৫), ইয়ার মোহাম্মদ খান (১৯২০-১৯৮১) প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) এবং শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) পরবর্তিতে এই সংগঠনকে আরও বেগবান করে তোলেন। অনেক উচ্চশ্রেণির হিন্দুর মতো উচ্চবিত্ত ও অভিজাত মুসলমানদেরও অনেকে যে নেহায়েত স্বার্থপর এবং জনস্বার্থবিরোধী হতে পারেন তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ইতিহাসভিত্তিক বৃহৎ উপন্যাস ʻসেই সময়’ থেকে। ১৮৫৭ সালে যখন সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়, মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে আবার মসনদে বসিয়ে ভারতীয়দের পূর্ণ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তখন সমগ্র ভারতবর্ষজুড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে, যে বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সবাই দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এই সময় দু’জন মুসলমান আগা আলী হাসান খাঁ এবং মুন্সী আমীর আলী ছদ্মবেশে নির্বাসিত ও ইংরেজদের হাতে নজরবন্দি অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর (১৮২২-১৮৮৭) সঙ্গে দেখা করলেন, তাকে বিদ্রোহের সাফল্যের কথাও কিছু জানালেন এবং তাকে বিদ্রোহে শামিল হতে বললেন। সেইসঙ্গে তারা এও বললেন যে, প্রয়োজনে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও তারা করবেন। তার প্রত্যুত্তরে তিনি সজল নয়নে বললেন,
‘খোআব থা জো কুছভী দেখা, জো সুনা আফসানা থা।’
অর্থাৎ, যা কিছু দেখেছি সবই স্বপ্ন, যা কিছু শুনেছি সবই রূপকথা।(৮)
তিনি তাদের কোন উপকারতো করলেনই না, উপরন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারকে জানালেন যে, বিদ্রোহীরা তাকে উস্কানি দিচ্ছে; কিন্তু তিনি এতে কোনোভাবেই জড়াতে চাচ্ছেন না।(৯)
ওয়াজেদ আলী শাহ কোনো রকম যুদ্ধ ছাড়াই কোম্পানির আধিপত্য মেনে নিয়েছিলেন এবং কোম্পানি নিজের সঙ্গে তার রাজ্য ১৮৫৬ সালে সংযুক্ত বা অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল। এ ছাড়া পরবর্তিতে বঙ্গাঞ্চলে মুসলমান অভিজাতদের আমরা দেখি ইংরেজদের কাছ থেকে তারা খান বাহাদুর পদক নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ওই দিকে ইংরেজ ঘেঁষা উচ্চবর্ণ ও বিত্তশালী হিন্দুরা তখন ইংরেজদের কাছ থেকে রায় বাহাদুর পদক নিতে ব্যস্ত। এদের মধ্যে দু-একজন যে ব্যতিক্রম ছিলেন না তা নয়। তবে মুসলমান উচ্চ শ্রেণির লোকেরা যে সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তার একটা যুতসই উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ইংরেজ আমলে আমরা দেখি বাংলা, মুর্শিদাবাদ, অযোধ্যা, হায়দরাবাদসহ বেশিরভাগ মুসলমানশাসক শাসিত অঞ্চলে মুসলমান রাজা ও নবাবরা ছিলেন মূলত শিয়া মুসলমান; কিন্তু সাধারণ জনগণের সিংহভাগই ছিলেন সুন্নী মুসলমান। তার কারণ কি? মধ্য এশিয়া, তুরস্ক ও আফগানিস্তান থেকে আগতরা এখানে মূলত সুন্নী ইসলাম প্রচার করেছেন। সুফিবাদিদের মধ্যে কিছু শিয়া প্রবণতা থাকলেও মূলত তারা বেশির ভাগই সুন্নী ঘরানার। শিয়ারা বড় সংখ্যায় এখানে এসেছেন অপেক্ষাকৃত পরে। দিল্লির মসনদ ছাড়া বেশিরভাগ রাজ্য বা পরগণার অধিপতি ছিলেন শিয়ারা; কিন্তু তারা এমনই আভিজাত্যের গরিমায় ভুগতেন যে, সাধারণ চাষা-ভূষোদের মধ্যে তারা শিয়া ইসলাম প্রচার করেননি। তার কারণ অবশ্য এই যে, যারা নিজ স্বার্থের বাইরে সাধারণ মানুষের ইহলৌকিক মুক্তি নিয়ে মাথা ঘামাননি, তারা তাদের পারলৌকিক মুক্তি নিয়ে কি মাথা ঘামাবেন? অনেক কেতাদুরস্ত ঐতিহাসিকও আছেন, তারা বলেন যে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে যখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বাহিনী পরাজিত হন, তখন হাজারে হাজারে সাধারণ মানুষ সেই যুদ্ধ দূর থেকে দেখেছেন। আর তারা নাকি এক টুকরো ঢিলও যদি মারতেন, তাহলেও ইংরেজদের পরাজয় ঘটত; কিন্তু নবাবদের আভিজাত্য তাদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল যে, তাদের ও ইংরেজদের সাধারণ মানুষ সমার্থকই মনে করতেন। মুর্শিদাবাদের নবাবরা স্থানীয়দের বাংলাভাষা জানতেন না। রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফারসি। ঘরে অনেকে বলতেন উর্দু। সাধারণ মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। মুসলমান মনে করে যারা এসব নবাবদের সমর্থন করতে চান, তারা বোঝেন না যে, এরা রাজতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্রের অনুগামী; কিন্তু ইসলামতো রাজতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্রের সমর্থক একেবারেই নয়। অবশ্য এটি সর্বৈব সত্য যে, ইংরেজের আগমনে ও তাদের ক্ষমতা দখলের পর সাধারণ মানুষের ভাগ্য আরও খারাপ হয়েছিল। ঢাকার নবাব পরিবারের লোকদেরও মাতৃভাষা ছিল উর্দু। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) আমাদের জানিয়েছেন যে, তার কাল পর্যন্তও নবাব পরিবারের ভাষা উর্দুই ছিল।(১০) আর তিনি আরও জানাচ্ছেন যে, ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ ও নবাব সলিমুল্লাহ এবং তার ছেলেরা কেউই অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেননি। ঢাকার নবাব পরিবার ইংরেজভক্ত বলেই সবার কাছে সুপরিচিত ছিল।(১১) নবাব পরিবার বিশেষত নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৫ সালে সৃষ্ট বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন, তারও কারণ ছিল হিন্দু অভিজাতদের কাছ থেকে মুসলমান অভিজাতদের স্বার্থ রক্ষা করা।(১২) তার মানে অভিজাত মুসলমান স্বাধীনতা চেয়েছে যখন গোষ্ঠীগতভাবে তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে, যা আমরা সামনে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
ছয়
অবশ্য এটি সত্য যে, মুসলিম লীগের কারণে সাধারণ মুসলমানের স্বার্থ কিছুটা সংরক্ষিত হতো, কারণ রাজনীতিটা যেহেতু গণমানুষকে নিয়েই করতে হয়; কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রভাবশালী হিন্দুরা ছিলেন তার বিরুদ্ধে। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় সব সময় কম-বেশি সচেষ্ট ছিলেন মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫)। শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০), বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০), বিপিন চন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২), লালা রাজপত রায় (১৮৬৫-১৯২৮) প্রমুখ হিন্দু দর্শনকে ভারতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের উপজীব্য করে তুললেন। এতে করে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে সরাতে আরও সচেষ্ট হলেন। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে মুসলমানদের ছিঁটকে পড়ার উপক্রম হলো। মূলত এলিট মুসলমানের মনোবেদনা তখন থেকেই শুরু হয়, কারণ কোনোভাবেই তাদের স্বার্থ উপনিবেশিক শক্তি ও প্রতিবেশী হিন্দুদের দিয়ে সংরক্ষিত হচ্ছিল না। তবে মুসলমানের স্বার্থ আদায়ে কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদের (১৮৮৮-১৯৫৮) সঙ্গে গান্ধীও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন, যে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ক্ষয়ে যাওয়া ইসলামী খিলাফতকে পুনরুদ্ধার ও রক্ষা করা; যদিও তার পরিসমাপ্তি শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের খেলাফতের যবনিকাপাত হয়। অন্যদিকে ১৯২১ সালের গয়া কংগ্রেসে চাকরি-বাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় মুসলমানদের জন্য যে সংখ্যানুপাতিক ন্যায্য দাবি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা রক্ষা করা হয়নি। ১৯২৩ সালে বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চিত্তরঞ্জন দাস বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তি সম্পাদন করেন। তবে তার কিছুকাল পরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেলে বাংলার কংগ্রেস নেতারা শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল করেন এই বলে যে, এই চুক্তি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিতে পাস হয়নি এবং এতে লেখা শর্তগুলি নাকি স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর কার্যকর করা হবে। এখানে বলা বাহুল্য যে, গান্ধী ও চিত্তরঞ্জন দাশের এসব মহতী কাজ কট্টর ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাছে তাদের অজনপ্রিয় করে তুলেছিল; কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় তারা যে নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তা বিরল এবং এক্ষেত্রে তারা তথাকথিত মুসলমান অভিজাতদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক বেশি আন্তরিক ছিলেন। আর ১৯৪৮ সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট মহাত্মা গান্ধী জীবন দিলেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম বিনায়ক গডসের (১৯১০-১৯৪৯) হাতে, যিনি আরও অনেক উগ্র হিন্দুত্ববাদীর মতো বিশ্বাস করতেন যে, গান্ধী দেশ-বিভাগ কালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় অতি বাড়াবাড়ি করেছেন।(১৪) ১৯৪৭ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান রায়ট বন্ধ করতে গান্ধী অনশনে বসেছিলেন এবং তিনি রায়ট বন্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন(১৫)। উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং অভিজাত মুসলমানরা সেদিন রায়ট বন্ধ করতে পারেননি; কিন্তু গান্ধীর সমর্থকদের মধ্যে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সংখ্যা ছিল কম; যদিও গান্ধী নিজে নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিলেন না, তিনি ছিলেন গুজরাটি বৈশ্য এবং পেশায় উকিল।(১৬) তবে সাধারণ জনতার ভালোবাসা তিনি অনেকটাই পেয়েছিলেন; যদিও হয়তো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার কৌশলগত ভুল ছিল। দলিত বা হরিজন অর্থাৎ অস্পৃশ্য হিন্দুদের স্বার্থ আদায়ে তিনি ছিলেন নিরলস। ১৯৩৩ সালে অস্পৃশ্য হিন্দুদের স্বার্থ আদায়ে তিনি হরিজন আন্দোলন শুরু করেন।(১৭) এক্ষেত্রে গান্ধী উচ্চবর্ণের ও অভিজাত হিন্দুদের কাছ থেকে তেমন আনুকূল্য পাননি।
সাত
১৯৪৬ সালে যখন কলকাতায় রায়ট হয়, উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদীদের অনেকে বরং সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন। দশ হাজারের বেশি লোক মারা যায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায়। ব্রিটিশ সরকার পুলিশ পাঠিয়ে এবং কার্ফ্যু জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়া হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বন্ধ করারও সামর্থ্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪) বা অন্য কোনো মুসলমানের ছিল না। তারা দাঙ্গার হোতা ʻঅখণ্ড হিন্দুস্তান’ বাদীদের এবং তাদের মুসলমান প্রতিপক্ষকে কোনোভাবে সামাল দিতে পারেননি। হিন্দুত্ববাদীরাই যে এই দাঙ্গার প্রথম হোতা তা বোঝা সহজ এই কারণে যে, তখন কলকাতার জনসংখ্যার শতকরা ৭৩ ভাগই ছিল হিন্দু, আর মুসলমান ছিল মাত্র ২৩ ভাগ।(১৮) শেখ মুজিবুর রহমানও তার ʻঅসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ এই সময়কার স্মৃতিচারণ করেছেন এবং তার লেখাতেও বোঝা যায় যে, এই দাঙ্গাগুলোর প্রধান হোতা উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাই ছিলেন।(১৯) ১৯৪৬ এ সবচেয়ে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধে পাঞ্জাবে। সেখানে উভয় সম্প্রদায়ের কয়েক লক্ষ লোক নিহত হন। পাঞ্জাবের দাঙ্গার আগ পর্যন্ত গান্ধী ভারত বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন এবং বলেছিলেন পাকিস্তানকে এক ইঞ্চি জায়গাও দেওয়া হবে না; কিন্তু পাঞ্জাবের দাঙ্গার পর এই দাঙ্গা আরও ছড়িয়ে পড়লে আর থামানো যাবে না অশীতিপর বৃদ্ধ গান্ধীকে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে জওহরলাল নেহেরু (১৮৮৯-১৯৬৪), বল্লভ ভাই প্যাটেল (১৮৭৫-১৯৫০) প্রমুখ ভারত বিভাজনে গান্ধীকে রাজি করিয়েছিলেন।(২০) ভারতের সাধারণ মুসলমানরা ইংরেজ আমলে ছিলেন ইংরেজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর হাতে নির্যাতিত, তাই তারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন; কিন্তু এখানকার মুসলমান অভিজাতদেরকে যে তারা বিশ্বাস করতেন বা ভালোবাসতেন-এমনটাও নয়। পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিল তাদের কাছে ʻমন্দের ভালো’।
আট
ভারতে মুসলমানরা প্রথম স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম ভারত বিভাজনের ডাক দেননি। ভারতকে বিভাজনের দিকে নিয়ে গিয়েছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী এবং তাদের নেতারা। প্রথমদিকে সাধারণ মুসলমানও তেমন করে ভারত বিভাজন চাননি। পরে এলিট মুসলমানরা ভারত বিভাজনের দিকে হাঁটতে বাধ্য হলে অনেক সাধারণ মুসলমান তাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। এর কারণ হিসেবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, অখণ্ড ভারতের চেয়ে খণ্ডিত ভারতেই মুসলমানরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছেন; যদিও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের রাজনৈতিক ভুল ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তাদের অনাদর ২৩ বছর পরেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। যাই হোক ভারতে প্রথম ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন ওয়াহাবীরা, যাদের নেতা ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ; যিনি ফারায়েজী আন্দোলনেরও প্রধান প্রবক্তা ছিলেন। এই আন্দোলনের অনেক অনুগামী ভারতে ইসলামী সমাজ গঠনে আগ্রহী ছিলেন, তাই উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতারা এই আন্দোলনে শামিল না হয়ে ইংরেজ রাজত্বে থাকাটাই অধিক বাঞ্ছনীয় মনে করলেন; কিন্তু ফারায়েজীরা ধর্মের নামে কপটাচারের বিরুদ্ধেও সংগ্রামে রত হয়েছিলেন।(২১) ফারায়েজী আন্দোলনকে সাধারণ মুসলমানরাই বেগবান করেছিলেন। একে কোনো অভিজাত মুসলমান পৃষ্ঠপোষকতাতো করেননি, বরং তাদের অনেকে এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ‘কৃষকদের মধ্যে শরীয়তুল্লাহর ব্যাপক প্রভাব এবং তাহার নেতৃত্বে মুসলমান কৃষকগণের অভূতপূর্ব সঙ্ঘবদ্ধতা ও কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করিয়া জমিদারগণ ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠেন। অন্যদিকে শরীয়তুল্লাহকে মুসলমান ধর্মের মৌলিক সংস্কার সাধন ও তাহা দ্বারা মুসলমান জনসাধারণকে আকৃষ্ট করিতে দেখিয়া প্রচলিত মুসলমান ধর্মের গোঁড়া সমর্থক ধনী মুসলমানগণও শরীয়তুল্লাহর ওপর ক্রুদ্ধ হইয়া উঠেন। সুতরাং ফরিদপুরের জমিদার-গোষ্ঠী ও ধনী মুসলমানরা একত্রিত হইয়া শরীয়তুল্লাহকে ঢাকা জেলা হইতে বিতাড়িত করেন।”(২২) বলা বাহুল্য শরীয়তুল্লাহর সর্বপ্রকার সংস্কার ছিল গণমানুষের পক্ষে।
ওয়াহাবীদের সাধারণ যে সমস্যা ছিল, তা হলো ওয়াহাবীরা ছিলেন গোঁড়া ও ধর্মান্ধ। তাই সর্ব শ্রেণির ও ধর্মের লোকদের তারা এক কাতারে দাঁড় করাতে পারেননি; কিন্তু মজার বিষয় হলো ফারায়েজীরা ওয়াহাবী হয়েও হিন্দু এবং দেশি খ্রিস্টানদের একাংশকে উপনিবেশবিরোধী লড়াইতে শামিল করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তারা সবাই মিলেই ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। শরীয়তুল্লাহর পরে দলের নেতৃত্বে আসেন তার পুত্র মোহসেন উদ্দিন দুদু মিঞা। সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, ‘দুদু মিঞা সংগ্রাম ঘোষণা করিয়াছিলেন জমিদার ও নীলকরগণের বিরুদ্ধে। ইহারা কেবল মুসলমান কৃষকের নহে, হিন্দু কৃষকেরও শত্রু। তাই হিন্দু কৃষকও দুদ মিঞার নেতৃত্বে এই সংগ্রামে যোগদান করিয়াছিল। এই সংগ্রাম ক্রমশ ফরিদপুর, বিক্রমপুর, খুলনা, ২৪ পরগণা প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে। দুদু মিঞার নেতৃত্বে অন্তত পঞ্চাশ হাজার হিন্দু-মুসলমান কৃষক যে- কোনো সময় জমিদার ও নীলকরগণের বিরুদ্ধে লাঠি হাতে সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িতে ইতস্তত করিত না।’ (২৩)
আর ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে ওয়াহাবীরা সামগ্রিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।(২৪) বিমলানন্দ শাসমল লিখেছেন, ‘হিন্দুরা এটা স্বীকার করতে চান না; কিন্তু বাংলা ও পাটনার ওয়াহবীরাই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের দিশারী ছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহেও এদের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল এবং যে যে স্থানে সিপাহি বিদ্রোহ ফলপ্রসূ হয়েছিল, তা অনেকটা এই ওয়াহবীদের প্রচেষ্টা ও সংগঠনে। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করে যত ওয়াহবী প্রাণ দিয়েছিলেন বা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, ইতিহাস এদের সেভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই যে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ-বিচার, এতেই প্রমাণ করে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে হিন্দু ও মুসলমান প্রথম থেকেই দুই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখতেন।’ (২৫)
অন্যদিকে সিপাহিদের মধ্যেও যারা সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম ডাক দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মুসলমান সিপাহিরাই ছিলেন অগ্রগামী। তবে হিন্দু ও মুসলমান সব বিদ্রোহী সিপাহিদের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন বেশিরভাগ হিন্দু ও মুসলমান অভিজাতরা, এমনকি তারা বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্যও করেছেন। তবে বলা হয়, একদিক দিয়ে ইংরেজরা এ সব হিন্দু ও মুসলমান অভিজাতদের থেকে শ্রেয় ছিলেন, তারা স্থানীয়দের সবাইকে একচোখে দেখতেন। ইংরেজ লেখক জর্জ ডড (১৮০৮-১৮৮১) লিখেছেন, ‘ইংরেজদের চোখে অভিজাত ব্যক্তিরা ও ছোটজাতের লোকেরা এক সমান, নিম্ন শ্রেণির লোকেদের সামনে তারা উচ্চশ্রেণির লোকেদের অপমান করে, এমনকি অস্পৃশ্য চামারদের অভিযোগে তারা ভদ্রলোক, নবাব ও রাজাদের গ্রেফতার করে কিংবা দপ্তরে তলব করে অপমান করে।’(২৬) জর্জ ডডের একথা আংশিক সত্য। যে কারণেও অভিজাত হিন্দু ও মুসলমানের ভেতর ইংরেজ বিরোধিতা একসময়ে দানা বাঁধে।
নয়
অর্থনৈতিক তিনটি কারণ মনস্তাত্ত্বিকভাবে অভিজাত মুসলমানকে স্বতন্ত্র মুসলিম রাজত্ব বা রাষ্ট্র কায়েমের দিকে পরিচালিত করেছে:
(ক) হিন্দুরা বিশেষত অভিজাত হিন্দু ইংরেজদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাদর্শ আত্মস্থ করেছিলেন, যেগুলো বিধর্মীর ভাষা ও সংস্কৃতি বলে মুসলমানরা, বিশেষ করে এলিট মুসলমান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষা মাদ্রাসাগুলোতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ফলে সরকারি সাহায্যের ও আনুকূল্য লাভের পথ এরা হারালেন।
(খ) ১৮৪৪ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজরা ফার্সির জায়গায় ইংরেজি চালু করলেন। ফলে সরকারি ও বেসরকারি সব চাকরিতেই যোগ্যতার বিচারে হিন্দুরা এগিয়ে থাকলেন, আর অনেক মুসলমান ইংরেজি না জানার কারণে চাকরি হারালেন। অনেক বিত্তশালী পরিবার একারণে রাতারাতি বিত্তহীন হয়ে গেল।
(গ) ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৩৮-১৮০৫) কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের ফলে হিন্দু বিত্তশালী বণিক ও জমিদারদের উত্থান ঘটল। এই তিনটি কারণে অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার দৌড়ে অভিজাত মুসলমান পিছিয়ে পড়লেন।(২৭)
মুসলমানদের এ অবস্থা দেখে তাদের সামনে এগিয়ে আনতে ১৮৭৫ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৮৯) আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করেন; কিন্তু এই সুবিধা শুধু উত্তর ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো।(২৮) তবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানও মনে করতেন যে, মুসলমান ও হিন্দু দুই জাতি এবং তাদের আলাদা রাষ্ট্র থাকা উচিৎ। ফলে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রথম উদ্গাতা তিনিই ছিলেন।(২৯)
দশ
ইংরেজ বড়লাটদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের প্রতি সবচেয়ে আন্তরিক ছিলেন লর্ড কার্জন (১৮৫৯-১৯২৫)। এ কারণেই তিনি বাংলাকে দুটি প্রদেশে ভাগ করেন। তখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে একটি প্রদেশ ছিল। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে একটি এবং পূর্ব বাংলা ও আসামের অংশ নিয়ে আরেকটি- এই দুটি প্রদেশ তৈরি করলেন, অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ ঘটল। শিক্ষা, চাকরি এবং অর্থনীতির নানাখাতে এই বিভাজন মুসলমানদের বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের জন্য বহু সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছিল। বিমলানন্দ শাসমল মন্তব্য করেছেন, ‘সেই স্বদেশী আন্দোলনের যুগ থেকেই মুসলমানরা স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে সরে ছিল, কারণ তিলক, অরবিন্দ, বিপিন পাল স্বদেশী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করবার জন্য হিন্দু ধর্ম দর্শনের বহু আদর্শকে এর মধ্যে উপ্ত করেছিলেন। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন নিঃসন্দেহে মুসলমান বিরোধী ছিল এবং সেই কারণে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বার বার লিখে গেছেন যে, মুসলমানরা এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি। […] কিন্তু বঙ্গ বিভাগ হলে পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা যে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার একটা প্রশস্ত সুযোগ পেত সে প্রশ্নটি তাঁরা (হিন্দু নেতারা-লেখক) বিচার করলেন না।’ (৩০)
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের চাপের মুখে ১৯১১ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৭৮৫-১৮৫৬) বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হন। একথা বলা যায় যে, বঙ্গভঙ্গ রদ ভারত বিভাজনকে পরে ত্বরান্বিত করেছে। বঙ্গভঙ্গ ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। বিমলানন্দ শাসমল লিখেছেন, ‘১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলা এবং ভারতের সমগ্র হিন্দু সমাজকে আলোড়িত করে তুলল। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ও ভারতের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে তিনটি সুস্পষ্ট কর্মবিধি রূপায়িত হলো, যার ফলাফল হলো সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলনেই প্রথম বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের প্রস্তাব ঘোষণা করা হলো। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনেই সাধারণভাবে প্রথম সন্ত্রাসবাদ ও ইংরেজ রাজকর্মচারী হত্যাকে দেশপ্রেমের গৌরবময় বহিঃপ্রকাশ বলে মেনে নেওয়া হলো এবং যারা দেশি-বিদেশি রাজকর্মচারী হত্যা করতে পারলেন বা এমনকি ভুলক্রমে রাজকর্মচারী ভেবে নিরীহ ইংরেজ ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাকে হত্যা করতে পারলেন- তাঁদের দেশের ও সমাজের নমস্য ও প্রণম্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। সন্ত্রাসবাদ শুধু রাজকর্মচারী হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো না, সন্ত্রাসের সাহায্যে নিজের বা মুষ্টিমেয়র মত অপরের বা সাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটাও রাজনৈতিক প্রগতির গৌরব অর্জন করলো। তৃতীয়ত, এই সন্ত্রাসবাদ বা বিপ্লববাদ আটকে থাকলো শুধু হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে- না পারলো টেনে আনতে সাধারণ জনসমাজকে, না পারলো মুসলমান সমাজকে।’(৩১) তবে তাদের মনস্তাত্ত্বিক মেন্টর ও নেতাদের অনেকে উচ্চশ্রেণির ও উচ্চবিত্তের হিন্দু ছিলেন।
এগারো
বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন পরে যে স্বদেশি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল, তা ছিল চূড়ান্তই সাম্প্রদায়িক। শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ, বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধর্মীয় স্রোতে অবগাহন করালেন। বিপিন পাল দেশমাতৃকাকে হিন্দু শাক্ত দেবীদের অর্থাৎ কালী, দুর্গা ও ভবানীর আদলে উপস্থাপনের দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলেন। অরবিন্দ ঘোষ ভারতের মধ্যেই সামগ্রিক ধর্মতত্ত্বের নিগূঢ় সার খুঁজে পেলেন।(৩২) অন্যদিকে মুসলমান বিরোধী সন্ত্রাসবিরোধীদের একাংশ ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জনের সহায়তায় গান্ধীর কংগ্রেসে যুক্ত হলে, মুসলমানরা কংগ্রেস ত্যাগ করেন।(৩৩) ফলে হিন্দু ও মুসলমানের এক স্বরাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। এটি ছিল চিত্তরঞ্জনের সবচেয়ে বড় ভুল। আর কংগ্রেসবিমুখী এই স্রোত পরবর্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনকে জোরদার করেছে।
বারো
ব্রিটিশের প্রতি হিন্দুর খেদের একটি কারণ, তারা ভারতের প্রাচীন সমাজকে বিপর্যস্ত করেছে, তার সামাজিক ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) লিখেছেন,
“All the civil wars, invasions, revolutions, conquests, famines, strangely complex, rapid, and destructive as the successive action in Hindostan may appear, did not go deeper than its surface. England has broken down the entire framework of Indian society, without any symptoms of reconstitution yet appearing. This loss of his old world, with no gain of a new one, imparts a particular kind of melancholy to the present misery of the Hindoo, and separates Hindostan, ruled by Britain, from all its ancient traditions and from the whole of its past history.” (৩৪)
কিন্তু মার্ক্স লেখেননি যে, ভারতের জাতীয়তাবাদীরা বিশেষত হিন্দুত্ববাদী ও মুসলমান আভিজাত্যবাদীরাও পরস্পরের রক্তক্ষরণ করেছে এবং ভারত বিভাজনের পথ প্রশস্ত করেছে। কারণ এসবের সূত্রপাত হওয়ার বহু পূর্বেই মার্ক্স মারা যান। মার্ক্স আরও লিখেছেন, “It was the British intruder who broke up the Indian hand-loom and destroyed the spinning-wheel. England began with driving the Indian cottons from the European market; it then introduced twist into Hindostan, and in the end inundated the very mother country of cotton with cottons. From 1818 to 1836 the export of twist from Great Britain to India rose in the proportion of 1 to 5,200. In 1824 the export of British muslins to India hardly amounted to 1,000,000 yards, while in 1837 it surpassed 64,000,000 of yards.”(৩৫)
অর্থাৎ, যন্ত্রের আবিষ্কারের পরে হস্তচালিত তাঁতের চেয়ে হাজার গুণ উৎপাদন বেশি হতে লাগল কাপড়ের। এতে যেমন ব্রিটিশের নগদ উপার্জন বাড়লো, সেই সঙ্গে ভারতের সনাতনী ঐতিহ্যে চিরস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হলো, আর তা অবধারিতভাবেই সনাতনী তাঁতী ও তার মালিকের ক্ষতির কারণ হলো। এই ক্ষত স্বভাবতই অভিজাত ও বিত্তশালী হিন্দুর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত আরও বাড়িয়ে তুললো। এই ক্ষতগুলো একদা মুসলমানের আগমনে তাদের মধ্যে হয়েছে মুসলমানরা ক্ষমতা দখলের পর। পরে ইংরেজও তার স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। ইংরেজকে সে সরাতে পারলেও মুসলমানকে সে পারেনি। তাই দেশ বিভাগ তার জন্য হয়ে উঠেছে জরুরি। আর মুসলমান অভিজাতরাও দেশ বিভাগ চেয়েছেন, তবে অপেক্ষাকৃত পরে, যা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। পরবর্তিতে নেহেরু, জিন্নাহ, প্যাটেল, লালা রাজপত রায় প্রমুখ রাজনীতিবিদরা যে রাজনীতিই করেছেন তা এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাকরণের ওপর ভিত্তি করেই, যে সম্পর্কে আমার বেশি কিছু লেখার দরকার নেই। কারণ সেসব বিষয়ে ইতিপূর্বে বহু লেখা লিখিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও লেখা হবে। আমি শুধু ভারত বিভাজনের ক্ষেত্রে বিশেষত অভিজাত মুসলমানের মনস্তত্ত্ব কীভাবে কাজ করেছে তার সারাংশটা লেখার চেষ্টা করলাম মাত্র।
১। Collins, Larry, Lapierre, Dominique. 1960. Freedom at Midnight. p.03. Vikas Publishing House PVT Ltd, Delhi.
২। নওশাদ, মুহাম্মদ তানিম. জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০.শিখ ধর্মের উত্থান এবং তার ঐতিহাসিক পথচলা, পৃ: ২৬-২৭, ত্রৈমাসিক দেশকাল পত্রিকা, ঢাকা।
৩। সেন, ড. গৌরী, ১৯৮৪, বাংলা ও হিন্দী বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে বাৎসল্য রস, পৃ:৭, সাহিত্যলোক, কলকাতা।
৪। শাসমল, বিমলানন্দ, ১৯৯১, ভারত কী করে ভাগ হলো, পৃ:০১, হিন্দুস্তান বুক সার্ভিস, কলকাতা।
৫। শাসমল, বিমলানন্দ, ১৯৯১, পূর্বোক্ত, পৃ: ০৩।
৬। উপরোক্ত
৭। Collins, Larry, Lapierre, Dominique. 1960. Op.cit.p.7.
৮। আফসানা শব্দের অনুবাদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করেছিলেন কাহিনি, তার সঠিক অনুবাদ হচ্ছে রূপকথা যা এখানে দেয়া হলো। – লেখক।
৯। গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল.১৪০২ বাংলা সন, সেই সময় ২য় খন্ড , পৃ: ১৫২-১৫৬, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
১০। ইলিয়াস, আখতারুজ্জামান.২০০৩, টুটাফাটা কাগজি নবাব, অগ্রন্থিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, পৃ: ১৩০, ঐতিহ্য।
১১। উপরোক্ত. পৃ: ১২৪-১২৫।
১২। See: https://en.wikipedia.org/wiki/Nawab_of_Dhaka
১৩। শাসমল, বিমলানন্দ .১৯৯১. পূর্বোক্ত, পৃ: ০৪।
১৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Nathuram_Godse
১৫। https://www.britannica.com/biography/Mahatma-Gandhi/Emergence-as-nationalist-leader
১৬। https://en.wikipedia.org/wiki/Mahatma_Gandhi
১৭। উপরোক্ত
১৮। উপরোক্ত
১৯। রহমান, শেখ মুজিবুর.২০১৭. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ৬৩-৬৮, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।
২০। শাসমল, বিমলানন্দ .১৯৯১. পূর্বোক্ত, পৃ: ০৬।
২১। উপরোক্ত, পৃ:১৭।
২২। রায়, সুপ্রকাশ. ২০১১. ফরিদপুরের ফরাজী বিদ্রোহ,পৃ:৯৩, ফরায়েজী আন্দোলন: আত্মসত্তার রাজনীতি (ফাহমিদ-উর-রহমান সম্পাদিত),
২৩। বাংলাদেশ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র।
২৪। রায়, সুপ্রকাশ. ২০১১. পূর্বোক্ত, পৃ: ৯৬।
২৫। শাসমল, বিমলানন্দ .১৯৯১. পূর্বোক্ত, পৃ:১৭।
২৬। উপরোক্ত, পৃ:১৮।
২৭। Dodd, George. 2003. The History of the Indian Revolt and of the Expeditions to Persia, China and Japan, 1856-7-8, p.427-428, Elibron Classics.
২৮। শাসমল, বিমলানন্দ .১৯৯১. পূর্বোক্ত, পৃ: ১৮-১৯।
২৯। উপরোক্ত, পৃ: ১৯।
৩০। https://en.wikipedia.org/wiki/Syed_Ahmad_Khan
৩১। শাসমল, বিমলানন্দ .১৯৯১. পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৭।
৩২। শাসমল, বিমলানন্দ .১৯৯১. পূর্বোক্ত, পৃ: ২০।
৩৩। উপরোক্ত, পৃ: ২১-২২।
৩৪। উপরোক্ত, পৃ:৫৭-৫৮।
৩৪। Marx, Karl.1853. The British Rule in India. Karl Marx in the New-York Herald Tribune 1853. See: https://www.marxists.org/archive/marx/works/1853/06/25.htm