ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৮)
বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর ধরে আমরা অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।
ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয়। সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে আজ থাকছে পর্ব- ৮।
সংস্কৃতির রূপান্তর
১৩১০ সালের ৪ঠা অগ্রহায়ন ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দীনেশচন্দ্র সেনের ‘মাতৃভাষা’ নামক একটি প্রবন্ধ। ওখানে দীনেশবাবু লিখেন: “মুসলমান হিন্দু সাহিত্য পাঠে–হিন্দু আচার-ব্যবহার শিক্ষায় ক্রমেই হিন্দু ভাবাপন্ন হইয়া পড়িবে; তাই বাঙ্গালা সাহিত্য সমন্ধে উদাসীন থাকা মুসলমানদের উচিত নহে।”১৫ অত্যন্ত মেধাবী, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও প্রাজ্ঞ মানুষ দীনেশবাবু প্রায় একশ কুড়ি বছর আগে লক্ষ্য করেছিলেন সাহিত্য তথা বইপত্রে ভিন্নতর সংস্কৃতি উপস্থাপন ও তা পাঠের মধ্য দিয়ে একটা জাতির সাংস্কৃতিক স্বভাব বদলে যেতে পারে, ধীরে ধীর মরে যেতে পারে তার নিজস্ব সংস্কৃতি। বহুবছর পর এ বিষয়ে সচেতন হয় বিভিন্ন উপনিবেশের মানুষেরা। বইপত্রে, শিক্ষাদীক্ষায় ভিন্ন ধারার জ্ঞান, মূল্যবোধ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে একটা জাতির মগজ দখল করার এই প্রক্রিয়াটাকেই বলা হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পৃথিবীর প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় এ কায়দাটাই প্রয়োগ করেছিল উপনিবেশী শক্তি। এ নিয়ে এখন বিস্তর লেখালেখি, তত্ত্ব দাড়িয়ে গেছে। তার বহু আগে দীনেশবাবু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এই চোরাস্রোতের দিকে ইঙ্গিত করে সতর্ক করেছিলেন সমকালীন মুসলমানদের। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানজগত যে অবস্থায় পৌঁছার পর দীনেশ বাবু সতর্কবাণী জারি করেন সেই মাত্রায় পতনেরও একটা ইতিহাস আছে। সেটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, বাংলা গদ্য এবং বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের বাইরে পাঠ্য বইপত্রের সাথে শক্ত করে জড়ানো।
উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চার জগতে লিখিত বইপুস্তকের খুব একটা ভূমিকা ছিল না। মূলত চোখে দেখে শিখা ও আর মুরুব্বিদের কাছে শুনে শুনে জানার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির শিক্ষা সম্পন্ন হতো। খুব ছোটোবেলা থেকে পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা, এরপর আশাপাশের মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপনের মধ্যেই সংস্কৃতির চিহ্নগুলো শিখিয়ে দিতেন নতুনদেরকে; তাও সংস্কৃতি নামে না, জীবনের আনন্দউল্লাস আচার-প্রথা হিসাবে। হাতে লেখা বই পড়ে শোনানোর একটা রেওয়াজ ছিল সে আমলে। যারা পড়ে শোনাতের তাদেরকে বলা হতো কথক। মাঝে মধ্যে কথকদের মুখে শোনা ঐসব কাহিনি সংস্কৃতি চর্চায় খুব একটা ছাপ ফেলতে পারতো বলে মনে হয় না। মোট কথা আজকের দিনে সংস্কৃতি পরিভাষায় যে বিস্তৃত পরিসরের চর্চার একটা বিষয় তৈরি হয়েছে তখন তার জায়গাটা ছিল অনেক ছোটো এবং জীবনযাপনের অংশ হিসাবেই তা রপ্ত হতো।
উনিশ শতকের শুরুতে ইংরেজের নির্দেশে পন্ডিতদের হাতে বাংলা গদ্য তৈয়ার হওয়ার পর বই পুস্তক লেখা ও ছাপা হতে থাকে। অচিরেই বাঙালির ছাপাখানাও বসে। নতুন কায়দায় স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়, স্কুল বুক সোসাইটি এবং স্কুল সোসাইটি গড়ে উঠে। দুইতিন দশকের মধ্যে পড়াজানা বাঙালির জীবনের নতুন অনুসঙ্গ হয়ে উঠে ছাপার বই। বই থেকে শিখার ব্যাপারটা আগে ছিল কেবলই সংস্কৃত ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ ও মোল্লা মৌলভীদের মামলা। ছাপা বই হাতের কাছে আসার পর বইয়ের পাঠ থেকেও যে শিখা যায় এবং শিখতে হয় এই ধারণা জায়গা করে নেয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। এবং এখান থেকেই বাঙালির সংস্কৃতিতে বইয়ের ভূমিকার সূচনা।
আদি মধ্যযুগে মানুষের জানার পরিধি ছিল সীমিত। আধুনিকযুগে তা বহুবিস্তৃত। আধুনিক মানুষ ছাপা পৃষ্ঠার প্রতীক ও সংকেতের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানতে পারে। সাধারণের সমাজে এ ধরনের জানার সূচনা হয় লেখা ছাপার কৌশল আবিষ্কৃত হওয়ার পর। ভারতে তার আরম্ভকাল আঠার শতকের শেষে। বাংলা বই ছাপা শুরু হয় একেবারে শেষদিকে। এই সুযোগে বাঙালি বই পড়ে দেখার জগতের বাইরে আরো বিচিত্র ভিন্ন ভিন্ন জগত ও জীবন কল্পনায় দেখতে পায়। পাঠের মাধ্যমে মনে মনে দেখা সেই জগতে মানুষ আছে, জীবন ও তার যাপন আছে। সেই জীবনেরও আচার প্রথা আছে, আনন্দ-উল্লাসের জন্য কিছু কিছু তৎপরতা আছে, সৃজনশীলতা আছে; যেগুলোকে আধুনিক কালে একত্রে সংস্কৃতি নামে ডাকা হয়, তার সবই সেখানে আছে। তাই নিজের জীবনের চচির্চত সংস্কৃতি আর পাঠের জগতের সংস্কৃতির তুলনা করার ও প্রয়োজনে পাঠের জগতকে অনুকরণের বাসনা দেখা দেয় তার মধ্যে। সংস্কৃতির বোধ গড়ে তোলা ও চর্চা করার কাজে লেখা-পাঠ তথা বইয়ের ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হয়। উনিশ শতকের শুরু থেকেই নতুন বাংলায় লেখা নতুন ধরণের রচিত বইপত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত পাঠের জগতের নানা উপাদান বাঙালির জীবনে জায়গা করে নিতে থাকে, যা আসলে তার ঐতিহ্যিক সঞ্চয় নয়। এই পরিস্থিতির ব্যাপারেই বাঙালি মুসলমানদের সতর্ক করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। ততদিনের পার হয়ে গেছে সত্তর আশি বছরেরও বেশি সময়। বাঙালি মুসলমানের মনে, মননে ও জীবনচর্চায় যে-প্রভাব যতটুকু পড়ার কথা তা যথারীতি ঘটে গেছে। কি করে তা ঘটলো সে সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা এখানে হাজির করতে চাই।
প্রজাদের কাছ থেকে নানা কায়দায় অর্থ সংগ্রহ করে নিজের হিস্যা রেখে নির্ধারিত অর্থ রাজকোষে পৌঁছে দেয়ার ঝামেলার কাজটা করতো রাজস্ব সংগ্রহে জড়িত কর্মচারী-সামন্ত-জমিদাররা।মুসলমান কর্মচারীদের অবিশ^স্ততার কারণে রাজস্ব আদায়ে হিন্দু কর্মচারীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন মুর্শিদ কুলি খান। এ ব্যবস্থা পরেও অব্যাহত থাকে। সিরাজ উদদৌলার সময় হিন্দুদের প্রাধান্য আরো বাড়ে। বৃটিশ দখলাদারিত্বের আগে আগে অর্থ ব্যবস্থা ও রাজস্ব ব্যবস্থার প্রায় পুরাটাই হিন্দু কর্মচারীদের হাতে উঠে গিয়েছিল। মুসলিম অভিজাত শ্রেণির অধিকাংশের আমিরানা চলতো মাসিক বেতন/বরাদ্দ/জায়গীর নানা তরফের উপহার উপটোকন ও অন্যান্য পাওয়া থেকে।
শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার পর মুসলমানরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার জায়গাগুলো হারাতে থাকে ইংরেজদের সচেতন উদ্যোগে। সে জায়গা দখল করে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। এটি ছিল খুবই স্বাভাবিক পরিণতি। মুসলমানদেরকে পরাজিত করে ক্ষমতা নেয়ার কারণে বৃটিশরা তাদেরকে বিশ্বাস করার কথা নয়। বর্ণ হিন্দু সমাজের প্রতিপত্তিশালী বেশ কিছু লোক পলাশির ষড়যন্ত্রের সহায়ক শক্তি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ইংরেজের বিশ^াস অর্জন করে নিয়েছিল শুরুতেই। ক্ষমতা পেয়ে তাদেরকে সহযোগী হিসাবে বেছে নেয় ইংরেজরা। ধীরে ধীরে মুসলিম অভিজাত শ্রেণি অর্থ ও ক্ষমতা দুই-ই হারায়। তাদের উপর নির্ভরশীল মুসলিম কর্মচারী-প্রজার দলের ভাগ্যের পতন ঘটে একই কারণে। রাজভাষা ফারসি চালু থাকায় কিছু সংখ্যক মুসলিম কর্মচারী এখানে সেখানে জায়গা নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। ১৮০০ সাল নাগাদ অভিজাত মুসলমান ও সাধারণ মুসলিম প্রজা উভয় শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ রীতিমত দারিদ্রে পতিত হয়। শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা এবং এর সাথে জড়িত অন্যান্য বিষয়গুলোয় ব্যাপক রদবদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিলো এই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভুমিতে ।
স্থানীয়দের সাথে সম্পর্ক যোজনে ইংরেজরা অভিজাত মুসলমান এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদেরই প্রাধান্য দেয়। মুসলিম অভিজাতদের বেশির ভাগ ছিল উত্তরভারতীয় বংশোদ্ভুত হিন্দী/উর্দুভাষী। কিন্তু অভিজাত হিন্দুরা ছিল বাঙালি, বাংলাভাষী। সাধারণ শ্রেণির যেসব মানুষের উদ্যোগে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা, গদ্যের চর্চা চলে আসছিল কয়েকশ বছর ধরে তারা ছিলেন রাজদরবার অথবা বিভিন্ন জমিদার সামন্তদের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার জন্য ছিল মক্তব, টোল ইত্যাদি। বৃটিশদের শাসনের কয়েক দশকের মধ্যে এ সমস্ত কেন্দ্রই ভেঙ্গেচুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নতুন শাসন কেন্দ্র, রাজস্ব আদায় কেন্দ্র, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে উঠে ইংরেজদের হাতে। সেখানে প্রাধান্য পায় ইংরেজদের সহযোগী উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। যারা নবাবী আমল থেকে পদপদবি দখল করে বসেছিল তারা তো থাকেই, সঙ্গে যুক্ত হয় নয়া দোসরের দল। যারা বাংলা ভাষায় লেখতেন, সাহিত্য চর্চা করতেন বিদ্যালয় টোল মক্তব চালাতেন তারা মুছে যান দৃশ্যপট থেকে। এসব চলে যায় ইংরেজদের বেছে নেয়া নতুন বর্ণ হিন্দুদের দখলে। পরে এরাও যুক্ত হন কলিকাতাকেন্দ্রিক নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাফেলায়।
আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৭)
এর মধ্যে কোলব্রুকস, হ্যালহেড জোনস প্রমুখের ভুল অনুমান ও সেই অনুমান নির্ভর বিশ্লেষণের বদৌলতে বাঙলাসহ ভারতীয় অন্যান্য ভাষার মা-বাপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় সংস্কৃত ভাষা। তারা এও ঘোণা করেন যে আরবফারসি শব্দসহ যে ভাষা প্রচলিত আছে তা মুসলমানী ভাষার শব্দদোষে দুষ্ট। বাংলা ভাষার উন্নতি করতে হলে সংস্কৃতকে আদর্শ ধরে, সংস্কৃতকে অনুসরণ করেই তা করতে হবে। এর মধ্যে বাংলাভাষার সে-যাবত কালের লেখকরা দৃশ্যপট থেকে পুরাপুরি অন্তর্হিত। ইংরেজরা মুসলমান অভিজাত শ্রেণি বলতে চিনতো উত্তরাভারতীয় উর্দুভাষী মুসলমানদের। এ কারণে তাদের ধারণা জন্মে অভিজাত মুসলমান যেহেতু বাংলা জানে না তাই বাংলা শিক্ষার কাজে মুসলমানদের নিয়োগ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আদতে অভিজাত শ্রেণি নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেই যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ ধারা চর্চিত হয়ে আসছিল সে খবর তারা জানতো না, জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি। ইংরেজ উদ্যোক্তারা বাংলা গদ্য লেখা ও শিক্ষকতার কাজের জন্য ইতিমধ্যে নানাসুত্রে সম্পর্কিত পন্ডিতদের ডেকে আনে, যারা বাংলা ভাষার লেখকও না,পৃষ্ঠপোষকও না। এ প্রক্রিয়ায় বাংলা গদ্য রচনা ও পড়ানোর কাজ থেকে সাধারণ হিন্দু-মুসলমান পুরাই বাদ পড়ে। এবং পরবর্তী ৫০/৬০ বছর পর্যন্ত তারা এ প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে যায়। তাই সে কালে বাংলা পাঠ্য পুস্তক বলি, সাধারণের পাঠ্য বই বলি, সংবাদপত্র বলি প্রায় সবই বর্ণ হিন্দুদের কর্ম। যেসব সাধারণ মুসলমান ও হিন্দু কবি, কবিয়াল, পাঠক লেখক ছিল তারা জ্ঞান উৎপাদনের এ মহাযজ্ঞে কোনা জায়গা পায় নাই। ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও ভাব জগতের ঐতিহ্যিক চর্চা নয়ারীতির জ্ঞানচর্চা ও বইপত্রে জায়গা না পেয়ে ঐতিহ্যিক প্রকাশরীতিতেই অস্তিত্ব রক্ষা করে চলে। । দীর্ঘদিন মৌখিক রীতিতে টিকে থেকে পরে ধীরে ধীরে লেখার জগতে প্রবেশ করে বাঙালির সবচেয়ে সমৃদ্ধ সে ভাবফসল, তাও ‘লোক’ শব্দে নির্দেশিত ‘নিচু-মান’-এর মার্কা নিয়ে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা।
মুদ্রিত লেখাকে কেন্দ্র করে জ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যচর্চার এই ধারায় যারা নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাদের সবাই টোলে পড়া সংস্কৃত পন্ডিত। বেদাদি, রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ, উপনিষদ, সুক্ত নিরুক্ত ইত্যাদিতে মহা পন্ডিত একেকজন। আবার বাঙলা ঠিকঠাক মতো জানেন না। আবার ইংরেজ প্রভুরা বলছেন সংস্কৃত ভাষা সব ভাষার মা-বাপ। তারা তাই সংস্কৃতের আদলে বাংলাকে রূপান্তরিত করে নয়া বাংলা ভাষায় বইপত্র লেখা শুরু করলেন। রচনার বিষয়বস্তুতেও তাদের জানাবুঝার ছাপ পড়ে। ঐসব সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতের জানাবুঝার জগত হলো সংস্কৃত ব্যাকরণ, রামায়ন মহাভারত, হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত বইপত্র, হিন্দু দেবদেবীর উপাখ্যান ইত্যাদি। তাই মাকাল গাছে আম ধরে না, মাকালই ধরে শেষপর্যন্ত; আগেও উল্লেখ করেছি পন্ডিতদের হাতে যেসব বই রচিত হয় তার প্রায় সবই আর্য পুরান কাহিনি, আর্য লোক আখ্যান, পুজার্চনা ইত্যাদি সম্পর্কিত। বাংলা সাহিত্য চর্চায় এই শ্রেণির সংস্কৃত পন্ডিতদেরই যে প্রাধান্য চলছিল অন্তত উনিশ শতকের প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত সে খবর জানা যায় জেমস লঙের এই মন্তব্য থেকে: “বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে যারা অগ্রণীর ভূমিকা পালন করছেন, যারা এখন বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক, তারা হলেন ইংরেজি থেকে ভাবসম্পদ আহরণ করার মত পর্যাপ্ত জ্ঞানসম্পন্ন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতবর্গ।”১৬ এই সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতবর্গের তৈরি মৃত্যুঞ্জয়ী বা সংস্কৃতানুযায়ী বাংলায় রচিত পাঠ্য পুস্তক বিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে সারা দেশের পড়–য়াদের বাধ্যতামূলকভাবে গেলানো হয়। সে তক বই পত্র বলতে হিন্দু ধর্মীয় বইপত্র, দেবদেবীদের আখ্যান, ধর্মীয় লোক আখ্যান, প্রাচীন হিন্দু রাজাদের বেডাগিরির কাহিনি, এবং প্রতাপাদিত্যের মতো আধাকাল্পনিক নায়ক চরিত্র নিয়ে লেখা বইপত্রই ছাপা হয়, পৌঁছে যায় বিদ্যালয়গুলোতে, পড়ায় আগ্রহী সাধারণ মানুষের হাতে হাতেও।

বাংলাদেশে উত্তরউপনবিশেী ভাবর্চচার পথিকৃৎ ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরণ, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, বাংলাদশের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান ( কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ।