| 24 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা বিশেষ রচনা: স্বাধীনতার ৭৫-এ  হেমচন্দ্র কানুনগো  স্মরণ  

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

স্বদেশরঞ্জন মণ্ডলের সঙ্গে আমার পরিচয় অমরনাথ করণের মাধ্যমে। স্বদেশবাবু কাঁথির মানুষ। অধ্যাপনা করতেন বেলদা কলেজে। ইতিহাসের অধ্যাপক। চাকরি জীবনের  শেষ দিকে তিনি দেশপ্রাণ বীরেন শাসমলের জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে গবেষণা শুরু করেন। বীরেন শাসমলের বাড়ি চণ্ডীভিটায়। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। অথচ তাঁর সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। ঢাকার সোমেন চন্দ, বর্ধমানের হরিশ মুখার্জী, ময়মনসিংহের কেদারনাথকে নিয়ে মশগুল ছিলাম। কিন্তু ঘরের কাছের মানুষকে করেছি অবহেলা। স্বদেশবাবুর মুখে শুনলাম বীরেন শাসমলের অবদানের কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যোগ্য স্থান পাননি বীরেন শাসমল। স্বদেশবাবু নিজের অর্থব্যয়ে বীরেন শাসমলের উপর একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা বই প্রকাশ করলেন। কিছু বই নিজেই পুশসেল করেছেন। এখনও অনেক বাঁধাই পড়ে আছে। উইপোকার খাদ্য হচ্ছে।

বীরেন শাসমল সম্পর্কে দেশের নেতা-মন্ত্রী ও ইতিহাসবিদদের অবহেলা খারাপ লাগত। তথাপি বীরেন শাসমল আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করেননি। আকর্ষণ করলেন হেমচন্দ্র (দাস) কানুনগো।একদিন আমার বাড়িতে এসে স্বদেশবাবু বললেন যে তিনি হেমচন্দ্রের রচনা, চিঠিপত্র, ছবি সংকলনে নিযুক্ত। এর জন্য তিনি রাধানগর, নাড়াজোল, আন্দামান চষে বেড়াচ্ছেন। হেমচন্দ্রের নামটাই শুনেছিলাম, আর কিছু নয়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী বলতে জানতান অরবিন্দ ঘোষ,বারীন ঘোষ, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, সূর্ষ সেন, গণেশ ঘোষ, পুলিন দাস, পি মিত্র প্রভৃতির কথা। স্বদেশবাবুর মুখে শুনলাম হেমচন্দ্র নিজের জমি বিক্রি করে ইউরোপ গিয়েছিলেন। নিজের কেরিয়ার গোছাবার জন্য নয়,পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার জন্য; ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। সেখান থেকে বোমা তৈরির কৌশল শিখে এসে দেশে তিনি তা প্রয়োগ করেছিলেন। সেদিক থেকে তিনি ইতিহাস। যে ক্ষুদিরাম তরুণ শহিদ হিসেবে আমাদের মনের মণিকোঠায় বিরাজ করেন,সেই  ক্ষুদিরামের অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র। একদিন মেদিনীপুরের রাস্তায় তরুণ ক্ষুদিরাম তাঁর গতিরোধ করে দাঁড়িয়ে ইংরেজ মারবার জন্য একটা রিভলবার চেয়েছিলেন। হেমচন্দ্র তাঁকে নিয়ে আসেন গুপ্ত সমিতিতে। তাঁর তৈরি বোমা নিয়ে প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে  কিংসফোর্ডকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম চলে যান মজঃফরপুর। সেখানে ধরা পড়েন ও বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। ধরা পড়েন হেমচন্দ্রও,তাঁকে পাঠানো হয় আন্দামানে। ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে ‘হাসি হাসি পরব ফাঁসি’ বলে যে গানটা প্রচলিত আছে, সেটা যে ‘অভিরাম’ নামের ছদ্মবেশে হেমচন্দ্রের লেখা,তা প্রমাণ করেছেন স্বদেশরঞ্জন।

সতেরোবার বিবর্তিত হওয়া ভারতের জাতীয় পতাকার প্রথম রূপকার হেমচন্দ্র। জার্মানির স্টুটগার্টের সম্মেলনে মাদাম কামা সেই পতাকা হাতে নিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন। হেমচন্দ্র ইউরোপে শুধু বোমা তৈরির কৌশল শেখেননি; পরিচিত হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার সঙ্গে, পরিচিত হয়েছিলেন বিপ্লবের রণকৌশল বিষয়ে। দেশে ফিরে তাই তিনি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন নেতাদের। বলেছিলেন দু-চারজন ইংরেজ মারলেই বিপ্লব হয় না। তাই তিনি তাঁর আত্মস্মৃতির নাম পরিবর্তন করে নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’; বিপ্লব নয়,বিপ্লব প্রচেষ্টা। বিপ্লব মানে সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। কিন্তু তখনকার নেতারা তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি,বালখিল্য কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

স্বদেশবাবু বলেছিলেন,বাংলার চরমপন্থী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের কুশীলবদের মধ্যে হেমচন্দ্র ছিলেন অন্যতম। তিনি খুব উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত, অভিজাতবর্গের মানুষ ছিলেন না। কিন্তু ত্যাগে ও নিষ্ঠায় তিনি তখনকার নেতৃস্থানীয়দের চেয়ে কোন অংশে ন্যূন ছিলেন না। বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত থাকাকালীন তিনি সংগঠনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেননি, কখনও কোন স্বীকারোক্তি দেননি অন্য কারও কারও মতো। সাহেব মেরে,ইংরেজ তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করাটাই যে শেষ কথা নয় তা তিনি উপলব্দি করতে পেরেছিলেন সুস্পষ্টভাবে।

স্বদেশবাবুর এ সব কথা শুনে আমি হেমচন্দ্র সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে উঠি। মাস কয়েক পরে স্বদেশবাবু আমার হাতে তুলে দিলেন তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘হেম কানুনগো রচনাবলি’। এতে আছে হেমচন্দ্রের দুটি বই:বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা ও অনাগত সুদিনের তরে। আছে পত্রাবলি, কবিতা ও গান, বংশলতিকা ও জীবনপঞ্জী, প্রতিকৃতি  ও আলোকচিত্র। হেমচন্দ্রের বই দুটি খুঁটিয়ে পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।

প্রথমে ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’র কথা বলি।এটি ‘বসুমতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। তারপর সংশোধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। বইটিতে মোট উনিশটি পরিচ্ছেদ আছে। গুপ্ত সমিতির সূচনা থেকে দ্বীপান্তর যাত্রা পর্যন্ত তার বিস্তার। আমি বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর স্মৃতিকথা পড়েছি; কিন্তু হেমচন্দ্রের মতো আবেগহীন,নির্মোহ, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দেখতে পাইনি। তিনি অরবিন্দ,বারীন প্রমুখ অন্যান্য নেতাদের মতো আধ্যাত্মিক ও অতিমানবীয় ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা ও তার দ্বারা ভারতীয় জনগণকে আকৃষ্ট করার অসারতা উপলব্ধি করেছিলেন,তাকে ‘ভক্তিতত্ত্ব কুজ্ঝটিকা’ বলে পরিহাস করেছিলেন। ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত এই মানুষটি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে সংমিশ্রিত করার বিপদ সম্বন্ধে দেশের মানুষকে সতর্ক করে গিয়েছেন,সতর্ক করে গিয়েছেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদ সম্বন্ধে। বইটির চতুর্থ,পঞ্চম,পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন,‘আমি কয়েকজন মাত্র নেতা বা কর্মবীরের কার্য সম্বন্ধে সমালোচনা করতে বাধ্য হয়েছি;অর্থাৎ জনকয়েক বিশিষ্ট নেতা ও কর্মীকে উপলক্ষ ধরে নিয়ে জাতীয় চরিত্রের যে সকল থাকতে প্রকৃত উন্নতি কখনও সম্ভব হতে পারে না,সেই সকল দোষেরই সমালোচনা অবশ্য কর্তব্য  জেনেই করেছি।’স্বরাজ ও বিপ্লবের পার্থক্য নির্ণয় করে হেমচন্দ্র বলেছেন,‘আমরা স্বরাজ চাই,তাই বিপ্লব আনতে হবে,কিন্তু স্বরাজ ও বিপ্লব কি এক বস্তু,তার সঠিক ধারণা না থাকলে তা কেমন করে আনা যাবে?’

হেমচন্দ্রের দ্বিতীয় বই ‘অনাগত সুদিনের তরে’ সুপরিচিত বই নয়।একে লেখক বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টার sequel বলেছেন। এডওয়ার্ড বেলামির গ্রন্থের আদল ব্যবহার করে হেমচন্দ্র এই বইটি লিখেছেন। এই বইতে তিনি বিপ্লবের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এবং ভবিষ্যৎ ভারতের পুর্নগঠনের কথা আলোচনা করেছেন।

এই রকম একজন স্বচ্ছ দৃষ্টির মোহমুক্ত মানুষ কেন ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন,কেন আন্দামান থেকে ছাড়া পাবার পরে রাধানগরের বাড়িতে স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণ করলেন,সে কথা আমরা জানি না। কিন্তু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া এই বিস্ময়কর মানুষটিকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। তাই ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আমাদের আবেদন:

১] পূর্ব মেদিনীপুরের বেলদা থানার অন্তর্গত রাধানগরে হেমচন্দ্রের ৭ একর জমি ও মাটির বাড়িটি অধিগ্রহণ করে তাকে হেরিটেজের মর্যাদা দেওয়া হোক।

২] বেলদা স্টেশনটি তাঁর নামে নামাঙ্কিতকরা হোক।

৩] হেমচন্দ্রের রচনা,চিঠি,ছবি সংগ্রহের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা হোক।

৪] রচনা করা হোক তাঁর একটি প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ।

৫] স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপর শীর্ষক একটি স্থায়ী প্রদর্শনী গড়ে তোলা হোক হেমচন্দ্রের জন্মভিটায়।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত