| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৫) । আদনান সৈয়দ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের জীবন, তাদের স্বপ্ন, তাদের ত্যাগ, তাদের মন, মনন, প্রেম, ভালোবাসা আর বুক চাপা কান্নার গল্প । সব মিলিয়ে এই ধারাবাহিক লেখায় উঠে আসবে নিউইয়র্কের বাঙালির গল্পগাথা। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকছে পর্ব-৫।


হোজে সানচেজের ঘরে ফেরা

(২০১৮ সালে হোজে সানচেজ তাঁর দেশ মেক্সিকোতে পাকাপাকিভাবেই  চলে যান।  ২০১৮ সালের সেপ্টম্বরে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল)

তাঁর পুরো নাম হোজে সানচেজ । এসেছেন মেক্সিকো থেকে। তিনি থাকেন জ্যাকসন হাইটস এর ৮৪তম সড়ক আর ৩৭তম এভেনিউতে। আমার বাড়ির খুব কাছাকাছি থাকার কারণে তাঁর সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আমার হাই হ্যালো হয়। আরেকটা বিষয় হল আমরা দুজনই একই কোম্পানীতে চাকরী করি। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। মাথার চুলগুলে কাঁচাপাকা সাদা। গায়ের রং তামাটে। পেটা শরীর। বেঁটে, মোটাসোটা শক্ত গড়নের মানুষটার চোখে-মুখে সব সময় যেন একটু মৃদু হাসি লেগেই থাকে।  তাঁর কাজ হল রাতের পাহাড়াদারি। আমার সঙ্গে বেশ সখ্য। আমি তাঁকে সম্বোধন করি ‘আমিগো’ বলে। স্প্যানিশ ভাষায় ’আমিগো’ অর্থ হচ্ছে বন্ধু। বেশ কয়েক দিন ধরেই শুনছিলাম খবরটা। হোজের নাকি আমেরিকায় থাকার বৈধতার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে চাকরীটাও আর সে করতে পারবে না। তাঁকে ফিরে যেতে হবে তার জন্মভূমি মেক্সিকোতে।  শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। হোজে একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিল তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগেই। মেক্সিকো থেকে তাঁর একমাত্র পুত্রকে নিয়ে নানান পথ ধরে আমেরিকায় এসেছিলেন। মেক্সিকোতে ওঁর আরও তিনটি কন্যা আছে। তাদের নিয়েই তাঁর যত স্বপ্ন। কীভাবে তাঁর বাকি তিন মেয়েকে আমেরিকায় নিয়ে আসবে, সেই স্বপ্নেই তিনি বিভোর ছিলেন। এখন হঠাৎ করে এই ট্রাম্প যুগে এসে তাঁর সব স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল!

স্বাভাবিকভাবেই হোজের এই চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। ওঁর জন্য কি কিছুই করা যায় না? করুণভাবে প্রশ্নটি করি আমাদের অফিসের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের পরিচালক ক্রিস্টি ফস্টারের কাছে। তার ঝটপট উত্তর, ‘কোনো কিছুই করা সম্ভব না। ওকে কাজে বহাল রাখলে উল্টো আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। আমরা অবৈধদের কাজ করার অনুমতি দিতে পারি না। আর জানেন তো, সময়টা খুব একটা সুবিধের নয়।’ আমি জানি সময়টা সুবিধার নয়, আবার এটিও জানি, হোজের জন্যও কিছু একটা করতে হবে’। হোজেকে যেহেতু তাঁর দেশে চলে যেতে হবে, ভাবছি যাওয়ার আগে তার হাতে যদি কিছু অর্থ তুলে দেওয়া গেলে কেমন হয়? আবারও দ্বারস্থ হলাম ক্রিস্টি ফস্টারের। সব শুনে তিনি বললেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। আপনি যদি চান, তাহলে আমি অফিস থেকে একটা মেইল করে দিতে পারি। যে যেভাবে পারে, তাঁকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। অথবা আরেকটা কাজ করা যায়। আমরা আমাদের একদিনের লাঞ্চের অর্থই তার হাতে তুলে দিতে পারি।,

ক্রিস্টিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম। হোজেকেও বিষয়টা জানালাম। আমাদের কোম্পানিতে আমরা যারা কাজকর্ম করছি, তারা সবাই কিছু টাকা তুলে তাঁর হাতে তুলে দেব। কথাটা শুনে এই দুঃখের দিনেও সে তাঁর অশ্রুমাখা চোখে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

একদিন খুব আয়োজন করে আমরা হোজেকে বিদায় জানালাম। ক্রিস্টি ফস্টার তাঁর হাতে একটা মোটা সাদা খাম তুলে দিলেন। আমরা করতালি দিয়ে হোজের মঙ্গল কামনা করলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না হোজের কাছে এই অর্থ এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সবার কাছে বিদায় নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন। আমারও মন খারাপ। হঠাৎ আমার কী জানি হল। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করল হোজের সঙ্গে। তিনি চলে গেলে তাঁর সঙ্গে আবার কী কখনো দেখা হবে? তাঁর জীবনের গল্পটা অজানাই থেকে যাবে।


আরো পড়ুন: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৪) । আদনান সৈয়দ


হোজেকে বললাম, চলুন আমরা দুজনে আজ এক সঙ্গে লাঞ্চ করি। রাজি? হোজে আনন্দের সঙ্গে আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন।   নিউয়র্কের দক্ষিণ ইয়ংকার্সে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটি ইতালীয় রেস্তোরাঁয় আমরা দুজন মুখোমুখি হয়ে বসলাম। তাঁকে নিয়ে তখন আমার মনে কত প্রশ্ন! এ—কথা, সে—কথার পর আমি আসল কথায় এলাম। হোজে, আপনার সঙ্গে আবার কি দেখা হবে? আপনি কি সত্যি আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবেন? আপনার পুত্রও আপানর সঙ্গে চলে যাবে? আমার মনে তখন কত প্রশ্ন! তারপর তাঁকে জিজ্ঞেস করি, আপনার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে তাহলে অনুগ্রহ করে কি আপনার জীবনের গল্পটা আমাকে বলবেন? কীভাবে এসেছিলেন আমেরিকায়? আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এখন কোথায়? কেমন আছেন তাঁরা? আমার আগ্রহ দেখে হোজে বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ভাবলেন। তারপর তিনি রাজি হলেন তাঁর রহস্যপূর্ণ জীবনের ঝাঁপিটা আমার সামনে ধীরে ধীরে খুলে দিতে। আমি তখন আমার অন্তর চোখ দিয়ে হোজে সানচেজের গোটা জীবনের ডকু ফিকশন দেখতে শুরু করলাম। 

হোজে কথা বলতে শুরু করেন।  আমার বাড়ি মেক্সিকোর দক্ষিণে সোনোয়টা শহরে। শহরটি অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের সীমান্ত এলাকা থেকে ৩০ মাইল পশ্চিমে। আপনি হয়তো জানেন না, সোনায়টা শহরটা বসবাসের জন্য খুব একটা সুবিধার নয়। আগে বেশ ভালোই ছিল, ইদানীং মাদক পাচার, নারী পাচার, সীমান্তের দালালিসহ নানারকম ভয়াবহ হিংস্র কাজে এখানে মানুষ ব্যস্ত। আমি থাকি শহরের এক প্রান্তের খুব নিরিবিলি একটা গ্রামে। সংসার বলতে আছে বউ, এক ছেলে আর চারটা ফুটফুটে মেয়ে। সেখানে একটি চামড়ার কারাখানায় কাজ করি। আমার প্রতিদিন রোজগার আমেরিকার ডলারে পাঁচ ডলার। বউ স্থানীয় একটা সাবান ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সেও তিন ডলারের মত পায়। দুজন মিলে সংসার চালাতে একটু কষ্ট হলেও আমাদের বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ করেই যেন আমাদের সব সুখ তছনছ হয়ে গেল। আমাদের এলাকার এক বড় মাদক ব্যবসায়ী আমার পনেরো বছর বয়সী মেয়েটাকে বাড়ির কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেল। বুঝতেই পারছেন। বাবার সামনে থেকে মেয়েকে তুলে নিল। আমি অর্ধেক মরে গেলাম। অনেক দেন দরবার করলাম, উকিল মোক্তার ধরলাম। কিন্তু কিছুতেই মেয়েটিকে উদ্ধার করতে পারলাম না। পরে শুনেছি, মেয়েটিকে নাকি ওই বদমাশটা কোনো এক পতিতালয়ে  বিক্রি করে দিয়েছিল। আমি যখন এই তথ্যটা শুনলাম, তখন আমি আর আমার স্ত্রী দুজনই মৃতপ্রায় মানুষ। সারা দিন মেয়েটার জন্য কান্নাকাটি করি। তাকে খুঁজে বেড়াই। তখনই আমি সিদ্ধান্ত  নেই, এই অভিশপ্ত গ্রাম থেকে বের হতে হবে। কিন্তু কোথায় যাব? কোথাও যাওয়ার কোনো পথ খুঁজে পাই না। প্রতিদিন তিন মেয়ে, স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমি ভাবতে শুরু করি। মেয়েটির জন্য কাঁদতে কাঁদতে সম্ভবত আমার চোখে অসুখ হয়ে গেল। স্থানীয় বন্ধুরা বলল, সীমান্ত অতিক্রম করে আমেরিকায় চলে যাও। কথাটা আমার মনে ধরল। তারপর থেকেই মওকা খুঁজতে থাকি কীভাবে মেক্সিকোর এই পচা গলিত শহর থেকে সপরিবারে কেটে পড়ব।

হোজে বলতে থাকলেন, আগেই বলেছি, আমাদের সোনায়টা শহর যত রকম বদ লোকের ভিড়। এখানে নগদ টাকায় সবকিছুই হয়। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ৬০০ ডলার দিলে দালালের মাধ্যমে আমাকে আমেরিকায় পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে কাজের কোনো গ্যারান্টি নেই। পথে আমার মৃত্যু হতে পারে। জেলও হতে পারে। স্থানীয় এক দালালের সঙ্গে দেখা করি। দালালের নাম মেনদোনা। তাকে ছদ্মনামে সবাই ক্যাট নামেই চেনে। ক্যাট বলল, ‘কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে অ্যারিজোনার দুই শত মাইল পশ্চিমে ডাওগ্লাস শহরের গা ছুঁয়ে সোনোরাম মরুভূমির ভেতর দিয়ে চোরাই পথে উত্তর আমেরিকায় যাওয়ার একটা রুট আছে। যদি যেতে চাও তাহলে বল। তোমাকে দলে নিয়ে নিই। তবে মনে রাখতে হবে, সীমান্তরক্ষীর হাতে ধরা পড়লে জেল জরিমনাতো বটেই, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।।’

হোজে বলে চলেন, জায়গাটির নাম আমি শুনেছি। আমরা স্থানীয় স্প্যানিশ ভাষায় জায়গাটির নাম দিয়েছিলাম The Devil’s highway অর্থাৎ ’শয়তানের হাইওয়ে’। গত পাঁচ বছরে এই হাইওয়ের পাশ দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ক্যাটকে বললাম, তার কথায় রাজি। ধুঁকে ধুঁকে নিজ গ্রামে এভাবে মরার চেয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে যেয়ে যদি মরেও যাই, তাও ভালো। কিন্তু ক্যাট বলল, সঙ্গে ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে নেওয়া যাবে না। তাহলে তাদের কোথায় রেখে যাব? শেষ পর্যন্ত ক্যাট রাজি হল, শুধু সাত বছর বয়সী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। আমি আর আমার স্ত্রী অনেক ভাবলাম। ছেলেটি এই অভিশপ্ত গ্রামে থেকে খুব বড়জোর একটা দালাল অথবা মাদক ব্যবসায়ী হবে। তার চেয়ে বরং সঙ্গে করে নিয়ে যাই। অনেক ভাবনা—চিন্তা করে স্ত্রী এবং মেয়ে তিনটাকে অন্য এক গ্রামে ওর খালার বাড়িতে রেখে আমরা পিতা—পুত্র রওনা হলাম অজানা এক পথে। তখন আমরা জীবনের আরেক ভাগ্য পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে। স্ত্রী আর মেয়েদের সেই যে রেখে এসেছি, তারপর তাদের এখনো দেখিনি। (কথা বলার এই পর্যায়ে হোসের চোখ থেকে তখন ঝরছিল অবিরাম অশ্রুধারা)।

হোসে কিছুক্ষণ থামলেন। ন্যাপকিন দিয়ে চোখ মুছলেন, তারপর আবার কথা শুরু করলেন। একদিন দিনক্ষণ ঠিক হল। আমি আর আমার সাত বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে চলে গেলাম ক্যাটের কাছে। ক্যাট আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সেখানে গিয়ে দেখি, আমাদের দলে আরও সাতজন রয়েছে। আগে থেকেই আমাদের সব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হল। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা ছোট ছোট সাতটি প্রাণী সোনোরাম মরুভূমির পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সঙ্গে সম্বল শুধু কিছু শুকনো খাবার, পানি আর আগুন জ্বালানোর জন্য কিছু দেশলাই। আমরা হাঁটছি গায়ে সব রকম শক্তি দিয়ে। কারণ সূর্য ওঠার আগেই আমাদের একটি গরুর খামার বাড়িতে যেতে হবে। সেই খামার বাড়িতে একটি গোপন সুড়ঙ্গ আছে। সেই সুড়ঙ্গ আমাদের তুলে দেবে অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের মূল শহরে। কথাটা যত সহজে বলছি, কাজটি যে তত সহজ ছিল না তাতো বুঝতেই পারছেন। এদিকে মাঝেই মাঝেই ছেলেটা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছিল। সে আর হাঁটতে পারছিল না। এক সময় তাকে আমার কাঁধে তুলে নিলাম। জানেন তো, মরুভূমিতে স্করপিয়ন, রেটলস্নেকসহ বিষাক্ত কিছু প্রাণী আছে যারা কখনো কখনো মানুষের চেয়েও হিংস্র হয়ে ওঠে। দিনের বেলায় মানুষের ভয় আর রাতের বেলায় এসব হিংস্র প্রাণীদের ভয়।

হোজে বলে চলেন, এক সময় সীমান্ত পারাপারের দালাল ক্যাট আমাদের সবাইকে ২০ মিনিটের জন্য বিরতি নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। এদিকে সঙ্গে আনা পানিও শেষ। গায়ে এক বিন্দু শক্তি নেই। সারাক্ষণ মনে পড়ছিল মেয়েদের কথা, স্ত্রীর কথা। হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম গাড়ির হেডলাইটের একটা আলো ঠিক আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম, হয়তো সীমান্ত রক্ষীদের টহল গাড়ি। তাদের গাড়িতে সব সময় প্রশিক্ষণ দেওয়া হিংস্র কুকুর থাকে। তারা লোক ধরতে কুকুর লেলিয়ে দেয়। যদি এখন কোনো কুকুর ছেড়ে দেয় তাহলে নির্ঘাত আমাদের সবার মৃত্যু। আমরা সবাই ভয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করছিলাম। একটু পর ভয়টা কেটে গেল। গাড়িটা না থেমে অনেকটা আমাদের নাকের সামনে দিয়েই চলে গেল। পাথরের ছোটখাটো ঢিবির জন্য আমাদের দেখতে পায়নি। আমরা তখন আবার পথ চলতে শুরু করলাম। ছেলেটাকে আবার কাঁধে নিলাম। পেটে খাবার নেই, পানি নেই, গায়ে কোনো শক্তিও নেই। ভাবছিলাম এই শয়তানের হাইওয়েতে বুঝি আমাদের সবার মৃত্যু হবে। কিন্তু ক্যাট খুব শক্তিশালী। এসবে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। তার একটাই কথা। রাতের মধ্যেই আমাদের যেতে হবে। সূর্য উঠে গেলে সব শেষ। তখন মৃত্যুই একমাত্র ঠিকানা। আমরা যখন হাঁটছিলাম, রাস্তায় কয়েকটা মানুষের খুলি, হাড় ইত্যাদি আবিষ্কার করলাম। আহা! এদেরও বোধ হয় ঠিক আমাদের মতোই এই সীমান্ত পথ অতিক্রম করতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেতে হয়েছিল। হায় ঈশ্বর! শেষ পর্যন্ত আমরা একটি গরুর খামারের দেখা পেলাম। ক্যাটের চোখ তখন বেশ চঞ্চল। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি অন্ধকারে দু-তিনজন লোক বের হল। ক্যাট তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করল। বুঝতে পারলাম, ক্যাটের সঙ্গে তাদের আগে থেকেই বোঝাপড়া আছে। তারপর কায়দা করে আমাদের একটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন বুঝতে পারলাম, আমাদের এই অভিযান সফল হতে চলেছে। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম। সুড়ঙ্গে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেকে একটা শুকনো রুটি তুলে দিলাম। পানি খাওয়ালাম। ছেলেটা তার মায়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তাকে তখন বললাম, আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। একবার আমেরিকায় যেতে পারলে আমাদের সব সমস্যা কেটে যাবে। সুড়ঙ্গ পথে আমরা আবার ঠিক সেই আগের মতোই হাঁটতে থাকলাম। নির্দিষ্ট একটি সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে গেলাম। বাইরে এসে দেখি, সেটিও একটি গরুর খামার। তবে দূরেই একটা শহর দেখতে পেলাম। বুঝতে অসুবিধা হল না, আমরা অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে ঢুকে পড়েছি। আর দেশটির নাম ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। তারপর যা হয়। পিতা—পুত্র সোজা চলে যাই একটি বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে বাসের টিকিট কেটে নিউইয়র্কের বাস  ধরি। নিউইয়র্কে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করি। শুরু হল আমাদের বাপ—ব্যাটার নতুন এক জীবন।

হোজের গল্প যখন শেষ হল তখন রেস্তোরাঁয় আমরা আরেক দফা কফির অর্ডার দিলাম। তাঁকে বললাম, যাক আপনার রাজনৈতিক আশ্রয় খারিজ হয়েছে তো ভালোই হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই এখন খুশি? অন্তত স্ত্রী আর তিন মেয়ের কাছে আবার যেতে পারছেন। এ কথা শুনে হোজের চোখে আবার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বললেন, ‘না আমার স্ত্রী মারা গেছেন দুই বছর হয়েছে। তাকে আর কখনই দেখতে পাব না। মেয়ে তিনটিও এখন বড় হয়ে গেছে। দুজন বিয়ে করেছে। আমিই তাদের খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে দিয়েছি। শুধু ছোটটা এখনো বিয়ে করেনি। ভাবছি, আমি মেক্সিকোতে গিয়ে ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দেব। তারপর ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার শেষ জীবন কাটিয়ে দেব।’

হোজে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার জীবনের গল্পটা আমাকে বলার জন্য। হোসে, আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? হোসে?

হোজেকের দুই চোখ তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে। কী খুঁজছেন হোসে সানচেজ?  দেশ থেকে দেশান্তরের বেদনার ছাপ তাঁর মুখে তখন স্পষ্ট। নিউইয়র্কের বিকেলের রাঙা রোদে হোসে তখন তার দু:খগুলোকে ঢাকতে ব্যস্ত।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত