irabotee.com, ২৬ মার্চ এর কবিতা

২৬ মার্চ সংখ্যা: একটি কবিতার জন্মকথা । বিশ্বজিৎ ঘোষ

Reading Time: 3 minutes
উনিশশ’ একাত্তর সালে সংঘটিত বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা, অসংখ্য সাহিত্যকর্ম। অনেক সাহিত্যকর্মের মধ্যে একটি কবিতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত ব্যতিক্রমধর্মী সেই কবিতার নাম ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, কবির নাম অ্যালেন গিনসবার্গ (১৯২৬-১৯৯৭)। আমেরিকার এ কবি ছিলেন নিপীড়িত মানবতার পক্ষে বলিষ্ঠ এক কণ্ঠস্বর। বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামরিকতন্ত্র ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখেছেন, আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় মানবমুক্তির গান গেয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গিনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড‘ তেমনি এক প্রতিবাদী রচনা, নিপীড়িত মানবতার পক্ষে এক শানিত আয়ুধ। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার জন্মকথা বলার আগে খান মোহাম্মদ ফারাবি-কৃত অনুবাদের খানিকটা অংশের প্রতি চোখ দেয়া যাক একবার :
 
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত, বিস্ফোরিত চোখের ধার
যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু কঠিন মাটি নিরুত্তর।
লক্ষ পিতা ভিজছে হিমেল বৃষ্টিতে
লক্ষ মাতা দুঃখ দেখে দৃষ্টিতে
লক্ষ ভাইয়ের হৃদয় শুধু যন্ত্রণা
লক্ষ বোনের নেই কে ঘরের সান্ত্বনা।
লক্ষ মাসি ভাতের জন্য যায় মরে
লক্ষ মাতুল মাতাল হয়ে শোক করে
লক্ষ পিতামহের গৃহ চূর্ণপ্রায়
পিতামহী হচ্ছে পাগল নিঃসহায়।
হাঁটছে পাঁকে লক্ষ পিতার কন্যারা
অবোধ শিশু ভাসিয়ে নিল বন্যারা
লক্ষ মেয়ে করছে বমন আর্তনাদ
লক্ষ পরিবারের আশা চূর্ণ সাধ।
লক্ষ প্রাণের উনিশ শত একাত্তর
উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর
সূর্য জ্বলে ধূসর রঙে মৃতপ্রায়
হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়।
পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কবিতা প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে আলোচ্য কবিতাটি পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কবিতাটির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা মনে রেখে উত্তরকালে অ্যালেন গিনসবার্গ তার ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ (১৯৮৭) কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি গ্রথিত করেন। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি সম্পর্কে বিখ্যাত ‘ডিলান’ পত্রিকায় গিনসবার্গ লিখেছেন : আমার ইচ্ছা ছিল, বব ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। অনেকটা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যাড অ্যাইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর মতো লম্বা কোনো গান, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানবিক আকুতি জাগাবে, যা ডিলানকে ভাবাবে, কাঁদাবে। আমি তা-ই লিখতে চেষ্টা করলাম। সম্প্রতি কলকাতা ঘুরে লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট দেখে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা-ই লিখলাম। কলকাতার ভাষা আর সঙ্গীতের মিশ্রণে সেটাকে গানে রূপ দিলাম ভারতীয় হারমোনিয়াম সহযোগে। সে সময়ে দেখা মানুষগুলোর অন্তহীন যাতনা আমাকে নির্বাক করেছিল। সব বয়সের মানুষের বেঁচে থাকার কষ্ট আমার বুকে চেপে বসেছিল। সেই যাতনা হৃদয়ে নিয়েই আমি লিখেছিলাম ‘যশোর রোড’ কবিতা। আমি মূলত ভারতীয় বজ্র গুরু নামের বৌদ্ধ সুরের সঙ্গে ‘বস্ন্যাক’-এর গাওয়া ‘ওয়ান অ্যানাদারস সরো’র অন্ত্যমিলের সমন্বয়ে ‘যশোর রোড’ গাওয়ার চেষ্টা করলাম।
উনিশশ’ একাত্তর সালে আমেরিকার কবি গিনসবার্গ কলকাতা এসেছিলেন কলকাতায় আশ্রয় নেয়া পূর্ববাংলার শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগ সরেজমিন ঘুরে একটি প্রতিবেদন রচনার জন্য। তিনি কলকাতা এসেছিলেন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আর নিউইয়র্ক ফিরে যান মধ্য নভেম্বরে। কলকাতায় অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গী হয়েছিলেন তখন বিবিসির হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও গিনসবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন কলকাতার পার্শ্ববর্তী শরণার্থী শিবিরগুলোয়। শরণার্থী শিবিরে লাখ লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পানি নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই_ এসব দেখে ভীষণ মর্মাহত হন গিনসবার্গ। দুঃসহ এ স্মৃতি, মানুষের এ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বিশ্ব মানুষের গোচরে আনার জন্যই আমেরিকা গিয়ে গিনসবার্গ রচনা করলেন ঐতিহাসিক এক কবিতা_ নাম যার ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
অ্যালেন গিনসবার্গ ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘোরবিরোধী। আমেরিকার বুকে বসেই তিনি আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছেন তার কবিতার মাধ্যমে, তার গানের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, অস্ত্র সরবরাহ করেছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে, জাতিসংঘকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে বাংলাদেশের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য। মার্কিনি এসব অপকর্ম ও ষড়যন্ত্র গিনসবার্গকে গভীরভাবে মর্মাহত করে। মার্কিনি ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে তিনি লিখেছেন আলোচ্য কবিতা, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতা পাঠের আসরে আবৃত্তি করেছেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, কবিতাটিতে সুর সংযোজন করে আমেরিকার নানা জায়গায় গেয়েছেন যশোর রোডে দেখা তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা।
অ্যালেন গিনসবার্গ আর নেই, কিন্তু আছে তার ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একটি কবিতার মাধ্যমে বিজড়িত হয়ে আছেন এ মার্কিন কবি। জয়তু ইরউইন অ্যালেন গিনসবার্গ, জয়তু ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>