| 17 এপ্রিল 2024
Categories
২৬ মার্চ

২৬ মার্চ: মুক্তির, নাকি স্বাধীনতার । সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

একাত্তরের যুদ্ধ মুক্তির ছিল, নাকি স্বাধীনতার? উভয়েরই। ৭ মার্চের সেই বিখ্যাত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান দুয়ের কথাই বলেছিলেন; ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখন এবং যুদ্ধের পরেও এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। কিন্তু পার্থক্য নিশ্চয়ই ছিল। নইলে পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে ‘মুক্তি’ সরিয়ে নিয়ে সে জায়গায় ‘স্বাধীনতা’ বসানো হল কেন, কেন প্রয়োজন পড়ল এই সংশোধনের? স্মরণ করা যাক, আমাদের আদি সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে, এক নম্বর অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছিল, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’ ১৯৭৮-এ জারি করা এক ফরমানের বলে সংবিধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রস্তাবনার ওপরে লেখা হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ এবং প্রথম অনুচ্ছেদের যেখানে ছিল ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’- এর কথা, সেখানে তো বদল করে প্রতিস্থাপন করে হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ শুধু তাই নয়, এরপরে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেখানে অঙ্গীকারের কথা আছে সেখানেও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ কেটে বসানো হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ’।

সেই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’র কথা এবং বাদ দেয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আদি সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল এবং তার স্থান ছিল জাতীয়তাবাদের পরেই। অর্থাৎ প্রথম অঙ্গীকার জাতীয়তাবাদের, দ্বিতীয় অঙ্গীকার সমাজতন্ত্রের। সংশোধনীতে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়া হয়নি সত্য, কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সর্বশেষে এবং সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তাও বলে দেয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্র অর্থ ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’ আদিতে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালি, সংশোধনের ফলে তা দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি। সংবিধানের দুটি পাঠ ছিল, একটি বাংলা, অপরটি ইংরেজি; বলা হয়েছিল অর্থের ব্যাপারে দুই পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠই গ্রাহ্য হবে। ১৯৭৮-এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে বিরোধের ক্ষেত্রে ইংরেজি পাঠই প্রাধান্য পাবে। সংশোধনগুলো মোটেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়; তারা একটি অভিন্ন চিন্তাধারার প্রতিফলন বটে। ওই চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে আছে একেবারে সূচনাতেই, প্রস্তাবনার সংশোধনীতেই যেখানে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’কে রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধে’। ব্যাপারটা যত নিরীহ মনে হয় তত নিরীহ নয়। যুদ্ধ একাত্তরের ব্যাপার বটে, কিন্তু সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, সংগ্রাম একাত্তরে শুরু হয়নি, শেষও হয়নি। ১৯৭৮-এ যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত তারা যুদ্ধটাকেই দেখতে চেয়েছেন। সংগ্রামকে উপেক্ষা করে। যুদ্ধে তারা ছিলেন, সংগ্রামে ছিলেন না। আর মুক্তি ও স্বাধীনতা যে এক নয় তাও তারা খেয়াল করেছেন। মুক্তি অনেক ব্যাপক ও গভীর ব্যাপার। স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বোঝান সম্ভব, কিন্তু মুক্তি বলতে বোঝাবে সার্বিক মুক্তি। হ্যাঁ, স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছে একাত্তরে। অবশ্যই। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীনতা থেকে বের হয়ে এসে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। কিন্তু সেটা একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। অথবা বলা যায়, মূল লক্ষ্য ছিল অনেক বিস্তৃত। সেটা ছিল জনগণের মুক্তি। যে জন্য রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের উল্লেখ করতে হয়েছে, বলতে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের কথা। অঙ্গীকার করতে হয়েছে এ চারটি মূলনীতি প্রতিষ্ঠার। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা প্রয়োজন ছিল ওই সর্বাত্মক লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই। স্বাধীনতা প্রথম পদক্ষেপ, মুক্তি চূড়ান্ত লক্ষ্য। সংগ্রাম ছিল মুক্তির।

মুক্তির জন্য সংগ্রামটা দীর্ঘকালের। এ লড়াইয়ে নানা মানুষ এসেছে, সংগঠন এসে যোগ দিয়েছে। সবার ভূমিকা সমান নয়। নানা মাত্রার ও মাপের। কিন্তু সব স্রোত মিলেই বৃহৎ ধারাটি তৈরি। হঠাৎ করে অভ্যুত্থান ঘটেনি। ভুঁইফোড় নয়। একাত্তরে শুরু নয়, শেষও নয়। মুক্তির সংগ্রাম এখনও চলছে এবং চলবে।

শেষ যে হয়নি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো ওই সংশোধনগুলো। ওগুলোর উদ্দেশ্য স্পষ্ট। সেটা হচ্ছে সংগ্রামের লক্ষ্যকে অস্পষ্ট করে দেয়া। মানুষকে ঠেলে দেয়া পেছনে। মুক্তির সংগ্রামকে চিহ্নিত করা একটি সামরিক যুদ্ধ হিসেবে। মুক্তির সার্বিক যুদ্ধে একাত্তরের মুখোমুখি লড়াই একটা অত্যন্ত বড় মাপের ঘটনা, অত বড় ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি, কিন্তু সেটা একমাত্র ঘটনা নয়। প্রথমও নয়। এ দেশের মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম অনেক কাল ধরে করে এসেছে। প্রচার করা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা তাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু দিল না। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরও পূর্ণ হয়নি, তার আগেই নতুন আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। ওই দাবিতে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট হয়েছে।

তারপরে আরও এগিয়েছে মানুষ। বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সর্বত্রব্যাপ্ত আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনের বোধটা জেগে উঠেছে। সবার মধ্যে নয়, কারও কারও মধ্যে। রাষ্ট্রীয় বিচ্ছিন্নতার কথা প্রকাশ্যে সর্বপ্রথম বলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ সালে। তখন তার ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়েছে; কেউ বলেছে ভাসানী কমিউনিস্ট, কেউ বলেছে তিনি ভারতের দালাল। তার নিজের প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তার পক্ষে দাঁড়ায়নি।

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ঘোষণাপত্র দিয়েছিল তাতে স্বাধীনতার কথা থাকার কথা নয়। নেইও। সেখানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি আছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তান হবে একটি প্রজাতন্ত্র, যার প্রতিটি ইউনিট ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষতারও উল্লেখ ছিল না। বরঞ্চ বলা হয়েছিল, ‘পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না।’ সমাজতন্ত্রও ছিল না। বলা হয়েছিল, অর্থনৈতিক কর্মসূচির লক্ষ্য হবে ন্যায় ও সমতাভিত্তিক একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। এসব বক্তব্য জিয়াউর রহমান আনীত সাংবিধানিক সংশোধনগুলো থেকে দূরে নয়; কাছাকাছি। বোঝা যায় ১৯৭০-এ বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। কিন্তু নির্বাচনের পর বদলে গেছে সবকিছু। যা ছিল অস্পষ্ট ইচ্ছা, তা রূপ নিয়েছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে। যে আকাক্সক্ষাকে ভয়-ভীতি, পীড়ন-নিপীড়ন, লোভ-আশা দিয়ে অবদমিত করে রাখা হয়েছিল তা সবেগে বের হয়ে এসেছে। ছয় দফা পরিণত হয়েছে এক দফায়। সেই এক দফা হল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তি।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল ওই জনগণেরই যুদ্ধ। তারাই লড়েছে। কোনো একটি রণাঙ্গনে নয়, সর্বত্র, সব রণাঙ্গনে; কেবল দেশে নয়, বিদেশেও। বলা হয়েছে, যোদ্ধাদের শতকরা ৮০ জন ছিল কৃষক। এ কোনো অতিরঞ্জন নয়। গ্রামে-গ্রামে, প্রান্তে-প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই যুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসকদের মধ্যে কুটিল যারা তারা আশা করেছিল সংঘর্ষ সীমাবদ্ধ থাকবে। বেছে বেছে হত্যা করা হবে। কট্টর আওয়ামীপন্থী, ছাত্র, পুলিশ, বিদ্রোহী সেনা- এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পারেনি, নৃশংস সৈন্যদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল, তারা বাছবিচার করেনি। আর জনগণও বসে থাকেনি। আক্রমণকে তারা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর আঘাত হিসেবে দেখেনি, দেখেছে তাদের নিজেদের ওপর আক্রমণ হিসেবে। সেভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অংশ নিয়েছে যুদ্ধে। ভাষা আন্দোলনের সময়েও এ রকমটাই ঘটেছিল। আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে, প্রথম দিকে সীমাবদ্ধ ছিল সেখানেই। কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যখন ছাত্রহত্যা ঘটল, তখন আন্দোলন ছড়িয়ে গেল সারাদেশে। ছাত্রহত্যাকে দেশবাসী নিজেদের ওপর আক্রমণ হিসেবেই দেখেছে, অন্যকোনো ভাবে নয়। এর আগে পুলিশ ধর্মঘট হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল বেশ কয়েকজন বাঙালি পুলিশকে, কিন্তু সে ঘটনা বায়ান্নর ঘটনার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে এই যে, পুলিশের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছিন্নতা ছিল, ছাত্রের সঙ্গে ছিল না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বেগবান ও সফল হয়েছে জনগণের অংশগ্রহণের ফলে। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছিল জনগণের কারণে।

জনগণই পাকিস্তান এনেছিল ভোট দিয়ে ১৯৪৬-এ। তারাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গেছে বায়ান্নতে। ১৯৫৪-র নির্বাচনে স্পষ্ট রায় দিয়েছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান জনগণেরই অভ্যুত্থান বটে। মূল লক্ষ্য একটাই। মুক্তি। মুক্তির এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একাত্তরের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে পরাভূত হয়েছিল দুর্ধর্ষ বলে কথিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। যুদ্ধের পেছনে যে চেতনা সেটা মুক্তির, যে মুক্তির সংজ্ঞা পাওয়া গেছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে। মূলনীতিগুলো যুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণ থেকেই বের হয়ে এসেছে, স্বাভাবিকভাবে। নইলে কারও সাধ্য ছিল না তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে; যেমন যুদ্ধের সময়ে ও তার অব্যবহিত পরে কারও সাধ্য ছিল না তাদের অস্বীকৃতি জানায়। শাসনক্ষমতা যখন জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে গেল, তখনই সম্ভব হয়েছে মূলনীতির সংশোধন। মুক্তির জায়গায় এসেছে স্বাধীনতা।

মুক্তির-যুদ্ধ ছিল একটা স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম। স্বতঃস্ফূর্ততার বহু গুণ ও সীমাবদ্ধতা তার মধ্যে পাওয়া যাবে। প্রধান গুণ হচ্ছে যুদ্ধের শক্তি ও বেগ; প্রধান দুর্বলতা তার সংগঠিত রূপ। যুদ্ধটা সংগঠিত, পরিকল্পিতভাবে শুরু হয়নি। চলেওনি। বিপরীতে পাকিস্তানিরা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত। তাদের ছিল বিদেশি শক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন মিত্র বলতে বাঙালির প্রায় কেউই ছিল না। ভারত যে যুক্ত হয়েছে তা আগের কোনো যোগাযোগের কারণে নয়, ঘটনা পরম্পরায়। একে সে প্রতিবেশী, তার ওপরে ছিল শরণার্থীর বোঝা।

এমনকি যারা ছিল নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগও এ কথা বলেনি যে, যুদ্ধ তারা শুরু করেছে। বলেছে যুদ্ধ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ যে ঐক্যবদ্ধ ছিল তাও নয়। সেখানে যেমন তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন, তেমনি ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাজউদ্দীন আপসে বিশ্বাসী ছিলেন না, খন্দকার মোশতাক সব সময়ই আপসের পথ খুঁজছিল। কিন্তু তাজউদ্দীনের আশপাশে যারা ছিল তারাও সবাই যে তার সঙ্গে ছিল; তা নয়। বিরোধ ছিল, যে জন্য মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল। খন্দকার মোশতাকরা যে শক্তিহীন ছিল না তা বোঝা গেছে ১৯৭৫-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডে। এও তাৎপর্যহীন নয় যে, তার আগেই মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বাদ পড়ে গেছেন, মোশতাক বাদ পড়েননি। যুদ্ধের সময়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি উঠেছিল। সেটা গৃহীত হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। তবে ছাড় হিসেবে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিল, কিন্তু সেই পরিষদের একটিরও বেশি বৈঠক হয়নি। জাতীয় সরকার গঠনের দাবি স্বাধীনতার পরেও তোলা হয়েছিল। গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে শত্রু কে ছিল? শত্রু ছিল তারাই যারা জাতীয় মুক্তির বিপক্ষে ছিল। অর্থাৎ আল-বদর, রাজাকারসহ সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের সমর্থকরা। দক্ষিণপন্থীরা। শত্রু ছিল তারা যারা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে মনে করেছে এবং নতুন রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগোতে না দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছে, বড় পাকিস্তান ভেঙে ছোট পাকিস্তান গড়বে ভেবেছে। ১৯৭৮-এর সাংবিধানিক সংশোধনগুলো দক্ষিণপন্থীদেরই কাজ। এরশাদের সময়ে পুঁজিবাদের পথকে আরও প্রশস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন পশ্চাৎগমনেচ্ছুদের আরেকটি বিজয় চিহ্ন। দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার বর্তমান সরকারের শাসনামলে ওইসব ফরমানগুলোকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা হয়েছে।

কিন্তু শেখ মুজিব এই দক্ষিণপন্থীদের প্রধান শত্রু মনে করেননি। বামপন্থীরা তার মিত্র ছিল না এটা ঠিক, কিন্তু তারা তার জন্য তত বড় শত্রু ছিল না-যত বড় শত্রু ছিল তার আশপাশে লুকিয়ে থাকা দুর্বৃত্তরা।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী উত্থাপন করে ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব যে বক্তৃতা দেন সেটি মুক্তিকামী জনগণের কণ্ঠস্বর নয়, সেটি একজন পথ-হারানো জননায়কের স্বগতোক্তি। অত্যন্ত উঁচু একটি জায়গায় ছিলেন তিনি, অতটা জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা কখনও কোনো বাঙালি রাষ্ট্রনায়ক লাভ করেননি। কিন্তু তিনি এগোবার পথ দেখতে পাচ্ছিলেন না। তার প্রধান কারণ, জনগণ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ঘাতকরা ওই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়েছে। নইলে অতি নিষ্ঠুর পাকিস্তানি শাসকরা যে কাজ করতে সাহস পায়নি, সে কাজ করার মতো দুঃসাহস স্থানীয় দুর্বৃত্তরা সংগ্রহ করতে পারত না।

যখন সুযোগ পেয়েছে তখন জনগণ তার শক্তির পরীক্ষা দিয়েছে। ভোট দিয়েছে ১৯৭০-এ, যেমন দিয়েছে ১৯৪৬-এ। পাকিস্তানিরা যে তাদের রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না সেটা তাদের অজান্তেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ১৯৪৮-এ, যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, বাঙালির দাবি তিনি মানেন না, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সেটি পুনর্নির্ধারিত হল সত্তরের নির্বাচনের আগে। যখন বাঙালিদের দাবির মুখে পাকিস্তানিরা এক মানুষ এক ভোট নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এর আগে ছিল সংখ্যাসাম্য; অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ৫৬ জনকে কেটেছেঁটে সমান করে দেয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ জনের। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়েই করানো হয়েছিল ওই কাজ, নইলে পাকিস্তানিরা নিজেরা পারত না। সংখ্যাসাম্য ভেঙে পড়ল যখন, তখন জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ববঙ্গকে দিতে হল ১৬৯টি, পশ্চিম পাকিস্তান পেল ১৪৪টি। আশা করেছিল ভোটের সময়ে বাঙালিকে বিভক্ত করা যাবে। যখন দেখল পারল না, তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল গণহত্যায়।

জনগণ সংগ্রাম করেছে, কিন্তু মুক্তি পায়নি। রাষ্ট্র এখন কতটা স্বাধীন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। কিন্তু জাতি যে মুক্ত নয় সেটা সন্দেহাতীত। জাতি বলতে জনগণকেই বোঝায়। সেই জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতার ধারে কাছে নেই। দেশে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতি মানে বড়জোড় ২০ জনের উন্নতি এবং ৮০ জনের অবনতি। ধনী-দরিদ্রের তারতম্য বোঝাতে আকাশপাতালের উপমা অগ্রাহ্য নয়। ওই দুই প্রান্তের মধ্যেই বিভিন্ন স্তরের বিন্যাস। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম চলছে। সরবে নয় নীরবে। তাকে চলতেই হবে, নইলে আমাদের ভবিষ্যৎ কি, দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত