| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: ফেসবুক ফেকবুক । শিশির পাল

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আমি অলিভিয়া। অলিভিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।  ক্লাস টুয়েলভ। লা মার্টিনিয়র ফর গার্লস । বাবা মা বড্ড বড় নাম রেখেছে। সবার মতো জিনিয়াও, বাধ্য হয়েই অলি বলে ডাকে আমাকে। জিনিয়া আমার জিগরি দোস্ত।সব কিছুর ভাগ করে নেওয়া বন্ধু। ও বলে, “অলি কত ফুলের মধু খাবি তুই !” আমি হাসি। বলি, “আমি খুব বেশি পরিবর্তন সহ্য করতে পারি না। এক ফুলই আমার যথেষ্ট।” জিনিয়ার পছন্দ হয় না কথাটা। ও পরিবর্তনকাঙ্খী সর্বদাই। বলে, “চেঞ্জ ইজ দ্য ওনলি কনস্টান্ট।” আমি চুপ করে যাই।

আমরা ভবানীপুরে যদু বাবুর বাজার এলাকায় থাকি। বাবার পৈতৃক ভিটে। আমাদের পূর্বসূরি দেশভাগের অস্থির সময়ে, ওপার থেকে এসে থাকতে শুরু করেন এখানে। আমাদের পাড়াতেই একটু দূরে থাকেন উমেশকাকুরা। বিহারী ব্রাহ্মণ। কাকু কাকিমা আর ওদের একমাত্র সন্তান, অচ্যূত ঝা । আমার চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ে অচ্যূত। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেন রাস্তায় আসার পথে ওদের একতলার ভাড়া বাড়ি। আসা যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যেই দেখতে পাই ওদের। আমি কথা প্রায় বলিই না। মায়ের সঙ্গে গেলে দেখি মা হেসে ফর্মালিটি করে। অচ্যূতের সঙ্গে সম্ভাব্য সবচেয়ে কম কথা বলি। পরিস্থিতি অনুযায়ী।ব্যস।এটুকুই। কিন্তু আজকাল আমি বুঝতে পারি, অচ্যূত কিছু একটা আড়াল করে। আড়ালে থাকতে চায়, না কি আমাকেই সযত্নে আড়াল করতে চায় অন্যদের কাছ থেকে,  ঠিক বুঝতে পারি না। আমাকে হয়তো দেখে চুপিচুপি। কখনও চোখাচুখি হলে, ও তাকিয়ে থাকতে পারে না। আমি অবাক হই। আমার চোখ দিয়ে তো আলো ঠিকরে আসে না। চোখ ধাঁধানোর মতো কোনও ব্যাপারও আমার মুখে নেই। তাহলে কি ও আমাকে পছন্দ করে।মানুষ যখন কাউকে নীরবে চায়, বলতে পারে না, সে অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই দেখে। এই জগৎটা তার একার। নিজের মতো ঘুড়ি ওড়ানো যায়। পুরো আকাশজুড়ে স্বপ্ন ছড়ানো যায়। প্রিয় মানুষের হাত ধরে, চোখের দিকে তাকিয়ে কবিতা লেখা যায়।

আজ সকালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়েছে। কলকাতার গলি রাস্তায় ম্যানহোলের আশেপাশে জল। আমি আমাদের গলি দিয়ে আসছি। রাস্তার মোড়ে এসে স্কুলে যাবার বাস ধরবো বলে। ছাতা মাথায়।টিপটিপ বৃষ্টি।দেখছি অচ্যূত আসছে একটা সাইকেল চালিয়ে।রাস্তার বাঁ দিক বরাবর। দূর থেকেই আমি চিনতে পেরেছি ওকে। নিশ্চয়ই সেও আমাকে চিনেছে। আমি আর না তাকিয়েই আমার মতো হাঁটছি।হঠাৎ দেখি রাস্তার লোকেরা হা হা হা করছে। একটা মৃদু চেঁচামেচি। সাইকেল উল্টে কুপোকাত, অচ্যূত।এটুকু তো বুঝতেই পারি, ও আমাকেই দেখছিল। আমার গোটানো সালোয়ারে ফর্সা ভেজা দুটো পা, নীলরঙা টপ, আমার দুপাশের বাঁধানো বিনুনি , স্কুলের ব্যাকপ্যাক, লাল ছাতা বা সব মিলিয়ে স্কুলগামি ইউনিফর্মে আমার সমষ্টিকেই হয়তো ও দেখছিল। না গিয়েও পারা যায় না।এক্কেবারে হাতের কাছেই ঘটনা।আমি গেলাম। একটু দ্রুতই বলা যায়।দেখি ম্যানহোলের ঢাকনার উপরে পড়েছে। পিচ আর লোহায়  হাত পা একটু ছড়েও গেছে। জমা জলে প্যান্ট জামাও ভেজা। আমি সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে সাইকেলটাকে সোজা করে দাঁড় করলাম।অচ্যূত নিজেই উঠল। অন্যরাও হেল্প করে বাড়ি নিয়ে গেল ওকে। আমি শুধু বললাম, “এভাবে ফাঁকা রাস্তায় পড়লে কীভাবে ?সাবধানে চালাতে পারো তো ! যাও বাড়ি গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে নাও।” অচ্যূত কোনও কথা বলেনি। ইতস্তত করছিল। খুব বিহ্বল এবং ভীত মনে হল ওকে।

আমি মেন রাস্তায় এসে এক্সাইডমুখি একটা বাসে উঠে পড়ি। স্কুলের অভিমুখে। মিন্টো পার্কের দিকে।

আজ শিউলি ম্যামের ক্লাস আছে। ক্লাসে দেরি হলে যা তা বলেন। মুড অফ করে দেন। ক্লাসে গিয়ে দেখি জিনিয়া ওর পাশে আমার জায়গা রেখেছে। আমাকে দেখেই ও হাসল। আমি বসলাম। ক্লাস একটু পরেই শুরু হবে।

আমি জিনিয়াকে বলি, “জানিস, আজ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে।”
“কী ? “
“আমাদের পাড়ার অচ্যূত, যাকে তোর কথা এর আগেও বলেছিলাম, সকালে আমাকে দেখেই কুপোকাত।”
“মানে ? বুঝলাম না। খুলে বল।”
“ভেজা রাস্তা, আমাকে দূর থেকে দেখেই সাইকেল থেকে পড়ে গেছে। লেগেওছে।”
“আহা।তুই কী করলি ?”
“গিয়ে তুলে দিলাম।বললাম সাবধানে চালাতে। ছেলেটা এত ক্যাবলা কেন রে!’
“ও তোকে ভয় পায়। বা ভালোবাসে খুব।”
বলেই হা হা শব্দ করে হাসল জিনিয়া।ক্লাস শুরু হয়নি, তাই ক্লাসে বেশ চেঁচামেচির আওয়াজ আছে।
“কী যা তা বলছিস ! এর সঙ্গে ভালোবাসার কী সম্পর্ক আছে ? আমার সঙ্গে কথাও তো হয় না।আমি তো বলিই না। সেও বলে না।”
“এটাই আমি তোকে বোঝাতে চাইছি। যদি ও তোকে চেয়ে থাকে ভেতরে ভেতরে , আর বলতে না পারে, তাহলে তো এরকমই হবে। তোকে দেখে ওর হার্টবিট বাড়বে , আরও অনেক কিছুই হবে।”
আমি জিনিয়াকে বলি, “যা তা বলিস না। শোন, কদিন ধরেই মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরছে। বলা হয়নি।”
“বল না। কী প্ল্যান ?”
“তুই তো ফ্লার্ট করতে পারিস।”
“কী যে বলিস!”
“অচ্যূতের পেছনে লাগতে হবে।ওকে একটু স্মার্ট বানাতে হবে। পারবি ?”
“বুঝেছি।”
ক্লাসরুমের আওয়াজটা থেমে যায় প্রথমে ধীরে, একটু পরে হঠাৎ। শিউলি ম্যাম ক্লাসে চলে এসেছেন।

ক্লাস শেষ হলে, জিনিয়া আমাকে বলে, “তুই আর একটু ডিটেইলসে বল অচ্যূত সম্পর্কে।”

আমি ওকে মোটামুটি একটা ধারণা দিলাম। ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে ওর ফটো বের করল জিনিয়া। সিম্পল প্রোফাইল। কোনও চমক নেই। জিনিয়া আমাকে বলে, “দু দিন সময় দে। আমি ওকে ট্র্যাকে নিয়ে আসব।” বলতে বলতে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল অচ্যূতকে। বিকেলে বাড়ি ফিরে জিনিয়া দেখে ওটা অ্যাকসেপ্টও করে নিয়েছে অচ্যূত। জিনিয়া খুশি। সঙ্গে সঙ্গে হোয়াট‍্সঅ্যাপ করল আমাকে। আমি অজান্তেই যেন লাফিয়ে উঠলাম।

কাকতালীয় ভাবে আমারও ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। অলীক। কোনও সারনেম নেই। প্রোফাইল পিকচারে শ্রীকৃষ্ণ । প্রোফাইল কভার পেজে কবিতার লাইন। টাইম লাইনে ওর নিজের কোনও ফটো নেই। মোটকথা কোনও ভাবেই মুখটা কোথাও নেই। সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা । বাংলা অনার্স। ফার্স্ট ইয়ার। বর্ধমান রাজ কলেজ। ফ্রম বার্ডোয়ান। সিঙ্গল। ইন্টারেস্টেড ইন ওমেন। একটু অবাক লাগছে । কোনও মিউচুয়াল ফ্রেন্ড নেই। টোটাল ফ্রেন্ডস ও দেখা যাচ্ছে না। কেন পাঠালো এই রিকোয়েস্ট ?

রাত্রের দিকে জিনিয়া ফোন করল আমাকে।
“ভালো খবর আছে।”
“কী ? কথা হলো কিছু ?”
“হ্যাঁ। মেসেঞ্জারে কিছু প্রাইমারি কথা। “
“যেমন ?”
“ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ।ছোট খাটো কিছু কিছু কথা হল।”
“বাহ। ঠিকঠাক কথা বলতে পারছে ? না আবার কুপোকাত !”
বলেই দুজনেই হাসি।

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা কনফার্ম করিনি।কয়েকদিন পর ফেসবুক রিমাইন্ড করল। তারপর কী মনে হল একসেপ্ট করলাম। দেখলাম, খুব কম কিছুই ও ফেসবুকে পোস্ট করে। যেটুকু করে, নিজের লেখা আবেগঘন কবিতার লাইন। লাইক তেমন পড়ে না। আমিও প্রথমে করিনি। পরে করা শুরু করলাম। লাইক।লাভ ইমোজি।

তিনমাস পরের একটা দিন। এই তিন মাসে আমার সঙ্গে অলীকের বেশ আলাপ জমেছে।ঠিক পেন ফ্রেন্ডের মতো।কেউ কাউকে দেখিনি। কিন্তু নিয়মিত কথা হয়। মেসেঞ্জারে। ফোন বা হোয়াট‍্সঅ্যাপে বলি না। এখনও অব্দি আমরা একটা বলয় রেখেছি দুজনেই।দুজনের চারপাশে। ওদিকে জিনিয়া এখনও লেগে আছে। এই তিনমাস কিছুতেই অচ্যূতকে নিজের মতো করে নিজের রাস্তায় হাঁটাতে পারছে না জিনিয়া। আজ ও শেষ চেষ্টা করছে। আজ ওর অচ্যূতকে নিয়ে ডেটিংয়ে যাবার কথা।

সবচেয়ে মজার কথা হল, অচ্যূত অন্য কাউকে পছন্দ করে। সেটা কথায় আচরণে বুঝলেও, জিনিয়া কোনওভাবেই জানতে পারেনি সেটা কে। যেটুকু জানে সেটা হল, অচ্যূত যাকে চায় প্রবল ভাবে চায়।খরস্রোতা নদীর গড়িয়ে যাওয়ার মতো সে চাওয়া প্রবল এবং অবাধ্য। ওর এই চাওয়ার বৃত্তের অনেক দূরে কোনও এক বিন্দুতে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া। ফ্লার্ট করতে করতে সে কখন ঢলে গেছে অচ্যূতের দিকে বুঝতেই পারেনি। একটা অদ্ভুত রসায়নে সম্পর্কটা বইছে। জিনিয়ার চোখ কান দেখে ভয় লাগে আজকাল। ওর মতো অসম্ভব জলি মেয়েটা গুটিয়ে গেছে । ওর এই থম মেরে যাওয়া, ঝড়ে আঁচড়ানো মাটির মতো ক্ষয়িষ্ণু চেহারা কি তাহলে জানান দিচ্ছে অন্যকিছু ? এই অনুরাগই কি প্রাকযৌবনের প্রেম ? অচ্যূত যদি সত্যিই এবার সরে যায়!

হোয়াট‍্সঅ্যাপ খোলা আমার। সবুজ লেখা ফুটে উঠছে। জিনিয়া টাইপিং। ক্লাসরুমে মোবাইল ম্যানেজ করাটা বেশ ঝামেলার। ম্যাম দেখতে পেলে  বের করে দেবেন ক্লাস থেকে। জিওগ্রাফির ক্লাস চলছে। প্রজেক্টারে স্লাইড দেখিয়ে  থিওরি পড়াচ্ছেন শিউলি ম্যাম। জিনিয়া ক্লাসে না থাকলে আমার ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে রাগ হয়, ও কি আমার চেয়ে অচ্যূতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আজকাল। কতবার বলেছি ওকে, চল এবার আমাদের এই মস্করার আড়ালটা ভেঙে সব বলে দিই। অচ্যূত জানুক, আমিই জিনিয়াকে বলেছি এরকম করতে। জানি না, জিনিয়া চায় না কেন ! এর পেছনে ওর  হারানোর ভয় কাজ করে ! আমার ভয় আবার জিনিয়াকেই হারানোর। অচ্যূত তো সামলে নেবে নিজেকে। শুনেছি ও বাইরে থেকে যতটা ইন্ট্রোভার্ট বা ভীতু, আসলে ততটা নয়। প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত। র‍্যাশনাল। ওর বাইরের ওই চাপা হাবাগোবা নরম স্বভাবের অন্তরালে শুয়ে আছে অন্য এক মানুষ। 

জিনিয়া লিখছে, “অলি, আয়াম ব্রোকেন। প্লিজ সেভ মি। আই কান্ট টলারেট দিস স্টরম্।”
আমি মেসেজের রিপ্লাই দিতে দেরি করলেই আবার টাইপ করে জিনিয়া।এটা ওর অভ্যেস। এক মিনিটে অনেকগুলো লাইন পাঠায়।

আমি যা ভয় পেয়েছি তাই ঘটেছে। লিখলাম, “ডোন্ট ওরি। আই এম উইথ ইউ। টেল মি হোয়্যার ইউ আর ।”
“ইউ নো, হি রুইন্ড মি। হি সিরিয়াসলি লাভস সামওয়ান ভেরি মাচ । বাট হি ডিডিন্ট টেল মি হু সি ইজ। হি ব্রোক এভরিথিং টুডে। আই উইল কুইট, অলি। আই কান্ট সারভাইভ উইদাউট হিম।”

জিনিয়া তো পাগল হয়ে গেছে দেখছি! আমাকে ইমিডিয়েট যেতে হবে।
“ডোন্ট ক্রাই। টেল মি হোয়্যার ইউ আর। আই এম কামিং।”
“ভিক্টোরিয়া।”
“ওকে।আই এম কামিং। বি দেয়ার। ডোন্ট মুভ এনিহোয়্যার।”
শিউলি ম্যামের ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বেরিয়ে গেলাম।

জিনিয়াকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, দেখি অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। মাকে বানিয়ে একটু মিথ্যে বলতে হল।

অলীক রাত্রে আমাকে মেসেঞ্জারে লিখছে।
“আমি কাল পরশু একবার কলকাতায় যাব। অনেকদিন হল, আমরা এক অন্ধকারকেশিখন্ডী করে হেঁটে যাচ্ছি। আমি দেখা করতে চাই একবার।”
“কেন? হঠাৎ এরকম মনে হল ?”
“সবকিছুর একটা এন্ডিং আছে। লুকোচুরির একটা শেষ চাই।”
“ও কে। পরশু এসো। কিন্তু, কোথায় আসবে? কীভাবে চিনবে আমাকে ? আমি কীভাবে চিনব?”
“সব বলে দেব। নন্দন চত্বরে দেখা করব।”
এটুকুই কথা হয়।

জিনিয়ার জন্য মনটা খারাপ। ও স্কুল টিউশন সব বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ওর মাকে সব বুঝিয়ে বলেছি।

আজ অলীক আসবে। দুপুর বেলা। কেন দুপুরে, জানতে চাইলাম। বলল, “দুপুরই  তো উপযুক্ত সময়। আলোর প্রাবল্য থাকে।অন্ধকার থাকে অনেক দূরে।” দুপুরও এরকম ভালোলাগার সময় হাতে পারে ধারণা ছিল না। আমি সময় হাতে নিয়ে এলাম। নন্দন চত্বরে। অ্যাকাডেমী অব ফাইন আর্টসের দিকে হাঁটছি। নির্ধারিত কথা মতো, নীল রঙের শার্ট ,কালো জিন্স,  সানগ্লাস পরা  রোগাটে চেহারার কাউকে খুঁজছি। আমি লাল শাড়ি। খোলা চুল। ম্যাট ফিনিশড লাল লিপস্টিক। কাজল। হ্যান্ডি ভ্যানিটি ব্যাগ। খোলা চুল , লাল শাড়ি ওই দুটোই আমার খুব পছন্দের। অলীক জানল কীভাবে? বলিনি তো কখনও! আমার নিজেরও কেমন একটা অস্থির লাগছে। একটা রোমাঞ্চ। রোমাঞ্চরেখা বরাবর খেলে যাচ্ছে বিদ্যুতের মতো  তীব্র এক অনুভূতি। এরকম কেন হচ্ছে , বুঝতে পারছি না। ছোটবেলায় ক্লাস সেভেনে আমার অঙ্কের স্যারকে দেখলে এরকম লাগত। সেই কমবয়সী, মৃদুভাষী, সদ্য বিবাহিত শান্ত সৌম্য চেহারার মাস্টারমশাই। যার চোখে ছিল আলাদা এক আহ্বান। পরে, মা কী বুঝেছিল জানি না, ঠিক এক সপ্তাহের মাথাতেই অঙ্কের স্যারকে পাল্টে এক নতুন দিদিমণিকে ঠিক করে দিয়েছিল। অলীকের সঙ্গে তো তেমন কোনও সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। মুখই চিনি না। গলার স্বর! কিছুই জানি না। শুধু মেসেঞ্জারেই  যেটুকু কথা হয়!

আমি বাংলা অ্যাকাডেমির দিকে গাছের গোড়ায় বেদিতে বসলাম। ক্যালকাটা ক্লাবের দিকে মুখ করে। ওভার ব্রিজ, সবুজ গাছপালা , গোটা নন্দন চত্বর রোদে আলোকিত। রোদেরও অনন্য সৌন্দর্য আছে, আজ তা প্রত্যক্ষ করছি। ভাবছি নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ পর অলীক এসে যাবে।এখানেই তো দেখা হওয়ার কথা।

পাশের স্টল থেকে  ছোট দু’শ এমএল এর একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিলাম। মেঘহীন আকাশে রোডের ঝাঁঝ আছে। কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিতে দিতে দেখছি, দূর থেকে, অচ্যূত আসছে। আমি সানগ্লাস খুলে, ভালো করে দেখি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য। হ্যাঁ, ও তো অচ্যূতই। অবাক লাগছে।নন্দন চত্ত্বরে অচ্যূত ! কালো জিন্স, নীল শার্ট, কালো সানগ্লাসে দূর থেকে বেশ স্মার্ট লাগছে। এই পোশাকই তো নির্ধারিত ছিল অলীকের।অচ্যুতের  হাঁটার মধ্যেও কোনও অসাম্য নেই। শান্ত চেহারার উপর নীলের এক অদ্ভুত দীপ্তি। অচ্যূতকে যে এত দীপ্তময় লাগে, কখনও তাকিয়ে খেয়াল করিনি সেভাবে। তাহলে কি, জিনিয়ার না চাওয়া সঙ্গতা এবং জিনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করার জেদ ওকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।কতটা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করলে, হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়া ইনফ্যাচুয়াশন উত্তীর্ণ হয়ে , ভালোলাগার মানুষটির মুখোমুখি হওয়া যায়! ও আসছে। আমার দিকেই। এক আশ্চর্য অনুভব, বিহ্বলতা আসছে আমার মধ্যেও।আমি তো ওকে সেভাবে চাইনি কখনও, যে ভাবে চেয়েছি অলীককে। অলীকের জন্য অনেক ভাবনা অনুভব কথা জমা আছে আমার। আমার অস্থিরতার সমান্তরালে, এক বিরাট ভয়ও হচ্ছে।জিনিয়াকে হারানোর। অচ্যূত জিনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছে আমাকে ভালবেসেই। আমি কি অলীককে ভালবেসে অচ্যূতকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না! কী করব আমি! বুঝে উঠতে পারছি না!

অচ্যূত আমার কাছাকাছি এসে গেছে। একটা স্মিত হাসি।আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আমাকে অবাক করার জন্য যথেষ্ট। আমিও একটু হাসার চেষ্টা করি। জানি না হাসিটা মুখে ফুটল কি না । আমার প্রায় মুখোমুখি অচ্যূত।
আমি অপেক্ষায় আছি, কথাটা ওই বলুক।আমি তো ওর সঙ্গে কথা বলিই না।
“সরি।”
আমি স্তব্ধ। একটু ইতস্তত। বরফ গলাই।
“কেন , সরি কেন ?”
“দেরি করলাম।পৌঁছাতে।”
“মানে। আমি তো অন্য কারোর জন্য অপেক্ষা করছি।”
হা হা করে হাসল অচ্যূত। হাসিটা সকালের রোদ যেভাবে উৎস থেকে দূর দিগন্ত পেরিয়ে এসে পাহাড় নদী শহর এবং পার্থিব সকাল অস্তিত্বকে স্পর্শ করে তেমনই আমাকেও নাড়িয়ে দিল।
“জানি। এই অপেক্ষা অলীকের জন্য।”
“জানো ? কীভাবে ? বলিনি তো আমি !”
“ফেসবুক তো আসলে ফেকবুক। যত প্রোফাইল দেখো, তার অনেক অনেক গুলোই ফেক। এই যে এত সুন্দর সুন্দর ফেস, স্বামী স্ত্রীর ফটো, প্রেমিক প্রেমিকার, সব কি সত্যি ! আমি মানি না।”

আমার সন্দেহ সত্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার রোমাঞ্চের আড়ালে কেন জানি না একটা রাগ যেন শুয়ে আছে। প্রতিবাদ থেকে, না কি অচ্যূতের জিনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করার পরম্পরা থেকে জন্মাল, বুঝতে পারছি না। একটা জেদ আমাকে আরও শক্ত করে দেয়।
“এটা অন্যায়। আমি মিথ্যের আশ্রয়কে ঘৃণা করি।”

দুপুরের উজ্জ্বল আলোয় আকাশ নীল। অচ্যূতের মুখটা ধূসর লাগে। সাইক্লোনে ভূপতিত বৃক্ষের মতো অসহায় দেখায় ওকে। বড় ধাক্কা খায় ওর আত্মবিশ্বাস।
“এই মিথ্যের আশ্রয় ছাড়া তোমার কাছে আমি তো আসতেই পারতাম না। এভরিথিং ইজ ফেয়ার…।”
কথা শেষ করার আগেই আমি আরও রূঢ় হয়ে উঠি।
“মনে হয় আমরা উভয়ের সময় নষ্ট করছি। আমি তো অলীকের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত। সে তো আর আসবে না কোনওদিনই। তুমি ফিরে যেতে পারো। তোমার ইচ্ছের আকাশে আমাকে আর ওড়াতে পারবে না। দুজনের পথ, চিন্তা দিশার সঙ্গে এত প্রভেদ থাকলে চলে না।”

কিছু কি বলার নেই ওর ! নিশ্চয়ই বলবে।ওর চোখ বলছে ও আরও যুক্তি সাজাচ্ছে। বলল, “মিথ্যের আশ্রয় তো তুমিও নিয়েছ। তুমি আড়ালে থেকে জিনিয়াকে এগিয়ে দিয়েছ! এই আড়ালও তো মিথ্যাকেই প্রশ্রয় দেয়।”

জিনিয়াকে ও চায় না। আমিও অলীকের জন্য দাঁড়িয়ে আছি।অচ্যুতের জন্য নয়। জিনিয়া যে বলেছিল অচ্যূত ওকে নয় অন্য কাউকে চায়, এই অন্য কেউ তো অনিবার্যভাবেই আমি ! এতসব জ্যামিতিক সমীকরণের ভিতে কি তাহলে একটা ধূসর অসম্ভবই আবর্তিত হচ্ছে না ! একটা অদৃশ্য বহুমাত্রিক সম্পর্ক! নাহ। আমার অস্থির মন আমাকে ভাবায়। এই জটিলতায় ক্ষতিই বেশি । এখান থেকে বেরোতে হবে। আমি নরম কিন্তু স্পষ্ট জবাব দিলাম।
“অচ্যূত। পথ আমাদের আলাদা। আমরা নিজ নিজ পথে যাই। ফিরে যাই। সামনে যাওয়ার জন্যই।”

অচ্যূতের চোখ মুখ বুদ্ধিমত্তার স্পষ্টতা দেখায়। ও আর বেশি কিছু বলে না।
“বেশ। জানি না কোনও দিন ফিরব কি না। তবে আমার অপেক্ষা তোমার জন্য থাকবে নিশ্চয়ই। তোমার চাওয়াকে সম্মান দিতে পারলাম। এটাই আমার জার্নির সার্থকতা। কিন্তু আমার আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি তো আরও কিছু বলতে পারি। তোমার শোনা দরকার। না হলে আগামী সবদিন আমি তো ভুল ছবি হয়েই থেকে যাব তোমার কাছে।”
আমার জেদ আমাকে প্রত্যাখ্যান শেখায়।
“না। আমি তো আমার বিশ্বাসে এবং ব্যাখ্যায় অটল।”
“বেশ। আসি। ভালো থেকো।”

নন্দন প্রেক্ষাগৃহ ঘিরে থাকা জলাশয়ের বাঁধানো পাড় বরাবর রেলিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে অচ্যূত। কিছুটা গিয়ে পেছনে তাকায়। ওর এই দেখা তো আসলে,  আমার স্থির দাঁড়িয়ে থাকা, প্রত্যাখ্যানের দুর্নিবার নেশায় ভেঙে দেওয়া অনাগত আগামীকেই দেখা। ও হয়তো ঠিকই বলছে। ওর শেষ যুক্তিটুকু না শুনে,ওকে ভুল বোঝার মধ্যে হয়তো আমিও নিজের বিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করলাম এবং আমার ভেতরকার আমিকে ওর কাছ থেকে  লুকিয়ে রাখলাম। এ তো  মিথ্যেরই আড়াল। সামনে এগিয়ে, পেছনে ফেরার মধ্যে এক অমোঘ বার্তা থাকে। আমাকে সেটাই বুঝতে হবে । এই আমার আজীবনের সঞ্চয়। অনন্ত মাধুকরি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত