| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-২) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“কদমতলি” শহর আর মফঃস্বল। প্রবাস আর স্বদেশ। কাঁটাতার আর নো ম্যানস ল্যাণ্ড। অপেক্ষা থাকেই। কখনও ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা, কখনও ঘর ছাড়ার আকুলতা। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা, শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক। সকলের মনের মধ্যে কোথায় এক কুঞ্জবন। সেখানে ঘর ছাড়া বাঁশির ডাক। সমাজ বদলের ডাক। পথের মাঝেই পথ হারিয়ে যায়। দিক ভুল হয়। আর সেই কদমতলা থেকে ভেসে আসে মধুর বাঁশি। বিবাগী হিয়ার নিরন্তর খুঁজে ফেরা কদমতলি। শ্যামলী আচার্যর নতুন উপন্যাস। আজ থাকছে কদমতলি পর্ব- ২।


 

পিলসুজটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন অনঙ্গবালা। পিতলের লম্বা পিলসুজ। খাঁজগুলোয় এতটুকু ময়লা পড়েনি। কালচে হবার তো প্রশ্নই নেই। এখনও প্রতি বৃহস্পতিবার নিজের হাতে তেঁতুল দিয়ে রগড়ান। জোরে জোরে ডলেন। শিরা-ওঠা কবজির যতটুকু জোর অবশিষ্ট আছে, ততটুকুই ঢেলে দেন। সঙ্গে আবেগ, ভালোবাসা।

       এই পিলসুজ অনঙ্গবালার শাশুড়ির ঠাকুরঘরের সম্পত্তি। তিনি নাকি পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছে। কয়েক প্রজন্মের স্পর্শ রয়েছে পিলসুজের গায়ে। তেল উপচে পরা ভারী প্রদীপটির গা বেয়ে লুটিয়ে পড়ত সোনা রঙের আলো। সেই আলোয় থাকত উষ্ণতা, আশ্বাস, জড়িয়ে থাকার অঙ্গীকার আর মঙ্গলকামনা। নিখাদ নিটোল শুভকামনা। আগুনের ভেজাল হয় না। আলোতেও এলেবেলে কিছু মিশিয়ে দেওয়া যায় না। যেরকম তেলই দাও, যে সলতেই থাক, প্রদীপ জ্বলে উঠবেই।   

       অনঙ্গবালা বরাবর নিজে সলতে পাকাতেন। যখন তাঁর হাতে এল সংসারের ভার, তখন যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো। তার আগে সলতের দায়িত্ব ছিল বাড়ির কচি-কাঁচাদের হাতে। শৈশব না পেরোতেই তাদের চৌকস করে তোলা হত বাড়ির কাজকর্মে। সব শিখিয়ে পড়িয়ে চোস্ত করে তোলা। পরের বাড়িতে গিয়ে বাপের বাড়ির সম্মান না ডোবায়। প্রতি মুহূর্তে সংসারের খুঁটিনাটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা মেয়েগুলোকে। পিছনে সর্বক্ষণ অদৃশ্য শাসানি। শ্বশুরঘরে গিয়ে ঠেলা বুঝবে! যেন সে এক জেলখানা। ভালো কাজের বিনিময়ে খাওয়া-পরার অধিকার।

       বাড়ির ছেলেদের জন্য খোলা আকাশ। তারা মাঠেঘাটে খেলে বেড়ায়, পাঠশালায় পড়তে যায়, তাদের জন্য মাছের মুড়োটা, দুধের সরটুকু, ঘি-মাখন ক্ষীরের বরাদ্দ। চোদ্দ বছরে পৈতে। তারপরে তার খাতির যত্ন আরও খানিক বাড়ল। লেখাপড়ায় মাথা ভালো হলে সিধে কলকাতা। সেখানে বোর্ডিঙে থেকে আরও পড়ার ব্যবস্থা। তবে শহরে গিয়ে বেশি ডানা মেলে ওড়ার খবর পেলে টিকি ধরে ঘরে এনে ফেলা। এবং অবধারিত বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারে জুতে ফেলা।    

পাতলা সুতির কাপড় ফালি করা থাকত। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর আগে ডিবের মধ্যে থেকে অনঙ্গবালা বেছে নিতেন একটি নিখুঁত সলতে। আগে প্রদীপ জ্বলত ঘিয়ে। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে ঘরে বানানো ঘি। পরের দিকে রামা কলুর ঘানি থেকে পরিষ্কারে নিয়ে আসা সরষের তেলের কাঁচা ঝাঁঝালো ঘ্রাণে চোখে জ্বালা ধরত। সেই সঙ্গে আকুল প্রার্থনা। যত বয়স গড়িয়েছে তত বেড়েছে ব্যাকুলতা। ওইটুকু সময় ঠাকুরঘরে নিজেকেই যেন জ্বালিয়ে তুলতেন অনঙ্গবালা। প্রদীপের বুক জ্বলে ওঠা বড় অলক্ষণ। তার আগেই হাতের বাতাসে নিভিয়ে দিতেন প্রদীপের শিখা। ফুঁ দিয়ে নয়। মুখের এঁটো হাওয়া অশুদ্ধ। কখনও প্রদীপ নিজেই নিভত। সেদিন হয়ত আনমনে ছিলেন। হাওয়া আড়াল করতে পারেননি। বা হয়ত উঠোন থেকে ছুটে আসা দমকা হাওয়ায় প্রদীপের শিখা মুহূর্তে নিভে গেছে। অজানা আশঙ্কায় তখন থর থর করে কাঁপতে থাকা।  

       তখন যদিও কথায় কথায় এত অঘটন ঘটত না। বা যা ঘটত, তাকে এখন পিছন ফিরে তাকালে আর অঘটন বলে মনে হয় না। সব সয়ে গেছে। সবই তো সয়ে যায়। না সইতে পারলে আর তুমি মেয়েমানুষ কীসের? 

       কোলের ছেলেপুলে আঁতুড়েই মরে যেত পট পট করে। কে আর ডাক ছেড়ে কাঁদত তখন? গুন গুন করে চাপা স্বর বাজে কোথাও। আঁতুড় মিটিয়ে কিশোরী বধূ হাল ধরত সংসারের। সে ততদিনে খুঁতো। এয়োর সব কাজে আর অধিকার রইল না তার। মরমে মরে থাকত তেরো-চোদ্দর অপুষ্ট মন। শরীরের ধকল সামলে উঠলেও মনের ক্ষত বহুদিন অবধি দগদগ করত তার। সহানুভূতির চেয়ে হায়-আফশোসই তো বেশি হত তাকে ঘিরে। ছেলেপুলের জায়গায় কচি মা মরলেও কান্নার রোল শোনা যেত না তেমন। বরং পুরুষমানুষটিকে আরেকবার ছাঁদনাতলায় ঘুরিয়ে এনে তার আদরযত্নের ব্যবস্থাটি পাকা করা হত।

বাড়ির বুড়ি ঝি ছিল হরিমতী। রাত জেগে রোগীকে সেবাশুশ্রূষা করতে তার মতো আর কেউ কখনও পারত না। বাড়ির কচি ছেলেপুলে থেকে শুরু করে যারই অসুখ হোক, তার হাতের সেবা না পেলে কারও রোগের উপশম হত না। বাড়ির কেউ মরে গেলে হরিমতী বড্ড মন খারাপ করত। তার সেবা সত্ত্বেও কারও জীবনদীপটি অকালে নিভলে হরিমতী গিয়ে চুপচাপ বসত খিড়কি পুকুরের ঘাটে। সবজে জলের মধ্যে সেখানে নিশ্চিন্তে ভেসে বেড়ায় জলঢোঁড়া। জীবন আর মৃত্যুর সীমানা অমেরুদণ্ডী প্রাণী বোঝে না। হিলহিলে সাপ তার বরফঠাণ্ডা গায়ের স্পর্শ নিজেই তো পায় না। পেলে হয়ত মৃত্যুর শীতলতা বুঝত খানিক।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১) । শ্যামলী আচার্য


 

       অনঙ্গবালা-র মনে পড়ে, হরিমতীর হাতে কাঁসা পিতলের বাসন ঝিকিয়ে উঠত। খিড়কির দুয়ার পেরিয়ে যেদিকে আগাছা আর আবর্জনার স্তূপ, সেখানেই পুজোর বাসন নিয়ে বসত হরিমতী। শুধুমাত্র ওরই অধিকার ছিল পুজোর বাসনে হাত দেবার। কত রকম বগি থালা ছিল ঘরে। সিন্দুকে তোলা থাকত। ছেলেপুলের নাম লেখা থাকত তাতে। বউ-ঝিদের জন্য ছিল কাঁসি। কানা উঁচু। ভুবনেশ্বরী আর গয়েশ্বরী কাঁসি ছিল শাশুড়ি আর বড় জায়ের। তাদের চাঁপাকলির মতো আঙুল থেকে চুনো মাছের বাটিচচ্চড়ি নিকিয়ে নিতে পারত কাঁসির পাতলা কানা। সর্বসুন্দরী বগি থালা রাখা ছিল প্রত্যেকের নামে নামে। সে থালার মাঝ বরাবর এমনই পালিশ আর কিনারার ডিজাইন, যে দেখলে মনে হবে আরেকটা ছোট প্লেট বুঝি সেঁটে আছে ওই থালার গায়ে। বড়োঠাকুর, মেজঠাকুরের মতো শ্বশুরমশাই ছাড়াও বড়, মেজ, সেজ, ন’, ফুল, রাঙা— বাড়িতে ভাসুর দেওরের কি অভাব? নিজের তো বটেই। সঙ্গে জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো। সবাই মিলে দালানে পিঁড়ে পেতে যখন খেতে বসত, কচি নতুন বউ অনঙ্গ’র চেয়ে চেয়ে মনে হত এ যেন যজ্ঞিবাড়ি। বাপ রে! এই এত মানুষ এক বাড়িতে? কী কান্না পেত! বাবা কেন তাকে দেখেশুনে এই অ্যাত্ত বড় বাড়িটায় বিয়ে দিল?  

       তিরিশ চল্লিশ রকম বাটি ছিল সিন্দুকে। সরফুলি, গয়া, আটপল। কত রকম নাম। শাশুড়ি, জেঠশাশুড়ি প্রত্যেকের বিয়ের বাসন। বাড়ির বাসন। কাজে কর্মে পালাপার্বণে সব বেরোত। জামবাটি ভরা ক্ষীর, ওপরে সবড়ি কলা আর আমসত্ত্ব–  এই ছিল বড়োঠাকুরের রোজকার বরাদ্দ। গরমের দিনের বিকেলে সরপোষ গেলাসে করে আমপোড়া শরবত যেত ঘরে ঘরে। সকালে গরম দুধ। গেলাসের ওপর এমন ঢাকা, তাতে সরও পোষ মানে। গেলাস থেকে কোনওরকমে উপচে মাটিতে পড়ে না একফোঁটাও। নতুন বিয়ের পর একগলা ঘোমটা সামলে গা-ভরা গয়না আর চওড়া লালপেড়ে শাড়ির মধ্যে জবুথবু হয়ে থাকা অনঙ্গর কাজ ছিল প্রত্যেকের ঘরে ঘরে শরবত পৌঁছে দেওয়া। গেলাস ভর্তি বড় থালা থাকত বাড়ির ঝি কালোর হাতে। অনঙ্গ তার সঙ্গে যেত। প্রতিটি ঘরে পৌঁছে তার কাজ নির্দিষ্ট গেলাসটি তুলে নিয়ে শ্বশুর ভাসুরদের পালঙ্কের পাশে রাখা টিপয়ের ওপর বসিয়ে দেওয়া। সাবধানে। যেন একটু শব্দ না হয়। একফোঁটাও চলকে না পড়ে।  

       সেই সময় থেকেই ঠাকুরঘরের পিলসুজটার সঙ্গে তার ভাব। শাশুড়ি বলেছিলেন, “আজ থেকে নিত্যপূজার সময় এই পিলসুজে প্রদীপ জ্বালাবে তুমি। ঠিক সন্ধের সময়। হরিমতী মেজে ঘষে গুছিয়ে দেবে। সলতে আছে, ঘিয়ের পাত্র দেখে নাও। তোমার হাতে প্রদীপ কেমন জ্বলে দেখব। প্রদীপের বুক যেন না জ্বলে বউমা। মনে রেখো।”

       পিলসুজটির দিকে তাকিয়ে অনঙ্গবালা সেদিন মনে মনে বলেছিল, ও পিলসুজ, তুমি হলে আমার সই। তুমি আগুন ধরে রেখো। আমিও ধরে রাখব তোমায়।

       ত্রয়োদশী নবোঢ়ার কেন এ কথা মনে হয়েছিল, আজ আর অনঙ্গ’র মনে পড়ে না। শুধু তার সইকে মুঠো করে ধরেন একবার। 

       খনখনে গলায় কে যেন হেঁকে ওঠে, “বলি ও ঠাকমা, এই অবেলায় ওই পিলসুজখান আঁকড়ে ঝিমোচ্ছ যে বড়?”                    

       অনঙ্গবালা তাকিয়ে দেখেন, পাশের বাড়ির শশিবালার নাতনি রূপালী। বড় খরখরে স্বভাব।

       “তুই হাঁক পাড়িস কাকে? কাকে চাই রে তোর?”

       অনঙ্গর প্রশ্নে একবার থমকে যায় রূপালী। তারপর বলে ওঠে, “চাইবার মতো কিছু কি আর অবশিষ্ট রেখেছ ঠাকমা? তা’ তোমার নাতিটিকেই দ্যাও না বরং। ভয় নেই, আঁচলে বেঁধে রাখব অখন।”

       অনঙ্গবালা রেগে যেতে গিয়েও হেসে ফেলেন। বলে ওঠেন, “আবাগীর বেটি। সারাদিন কেবল তোর ওই এক কথা।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত