| 29 মার্চ 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: নিঃশব্দ ক্ষরণ । গাজী তানজিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

অনিতা আজ দু’দিন ধরে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হয়ে বসতে পারছেন না। সমানে পায়চারি করে যাচ্ছেন। খবরটা পাওয়ার পর থেকে বুকের ভেতরে যে কাঁপন শুরু হয়েছে সেটা ক্রমশই বাড়ছে। নিঃশ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু কোথাও একটু বসতে পারছেন না কেন? এভাবে ক্রমাগত পায়চারি করতে করতে তার পা দুটো ফুলে গেছে। দিনভর হাঁটাহাঁটি শেষে তিনি এখন দাঁড়িয়েছেন তাদের ক্ষয়ে যাওয়া জমিদারির কাচারিঘরের বিশাল হলঘরটাতে।

অনিতার স্বামী অতনুর পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। জমিদারি যাওয়ার পর সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা বেচা-কেনা হয়েছে অনেক, তবে ওদের এই বিশাল বাড়িটা এখনো রয়ে গেছে কালের শাক্ষী হয়ে। অনিতা বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতেই থাকছেন। তবে আজ অনেকদিন পর তিনি এই কাচারিঘরে পা রাখলেন। ভেতরের অস্থিরতা কাটানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না বলে।

দাদাশ্বশুরের জমিদারি যাওয়ার পর এখানে আর দফতর বসার কোনো প্রশ্ন নেই। কাচারিঘর সব সময় তালাবদ্ধই থাকে অন্তত তিনি তার বিয়ের পর থেকে আজ তেত্রিশ বছর ধরে এমনই দেখে এসেছেন। প্রাসাদের মূল ভবনটাই এতো বড় যে কাচারিঘরের অস্তিুত্ব না থাকলেও কিছু যেত আসত না। ভেতর বাড়িতেই আটটা ঘর, দুটো বড় খোলা বারান্দা আর রান্নাঘর, ভাড়ার ঘর নিয়ে তার বসবাস। সেক্ষেত্রে এই কাচারিঘরে আসাই হয় না। তাছাড়া সম্পত্তির ভাগাভাগিতে এটা তার ছোট দেবর অরিত্রর ভাগে পড়েছে, সে থাকে বিদেশে। অনেকে সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়, কিন্তু অরিত্র দেয়নি। বাড়ির ঐতিহ্যটাকে ধরে রাখতে চেয়েছে সে। সব চেয়ে যেটা বড় কথা, টাকা পয়সার অভাব কখনো সেভাবে হয়নি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে যখন ঝাড় পোছ হয় তখন অনিতাকে আসতে হয় এই দালানে, বিশেষ করে দামি কিছু আসবাবপত্র এবং দুর্লভ কিছু বইয়ের কালেকশান আছে এই দোতলা দালানটাতে। কিন্তু আজ তার এতোবড় বাড়িটাকেও ছোট মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে সারা পৃথিবীটাকে একবার চক্কর দিয়ে ঘুরে কোথায় কি ঘটছে স্বচক্ষে দেখে আসতে। আর সেটা করতে পারলেই যেন তার শান্তি মিলত এই মুহূর্তে। নাকি শুধুমাত্র তার ছেলে রোহানের মুখটা একবার দেখতে পারলেই বা নিদেনপক্ষে ফোনের ওপাশে ওর গলাটা শুনতে পাওয়া গেলেই আগ্নেয়গিরির সব অগ্নুপাত বন্ধ হয়ে যেত! থেমে যেত সব জলোচ্ছাসও। অথচ মনে হচ্ছে যেন এই বিশাল হলঘরে রাখা বড় বড় বইয়ের আলমারি, ঝাড়বাতি, শ্বেত পাথরের টেবিল, ভারী কাঠের চেয়ার সবকিছু যেন তাকে চেপে ধরতে চাচ্ছে। অনিতা ছুটে বাইরে চলে আসে। বাইরেটাও প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পূজোয় বসতে হবে এখনই। পূজোর কথা মনে হতে তার ভেতরটা একটু হালকা হলো যেন।

আজ থেকে দশ বছর আগের কথা, সেদিনও এমনি এক সন্ধ্যায় অনিতা ঠাকুর দালানের সামনে উঠোনের মাঝখানে কংক্রিটের পাঁচিল ঘেরা তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম টেকিয়ে গৃহমন্দির থেকে বের হয়ে আসছেন এমন সময় অতনু হাসিমুখে সামনে এসে দাড়িয়েছিলেন, স্বামীর এই মূর্তি দেখে অনিতার ভেতরে যেন ডাক দিয়ে গিয়েছিল সুখবরটা।

– কি, বাবুর কোনো খবর এসেছে? কি খবর?

– হ্যাঁ এসেছে, তবে এই খবরটা দেয়ার জন্য আগে তুমি আমাকে কি দিবা বল? তারপর বলছি।

– আহারে! আমি আবার কি দেব? আমার সাধ্যের মধ্যে যা আছে তাই পাবা।

অতনু হাতে ধরা কোরা রঙের খামটা ঝাঁকিয়ে বললেন, আজ এই মুহূর্তে তোমাকে কোলে তুলে ভীষণ নাচতে ইচ্ছা করতেছে। কিন্তু বয়সের তারুণ্য কোথায় ফেলে আসছি তাই এই রিস্কটা নিলাম না। আমাদের সারা জীবনের স্বপ্ন স্বার্থক হয়েছে অনি, অক্সফোর্ড, রোহান অক্সফোর্ডে পড়তে যাচ্ছে। ডিপার্টমেণ্ট অব এঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স, মেরটন কলেজ। অনেক প্রাচীন কলেজ বুঝলা!

ঐ মুহূর্তে অনিতা আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে তখনই ছুটে গিয়েছিলেন গৃহ মন্দিরে। অতনু ওভাবেই দাড়িয়ে রইলেন মন্দির ঘরের দরজায়। ধর্মে তার বিশ্বস নেই বলতে গেলে। কিন্তু চরমতম হতাশার দিনে বা জীবনের চরমতম পতনের সময়ে কি শেষ আশ্রয় হিসেবে কাউকে কোনো শাক্তিকে কল্পনা করেননি তিনি! আর সেই অদৃশ্য আশ্রয়ের কথা ভেবে সেদিন অদৃশ্য শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়েছিলেন তিনি ঐ মন্দিরের পাথর মূর্তির দিকে তাকিয়ে। অনিতা অসময়ের পূজা শেষে বের হয়ে এসে অমিয়র বুকে মাথা রেখে বলেছিলেন, আজ মনে হচ্ছে আমাদের ওপরে কোনো অভিশাপ নাই।

– তুমি এখনো পর্যন্ত ওই কথা ভাবো অনি!

– এই খবরটা আসার আগপর্যন্ত।

– কিন্তু কেন?

– নাহ্ এমনি। কথাটা ওই মুহূর্তে এড়িয়ে গেলেও অনিতার ভেতরে একটা আশঙ্কা একটা গূঢ় পাপবোধ ছিল হয়ত।

এটা অতনুর ধারণা। একদিন তাদের বারদালানের ভাড়ার ঘরে রাখা নানা ধরণের জিনিসপত্রের মধ্যে একজোড়া প্রায় সওয়া হাত লম্বা জুতা দেখে অনিতা বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘এটা কার জুতা ছিল, এতোবড়!’

জবাবে যা শুনেছিল তার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

অতনু বলেছিল, ও জুতা পায়ে পরার জন্য না। অবাধ্য, দুর্বিণীত প্রজাদের শায়েস্তা করার জন্য।

অনিতার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল সেদিন। সহসাই প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা, তোমরা কি চাবুক-পেটাও করতা প্রজাদের? আর সেই শাস্তিই কি ঈশ্বর দিয়েছেন আমাকে! আমাদের প্রথম সন্তান ওই পুকুরে ডুবে…!

ধ্যৎ! তোমার সব উদ্ভট চিন্তা। কথাটা ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল অতনু।

কিন্তু আজ, এতো বছর পর আজও এক গভীর পাপবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অনিতাকে। তাকে যে আজ কনফেস করতেই হবে। কাকে করবে ঈশ্বকে? নাহ্ তিনিতো সব জানেন, তাঁর কাছে এজন্য বার বার ক্ষমা চেয়েছে অনিতা। তাহলে কাকে বলবে সে! হ্যা অতনুকে, বলবে আজ। এটা যে তার পাপের ইতিহাস।

– এখনো এখানে কি করছ অনি? কখন যেন নিঃশ্বব্দে ঠাকুর দালানে এসে দাড়িয়েছেন অতনু।

অনিতা চকিতে পেছন ফিরে চেয়ে প্রায় যেন ছুটে আসে সেদিকে। কোনো খবর পেলে? রোহান ফোন করেছে?

– না, এখনো করে নাই। করবে, তুমি এতো ভেবনা তো। এখানে এই রাত পর্যন্ত কি করছ একা একা? চলো, ঘরে চলো। প্রায় ভেঙ্গে পড়া গলায় অনিতা বলল, এখনো করল না ফোন? অথচ আজ নিয়ে দুদিন হয়ে গেল জাপানে ভূমিকম্প হয়েছে। জাপানের বিভিন্ন শহরে আমাদের চেনা জানা যারা আছে সবাই বাড়িতে যোগাযোগ করেছে। রোহানের কি হলো বলো? কী হলো! একটা ফোন কেন করছে না ছেলেটা! স্বামীর বুকে আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকে অনিতা। একটা ফোন, শুধু একটা ফোন পারতো তার বুকের ভেতরে চেপে বসা পাথরটা নামিয়ে দিতে।

অনিতাকে এখন কী সান্ত্বনা দেবে সে! তিন দিনের মধ্যেই জাপানে অবস্থিত বাংলাদেশ দুতাবাস নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। এটা সরকারের কেমন পদক্ষেপ হলো অতনু বুঝতে পারে না। দুতাবাসে কর্মকর্তা কর্মচারি আছেন সর্বসাকুল্যে পাঁচ-ছয় জন। অথচ তাদের জীবনের গুরুত্বটাই বেশি! ওদিকে যে হাজার হাজার বিপদগ্রস্থ এদেশি স্টুডেন্ট, চাকুরে ও শ্রমিক রয়েছে ওখানে, তাদের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই!

তারপরও স্ত্রীকে বললেন, করবে অনি, ভেব না- রোহান নিশ্চই ফোন করবে। হয়ত টেলিযোগাযোগে কোনো প্রবলেম হচ্ছে। এতোবড় ডিজাস্টার! ফোন তো পার্ট অফ টেকনোলজি, তাই না? দেখছোই তো টাওয়ার-ফাওয়ার গুলো সব লন্ড-ভন্ড। তুমি এতো ভাবতেছ কেন অনি? তুমি চিন্তার ভেতরে এতো নেগেটিভ প্রেসার কেন নিচ্ছ? রোহানের কিচ্ছু হবে না।

– বল কি, ভাবব না! এখন ভাবব না তো কখন ভাবব? টিভিতে দেখলাম ফুকুশিমা পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুলি্লতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। রোহান তো ওই শহরেই থাকে। ওখানেই রিসার্চ করছে সে। কেন যে ওখানে গেল ছেলেটা! রিসার্চ করার জন্য আর জায়গা খুঁজে পেল না পৃথিবীতে!

– শোনো, তুমি অতো ভেঙ্গে পড়ো না। তোমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে রোহান নিরাপদেই আছে, তার কিছুই হয় নাই । আমারতো তোমাকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে বেশি। এই দেখ পত্রিকায় কি লিখেছে? পারমানবিক চুল্লিতে ফাঁটল ধরেছে মাত্র। আমি টিভিতেও দেখেছি; এটা খুব বেশি ছড়াতে পারে নাই। আর তাছাড়া ওই শহরের বাসিন্দাদেরকেও তো সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যত্র।

– কিন্তু তেজস্ক্রিয়া! ওটাতো ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। তখন!

– পড়বে না। আমি ইণ্টারনেটে এ প্রসঙ্গে খোঁজ নিয়েছি, এটা এখন খুব খারাপ অবস্থায় যায় নাই। দেখো, অতনু ডাউনলোড করা কপি এনে মেলে ধরলেন স্ত্রীর সামনে। এই দেখো, তেজস্ক্রিয়া নিয়ে তুমি যতটা দুশ্চিন্তা করছ তা কিন্তু না। এই যে এখানে লিখেছে,“ তেজস্ক্রিয়ার এক্সপোজার নির্ধারণ করা হয় গ্রোসিভার্ট একক দিয়ে। সাধারণত বছরপ্রতি ২ মিলিভার্ট তেজস্ক্রিয়ার সন্মুখীন আমরা সবাই হই। এই মাত্রা স্বাভাবিক। এক দফায় ১ গ্রে(১০০০ মিলিসিভার্ট) পরিমাণ তেজস্ক্রিয়া এক্সপোজার বিভিন্ন অসুস্থতা তৈরি করতে পারে। এক দফায় ৪ গ্রে(৪০০০ মিলিসিভার্ট) পরিমান তেজস্ক্রিয়া এক্সপোজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।”

– বল কি! আঁৎকে ওঠেন অনিতা। ওখানে এখন কত?

– ভয় পেও না। ওখানে এখনো বিপদ সীমার অনেক নিচে অবস্থান করছে। জাপানের ফুকুশিমা এখন পর্যন্ত ঘন্টাপ্রতি ৪০০ মিলিসিভার্ট তেজস্ক্রিয়তা বন্ধ করতে সক্ষম। এটা বাংলাদেশ না। ভাবো এখানে পরমাণু কেন্দ্র হচ্ছে। কখনো বিপদ ঘটলে কী হবে!

কথাটা স্ত্রীকে বললেন ঠিকই কিন্তু তার বুকের ভার লাঘব হলো না। সারা বিশ্বের তেজস্ক্রিয়ার বিরুপ প্রভাব সম্পর্কে তিনি জানেন। বিশ্বব্যপি বিশেষ করে এশিয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে তেজস্ক্রিয়া আতঙ্ক। ভারতের ভূপালে তেজস্ক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের অসহায়ত্বের স্মৃতি এখনো মানুষের মনে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। কে-১৯ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ব্যালাস্টিক মিসাইল নিউক্লিয়ার সাবমেরিন । এ ধরণের সাবমেরিন প্রথম হওয়ায় যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল । ছিল অদক্ষ নাবিকও। যার কারণে হঠাৎ বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর টেকনোলজির উন্নতির ফল স্বরুপ ধেয়ে আসা ভয়াবহ সব বিপদের হাত থেকে আমরা আমাদের সন্তানদের বাঁচাবো কি করে!

অন্যদিকে উন্নতবিশ্বই তাদের নিজেদের স্বার্থে এধরণের ঘটনা বা দুর্ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য থাকে সদা প্রচেষ্ট। এই সেদিন চেরনোবিল দুর্ঘটনা নিয়ে নির্মিত রুশ চলচ্চিত্র “ ইনোসেণ্ট স্যাটারডে” ছবিটার প্রচার সে দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। গা-বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে মানুষ এখন আর অবাক হয় না, কি উন্নত দেশ আর কি তৃতীয়বিশ্ব। রাষ্ট্রযন্ত্র যার হাতে সে-ই ডিকটেটর। ভাবতে অবাক লাগে যে, চেরনোবিল এলাকার অধিবাসীরা তেজস্ক্রিয়ার কথা না জেনে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছিল। আর তেজস্ক্রিয়া অদৃশ্য দানবের মতো তাদের দেহে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। তবে এই কথাগুলো অনিতাকে জানানো যাবে না। তাহলে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমনিতেই দুদিন ধরে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যত দিন গড়াচ্ছে ওর নিঃশ্বাসের কষ্টটা ততই বাড়ছে। আচ্ছা যদি ঈশ্বর না করেন খারাপ কোনো খবর আসে! তবে কি অনিতা আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে না! না, সেটা হতেই পারে না। আতনু ডাউনলোডেড পেপারটা হাতে নিয়ে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার হয়ে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঠাকুর ঘর থেকে প্রসাদ হাতে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে অনিতা। অঝোরে কাঁদতে থাকে সে। হতচকিত অতনু তার মাথা পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, কাঁদতেছো কেন অনি, কি হইছে?

– আমি পাপ করেছি, ভীষণ পাপ করেছি। আর সে জন্যেই আমার এই শাস্তি।

– তুমি কি পাপ করেছ বল? তুমি কেন পাপ করতে যাবা!

– হ্যাঁ করেছি। অভিলাসা মাসির সাথে ভীষণ অন্যায় করেছি আমি। আর সেই পাপেই..!

কথা শেষ করতে পারে না অনিতা – দুদিনের টানা ক্লান্তির ভারে জ্ঞান হারায় সে।


আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: সাতটা নদী দুইটা মাছ । শা হ্ না জ মু ন্নী


অভিলাসা মাসি। দীর্ঘদিন পর মুখটা ভেসে ওঠে অমিয়র চোখের সামনে। সেই শৈশবের দেখা হাসি হাসি মুখ, তাকে আদর করতে যাওয়া আর তার ভেঙচি কেটে ছুটে পালানো।

অভিলাসা মাসি ছিলেন অতনুদের গভর্নেস। অতনুর মা যখন মারা যান তখন তার বাবা চন্দ্রধর রায় চৌধুরীর বয়স চল্লিশ। অতনুরা তখন ছোট ছোট তিন ভাই-বোন। অতনুর বয়স দশ, ভাই অরিত্র ছয় আর বোন মেঘনার বয়স মাত্র চার মাস। জমিদারী প্রথার বিলোপ ঘটেছিল আরো কয়েক পুরুষ আগেই। অর্থনৈতিকভাবেও তখন তাদের ভগ্নদশা চলছে। যৌথ পরিবার ভাগ হয়ে গেছে যে যার মতো। তবে জমিদারী ঠাঁট রয়ে গেছে। তাই এই মাতৃহীন তিন সন্তানকে বিশেষ করে শিশু কন্যার দেখভালের জন্য একজন নারীর খুব প্রয়োজন দেখা দেয়। চন্দ্রধর চৌধুরীকে সবাই দ্বিতীয় বিয়ে করার পরামর্শ দিলেও তিনি সন্তানদের সম্পত্তির ভাগ কাউকে দিতে চাননি বিধায় আর বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না, তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন একজন গভর্নেস চেয়ে।

অভিলাসা ছিলেন এক গরীব কৃষক পরিবারের মেয়ে। তার বাবা মা কেউ ছিল না। কাকারা বারো-তের বছর বয়সে তার বিয়ে দেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। লেখা-পড়া জানতেন সামান্যই- কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো। বিধবা হওয়ার পর তার জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। কয়েক বছর তাকে প্রায় নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তার এই যন্ত্রণা লাঘবের জন্যেই তার এক আত্মীয় বিজ্ঞাপন দেখে ওর হয়ে দরখাস্ত করেন। এবং তার পর সৌভগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমেই হোক শিশু মেঘনার দেখভালের জন্য তিনি এ বাড়িতে যোগ দিলেন। তখন থেকেই তিনি এ বাড়ির বাসিন্দা। তিনি যথেস্ট সুন্দরী ছিলেন। মাথার চুল লম্বা এবং এখনকার মেয়েদের মতো সিল্কি, লম্বা মেদহীন ছিপছিপে শরীর, গায়ের রঙ উজ্জল বাদামী। তবে কাগজে কলমে তিনি মেঘনার গভর্নেস হলেও অন্য দুই কিশোর ছেলের দেখভালের দায়িত্বও তারই ছিল।

জীবনে মায়ের ভূমিকাটা কত জরুরি এটা যখন অতনু বুঝতে পারছিল, ঠিক তখনই মা তাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর সেখানে মায়ের ভূমিকা কিছুটা হলেও পূরণ করতে যিনি এসেছেন, তার জন্য ছোট্ট মেঘনা ব্যকুল হলেও অতনুর ভেতরে তার জন্য এক ধরণের বিতৃষ্ণা বয়ে যেতে লাগল। তার প্রায় সময় মনে হতো এই মহিলা বুঝি তার মায়ের আসনে বসতে চাচ্ছেন ধীরে ধীরে। অভিলাসা অতনু ও অরিত্রকেও খুব যত্ন করত। তাদের মাতৃহীনতার শুন্যতা সে পূরণ করতে চাইত, তবে অতনুর ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ স্বামী সন্তানহীন অভিলাসার স্নেহের মধ্যে কেমন একটা দেখানেপনা ছিল। যা অতনুর সহ্য হতো না। অভিলাসার শরীর থেকে ভেসে আসা নারকেল তেল আর স্নোর গন্ধ, ওর হাতের স্পর্শ, কখনো বাবা-সোনা বলে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার সময় চকিতে বুকের স্পর্শ লাগলে বিরক্তিতে সে ছুটে পালাত। আবার ছোট বলে এই মহিলার সেবা না নিয়েও তার কোনো উপায় ছিল না। আবার সে বিরক্তও হতো চরম। এখন সেকথা মনে হলে সত্যিই আশ্চর্য লাগে! সে আদর করতে এলে খামচে দিত, জ্বিভ বের করে ভেঙ্গাত। অথচ এটা না করলেও চলত। কিন্তু তখন কেন এটা বুঝতে পারে নাই সে!

তবে অভিলাসা মাসি ওদের সঙ্গে যখন মিশতো তখন অনেকটা যেন শিশু হয়ে যেত। দিনভর ওর গাঢ় উপস্থিতি অতনুকে যতটা অস্বস্তিতে ফেলত ওর অন্য ভাই-বোনকে কিন্ত তা ফেলত না। বরং অরিত্র অভিলাসার অদ্ভুত ও আজগুবি সব গল্প শুনতে পছন্দ করত। ছোটবেলায় কোন এক সময় কোলকাতা গিয়েছিল সে, আর সেখানে চিড়িয়াখানায় দেখা আজব সব প্রাণীদের গল্প সে এমন অদ্ভুত বর্ণনায় বলত যে ওরা সবাই বিস্মিত হয়ে শুনত। রুপকথার গল্পতো ছিলই, তার ওপরে এমন কিছু আজগুবি বানানো গল্প তার ঝুলিতে ছিল যা লিখলে হ্যারিপটারের জনপ্রিয়তাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারতো বলেই অতনুর এখন ধারণা।

অতনুর মাঝে মাঝে মনে হয় তার বাবার অন্ধসন্তান বাৎসল্যের কারণে তিনি যে কতবড় একটা ভুল করেছেন! অভিলাসাকে এ বাড়িতে চাকরি দেয়ার পরিবর্তে তিনি যদি কাউকে বিয়ে করতেন! হলোই বা সম্পত্তির বিভক্তি তাতে কি এসে যায়! আজ কেন জানি না মনে হচ্ছে, অভিলাসা মাসির সারাজীবনের গোপন দীর্ঘশ্বাস কি তাহলে সত্যি তাদের ওপরে এসে পড়েছে! অনিতার ধারণাই কি ঠিক তাহলে? সেই দীর্ঘশ্বস ও তার প্রতি করা যাবতীয় অন্যায়ের ফলই কি তাদেরকে তাড়া করে ফিরছে এখনো? কিন্তু বাবা তাকে বিয়ে না করলেও তারওতো একটা গতি হয়েছিল এ বাড়িতে এসে। হিন্দু বাল্যবিধবা সহায়হীন নারীর যেখানে সারাজীবন অবহেলায় অযত্নে কাটার কথা – এ বাড়িতে এসে একটা আশ্রয় বা একটা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা তো মিলেছিল তার। অথচ সেই নিশ্চয়তা তাকে সুখ দিতে পারল কই! বাবার মৃত্যুর পর অনিততা তাকে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করলে, বাড়ি ফিরে গিয়ে সে আর বাঁচল কই! ছয় মাসের মাথাতেই মৃত্যু। অথচ তিনি বেশ শক্ত পোক্ত ছিলেন। তার কোন বিশেষ রোগ ছিল না। তাহলে কি তিনি অনিতা এখন যেমন কষ্ট পাচ্ছে – শুধুমাত্র মানসিক যন্ত্রণায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, এভাবে তারও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?

হা ঈশ্বর! অসুস্থ, ইনজেকশানের প্রভাবে ঘুমন্ত স্ত্রীর হাতটা আঁকড়ে ধরেন তিনি। এ যেন যমদূতের হাত থেকে স্ত্রীকে রক্ষার জন্য নিস্ফল প্রচেস্টা।

অনিতা কখনোই অভিলাসা মাসিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। চন্দ্রধর চৌধুরি আর তার বাড়ির গভর্নেস অভিলাসাকে নিয়ে বাইরে অনেক রগরগে স্ক্যান্ডাল থাকলেও সেটাকে তিনি পাত্তা দেন নি কখনো। শেষ পর্যন্ত অতনুর সাথে যখন অনিতার বিয়ের সম্মন্ধ হয়, তখন এমন উপযুক্ত পাত্র পেয়ে অনিতার বাবা বর্তে গেলেও শশুরের ব্যপারটা নিয়ে অনিতার মা তুমুল আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু তারপরও বিয়েটা কিভাবে যেন শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল। অনিতার বাবার আগ্রহের সামনে মা’র ক্ষীণ আপত্তি টিকল না। কিন্তু তার মায়ের ওই বিরুপ মনোভাব তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সে অভিলাসার কর্তৃত্ব কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। তার মনে হতো অভিলাসা তার ওপরে হয়ত শাশুড়ি সুলভ কর্তৃত্ব ফলাতে চাচ্ছে। বিশেষ করে তার ওপরে জমিদার বংশের অন্দরমহলের যে সব বিধি নিষেধ ও নিয়ম কানুনের সংস্কারগুলো আরোপ করতে চাইত তার সব কিছুই অনিতার কাছে অনধিকার চর্চা বলে মনে হতো। একই মনোভাব তো অতনুরও ছিল তার প্রতি। মায়ের মৃত্যুর পর অভিলাসা যখন এবাড়িতে এসেছিল তখন অন্যরা স্বস্তি পেলেও অতনু পায়নি। কিশোর অতনু বুঝতে পারত যে সে তাদের কেউ হয় না, তাদের পড়াতে বসালেও তাদের শিক্ষক না, আবার তাদের সাথে লুডো ক্যারাম খেললেও তাদের খেলার সাথীও না। আবার সে বাড়ির অন্যান্য সাধারণ কর্মচারিদের মতোও না। তাহলে সে কে?

তবে অভিলাসা অনিতার ক্ষেত্রে মনে করত যে, সে যেহেতু অনিতাকে বরণ করে ঘরে তুলেছে তাই তার আচার আচরণ সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান দেয়ার অধিকার তার আছে। আর বিপত্তিটা ঘটে এখানেই। অভিলাসার প্রতি অনিতার বিদ্বেষ প্রতিনিয়তই বেড়ে যেতে থাকে।

তবে অভিলাসার প্রতি অনিতার এই দুর্ব্যবহারে অতনু মনে মনে অনিতার ওপরেই বিরক্ত হতো। কারণ ততদিনে এই বঞ্চিত অসহায় নারীর ব্যথাটা সে উপলদ্ধি করতে শুরু করেছে, আর এটা সম্ভব হয়েছিল বিয়ে পরবর্তী অভিজ্ঞতার কারণেই।

অনিতা যে তাকে পছন্দ করেনা, এটা অভিলাসা ক্রমেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিল। অনিতা কোনো এক আদীম সংস্কারের জায়গা থেকে অভিলাসাকে শুরু থেকেই অপছন্দ করত। আর সে এটা বুঝতে পেরেছিল বলেই চন্দ্রধর চৌধুরীর মৃত্যুর পর এ বাড়িতে ওর জীবন পুরোপুরি অসুখী হয়ে উঠেছিল। মুখে বিষন্নতার ছায়া লেগে থাকত। ওর প্রতি অনিতার চাপা ঘৃণা আর উপেক্ষাই এই বিষন্নতাকে জাগিয়ে রাখতো।

অনিতা বলত, অভিলাসা কী করে আশা করে যে, এই বাড়ির মানুষগুলোর মতো অনিতারও তার ওপরে একটা দরদের জায়গা থাকবে! সাধারণ গভর্নেস থেকে যখন কেউ অলিখিত গৃহকর্তীর আসনে পৌছে যায়, বা তাকে পৌছে দেয়া হয়, তখন সে নিজেকে মহারাণী ভাবতে শুরু করে। নিজের আশ্রিত সত্বাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আশ্রয় দাতাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। কখনো কখনো কাজটাতে সফলও হয়, এটা আমি হতে দেব না। তোমার বাবার অসহায় হওয়ার ভানটাকে বেশ ভালো করে বুঝে নিয়ে মানুষটাকে পুতুলের মতো নাচিয়েছে। এমন প্রভাবশালী একজন মানুষ ঘরে একজন আশ্রিত নারীর কাছে কিভাবে নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার অত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিতে পারে! শুধু কি কাম! শরীর নামের এই অদ্ভুত কারখানার কারসাজি, নাকি সেবা বা নির্ভরতা নিঃশ্চয়তা নামের আরো কিছু মোহময় শব্দ এর সাথে জড়িয়ে আছে?

অনিতার এই বক্তৃতা মুখ বুজে শুনে যাওয়া ছাড়া অতনুর আর কিছু বলার থাকে না। সে বলতে পারে না যে এর বাইরের বা গভীরের কিছুওতো হতে পারে; যাকে বলে প্রেম বা ভালোবাসা! তবে সে এ বিষয়েও সন্দিহান। তার বাবা কি আদৌ অভিলাসাকে ভালোবাসতেন? না। ভালোবাসা শব্দটার সাথে মিশে থাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা। তেমন কিছু থাকলে বাবা অভিলাসাকে বিয়ে করতে দ্বিধা করতেন না। তবে কি স্বার্থপরতা! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই নারীর অকৃত্রিম সেবা পাওয়ার জন্য এটুকু প্রশ্রয় তাকে দিয়েছেন? তবু দ্বিতীয় বিয়ে করে ব্যক্তিত্বের বিসর্জন দিতে চাননি? এটা ভেবে অভিলাসার প্রতি এক ধরণের মমতা ও বাবার প্রতি করুণা হয়েছিল অতনুর। সেই প্রথম হালকা হতে শুরু করেছিল অভিলাসার প্রতি অতনুর মনের ভার। কিন্তু কথাটা অনিতাকে কে বোঝাবে? তাহলে সে যে এই বৃদ্ধা নারীর সাথে তাকে জড়িয়েও সন্দেহের আঙ্গুল তুলবে না কে বলতে পারে! তাই অতনু এ বিষয়ে চুপচাপ থাকাই ঠিক মনে করেছিল। যদিও অতনুর যখন বিয়ে হয় তখন অভিলাসা আক্ষরিক অর্থেই বিগত যৌবনা। তার মুখে এক সময় যে স্বাভাবিক লাবন্য ছিল তার অনেকটাই আর নেই। মাথাজুড়ে পাকা চুল, ভারী শরীর। তাই অনিতার অনেক অভিযোগের উত্তরে একদিন অতনু গলার স্বরে ঘৃণা ঝরিয়ে বলেছিল, আমরা শুধু ওকে মা বলে ডাকি নাই। এটা বাদ দিলে তো সে আমাদের জীবনের অনেকটা। মহিলা একসময় আমাদের সংসারটা ধরে রেখেছিলেন, আজ তুমি এসেছো বলেই ওকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে? অথচ তখনো অতনু বুঝতে পারেনি যে, জীবনের তালিকা থেকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও অনেক নাম ছেঁটে বাদ দিতে হয়।

যাবার আগের দিন নিজের ঘরে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল অভিলাসা। এ বাড়ির কারো সঙ্গেই ওর রক্তের সম্পর্ক নেই। শুধু মেঘনা মেয়েটা তাকে সত্যিই ভালোবাসত। কিন্তু সে তো আর তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারে নাই। অথচ এদের কষ্ট, সুখ, অপমান সবকিছুই ওর হৃদয়কে উথাল পাথাল করে দিয়েছে। কতবার অভিলাসা ভেবেছে নিষ্ঠুরের মতো নির্লিপ্ত থাকবে, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। এরা মরুক শেষ হয়ে যাক তাতে তার কি? এরা তার কেউ না। পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ক আর আইনের সম্পর্কই যেখানে সব, সেখানে কী লাভ এই মিথ্যা ভালোবাসা আদর স্নেহের মোহে ডুবে থেকে! বৌটা প্রথম থেকে তার আচরণে স্পষ্ঠ করে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সেএ বাড়ির কেউ না। সে যখন তখন চোখের ভাষায় ঘৃণা ছুড়ে দেয়ার আগে তাকে মানুষ বলে মনে করে নাই। তবুও তারপরও ওদের জন্য বুকভরা ভালোবাসা কেন? দুচোখ দিয়ে সেই ভালোবাসা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ার আগে অভিলাসা নিজেই জানতেন না যে এতো জল সে তার বুকের মধ্যে ধরে রেখেছিল।

তবে হিন্দু সাধারণ ঘরের বিধবার চন্দ্রধর রায়ের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার পেছনে অভিলাসার দিক থেকেও এ সম্পর্কের কোনো ব্যাখ্যা ছিল কি না জানা যায়নি। তবে সে ব্যাখ্যা নিতান্তই জৈবিক ছিল না নিশ্চয়ই। সংসারের সুপ্ত বাসনাই তাকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছিল হয়ত। সবার ওপরে এই সর্বহারা নারী চেয়েছিলেন একটা নিশ্চয়তা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই নিশ্চয়তার ভেতরেই তিনি সমর্পণ করতে চেয়েছিলেন নিজেকে। কিন্তু পরেননি। সমাজ গড়া বিদ্বেষের কারণে তাকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।

কিন্তু অভিলাসা মাসির ভেতরের এই নিরব কান্না যে লুকিয়ে রাখা তেজস্ক্রিয়ার ক্ষতিকর প্রভাবের মতো নিঃশব্দ ক্ষরণ হয়ে অনিতাকে কুরে কুরে খেয়েছে এবং এতোদিন পর হলেও অনিতার মনে তা জেগে আছে এটা জেনে অতনু এক ধরণের স্বস্তি পেলেন। অনিতার ভেতরের এই পাপবোধ তার মানুষত্বের স্বীকৃতি দেয়। ওর অনুতপ্ত হওয়ার খুব দরকার ছিল। অন্তত অতনু এখন ভাবতে পারছে যে তার স্ত্রী স্বার্থপর বা খুব সাধারণ একজন মানুষ নন। আর তাই এই মানুষটার জন্য তিনি আবারও একবার প্রার্থণা করলেন, হে ঈশ্বর তুমি তোমার এই মানব সন্তানের প্রতি একবার করুণা কর প্লিজ!

প্রার্থণা শেষে অতনু অনেকটা নির্ভার ভঙ্গিতে সেল ফোনটা হাতে নিয়ে এর পর কাকে ফোন করবেন সেটা খোঁজার জন্য ফোন বুকটা সার্চ করছেন।

এবং তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। অতনু হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ঝড়ের গতিতে রোহান বলে উঠলো,

– বাবা, কেমন আছো?

অতনুর যেন খাদের কিনারায় গড়িয়ে পড়তে গিয়েও হঠাৎ পেয়ে যাওয়া শুকনো ডাল ধরে ঝুলে বেঁচে থাকার মতো অনুভূতি হলো।

– ভালো, ভালো বাবা, তুই ভালো তো!

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত