| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৬) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
স্বয়ংবর সভা সাধারণত রাজারাজড়াদের ঘরেই হত। কারণ এই বিপুল আয়োজন করা তো সহজ কথা নয়। নানাদেশ থেকে নেমন্তন্ন পাওয়া রাজারা, নেমন্তন্ন না পাওয়া রাজারা সবাই আসতে পারেন। রাজ্যের সাধারণ নাগরিকরাও এমন স্বয়ংবর সভার বিপুল আড়ম্বর থেকে বঞ্চিত থাকবেন কেন? আর সর্বঘটে কাঁঠালিকলার মতো বামুনরা তো আছেনই। তাঁদের তো দুনো মজা। ডবল ধামাকা। এক তো উৎসবের মজা নেওয়া। দুই, যেসব রাজারা আসবেন, জয়লাভের জন্য পুণ্য অর্জনও করতে চাইবেন। আর বামুনেরা থাকলে তাঁদের সোনাদানা গরুবাছুর ভালো ভালো খাবারদাবারও দিয়ে পাল্লা দিয়ে পুণ্য অর্জন করবেন আর বামুনদের ঝোলা ভরে উঠবে। দ্রৌপদীকে লাভ করা নিয়ে মাথাব্যথা ক্ষত্রিয়গুলো করুকগে। তো বারাণবতের পর একচক্রা গ্রামে পাণ্ডবরা তো বামুনের ছদ্মবেশেই ছিলেন। সেখান থেকে ব্যাসদেবের পরামর্শে তাঁরা যখন পাঞ্চাল রাজ্যের দিকে যাবেন বলে রওনা হয়েছেন, পথে দেখলেন দলে দলে বামুনরাও চলেছেন। তাঁরাও চুপচাপ সেই রকম একটি দলে ভিড়ে পড়লেন।
পাঞ্চাল রাজ্য জুড়ে তখন উৎসবের আবহাওয়া। দীয়তাং ভুজ্যতাং চলছে। রাজাদের স্বয়ং দ্রুপদ রাজা অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। তাঁদের উপযুক্ত খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করছেন।  মূল সভাটির চারপাশে অনেকগুলি সাততলা অট্টালিকাগুলি তৈরি করা হয়েছিল। সভার বাইরে নিরাপত্তার জন্য উঁচু পাঁচিল তোলা হয়েছিল। পরিখা কাটা হয়েছিল। এখনকার রুমস্প্রের চেয়ে ঢের সুগন্ধী অগুরুর গন্ধ ছড়িয়েছিল সেই সভার আনাচকানাচ জুড়ে। মাঝে মাঝেই আবার চন্দন দেওয়া জল ছিটোনো হচ্ছিল। টাটকা সব সুরভিত ফুল আর মালা তো ঝুলছিলই। অট্টালিকাগুলির ভেতরে, রাজাদের থাকা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিছানা, বসার আসন থেকে শুরু করে দামী দামী সব পোষাকআষাকও ছিল। যদি কোনও রাজা সাজগোজের বাক্সটি ফেলে আসেন তাড়াহুড়োর চোটে! আসলে দ্রৌপদীর রূপের খ্যাতি এমনভাবে ছড়িয়েছিল, বোধহয় রাজাগুলো সবাই তাঁকে পেতে চাইত মনে মনে। এখন এই স্বয়ংবরের সুযোগে অতিরিক্ত উৎফুল্ল হয়ে এমন ভুল তো করতেই পারে। আর বাপু, ছেলেরা তখনও সাজত, এখনও সাজে। ছেলেদের বিউটি পার্লার আর জিম নেই বুঝি? পুজোর এক দুমাস আগে সেখানে ভীড় উপচে পড়ে। কী ? না পুজোয় মেয়েদের চোখে আকর্ষণীয় হতে হবে না? একটু মাসল ফোলা থাকবে, জিন্স পড়লে মেয়েগুলোর চোখ আটকাবে, গা থেকে সুরভী বের হবে, জেল মেখে রুখুসুখু চুল বশে আসবে; তবে না!! আমরা শুধু উল্টোটাই ভেবে মরি!!
যাক গে, দ্রুপদ শুধু রাজাদের কথাই ভাবেন নি কিন্তু। সাধারণ নাগরিকরাও যাতে স্বয়ংবর সভার পুরো মজা দেখতে পায়, তাই মূল মঞ্চের চারদিকে সুন্দর করে বসার আয়োজন করে রেখেছিলেন। আর সভাকে মধ্যমণি রেখে নগর জুড়ে চলছিল উৎসব। নাচাগানা খানাপিনা দানধ্যান। একেবারে ফুলটুস মস্তি যাকে বলে, করে নাও। পুরো এক পক্ষ কাল মানে পনেরোদিন ধরে চলল সেইসব নাচাকোঁদা। তারপর ষোল দিনের দিন আসল কাজ। লক্ষ্যভেদ। তা পাণ্ডবরা বামুনদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে চুপচাপ বসলেন। যথাসময়ে কৃষ্ণা দ্রৌপদী এলেন। তাঁকে দেখে সভাস্থ সকলে চুপ করে গেলেন। আসলে শুধু তো রূপ না, এমন একটা আবিল করা ব্যক্তিত্ব, যার জন্ম নিয়েও অদ্ভুত একটা রহস্য, যার গায়ের গন্ধ নাকি এক ক্রোশ থেকে পাওয়া যায়, তাকে চোখের সামনে দেখে সাধারণ নাগরিকদের মতো রাজারাজড়াদেরও বুকের ভেতর দুন্দুভি বাজতে লাগল। বুকের মধ্যের দুম দুম আওয়াজ যেন পাশে বসা লোকটাও শুনতে পাবে, এমন অবস্থা।
ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রথমেই দ্রৌপদীকে অর্জন করার শর্তগুলি বলে একে একে রাজাদের পরিচয় করাতে লাগলেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্রৌপদীকে পেতে একইসঙ্গে ভাইয়েরা এসেছে, মামা-ভাগ্নে (শল্যরাজ ও কুরুপাণ্ডব ভাই), এমনকী বাপ-ছেলেতেও(বিরাট ও তাঁর পুত্র, সোমদত্ত ও তাঁর পুত্রেরা) সবাই এসেছেন। চান্স কেউ ছাড়বেন না, এই আর কী!

আরো পড়ুন: একাকিনী (পর্ব-৫) । রোহিণী ধর্মপাল


এই সভায় প্রথম কৃষ্ণ-বলরামকেও আমরা পেলাম। অতি চতুর কৃষ্ণ বুঝেছিলেন যে পঞ্চপাণ্ডব বেঁচে থাকলে এই সভায় আসবেনই এবং নিশ্চিত ভাবে ছদ্মবেশেই আসবেন। তাই তাঁর চোখ ঘুরছিল সাধারণ বেশভুষাতে থাকা নাগরিক ও বামুনদের বসার সিটে। এবং তাঁর চিনে নিতে বেশি দেরি হলোই না। তিনি দাদাকেও দেখালেন। ওই দুজন ছাড়া বাকি সকলে তখন শুধু দ্রৌপদীকে দেখছেন আর ভাবছেন একে আমিই পাব। একই অবস্থা, আগেই বলেছি, পাণ্ডবদেরও। কিন্তু যেহেতু তাঁরা বামুনের ছদ্মবেশে আছেন, দুম করে উঠতেও পারছেন না।
ধৃষ্টদ্যুম্ন শর্ত বলার পর শুরু হল রাজাদের আস্ফালন। এক এক করে গর্জন করতে করতে উঠছেন, কিন্তু ধনুতে গুণ পরাতে গিয়ে ছিটকে যাচ্ছেন। তাঁদের মুকুট আর অন্য সব গয়নাপত্তর সব ছিটকে ছিটকে পড়ছে। কোনরকমে সে সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে আবার নিজের আসনে এসে বসছেন। চলে যেতেও তো পারছেন না। কে দ্রৌপদীর মালাটি গলায় পরার সৌভাগ্য পাবে, তা দেখার কৌতূহল তো ষোলোর জায়গায় আঠারো আনা!
দ্রৌপদী কর্ণকে না করার পর উঠলেন জরাসন্ধ। তিনি পর্যন্ত ব্যর্থ হলেন এবং মাথা নিচু করে সেই যে বেরোলেন, একেবারে নিজের রাজ্যে গিয়ে নিঃশ্বাস নিলেন! শিশুপাল আর শল্যের মতো বীরও যখন গুণের আঘাতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন, তখন অর্জুন আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। তাঁর তো অনেকক্ষণ ধরেই হাত চুলকোচ্ছিল কিনা! কিন্তু রাজারা বাকি থাকতে ওঠাও যাচ্ছিল না। এইবার তিনি উঠলেন । অর্জুনকে উঠতে দেখে নাগরিক ও বামুনদের মধ্যে দুটি দল হল। একদল বলল, কী বোকারে লোকটা! বলে হাতীঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! এইসা সব বীরেরা হেরে ভূত হয়ে গেল, এখন এই বামনাটা কী করবে! জীবনে কখনো যে অস্ত্র ধরেনি, ভিক্ষাজীবী, যাগ করা শুধু যার কাজ, সে কখনও পারে! আবার আরেকদল বলল, চেষ্টা তো করুক। রাজারা যেখানে পারেনি, এ না পারলেও কী বা গেল এল! বরং এর চেহারাটি দেখ! রীতিমত চওড়া কাঁধ, লম্বা শক্তিশালী হাত দুখানি, সিংহের মত এগোচ্ছে, রীতিমত তেজ ঠিকরে বেরোচ্ছে। দেখাই যাক না কী হয়! যদি পেরে যায়! তাহলে তো দারুণ ব্যাপার হবে!
অর্জুন লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছিলেন, সেটা আমরা সবাই জানি। তার পরে বাকিদের কী প্রতিক্রিয়া হল, সেই কথা বলার আগে একটু দ্রৌপদীর কর্ণকে না বলার কথায় আসি। নাহং বরয়ামি সূতম্, সূতকে আমি বরণ করব না, এই বলে কর্ণ লক্ষ্যভেদ করার আগেই না করেছিলেন দ্রৌপদী। এখানে অনেকগুলি কথা আছে। প্রথম কথা, ধৃষ্টদ্যুম্ন (হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ও রাজশেখরবসুর সারানুবাদ অনুসারে ) প্রথমেই বলেছিলেন যে উচ্চবংশ হতে হবে প্রতিযোগীকে। অথচ যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে উপস্থিত সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের পরিচয় করাচ্ছিলেন, তখন তো কর্ণের সঙ্গেও পরিচয় করিয়েছিলেন। তাহলে কি তিনি জানতেন না যে কর্ণ অধিরথের পুত্র বলে পরিচিত? অথচ দ্রৌপদী জানতেন? নাকি ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ণকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেননি? তাও তো হওয়ার কথা নয়? শর্তের আর একটি শব্দ ছিল রূপবান। তা কর্ণকে কুরূপ কেউ বলবেন না। কুন্তী আর সূর্যের পুত্র, যথেষ্ট বীরব্যঞ্জক চেহারা! সুতরাং এই কারণে না বলার কথা না। নাকি দ্রুপদের অর্জুন কে জামাই হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছের কথা দ্রৌপদীর অজানা ছিল না? দ্রৌপদীর মতো মেয়ের সঙ্গে দ্রুপদ রাজনীতি, নিজের রাজ্যের শক্তি বাড়ানোর কথা আলোচনা করা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। ফলে কর্ণকে গুণ পরাতে দেখে পাছে লক্ষ্যভেদও করে ফেলেন আর অর্জুন হাতছাড়া হয়ে যায়, এই ভয়ে দ্রৌপদী না বলে উঠেছিলেন তৎক্ষণাৎ? হয়ত এর যে কোনও একটা। কিন্তু একটা কথা তো মানতেই হবে যে না টা বলেছিলেন দ্রৌপদী। তুমি তাই নিয়ে তর্ক করতে পারো, দ্রৌপদীর শ্রেণীচেতনা নিয়ে কটূক্তি করতে পারো — যদিও সেই সময়ের প্রেক্ষিত আর তৎকালীন সামাজিক পরিকাঠামোর কথা ভুলে গেলে চলবে না, তা যতই নিন্দনীয় হোক না কেন এখন, আর এখনও শ্রেণীভেদ যেন কতই দূর হয়েছে–, দ্রৌপদীকে অহংকারী বলতে পারো, তাতে দ্রৌপদীর বয়েই গেছে। এমনকী, কেউ কেউ এমনও বলেছেন, কর্ণ কে অপমান করার ফলেই দ্রৌপদীর নির্যাতন justified, তাতেও দ্রৌপদীর কী বা এসে যায়! দ্রৌপদীর মনে হয়েছে না বলার কথা। তিনি না বলেছেন। সভার সকলের সামনে। আড়ালে না। নিজের অপছন্দ এইভাবে সকলের সামনে স্পষ্ট করে বলার মতো সাহস এখনকার কতজন মেয়ের মধ্যে আছে শুনি? ছেলেদের মধ্যেও আছে কি? সব তো দেখি বিয়ের সময় মা বাপের কথা শুনে সুড়সুড় করে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে। তাছাড়া কর্ণকে না বললে পরে যিনি লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তিনিই যে অর্জুন-ই হতে চলেছেন, তাও তো দ্রৌপদী জানতেন না।
আর অন্তত সেই মুহূর্তে সভার একটি ব্যক্তিও দ্রৌপদীর এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। গোলমালটা আরম্ভ হল বামুনের ছদ্মবেশে অর্জুন-এর সফলতায়। সরাসরি এবার ক্ষত্রিয়ের ইগোতে লাগল। এবং কর্ণের ইগোতেও। কী! আমরা থাকতে ব্যাটা বামুন পাবে এমন রাজকন্যে কে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত