| 19 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

অহংকার : স্বরূপ ও অস্তিত্ব ।। আশিস দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

“আমাদের মধ্যবিত্তদের আর কিছু নেই,কিন্তু একটা জিনিস আছে,অহংকার l যে নীচে পড়ে আছে তারও,যে একটু ওপরে উঠে গেছে তারও l আর সেই ‘অহংকার’ শব্দটাকে আমরা একটু বোধহয় বদলে নিয়ে বলি ‘আত্মসম্মান’, রমাপদ চৌধুরী তাঁর “আশ্রয়” উপন্যাসে এই কথা বললেন। একথা ঠিক যে অহংকার সর্বশ্রেনীর মাঝে বিরাজমান, এ তো গেল তার অস্তিত্বর কথা,কিন্তু তার স্বরূপ টা কি? সর্বময় অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও এই অভিব্যক্তি প্রশংসনীয় নয় একথা বোঝা যায় কিন্তু রাজা উজির থেকে আরম্ভ করে হরিদাস পাল, সবার মাঝেই এই প্রকৃতি অল্পবিস্তর বর্তমান।

 

রাবণের নাকি খুব অহঙ্কার ছিল; অন্তত প্রবাদবাক্য সেই কথাই বলে কিন্তু অহংকার কারই বা কম ছিল! মহাভারতের অর্জুনের বীরশ্রেষ্ঠ বলে যথেষ্ঠ অহংকার ছিল, সৌন্দর্য্যের জন্যে দ্রৌপদী কম অহংকারী ছিল না। পৌরুষ,ন্যায়পরায়ণতা,সততা ইত্যাদির জন্যে কর্ণের মধ্যেও অহংকার ছিল। এরপরেও কর্ণের মধ্যে ছিল বঞ্চনার বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে থাকার অহংকার; তাঁর অনেক কিছুই নেই,কিন্তু সেই না থাকার জন্যে সে ভিখারি নয়, সে কারো দয়ার প্রত্যাশী নয়, এটাই তাঁর অহংকার। তাহলে অহংকার মাত্রেই যে নিন্দনীয় তা নিশ্চিৎ ভাবে বলা যায় না; যার কিছুই নেই তার থাকে কিছু না-থাকার অহঙ্কার; তার হয়তো পয়সার ঝনঝনানি নেই,চোখ ঝলসানো রূপ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তর ডিগ্রী নেই,তবু দেখা যায় সে অহংকারী। তাহলে তার কিসের এই অহংকার? ওই যে, এটাই হলো কিছু না-থাকার অহংকার। আমার কিছুই নেই,আমার কিছু থাকার লোভ ও নেই-এটাও তার অহংকার l

সমাজে আমরা নিরন্তর নিজেদের মধ্যে একধরনের তুলনা করি; যে হয়তো সবদিক দিয়ে অনেকটাই সফল,সমাজে আর পাঁচজন তাকেই একটু ছোট করে দেখাবার চেষ্টা করি; যে একটু অর্থবান, তাকে আমরা অনেক সময়ে অসৎ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করি, প্রায়শঃই বলতে শুনি আমরা ওর মতো না তাই বড়লোক হতে পারিনি, আমরা ওইরকম নিকৃষ্ট শ্রেনীর নই,আমাদের অনেক মান মর্যাদা আছে। যে বড় হয়েছে সে আসলে বড় নয়, প্রকৃত বড় আমরাই। আসলে এসবই এক ধরনের ঠুনকো অহংকার। রমাপদ চৌধুরী তাঁর “অহঙ্কার” উপন্যাসে এই রকমই একধরনের ঠুনকো অহংকারের গল্প বললেন।


আরো পড়ুন: ভারতবর্ষ । রমাপদ চৌধুরী


“অহঙ্কার” উপন্যাসে সুকমলের অহংকার ছিল যে সে আর পাঁচজনের মতো নয়, সে অন্যদের থেকে আলাদা ; কিন্তু একদিন তার সেই অহংকার ও ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করলোl অফিসের নির্মলেন্দু,যাকে সে কোনোদিনই খুব একটা আমল দেয়নি, সেই নির্মলেন্দু একদিন সরকারী চাকরী ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট কোম্পানীর বড় পদে আসীন হলো। সেদিন সুকমলের মনে হলো নির্মলেন্দু ভুল করেছে, যতোই হোক তার নিজের তো সরকারী চাকরী, নির্মলেন্দুর থেকে সে এখনো অনেক বড়, কিন্তু নির্মলেন্দুর ফ্ল্যাট দেখে, তার ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র দেখে সুকমলের অহংকারে কিছুটা চিড় ধরলো এবং তারপর যখন জানলো যে নির্মলেন্দুর মেয়ে দূরদর্শনের পর্দায় অভিনয় করে এবং তার বেশ নামডাক হয়েছে, তখন সুকমলের সব অহংকার যেন ধ্বসে পড়লো কারন সে নিজে একদিন তার মেয়ে ঋতাকে সিনেমায় অভিনয় করতে দেয়নি। সুযোগ এসেছিল কিন্তু সে সুযোগ হেলায় দুরে ঠেলে দিয়েছে, কারন তখন তার অহংকার ছিল যে তাদের মতো পরিবারের মেয়েরা কোনোদিন সিনেমায় অভিনয় করেনা। আসলে সেদিন সুকমল বোঝেনি যে সমাজ, নীতি, আদর্শ ইত্যাদি চিরকাল একরকম থাকেনা। সবই বদলে যায়, সমাজ বদলে যায়, নীতি, মূল্যবোধ এসব ও চিরদিন এক থাকেনা। সংস্কৃতি কালচার ইত্যাদির ও অর্থ সব কালে এক নয়l

দিব্যেন্দু পালিতের “অহঙ্কার” উপন্যাসে আমরা দেখলাম বিমান মজুমদার ও তার বন্ধু জ্যোতি কে : জ্যোতির স্ত্রী নীপা বিমানের প্রতি আসক্ত কিন্তু বিমান তার আত্ম অহংকার বিসর্জন দিতে পারলো নাl বিমান জ্যোতি আর নীপার মধ্যে অহংকারের এক দূর্লঙ্ঘ্য দেওয়াল থেকেই গেল; আসলে অহংকারের দেওয়াল টপকানো যায় না, শেষ পর্যন্ত হয়তো থেকেই যায় অনড় অটল। এই লেখকেরই “একা” উপন্যাসে আমরা দেখলাম অহঙ্কারের আরেক রূপl শিশির রায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর বড় অফিসার, চার বছরে পাঁচবার প্রোমোশান পেয়ে সে এখন কোম্পানীর প্রথম থেকে তিন নম্বরে অবস্থান করে, সে তাঁর ওপরওয়ালার স্ত্রীর সঙ্গে স্বচ্ছন্দে প্রেম করে, সেই শিশির রায় এর স্ত্রী শ্রীলা একদিন আত্মহত্যা করলো; শিশির রায় এর স্বভাবের জন্যেই শ্রীলা আত্মহত্যা করলো একথা বোঝাই যায় কারন শিশির রায় শ্রীলার বোনের প্রতিও আসক্ত ছিল, একথা শ্রীলাও জানতো। এতসব করেও শিশির রায় এর অহংকারে কোনোদিন চিড় ধরেনি কিন্তু শ্রীলা যেদিন চলে গেল চিরতরে, সেদিন শিশির রায় ও মনেপ্রাণে নিঃশেষ হলোl শেষ হলো তার অহংকার; শ্রীলার মৃত্যুর খবর শুনে মাষ্টারমশাই নীরদ ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন, “যার কিছু নেই তার শুধু বোধ থাকে, আমার কি থাকলো শিশির?” একথা শুধু মাষ্টারমশাই বা দিব্যেন্দু পালিতেরই নয়, একথা হয়তো সবারই। যার কিছু থাকেনা,তার শুধু বোধ থাকে,হয়তো অহংকার ও থাকে কিন্তু সেই অহংকার ও একদিন শেষ হয়,তখন “থাকে শুধু অন্ধকারl’’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত