| 24 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে প্রযুক্তি ও বিস্ময়

আইনস্টাইন ও সময় । জয়জিৎ দে

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“সময়” কি সত্যি ? নাকি নিছক এক কল্পনা?

টাইম, বলতে সর্বপ্রথম কি ধারণা মাথায় আসে?  সময় নিতান্তই কি ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডের বেড়াজালে আবদ্ধ একটা নিরবিচ্ছিন্ন বহমানতা? সময় এমন একটা বিষয় যার ব্যাখা দেওয়া বা যার ব্যাপ্তি নির্দিষ্ট করে দেওয়া এককথায় অসম্ভব। কারন এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড তে যদি কোনো চালিকা শক্তি বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে তা হল সময়… যার সূচনা হয়েছিল আমাদের ব্রহ্মান্ডের জন্মলগ্নে, বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের সাথে সাথে। সেই যে তার পথ চলা শুরু হল এর কোনো শেষ নেই, যতদিন ব্রহ্মান্ড থাকবে ততদিনই সময়ও থাকবে, একমাত্র যদি না কোনো কল্পনাতীত রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোল সম্পূর্ণ ব্রহ্মান্ডকে গ্রাস করে যাকে সুপার অ্যানাইহিলেশন বলা হয়।

কিন্তু সময়ের কি আদৌ কোনো “ফিজিক্যাল” অস্তিত্ব আছে? উত্তরটা অবশ্যই না। আর এখানেই মনে প্রশ্ন আসে সময় কি তাহলে কোনো ভ্রান্তি বা ইলিউশন? এর উত্তরটা বেশ প্যাঁচালো – মানে হ্যাঁও বটে, আবার নাও বটে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী এই ব্রহ্মান্ডে সব কিছুই পরস্পর পরস্পরের সাপেক্ষে ” আপেক্ষিক “, কিছুই ধ্রুবক নয়, এবং সেই তুলনাটাও অবশ্যই সময়ের সাপেক্ষে। তাই এভাবে চিন্তা করলে সময়ের ” সামগ্রিক অস্তিত্ব ” টাই অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ফিজিক্স বলে সময় ” আছে “, এক অনন্ত অব্যাখ্যাত তার অস্তিত্ব – সময় কে পরিমাপ করা যায়, কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই, তাই সময় একটি স্কেলার রাশি। সময়ের সার্বিক ব্যাপ্তির ব্যাখা বিজ্ঞানের দ্বারা একার কম্ম নয়, বিজ্ঞান শুধু সময়কে কার্যকারন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে মাত্র, বরং তার ব্যাখা পেতে গেলে আমাদের পাড়ি দিতে হবে অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স ও দর্শনের আওতায়, কারন যেখানে বিজ্ঞান শেষ হয়, সেখান থেকেই দর্শনের পথ চলা শুরু হয়।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বলে যে স্পেস ও টাইম একে অপরের সাথে যুক্ত অর্থাৎ স্পেস ও টাইমের এক অদৃশ্য সুতোর বুনন বা ফেব্রিক জালক এই ব্রহ্মান্ড কে ধরে রেখেছে। এবার এই স্পেস বলতে শুন্যতা বোঝায়, যা একটা পরম বা অ্যাবসোলিউট ধারণা। পদার্থবিজ্ঞান বলে সময় ও মহাশূন্য অর্থাৎ স্পেস এবং টাইম পরস্পর পরস্পরের সাথে সমান্তরালে বাঁধা রয়েছে একধরণের অদৃশ্য এলাস্টিক সুতোর দ্বারা, ঠিক যেমন সুতো দিয়ে পর পর ফুল জুড়ে মালা গাঁথা হয়, তেমনি। তবে পার্থক্য শুধু এটাই যে এক্ষেত্রে এই মালার বিস্তৃতি অসীম বা ইনফিনিটি, যার ধারণা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা। এই স্পেস ও টাইম একইসাথে সুতোয় বাঁধা পড়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে। এর গতিপথ সর্বদা একমুখী, কোনোভাবেই একে উল্টোপথে চালিত করা যায় না। আমরা তথা সমগ্র ব্রহ্মান্ড একটা অসীম টানেলের মধ্যে দিয়ে এগিয়েই চলেছি তো চলেছি। একে বলা হয় স্পেস টাইম ফেব্রিক। মহাকাশের প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র থেকে শুরু করে সমস্ত এলিমেন্ট তথা ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত এই তন্তুজালে আবদ্ধ। আবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি অনুযায়ী সময় কখনোই পরম স্থিত বা absolute নয় বরং আপেক্ষিক, অর্থাৎ কোনো বস্তু বা ব্যক্তির চলমানতা এবং স্থির মাধ্যম সাপেক্ষে তার দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যতার সাথে তাল মিলিয়ে সময়ও পৃথক পৃথকভাবে নির্দিষ্ট গতিতে অতিবাহিত হয়, কখনো দ্রুত তো কখনো ধীরে। কোনো ব্যক্তি স্পেসে যত দ্রুতগতিতে মুভ করবে আদতে সময়ের সাপেক্ষে সে ততো ধীরে এগিয়ে যাবে অর্থাৎ তার কাছে সময় এক্সটেন্ডেড একটা ‘ অবস্থা ‘ হিসাবে ধরা দেবে। একমাত্র কোনো বস্তু যদি আলোর সমান বেগে ছুটতে পারে, তাহলে তার সাপেক্ষে সময় থমকে যাবে পুরোপুরি। কিন্তু ব্রহ্মান্ডে আলোর গতিবেগই পরম, কোনো বস্তুই আলোর থেকে বেশি বেগে ছুটতে পারেনা, কারন সেক্ষত্রে বস্তুটির ভরের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, সেটা পুরোপুরি পরিণত হবে ফোটন কণার শক্তিতে ( E=mc^2, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুসারে )


আরো পড়ুন: এরিখ গুটকিন্ডকে লেখা আইনস্টাইনের বিখ্যাত গড লেটার বা ঈশ্বর পত্র


১৯২৭ সালে স্যার আর্থার এডিংটন একটি শব্দবন্ধের সৃষ্টি করেন ” দ্য অ্যারো অফ টাইম “, যা পরে ১৯২৮ সালে তার লেখা ” দ্য নেচার অফ দ্য ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড ” বইতে তিনি প্রকাশ করেন। এখানে সময়ের বহমানতা কে একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ প্রদানের চেষ্টা করা হয় – বলা হয় যে যদিও স্পেসের প্রসারের কোনো নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই কিন্তু তাকে যে বেঁধে রেখেছে সেই সময় সর্বদা একমুখী- অর্থাৎ সময় কেবলমাত্র সামনের দিকে বা ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। এডিংটন এবিষয়ে তিনটি প্রতিপাদ্য দেন :

১. সময়ের অগ্রসর সর্বদা একমুখী এবং একে বোঝা ও পরিমাপের আওতায় আনা সম্ভব।

২. সময়ের বহমানতা কে কোনোভাবেই বিপরীতমুখী করা সম্ভব নয়, অর্থাৎ অতীতের দিকে চালনা করা সম্ভব নয়, নতুবা ব্রহ্মান্ডে ” অস্তিত্ব ” বলে কোনো বস্তুই থাকবেনা।

৩. অ্যারো অফ টাইম সর্বদা তার যাত্রাপথে অগ্রসর হওয়ার সময় সমস্ত বস্তুকে ডিসইন্টিগ্রেট করে, অর্থাৎ পরিবেশে ছত্রভঙ্গ করে ছড়িয়ে দেয় এক সাম্যবস্থায় পৌঁছনোর লক্ষে।

এই তৃতীয় প্রতিপাদ্যটাই সময়ের চরিত্র নির্দেশ করে। সময় তার বহমানতার পথে ব্রহ্মান্ডে রেট অফ ডিসইন্টিগ্রেশনকে বাড়িয়ে দেয় – যাকে তাপগতিবিদ্যা বা থার্মোডাইনামিক্সয়ের পরিভাষায় বলা হয় ” এন্ট্রপি “। যত ব্রহ্মান্ডে এন্ট্রপি বাড়বে, ততই বিভিন্ন এলিমেন্টের ক্ষয়সাধন হবে ও তাদের গঠনগত উপাদানগুলো মহাশুন্যে ছড়িয়ে পড়বে অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা বাড়বে। কিন্তু কোনো উপাদানই সময়ের সাথে সাথে নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারেনা অর্থাৎ পূর্ববর্তী স্থিত অর্ডারে আসতে পারেনা। এর থেকেই বোঝা যায় সময় একমুখী।

তবে বিজ্ঞান সময় নিয়ে যে কিছুটা দ্বন্দ্বে নেই – এমন কথাও বলা যায়না। আদতে ” সময় ” নিজেই আপেক্ষিকতাবাদ আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাঝে বিরাজ করা একটা ধাঁধা। আপেক্ষিকতাবাদের ক্ষেত্রে সময়কে পরিমাপ করা যায়, তাকে কোনো ভৌত কার্যকারন সম্পর্ক নির্ধারণের মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার যেমন করা যায়, তেমনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সময় কে প্রেক্ষাপট ( background ) হিসাবে ধরা যায় মাত্ৰ কিন্তু অনুধাবন করা যায়না ( not an observable )। আবার মানব মস্তিস্কর কাছে সময় মূলত কিছু পরিবর্তনের নজির। আমাদের চারপাশে ঘটে চলা সমস্ত পরিবর্তনশীল ঘটনা তথা মানব শরীরের বয়সজনিত ক্রমবর্ধমান পরিণতির ওপর নির্ভর করে, তাদেরকে পর পর একটা দৃশ্যপটে সাজিয়ে নিয়ে মানুষ সময়ের বহমানতার বিচার করে। (…..” time is encoded in static configurations, which we see or experience subjectively, all of them fitting together to make time seem linear. ” – Julian Barbour )

– অর্থাৎ একটা ব্যাপার পরিষ্কার। বিজ্ঞান ব্যাখা করতে পারুক বা নাই পারুক, সময় ছিলো, আছে আর থাকবে। সময়ের ব্যাখা বিজ্ঞান ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ অনুধাবন করে উঠতে পারে কিনা, সেই উত্তরটাও সময়ই দেবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত