| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: আত্মকেন্দ্রিক । ইকবাল তাজওলী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ পাঠ করার পর তাবাসসুম মৌয়ের আনন্দে খুব টেনশন হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই টেনশনে এখনই হার্টঅ্যাটাক বা ব্রেনস্ট্রোক করে যেতে পারে। অথবা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়াও বিচিত্রও নয়!
আনন্দে যে হরিষে বিষাদ হয়,এই তো মাস তিনেক আগে নিজ বাসাতে বসে সেটা তাবাসসুম তার সমবয়সী চাচাতো ভাইয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে! বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের বাসায় এসে ভোরবেলায় আর্জেন্টিনা ভার্সাস ব্রাজিলের খেলাটি উপভোগ করছিল তার ছোটোভাইয়ের সঙ্গে আর্জেন্টিনা সাপোর্টার চাচাতো ভাইটি। খেলাটিও দারুণ উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার মেসি যেই না নিজ দলের পক্ষে প্রথম গোলটি হানল, অমনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গোল গোল বলে চাচাতো ভাইটি একেবারে চিৎপটাং হয়ে গেল। তারপর, চিৎকার-অ্যাম্বুলেন্স-হাসপাতাল। সুস্থ হতে হতে হাজার পঞ্চাশের ওপর টাকা নাকি বের হয়ে গেল বড়োচাচার!

হলে হোক ব্রেনস্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক বা প্যারালাইজড। কোনো চিন্তা নেই তাবাসসুমের। নো চিন্তা ডু ফুর্তি। ইকবালের তো একটা গতি হল। টিউশনিতে আর কাহাতক চলা যায়! যাক, তিন ফাঁড়ার এক ফাঁড়া তো মাইনাস হল! আর দুই ফাঁড়া যে কী, তা তাবাসসুম নিজেই জানে না! জানারও দরকার নেই। প্রেমিকের যে সবকিছু ইনটু টু জানতে হবে, সে রকম মেয়ে নয় তাবাসসুম। আর যে প্রেমিক তার সবকিছু প্রেমিকাকে জানিয়ে দেয়, তার কোনো পারসোনালিটি নেই। এরূপ পারসোনলেস লোকের সঙ্গে আর যেই থাকুক, তাবাসসুম নেই। আর না হলে আপন ফুফাতো ভাই আসিফ সেই ক্লাস ফাইভ থেকে চন্ডিদাসের মতো বড়শি বেয়েই গেল, বেয়েই গেল। তাবাসসুম পাত্তাই দেয়নি। চিঠি দেয়া, উত্তর না পেয়ে কান্নাকাটি করা থেকে শুরু করে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে কত কিছুই না লিখল আসিফ! হু! তাবাসসুম তাও গলেনি!

সুন্দরী বিউটিকুইন হলে এক মোবাইলেই কী যে জ্বালা, তাবাসসুম ছাড়া কে-ইবা বেশি জানে! ভাগ্যিস এখন ছোটোচাচা কানাডা যাওয়ার আগে ফার্মেসি কাম ফ্লেক্সিলোডের দোকান দিয়ে টাইমপাস করছে, তাই কিছুটা রক্ষা। ছোটোচাচার ফার্মেসি থেকে মাসে একবার বিকাশে বেশ খানিক টাকা ভরিয়ে নিলেই হল। ব্যাস, নো চিন্তা।
অবশ্য তাবাসসুমের এমনিতে কোনো চিন্তা নেই; ভাবনাও নেই। আর থাকার কথাও নয়। বাবা এখনও পূর্ণদমে সক্রিয়। বছর দুয়েক আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে শহরের মেইনস্ট্রিটে বড়ভাইয়াকে নিয়ে বেশ বড়ো-সড়ো ফার্মেসি দিয়ে বসেছেন। ব্যবসাও দিব্যি হচ্ছে। আর মা ও সরকারি চাকরি করতেন। এই তো তাবাসসুমের সরকারি চাকরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ মোটা অঙ্কের গ্র্যাচুয়িটি আর লামগ্র্যান্ট নিয়ে অকালে অবসরে যেয়ে বাসায় অবস্থান করে ঘর-সংসারে মন দিয়েছেন মা।

ভাবনা ছিল ইকবালকে নিয়ে। যাক, সে ভাবনারও অবসান হতে যাচ্ছে। পাক্কা আড়াই বছর ধরে ইকোনোমিক্সে অনার্স-মাস্টার্স করে একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছিল ইকবাল। সে শুধু পরামর্শ দিয়েছে ধৈর্যহারা না হতে। আজ হোক কাল হোক, গতি একটা হবেই। তার শুধু ভয় ছিল, শেষে না ধৈর্যহারা হয়ে ইকবাল রণেভঙ্গ দিয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লাগে। সারা দেশের মানুষ সুযোগ পেয়ে আমেরিকা-কানাডা চলে গেলেও সে কখনও বিদেশবিভুঁইয়ের জন্যে উতলা হবে না, যাবেও না। এটি তার কমিটমেন্ট। বিদেশের স্বর্গ তার দরকার নেই। নিজ আকাশ, নিজ বাতাস, নিজ ভাষা, নিজ সংস্কৃতি-কালচার কোনো কিছুই হারাতে ইচ্ছুক নয় সে। তার মায়ের কান্না এই সেদিনও প্রত্যক্ষ করেছে সে। মা তো এখনও হাহাকার করেন, কাঁদেন। বলেন, কেন যে বাবা-মা-ভাই-বোন সকলের মত অগ্রাহ্য করে সকলকে ছেড়ে খালাতো ভাইয়ের হাত ধরে এদেশে চলে এসেছিলেন! মায়ের তো আকাশ-বাতাস-ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম কোনো কিছুই বদলে যায়নি! কেবল দেশ বদলে গিয়েছিল। আর তাবাসসুম নিজ আকাশ-বাতাস-ভাষা-সংস্কৃতি সবকিছু ঠিক থাকলেও মায়ের মতো দেশ বদল করতে ইচ্ছুক নয়।
যাক, তাবাসসুমের টেনশনটা দূর হয়ে গেল।

এবার মনে হয় আটকে রাখা যাবে না ইকবালকে। নিজের দেয়া ওয়াদা বলে কথা! নিজের দেয়া ওয়াদা তো তাকে পূরণ করতেই হবে। আর কত ধৈর্য ধরবে ইকবাল! বছর চারেক ধরে ধৈর্য ধরতে ধরতে ওর মনে হয় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে ভাবতেই তাবাসসুমের চোখেমুখে আনন্দের একটা ঝিলিক খেলে গেল। তাবাসসুম জানে তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যাওয়া মানে বিপদকে আ তু তু করে নিজ দোরগোড়ায় ডেকে নিয়ে আসা! একবার নয়, দু-তিনবার আনন্দের ঝিলিক দিয়ে বিপদকে সে দোরগোড়ায় ডেকে নিয়ে এসেছিল।

অন্যদের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল। কিন্তু, বাসা লাগোয়া প্রতিবেশী ফরিদের কথা সে কী করে ভুলে! বাবার রক্তের সম্পর্কের ফুফাতো ভাই হওয়ায় ফরিদ চাচাকে সে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল। তার ডাক শুনত; ফাইফরমাশ খাটত। তার আহ্বানে লাগোয়া মুদি দোকান থেকে পান-সিগারেট-দিয়াশলাই এগুলো এনে দিত। আর সেই চাচা-ই কিনা একদিন তার বুকের চারিদিকে হাত বুলাল! তখন তার বয়স-ই বা কত? দশ কী এগারো। আর বুড়া খাটাশ তখন সত্তোরোর্ধ! এই বুড়া খাটাশের হাত থেকে তার বাসার কমবয়সী কাজের মেয়ে একটাও রেহাই পায়নি! কত গুণগুণ কানাকানি শোনা হয়েছে তার!

তাবাসসুমের মুখ হতে আনন্দের ঝিলিকটা সরে গেলেও মুচকি হাসিটা তার মিইয়ে গেল না। ইদানীং ইকবাল বেশ অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে। মাঝেমধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে দেড়শো গজ সীমানার মধ্যে উঁকিঝুকি মারারও কইসিস করছে। তাবাসসুম বাধা দিতে গিয়েও তেমন একটা বাধা দেয় না। আজ হোক কাল হোক নিজ বর-ই তো হবে। আর একটু-আধটু খেলা-নেলা কার না ভালো লাগে। প্রতি সোমবার অথবা মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর স্টেশন রোড থেকে যখন ইকবাল রিক্সায় করে আম্বরখানা-শাহি ঈদগাহ রোড ধরে টিলাগড় পর্যন্ত তাবাসসুমকে সঙ্গ দেয় তখন কনুইয়ের নড়াচড়া বেশ টের পায় তাবাসসুম। কিন্তু নিজ কনুই দিয়ে গুতো মেরে সতর্ক করে হলুদ কার্ড দেখালেও এটা তো সত্য আনন্দে, জৈবিকসুখে আপ্লুত হয়ে যায় তাবাসসুম।

ইস, বিপাশা যদি আজ বেঁচে থাকত। ঢিল দিলে কীভাবে জোড়েসোড়ে পাটকেলটি নিক্ষেপ করতে হয় বিপাশা বেশ সুন্দর করে বলত আর হাসত। বিপাশা তার ক্লাসমেট ছিল। বিপাশা, জুঁই, রুজিনা, আতিয়া, সুয়াদা, খাইরুল, অরিন্দম স্মৃতিতে থাকা কত সব আদুরে নাম। সকলেই তখন মখন মেমোরিয়েলের ছাত্র-ছাত্রী। আর বিপাশা কী একটা অজানা কারণে অরিন্দমকে একদমই সহ্য করতে পারত না। দেখলেই বলত,‘ ওই দেখ, দেখ, আচুদাটা আসে। হেন্ডেল মারতে মারতে শরীরের যে কী অবস্থা করছে! আমি নিশ্চিত ওর আর…।’ জুঁই, রুজিনা, সুয়াদা আর আতিয়া-র তো সে সময় হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড় হত! হাসতে হাসতেই একটু মুখ খুলে রুজিনা জিজ্ঞেস করত, ‘তুই বুঝলি কী করে?’ বিপাশা বলত,‘ আচুদাদের হাঁটার সাইজ আর গাল দেখলেই বোঝা যায়।’ শুধু অরিন্দম না, অবিবাহিত তরুণ হান্নান স্যারকে দেখলেই বিপাশা হট মন্তব্য করত! তবে তার হান্নান স্যারকে নিয়ে মন্তব্যগুলো একান্তে কেবল তাবাসসুমকেই সে শেয়ার করত। তাবাসসুম হাসত আর লুটোপুটি খেত।
তখন তাবাসসুমরা কেবল নাইনে উঠেছে। ক্লাসও তেমন ফুল সুইংয়ে শুরু হয়নি। অ্যানুয়েল স্পোর্টসের কারণে সর্বোচ্চ সেকেন্ড পিরিয়ড, আর না হলে ইনডোর ট্রায়াল থাকলে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ক্লাস অনুষ্ঠিত হত। সেই সময় একদিন বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ দিন দশেক বাদে সুয়াদা ক্লাসে এসে রুজিনা , আতিয়া আর জুঁইকে বলল, ‘শ্বশুরবাড়ি থেকে এলাম রে। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। থাক, কাউকে বলিস না।’ কিন্তু বললেই কি হল? মেয়েরা কি আর কানাকানি থেকে বিরত থাকে? এককান-দুইকান হয়ে মুহূর্তে মেয়েমহলে শতকান হয়ে গেল! হায়রে মেয়েদের কী কানাকানি! সেদিন ইনডোর গেমের ট্রায়াল থাকলেও ক্লাস নাইনের মেয়েরা কেউ আর ট্রায়ালেই গেল না। দরোজা লাগিয়ে হা হা, হি হি করে লেট নাইট শোর অভিজ্ঞতা একদম খেলোয়াড়ের মুখ থেকে শুনে তারপর ক্ষান্ত হল।

এই বিপাশাটা এইটে এসে তাদের সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল। নাইন থেকেই মেয়েদেরকে গল্প-হাসি-আড্ডায় পুরোপুরি সে জমিয়ে রাখতে পারত। ছেলেরাও ওর সঙ্গে কথা বলার সময় একবার কী দুবার করে কড়ায়গন্ডায় হিসেব করত! তারপর যখন কথায় আর পেরে উঠতে পারত না, তখন ঠোঁট দিয়ে বিড় বিড় করে মুখসিনাল স্বগোতোক্তি করে দ্রুত কেটে পড়ত।

সেই বিপাশাই কিনা এসএসসি দেয়ার প্রাক্কালে একদিনের ডায়রিয়ায় লবণ-পানি খুইয়ে ধরাধাম ত্যাগ করে বসল! হায়রে বিপাশা, স্যালাইন খেলে তোর কী হতরে বোন! কেন তুই স্যালাইন খেলি না, সঠিক সময়ে হাসপাতালে গেলি না!
এবার তাবাসসুমের মোবাইলে আবার একটি ম্যাসেজ ধেয়ে এল।
তাবাসসুম আজ অফিসে যায়নি। যায়নি বললে কথাটা সত্যি হল না। মায়ের কারণে অফিস কামাই করতে সে বাধ্য হল।

গোসল-টোসল সেরে রেডি হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মায়ের কাছে ছোটো ফুফির ফোন আসায় মায়ের নিমিত্তেই একদিনের নৈমিত্তিক ছুটির জন্যে বসকে ফোন করে ছুটি মঞ্জুর করতে রিকোয়েস্ট করতে হল তাকে। আর না হলে সহজেই রিকোয়েস্ট করার মেয়ে নয় সে। এক বছরের এই চাকরি জীবনে এই প্রথম সে বসকে ফোন করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে তারপর হাম্বল রিকুয়েস্ট করল। আর না হলে এত সহজেই গলে যাওয়ারও মেয়ে নয় সে। কেউ সামান্যতম উত্যক্ত করলে সাতঘাটের পানি খাইয়ে তারপর শান্ত হওয়ার মেয়ে সে।

সেকশন অফিসার আবিদ আলি হারে হারে টের পেয়ে কী করলাম রে, কী করলাম রে গোঙাতে গোঙাতে জেলের ভেতর এখন দিন গুজরান করছে। তখন তাবাসসুম এই অফিসে কর্মরত ছিল না। ফিনান্সে অনার্স কমপ্লিট করে উচ্চ শিক্ষার একটি প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টারের দফতরে সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিল। সেই সময়ে তারই সঙ্গে যোগদানকারী সেকশন অফিসার তনিমা বটব্যালের দু-তিনদিনের অনুপস্থিতির সুযোগে রসের কথা বলে আবিদ আলি তার নিতম্ব স্পর্শ করে অন টেস্ট হিসেবে টেস্টিং করেছিল বলে তাবাসসুমের ধারণা। তাবাসসুম বসে থাকেনি, সঙ্গে সঙ্গে ধারণা গুড়িয়ে দিতে জুতো খুলে জবাব দিয়েছিল এবং কতৃপক্ষের অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও মাস তিনেকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কোর্টে মামলা দায়ের করে তারপর বাসায় ফিরেছিল।

এই হল আমাদের তাবাসসুম মৌ। আর তার ছোটো ফুফি তো সইতে মরা, মানে লজ্জাবতী লতা। পান থেকে চুন খসলেই ছোটো ফুফির ডাকাডাকি-কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। আজ অবশ্য পান থেকে তাঁর চুন খসে পড়েনি। কান্নাকাটিও শুরু হয়নি। তবুও মাকে যাওয়ার এন্তেজাম করতে হল। ননদের ডাকে সাড়া দিতে হল। বড়োলোকের বউ বলে কথা। আজ মা হাইয়েস মাইক্রোয় গেলেন। এর আগে আরেকদিন পাজেরোয় গিয়েছিলেন। মিনিট পনেরো-বিশের যাত্রায় কী আলিশান কাজ-কারবার! আর হবেই না বা কেন! ইমতিয়াজ ভাই, ইস্তেকবাল ভাই, আর ইসতিয়াক ভাইয়ের মা বলে কথা! ইমতিয়াজ ভাই জেনেভায় জাতিসংঘের একটি দফতরে মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ইস্তেকবাল ভাই ইংল্যান্ডের একটি ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হিসেবে, আর ইসতিয়াক ভাই কর্ণেল ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্কে লেকচারার হিসেবে কাজ করছেন। তিনজনই দেশ থেকে এইচএসসি দিয়ে বৃত্তি নিয়ে ইংরেজির বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করে তারপর বিদেশ যাত্রা করেছেন। এই ইসতিয়াক ভাইয়ের সঙ্গে শৈশবে বেশ আনন্দের সঙ্গেই তার জামাই-বউ, জামাই-বউ খেলা হত। ইসতিয়াক ভাই জামাই আর সে বউ সাজত। ছোটো ফুফি মনে হয় ওই সময় কথা একটা আদায় করে নিয়েছিলেন। মা ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিমরাজি হয়েছিলেন সে সময়।

তাবাসসুম তার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলাও তো কম হয়নি। যাক, একদিক দিয়েই ভালোই হল। সইতে মরা ছোটো ফুফির কারণে ওয়াদা পূরণের সুযোগ একটা এসে গেল। আজ বাড়িতে কেউ নেই। বড় ভাইয়া তো ফার্মেসিতে, আর সদরুল তো ইউনিভার্সিটিতে। যাক আজ খেলা হবে। খেলা হবে। আজ তাবাসসুম জোড়েসোড়েই পাটকেলটি নিক্ষেপ করবে। মিয়ার বেটা মিয়া দেখি কেমন খেলতে পারে। এতদিন তুমি ট্রায়াল দিয়েছ। আজ দেখি হিটে কেমন পারফর্ম কর। বলতেই বলতেই তাবাসসুম ০১৭১২০৫১৫… নম্বরে নক করল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মোবাইলটি জানাল, সরি, এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়।

ধীরে ধীরে তাবাসসুমের রাগ উঠতে শুরু করেছে। একবার রাগলে মাথা ঠান্ডা করতে তাবাসসুমের ঘণ্টা চব্বিশেক সময় লেগে যায়। আর এ তো অন্যরকম রাগ। শরীরের সর্ব অঙ্গের রাগ! এ রাগ তো সাতদিনেও কমবে না। নাকি ইকবাল সিনথিয়ার দরবারে আবার আনাগুনা শুরু করে দিয়েছে! নটীটাকম হুজ্জতি না! একবার তাবাসসুম কায়দা করে ইকবালের মোবাইল থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিয়ে কী বেইজ্জত-ই না করল নটীটাকে! সেই সময় সে একদম বিপাশার মুখ ধারণ করেছিল! তাও নটীটার শিক্ষা হল না। বদমাশ নটী।
তাবাসসুম আবার ইকবালকে রিং দিল। কিন্তু সেই থোড়া- বড়ি- খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়! কাঙ্খিত নম্বরে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়।

তাবাসসুম হট টেম্পারড হয়ে গেল। হট টেম্পারড হলে তার স্বাভাবিক ভাষা জ্ঞান তাল-লয় হারিয়ে দ্রুত পুরোপুরি মান ভাষার রূপ ধারণ করে কুলীন বাঙালি সমাজের মুখের ভাষায় রূপান্তরিত হয়। তখন নিজেকে তার আর সাধারণ মেয়ে বলে মনে হয় না। মনে হয় একজন স্মার্ট- রুপসী তরুণীর সঙ্গে এক নোবেল জয়ী বাঙালির কথোপকথন-সাক্ষাৎকার সরাসরি বিভিন্ন নেটওয়ার্কে সম্প্রচারিত হচ্ছে। ‘আর ফোন দিস বেটা! দেখি তোর ফোন কে রিসিভ করে? সেদিন তোকে পাত্তা না দিলেই ভালো ছিল। সিনথিয়ার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতি, স্বপ্ন দেখতি।’
স্বগোতোক্তি করতে করতে তাবাসসুম তার মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ পড়তে শুরু করল।
ইকবাল লিখেছে,‘ ‘আজ আমি ভীষণ ব্যস্ত ডার্লিং। আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করাই ভালো। আজ আমার বলা যায়, হোল টাইম মোবাইলের রিংটোর অফ থাকবে। সে পর্যন্ত বাই বাই।’
তার সব রাগ গিয়ে মায়ের ওপর জমা হল।
মা যদি খামোখা ছোটো ফুফির বাড়ি না যেতেন তাহলে তাকে ছুটি নিতে হত না, আর এই দুর্গতিতেও পড়তে হত না।
তার স্বগোতোক্তি বেড়েই চলল।
‘মা টা যে কী! সকলকে তাঁর ডিস্টার্ব দিতে হবে। জাত চেনাতে হবে। সালাউদ্দিন আহমদ রাজ বড় ভূইয়ার মেয়ে তিনি। আর মা তাঁর বিলাতুন বিবি বড়লস্কর! বাবা তোমাকে ভালোভাবেই চেনে গো মা। একদিন রাগ করলে চার-পাঁচ দিন যে হাঙ্গার স্ট্রাইক কর তা সকলেই জানে। বাবা তো তোমাকে আরও হাড়ে হাড়ে হাড়ে চেনে। একবার তো বাবাকে কী খেলাটাই না তুমি দেখিয়েছিলে।’

তাবাসসুম আর এগোলো না। গর্ভধারিণী মা বলে কথা। সারাটা জীবন স্বজন বিহীন হয়ে কাটিয়েছেন মা। দুঃখ-বেদনা শেয়ার করার মতো একজন স্বজনকেও এ তল্লাটে খুঁজে পাননি মা। খালাতো ভাইবোনেরা সেই কবে বেয়াই-বেয়াইন হয়ে গেছে! আর খালাও খালা থাকেননি। শাশুড়ি বনে গেছেন। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই তাবাসসুমের রাগের টেম্পারেচার কমে একেবারে স্বাভাবিকের পর্যায়ে নেমে এসে দাঁড়াল।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিনিট ত্রিশেক আগেও শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ালেও আকাশ ঘন-কালো হওয়ার কোনো লক্ষণ ছিল না। কিন্তু এখন মুষলধারে বৃষ্টি ঝর ঝর করে ঝরছে। যেন নিজের সব কান্না উগড়ে দিচ্ছে। তাবাসসুম তাও সংকল্পবদ্ধ হল।
এবার-ই শেষ। যার কথা আর কার্যকলাপে কোনো মিল নেই, তার কোনো মূল্য এ সমাজে নেই। এক কথায় এই সমাজ তাকে বাউটা-থুবলা-বইতল নামে অভিহিত করে। তারপর এই নামেই হাটে-মাঠে-ঘাটে সব জায়গাই ডাকে। তাবাসসুম কোনো বাউটা, থুবলা আর বইতলের সঙ্গী হতে আজীবন তো দূরের কথা, সাময়িক সময়ের জন্যেও ইচ্ছুক নয়।

বছর পাঁচেক পরের ঘটনা।
তাবাসসুম আমেরিকার নিউইয়র্কে সুখেই দিন অতিবাহিত করছে। তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এবং উচ্চতর শিক্ষা সমাপ্ত করে সে এখন পিএইচডির জন্যে জোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে। মা, বাবা আর ভাই ছাড়া কারো সঙ্গেই তার তেমন আর যোগাযোগ নেই। আর তার ভাবনার মধ্যে নিজ আকাশ, নিজ বাতাস, নিজ ভাষা, এমনকি নিজ দেশও নেই। বড়ো আত্মকেন্দ্রিক সে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত