| 20 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

আধুনিক কবিতার সমস্যা । আহসান হাবীব

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

‘আধুনিক কবিতা’ মানে আধুনিক কালে বা এ কালে লেখা কবিতা—এ রকম মন্তব্য করে মাঝে মাঝে ভুল বোঝাবার চেষ্টা হয়। এটা অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা উদ্দেশ্যমূলক, যাই হোক, কথাটা সত্যি নয়। আধুনিক কবিতা অবশ্যই আধুনিক কালে লেখা; তবে সেজন্যেই নয়, আধুনিক কবিতা চরিত্রেই আধুনিক।
তাই যদি না হতো, তবে পাঠক সমস্যার প্রশ্ন উঠতো না—যদি না সামগ্রিকভাবেই একালে কবিতার পাঠক কমে যেত। যে কোনো কবিতারই পাঠক সংখ্যা কম এ উপলব্ধি কোথাও আজ অনুপস্থিত নয়, অথচ অনেকেই সতর্কতার সঙ্গে সে-কথাটি এড়িয়ে গিয়ে সরাসরি দোষী করেন আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতাকে।
লেখককে যেমন সৎ লেখক হতে হয়’ তেমনি পাঠককেও হতে হয় সৎ পাঠক। সে যাকগে, দুর্বোধ্যতার কথা উঠেছে, এটা অস্বীকার করা চলে না; কিন্তু লক্ষ করা হয়নি যে, সরাসরি অবোধ্যও কেউ বলছে না। এই দুবোর্ধ্যতার মূল কারণ খুঁজে পেলে সমস্যার সমাধানের পথও একটা পাওয়া যেতে পারে। অবোধ্য মানেই অর্থহীন; কিন্তু দুবোর্ধ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যা আপেক্ষিক-বোধ্য, তবে তা বুঝবার জন্যে কিছু আয়াস স্বীকার করতে হবে। দুর্বোধ্য বলে এক কথায় আধুনিক কবিতাকে উড়িয়ে দিয়ে যারা রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত, নজরুলের নাম করেন বিগলিত কণ্ঠে, তাঁরা তাঁদের কবিতাওযে সত্যি সত্যি বোঝেন বা সহজে বোঝেন এমন উদার বিশ্বাসের কোনো কারণ নেই। তবে সত্যি সত্যি যাঁরা কবিতার পাঠক এবং সমঝদার তাঁরাও যখন আধুনিক কবিতায় আপত্তি তুলতে চান, তখন স্বীকার করে নিতে হয় দুর্বোধ্যতার অস্তিত্ব; আর তাই বলছিলাম, এরই মূল কারণটি খুঁজে বার করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে।
সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিসত্তার কোথাও স্থিরতা নেই, প্রশান্তি নেই। জটিলতা, নৈরাশ্য আর বিভ্রান্তি দুশ্চর অন্ধকারের মতো মানুষের সামনের পথ ঢেকে রেখেছে। যে-জীবনভঙ্গি থেকে ক্লাসিক-শিল্প একদিন তারদেহ এবং আত্মার রস গ্রহণ করেছিলো, অনেকের জীবন থেকে সেই ভঙ্গি, জীবনের সেই পদ্ধতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। যদিও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত সমাজই এই বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থার প্রধান শিকার তবু আক্রমণের বেলায় তারতম্য ঘটেছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। বুদ্ধি এবং অনুভবে এই সমাজের যাঁরা প্রথম সারিতে, আক্রমণটা স্বাভাবতই তাঁদের ওপরে হয়েছে সরাসরি এবং যেহেতু শিল্পীর জন্ম এই সারি থেকে সুতরাং তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে—তাঁর কাহিনী, তাঁর কাব্য তাঁর চিত্রে যুগের সমগ্র নগ্নতা সমস্ত বিকৃতি চিত্রায়িত হওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। অনুভবের তীক্ষ্নতা আর বুদ্ধির প্রখরতায় কবি তাঁর কবিতায়, এখানে কবিতার কথাই বলি, এই যুগসন্ধির সমগ্র অবয়বকে বারবার খ- খ- করে দেখতে চেয়েছেন—শব-ব্যবচ্ছেদের সতর্কতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছেন।
এখন প্রশ্ন, যে-শ্রেণীতে কবির জন্ম, সেই শ্রেণীরই পাঠক তাঁর লেখা বুঝতে পারছেন না—মানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কবির লেখা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পাঠক বুঝতে অক্ষম এমন দুর্ঘটনা কেন ঘটলো—চরম বিভ্রান্তিই এর কারণ। কবি যে জটিলতার মুখোমুখি হয়ে তাঁকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখে নিতে চান, পাঠক অন্তত বেশির ভাগ পাঠক, সেই জটিলতাকে এড়াতে চান, এক পুরাতন জীবনভঙ্গির অক্ষম আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখে—উটপাখির চরিত্র তাঁর।
সারল্য নেই—কিন্তু সারল্যের দিকে একটি মারাত্মক প্রবণতা আছে। ফলে নতুন, যেহেতু কেবল নতুনই নয় কিছুটা দুরূহও, সুতরাং ভয় আছে তার মুখোমুখি হওয়ার। যাকে কখনও আগে দেখিনি, তার পরিচয়টি জেনে নিতে হয়; কিন্তু যদি পরিচর্যার দাবিকে আমার ভয় থাকে, অবশ্যই বলবো—এ আমার কেউ নয়, একে চিনিনে।
শুধু কি তাই? আধুনিক কবিতার শত অপরাধ স্বীকার করেও সান্ত¦না কোথায়? আসলে কবিতার যাঁরা সত্যিই ভক্ত তাঁরা এমন মারমুখী নন; তাঁরা নিশ্চয়ই করেন, সমাজের—প্রবহমান সমাজের দেহমন জুড়ে যে কবির আত্মা, আর দৃষ্টি ব্যাপ্ত, তাঁর হৃদয়ের উৎসার কখনো উদ্ভট কিছু হতে পারে না।
তাই বলতে চাই, আধুনিক কবিতার পাঠক-সমস্যা আসলে কবিতার পাঠক-সমস্যা। সাধারণ পাঠক-সমাজে যে পুরাতন প্রীতি ও প্রবণতার উল্লেখ করেছি তারও নিরসন সম্ভব সাধারণভাবে কবিতার পাঠক বাড়িয়ে।
প্রশ্ন হবে, সেটা কি করে সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে কেবল পাঠকই নন, পাঠক, লেখক এবং প্রকাশক এমনকি সাহিত্য-সংস্থা ও সাহিত্য বৈঠকগুলো পর্যন্ত সমভাবে সংশ্লিষ্ট।
এ-কথা মনে করবার কোনো কারণ নেই যে, আমার অভিযোগ কেবল পাঠকদের নিয়েই। আজকের বহু কবি—বহু অক্ষম কবি, কবিতা রচনায় আধুনিকতার আশ্রয়ে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকবার চেষ্টা করেছেন অনবরত। ফলে, পাঠকমহল থেকে, শিক্ষিত পাঠকমহল থেকেও এমন অর্বাচীন উক্তি আমাদের শুনতে হয়েছে যে, একপৃষ্ঠা গদ্য রচনাকে কোনাকুনি ছিঁড়ে নিলেই দু’টি আধুনিক কবিতার জন্ম হয়। তার মানে, আধুনিক কবিতা হচ্ছে ছোট-বড় লাইনে সাজানো কতকগুলো কথামাত্র। তাই, আধুনিক কবির কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন চরিত্রে আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করেন। এবং সে চরিত্র যে দুর্বোধতা বা চিত্রকল্পের নামে নিরেট ধোঁয়া নয় এই সৎ-বিশ্বাসে অটল থাকেন।
‘এক আকাশ রোদ’-এ যে সংশ্লেষ সহজে অনুভবযোগ্য—‘এক হাঁটু রোদ’-এ তা নয়। আধুনিক কেন, অত্যাধুনিক হতেও বাধা নেই যদি সেই প্রবণতা যুগাভিসারে নিষিক্ত হয়। যুগের চরিত্র যদি তাঁর রচনায় যথাযথ বিধৃত হয়—যদি যুগমানসে কিছুমাত্র আলোড়ন সৃষ্টিতে সে সক্ষম হয়।
বলেছি, লেখককে যেমন সৎলেখক হতে হবে, পাঠককেও তেমনি সৎপাঠক হতে হবে। আধুনিক কবিতার ব্যক্তিসত্তাও কাজে কাজেই ব্যক্তিক অনুভূতির যে প্রাধান্য মাঝে মাঝে পাঠককে কিছুটা বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে তার কারণ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে অনুভব এবং এষণার তারতম্য। এ-ক্ষেত্রে লেখকের কাজ যেমন নিজের অনুভূতিকে পাঠকচিত্তে Convey করা বা পৌঁছে দেওয়া, তেমনি যেখানে অনৈক্য বেশি সেখানে পাঠকের প্রয়োজন সতর্কতার সঙ্গে ঐক্য সন্ধান—অন্তত স্বীকৃতির শালীনতা।
যে-যুগে সাহিত্য-শিল্পের পঠন-পাঠন ও চর্চায় অভিজাত দরবারের অধিকার ছিলো একচেটিয়া সে যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে অনেক আগে। তাই লেখক-পাঠকের সমঝোতাই আজকের দিনে সব চাইতে বড় কথা এবং সে সমঝোতা সম্ভব হবে স্বীকৃতির মাধ্যমে—অস্বীকৃতি, অন্তত অসহনশীলতার অহঙ্কার সর্বদা এবং সর্বত্রই অকল্যাণকর।
পাঠকের জন্যে আশার বাণী এই যে, অক্ষমতার ফলে আধুনিক কবিতার অবয়বে যে জঞ্জাল জমে উঠেছে, পাঠকসমাজেরই সতর্ক দৃষ্টির পাহারায় একদিন তার প্রবেশপত্র বন্ধ হবে, পুরনো জঞ্জাল ঝরে যাবে। আর যাই হোক অন্তত শিল্পের ক্ষেত্রে অক্ষমতা কেবল মাত্র ভাঁওতা দিয়ে কোনো কালেই জয়ী হয়নি।—একালেও তা হবে না।
সব শেষে দু’পক্ষকেই অনুরোধ জানাবো পারস্পরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদার একটি সীমান্তে এসে দাঁড়াতে, যেখানে অশ্রদ্ধাও নেই, সন্দেহও নেই এমন কি সাধারণ উদাসীনতাও থাকবে না। আধুনিক কবিতা শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্য হয়ে থাকলে কিছু বলবার নেই। কিন্তু সত্যিই তাই কিনা, সেটাও অন্তত পরখ করা দরকার।
আর কবিকে বলব, তাঁর রুচি, সাংস্কৃতিক মান এবং তাঁর ব্যক্তিচিত্তে প্রজ্ঞার যে আলো, তাকে অক্ষুন্ন রেখেও আঙ্গিক এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যাপারে তিনি পাঠকের কত বেশি কাছে আসতে পারেন, কতটা বেশি আত্মীয়তা গড়ে তোলা সম্ভব তা ভেবে দেখতে।

কবি যদি মননশীলতার বড়াই নিয়ে আঙ্গিকে এবং অভিব্যক্তিতে ক্রমশই একটি দূরত্ব সৃষ্টির পরিকল্পিত সাধনায় নিয়োজিত থাকেন, তাহলে আশা নেই—আধুনিক কবিতার দুর্নাম কোনোদিনই ঘুচবে না।

জীবনবোধ যতই গভীর হয়, চিন্তার স্বচ্ছতা ততই কমতে থকে—অভিব্যক্তি ততই অন্যের কাছে সহজগ্রাহ্য হয়। তাই কবিকেও —বিশেষ করে আজকের আধুনিক কবিকে সর্বদা আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মপরীক্ষায় নিয়োজিত থাকতে হবে।

[রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে ২৬ নভেম্বর ১৯৫৯ তারিখে প্রচারিত]

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত