| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: পালকের বালিশ । ওরাসিও কিরোগা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

ওরাসিও কিরোগা (১৮৭৮-১৯৩৭)

ওরাসিও সিলভেস্ত্রে কিরোগা ফোর্তেসা ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার সুদূর দক্ষিণে অবস্থিত উরুগুয়ে দেশের মানুষ। তাঁকে ‘জাদু বাস্তব’ সাহিত্য ধারার একজন পুরোধা হিসেবে স্বীকার করা হয়। তাঁর গল্পে দৈনন্দিন বাস্তবের সঙ্গে মিশে আছে তাঁর দেশের জঙ্গল ঘেরা মানব সমাজের নানান উপকথা এবং অতিপ্রাকৃত কাহিনির ছোঁয়া।


অনুবাদক : শুক্তি রায়

মধুচন্দ্রিমার গোটা সময়টা জুড়ে কী এক অদ্ভুত জ্বর জ্বর ভাব থাকত আলিসিয়ার। সোনা রঙের চুল, নিষ্পাপ মুখ আর নরম স্বভাবের মেয়েটি নতুন বিয়ে হওয়া বৌ হিসেবে যা যা স্বপ্ন পুষে রেখেছিল, সেগুলি স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল ওর স্বামীর কঠোর স্বভাবের সামনে। তা সত্বেও আলিসিয়া ভালোবাসত ওর বরকে। যদিও রাতের বেলা যখন ওরা রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরত একসঙ্গে তখন কেন যে জানে একটা কাঁপুনি জেগে উঠত আলিসিয়ার শরীরে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর বর চুপ করে থাকত। একটা শব্দও বেরোত না ওর মুখ দিয়ে। আলিসিয়া মাঝে মাঝে ত্যারছা চোরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত ওর বর জর্ডনের সুঠাম চেহারাটাকে। জর্ডনও কিন্তু গভীর ভাবে ভালোবাসত আলিসিয়া-কে কিন্তু সে ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করত না সে।

এপ্রিল মাসে বিয়ে হয়েছিল ওদের। তারপর তিনটে মাস ওরা ভালোই ছিল, শান্তিতেই ছিল।

আলিসিয়া-র ইচ্ছা করত ওর তীব্র ভালোবাসার আকাশটাকে আরো ছড়িয়ে দিতে, ওর কোমল অনুভূতিগুলোকে আরো সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে কিন্তু ওর স্বামীর নিরাসক্ত মনোভাব যেন ওকে লাগাম পরিয়ে দেয়।

ওরা যে বাড়িটায় থাকত, সেই বাড়িটার পরিবেশ অনেকখানি দায়ী ছিল আলিসিয়া-র সর্বক্ষণের শীত শীত অনুভূতির জন্য। বিশাল উঠোনটা একেবারে সাদা… মোটা দেওয়াল, বিরাট বড় বড় থাম আর শ্বেত পাথরের সব মূর্তি… সব মিলিয়ে যেন ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়া একটা কুহকমোড়া চিরশীতের আবহ। ভেতরে হিমবাহের মতো উজ্জ্বল একটা প্রলেপন, একেবারে নিরাভরণ দেওয়ালগুলোতে যেন একটা অস্বস্তিকর শৈত্যের জড়সড় ভাব। ওই বাড়িটাতে একটা ঘর থেকে অন্য একটা ঘরে যাওয়ার সময় পায়ের শব্দের একটা প্রতিধ্বনি দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। যেন অনেক দিনের একাকিত্ব ওই প্রতিধ্বনির মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে।

ওই অদ্ভুত ভালোবাসার বাসাটায় আলিসিয়া কাটিয়ে দিল শরৎকালটা (দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ, এপ্রিল মে শরৎকাল)। ও নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিল বিয়ের আগে দেখা স্বপ্নগুলোর উপর একটা পর্দা ফেলে দেওয়ার। নিজেকে রাজি করিয়ে ফেলল ওই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো দিন কাটাতে।

স্বাভাবিক ভাবেই দিনে দিনে শুকিয়ে যেতে থাকল আলিসিয়া। সামান্য সর্দিজ্বর টানা চলতেই থাকল বেশ কিছু দিন ধরে। একদিন বিকেলের দিকে ওর স্বামী ওকে ধরে ধরে নিয়ে এল ওদের বাগানটায়। আলিসিয়া অপলক চোখে চারদিকটা দেখতে থাকল।

হঠাৎ করেই জর্ডন অত্যন্ত কোমলতার সঙ্গে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আলিসিয়ার মাথায় আর সঙ্গে সঙ্গে আলিসিয়া আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল জর্ডনকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওর পাথর চাপা দিয়ে রাখা ভয় এবং দুঃখগুলো চোখের জলের সঙ্গে না বেরিয়ে গেল, ততক্ষণ আলিসিয়ার কান্না থামল না বরং জর্ডনের সামান্যতম স্নেহ স্পর্শে তার বেগ আরো বেড়ে গেল। কান্না থামার পর দীর্ঘ সময় ধরে আলিসিয়া চুপ করে বসে রইল জর্ডনের বুকে মাথা রেখে।

আলিসিয়া তার পর আর কোনো দিন বিছানা থেকে উঠতেই পারল না। পরের দিন যখন ওর ঘুম ভাঙল, তখন ওর মাথা তুলে বসতেই পারছিল না। জর্ডন ডাক্তার ডাকল। ডাক্তার খুব যত্ন করে পরীক্ষা করলেন আলিসিয়াকে এবং সম্পূর্ণ শারীরিক আর মানসিক বিশ্রামের নিদান দিলেন।


আরো পড়ুন: ফুনেস, তার স্মৃতি । হোর্হে লুই বোর্হেস


বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবু জর্ডনকে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এত দুর্বলতার কারণটা কী? বমি নেই, অন্য কোনো উপসর্গ নেই… যদি কাল ওর ঘুম ভাঙে আমাকে তক্ষুনি ডেকে পাঠাবেন।

পরের দিন যখন আলিসিয়ার ঘুম ভাঙল, ওর অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। ডাক্তারদের সঙ্গে আর এক দফা পরামর্শ হল। যেটা বোঝা গেল, সেটা হল যে খুব খারাপ ধরনের রক্তাল্পতার রোগে ধরেছে আলিসিয়াকে এবং সেই রক্তাল্পতা বেড়ে চলেছে অতি দ্রুত। কিন্তু রক্তাল্পতার কারণটা অধরাই রয়ে গেল। মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল আলিসিয়া। স্পষ্টতই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছিল ও। শোওয়ার ঘরের সব কটা আলো জ্বালিয়ে রাখা হল, বজায় রাখা হল সম্পূর্ণ নীরবতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গোটা বাড়িতে কোনো শব্দ নেই। আলিসিয়া ঝিমিয়ে পড়ে থাকে। জর্ডন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে আলোয় ভরা বসার ঘরটাতে। অক্লান্তভাবে সে পায়চারি করে যায় ঘরের এক দিক থেকে অন্য দিক। গালিচার মধ্যে ডুবে যায় ওর পায়ের শব্দ। এক এক সময় ও শোওয়ার ঘরে ঢোকে। খাটের এক ধার থেকে অন্য ধারে আসা যাওয়া করতে থাকে। আর মাঝে মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে আলিসিয়ার দিকে।

হঠাৎ আলিসিয়া যেন ঘোরের মধ্যে কী সব দেখতে শুরু করল। প্রথম দিকে ওর মনে হত অস্পষ্ট কী সব যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে নীচের দিকে আর তারপর খসে পড়ছে মেঝের উপর। বিস্ফারিত চোখে ও তাকিয়ে থাকে ওর বিছানার দু পাশে টাঙানো দেওয়াল গালিচার দিকে। একটা রাতে ওর চোখদুটো কোনো একটা কিছুর উপর স্থির হল যেন। চিৎকার করে ওঠার জন্য ফাঁক হয়ে গেল ওর মুখ। ওর নাক আর ঠোঁট বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগল।

‘জর্ডন! জর্ডন!’ আলিসিয়া গালিচাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে। ওর সমস্ত শরীর কী এক অজানা ভয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছিল।

জর্ডন ছুটে আসে আলিসিয়ার কাছে। ওর দেখেই ভয়ার্ত চিৎকারে অস্থির হয়ে ওঠে আলিসিয়া।

‘এই তো ! এই তো আমি !’ জর্ডন আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করে আলিসিয়াকে।

আলিসিয়া একবার জর্ডনের দিকে তাকায় তারপর আবার চোখ ফেরায় ওই দেওয়াল গালিচাটার দিকে। কিছুক্ষণ ওই ভাবে থাকতে থাকতে আলিসিয়ার চেতনা ফেরে। জর্ডনের হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে নিজের কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো ও জর্ডনের হাতের উপর বোলাতে থাকে আধ ঘণ্টা ধরে।

বিকারের ঘোরে যে দৃশ্যটা প্রায়ই দেখতে পেতে আলিসিয়া, সেটা হল মানুষের মতোই দেখতে কী যেন একটা ওই গালিচাটার মধ্যে থেকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

আবার ডেকে আনা হল ডাক্তারদের কিন্তু লাভ হল না কিছুই। ওরা চোখে সামনে একটা জীবনকে ধীরে ধীরে নিভে যেতে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারলেন না। মানুষটা যেন প্রতি দিন প্রতি ঘণ্টায় আরো একটু করে রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার কারণটা বোঝা যাচ্ছে না কোনো মতেই। আলিসিয়া পড়ে থাকে নিস্পন্দ; ডাক্তাররা একের পর এক ওর নাড়ি দেখেন তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একসঙ্গে বসেন খাওয়ার ঘরে।

‘নাহ্‌ !’ ডাক্তারদের দলনেতা হতাশ হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘কেসটার কিছু বোঝাই গেল না !’

‘আমরা যদি এভাবে একটু দেখি…’ আর একজন বলেন।

‘কীভাবে?’ জর্ডন টেবিলটা ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘বলুন, কী ভাবে? সেটাই আমার শেষ আশা!’

আলিসিয়া-র জীবনটা বিকারের ঘোরের মধ্যে নিভে আসছিল। যতটা না দিনের বেলা, তার চেয়ে সন্ধ্যার দিকে অনেক বেশি করে জাঁকিয়ে বসত ওর বিকারের ঘোর। সকালে যখন ও উঠত তখন ওর মুখটা মরা মানুষের মতো ফ্যাকাশে মনে হত। ওর চোখে যেন তখনো লেগে থাকত তন্দ্রা। তারপর ধীরে ধীরে একটু সুস্থ অনুভব করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে আসত আর আলিসিয়া যেন তলিয়ে যেন কী এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে। ওর মধ্যে হয় যেন ওর উপর যেন বিশাল ওজনের কী একটা চেপে বসে আছে।

তিন তিনটে দিন এইভাবে চলার পর আলিসিয়া আর বিছানা থেকে উঠে বসা দূরে থাকা মাথা নাড়াতেও সক্ষম রইল না। ওর একদম চাইছিল না যে কেউ ওর বিছানায় হাত দিক। এমনকি বিছানার চাদরটা পাল্টাতেও ওর আপত্তি। ওর সান্ধ্যকালীন ভয় এখন সারাটা দিন জুড়ে ঘুরপাক খায় ওর ঘরের মধ্যে। ওর মনে হয় যে মেঝে থেকে কয়েকটা ক্ষুদে রাক্ষস ওর বিছানার চাদরটা টেনে ধরে পিলপিল করে উঠে আসছে ওর কাছে।

গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে গেল আলিসিয়া। শেষ দুটো দিন সারাক্ষণ কী যেন বিড়বিড় করে গেল ও দুর্বল গলায়। শোওয়ার ঘর আর বসার ঘরের আলোগুলোতেও যেন পড়ল আসন্ন মৃত্যুর ছায়া। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ বাড়িটায় শোনা যাচ্ছিল আলিসিয়ায় একঘেয়ে গোঙানি আর জর্ডনের অস্থির হয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘর পায়চারি করে যাওয়ার পায়ের শব্দ।

অবশেষে মারা গেল আলিসিয়া। বাড়ির পরিচারিকা বিছানা পরিষ্কার করতে এসে হতভম্ব হয়ে গেল ওর বালিশটা হাতে নিয়ে। ‘বাবু!’ নীচু গলায় সন্তপ্ত জর্ডনকে ডাকে মেয়েটি, ‘বালিশের গায়ে যেন রক্তের মতো দেখা যায় !’

জর্ডন ছুটে এসে দেখল বালিশটার মাঝখানে আলিসিয়ার মাথার চাপে একটা গর্ত মতো হয়েছে আর তার দু ধারে যেন ছোট্ট ছোট্ট দুটো শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্তের দাগ !

‘আলোর সামনে আনো তো এটা !’ জর্ডন মেয়েটিকে বলে।

মেয়েটি বালিশটা তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে ওটা ফেলে দেয় মাটিতে আর তারপর ভীত সন্ত্রস্ত চোখে ওটার দিকে তাকায়। ওর গোটা শরীরটা শিউরে ওঠে যেন। জর্ডনেরও মনে হয় কোন এক অজ্ঞাত কারণে ওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে।

‘কী হয়েছে?’ জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করেন জর্ডন।

‘কী ভারি দেখুন !’ মেয়েটি কাঁপা গলায় উত্তর দেয়। তখনো ওর শরীরটা কাঁপছে থরথর করে।

জর্ডন বালিশটা তুলতে গিয়ে দেখে যে সত্যিই সেটা অস্বাভাবিক রকমের ভারি। ওটা নিয়ে খাওয়ার ঘরে যায় জর্ডন। বালিশটাকে টেবিলের উপর রেখে ছুরি দিয়ে ওটা চিরে ফেলে। উপরের পালকগুলো বেরিয়ে আসতেই পরিচারিকা মেয়েটি চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায় ভয়ে, একটা ভয়ার্ত চিৎকার করে ও হাত দিয়ে শক্ত করে ঢেকে ফেলে নিজের মুখটা। বালিশের নীচে জর্ডনের চোখে পড়ে পালকের মধ্যে লোমশ পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা গোল্লা মতো রাক্ষুসে জীব। এত ফুলে গেছে ওর শরীরটা যে ওর মুখটা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

রাতের পর রাত আলিসিয়া যখন ঘুমিয়ে থেকেছে, এই কদর্য জীবটা তার শুঁড় দিয়ে মেয়েটার কপালের শিরা থেকে রক্ত চুষে খেয়েছে। এতটাই সূক্ষ্ম ছিল সেই ফুটো যে ডাক্তারদেরও নজরে পড়েনি। যখন আলিসিয়া উঠতে পারত, হাঁটা চলা করত তখন সারা দিনের জন্য বন্ধ থাকত ওই রক্তচোষার কাজ। পরে যখন আলিসিয়ার আর ওঠার ক্ষমতাই রইল না, তখন তিন দিন তিন রাত ধরে রাক্ষসটা চুষে শেষ করে দিয়েছে আলিসিয়া-র জীবনটাই।

এই রক্তচোষা পরজীবীদের সাধারণত খালি চোখে দেখাই যায় না। শুধু বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এরা রাক্ষুসে আকার নেয়। মানুষের রক্ত খেতে এরা খুবই পছন্দ করে আর মানুষের বালিশে মাঝে মাঝে এদের সন্ধান মেলে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত