| 19 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (শেষ পর্ব) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

নটে গাছ

গন্তব্য স্টেশনে একটা নাকি হলুদ জোরালো আলো থাকে। তাই দিয়ে চিনে নেওয়া যায় তাকে। সে আবার যাত্রা শুরুর স্টেশনও হয়। টার্মিনাস। কিন্তু সেই টার্মিনাস আমার স্মৃতিতে নেই। কী করে কোথা থেকে এলাম কে জানে? কিন্তু গন্তব্য ঠিক দেখতে পাবো, এই প্রত্যয় নিয়ে বসে থাকি। বৃত্ত সম্পূর্ণ না হলে তো যাত্রাও সম্পূর্ণ হয় না।  

রাতে গভীর ঘুমে কখনো দূরাগত রেলগাড়ির শব্দ কানে আসে। কানে? নাকি চেতনসীমায় তা বাজে না। বাজে ভেতরে কোথাও। বুঝতে পারি না। ঘুম ভাঙে না। শুধু রাতের নিজস্ব আলোয় এগিয়ে আসে রেলগাড়ির কামরা। ভেতরে বসে থাকে কত অচেনা মানুষজন !

এক শিশু তার আধফোটা বুলি দিয়ে ক্রমাগত আমাকে ডাকে। আমি বিস্মিত চোখ মেলে দেখি। কে এ? আমাকে এমন আপন করে ডাকে কেন? ও চেনে আমায়? আমি কেন চিনি না? বুকে ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু বোবা কথা মুখ ফুটে বেরোয় না। আমি তাকে দুহাত বাড়িয়ে ধরতে যাই। সে দুষ্টু হেসে অন্য দিকে দৌড় দেয়। আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই।

রাতের অন্ধকারে পৃথিবীর ছবি একরকম। শ্যামল প্রান্তর ঊষর ভূমি পাহাড় পর্বত সাগর কিনার সব এক। কোনো ভেদ নেই। অথচ দিনের আলোয় কত বৈচিত্র্য! আমার মনে হয় অনন্তকাল এই কামরায় উঠেছি আর নেমেছি। স্টেশন বদলায়। কিন্তু ওঠানামা বদলায় না।

ঘুমের মধ্যেই তাই চেনা শব্দে বেঁচে উঠি। এই কামরায় ওই যে যুবক তার পকেটঘড়ি বের করে দেখছে। তাকে তো আমি ভীষণ ভালোবাসি! আমার বুকের সব কটা শিরায় টান পড়ছে যে! আমি দৌড়ে কাছে যেতে চাই। কালো কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে সেই সুদর্শন যুবক কিন্তু আমাকে দেখে না। তার দৃষ্টি আমাকে ভেদ করে চলে যায়। “বুবু, কাশীতে নামবো। তৈরি থাকো”। আমি এবার বুবুর দিকে তাকাই। আঃ! সেই মুখ! সেই ছোট্ট কপাল আর অদ্ভুত সুন্দর আঁকা ঠোঁট! এবার যেন জোয়ার আসে বুকে। আমি থামতে পারি না। ছুটে যেতে গিয়ে দেখতে পাই, সেই শিশু হাত বাড়িয়েছে। সুদর্শন যুবক তাকে কোলে তুলেছে। স্টেশন আসছে। নেমে যেতে হবে।

আমার কান্না পায়। আমি বলতে চাই -মামন! আমায় নিয়ে যাও। ও কাকে কোলে নিয়েছ? ও কে? ঠিক তখনই সেই যুবক মুখ ফিরিয়ে দ্যাখে। কী অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! আমি কাঁদতে থাকি। যুবক ডাকে, বুবু এসো। ও এখন থাক। ওর স্টেশন আসেনি।

আমাকে চিরকালীন বিষাদে আচ্ছন্ন করে নেমে যায় মা মামণ আর আমার পিঠোপিঠি ভাই।

রেলগাড়ি আমাকে নিয়ে চলতে থাকে। আমি স্টেশনের অপেক্ষায় জেগে থাকি। আমার স্বপ্নচেতনা পাথরে দাগ তোলার স্বরে বলে -স্টেশন আসবে। আসবেই।

ভুলোকাকার মতন আমাদের অজস্র ভাড়াটে বাড়ি হল না। ওরা যে সাতপুরুষে ভাড়াটে, ওদের যে পায়ের তলায় মাটি নয়, জল বা হাওয়া থাকে, ওদের যে বাড়ি মানেই চাকাওলা বাড়ি, ক্যারাভান, তা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। আমরা অতটা ভাগ্য করে আসিনি। থিতু হওয়া মানে যে রূপকথার শেষ, এই কথাটা বুঝতে পারলাম যখন দাদু চলে গেল, দিদার আমরা ছাড়া আর কেউ রইল না। আমাদের শেষ ভাড়াটে বাড়ি।

বাবার অবশ্য ইচ্ছে ছিল আবার কোথাও ভাসার। কলকাতা শহরের অন্য কোনো প্রান্তে, অন্য কোনো এলাকা, যা এখনও আমরা জানিনা। বাবা অন্তত নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবে। কিন্তু তা যে হবে না তখনও সেকথা জানা যায়নি। দাদু আর দিদা আমাদের অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল। রাত্রি বারোটা বাজলে দাদুর ভীষণ খিদে পায়। কে খেতে দেবে? কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট লুচি পেলেই মেটে। কিন্তু দেয় কে? ঘরের দরজায় ছোট ছোট আওয়াজ। মা বুঝতে পারে। রান্নাঘরের আলো জ্বলে ওঠে। তৈরি হয় লুচি। দিদার বিরক্ত মুখের সামনে বসে দাদু। বিশাল এক খুরো দেওয়া কাঁসার থালায় নরম আলুভাজার সঙ্গে চারটে ছোট্ট ছোট্ট লুচি। দাদু একদিন সকালে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে বলল, ছোটি, আর ব্রেড বাটার খাওয়া উঠে গেল। আমি একটু অবাক। কেন? অন্য কিছু খাবে তুমি? উঁহু। মাথা নাড়ল দাদু। তারপর বিরাট শরীরটা খাটে নিয়ে ফেলল। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, বাচ্চুকে খবর দে। ছুটলাম বাচ্চুদার কাছে। আমাদের পাড়ায় বাড়ি। সকলের ডাক্তারবাবু হয়ে উঠেছেন ছেলেমানুষ ডাক্তারটি। সত্যি সত্যি সেই ফাল্গুনের সকালে দাদু প্রায় কথা বলতে বলতে চলে গেল। বাচ্চুদা জীবনে প্রথম ডেথ সার্টিফিকেট লিখল। দিদার চোখে এতটুকু জল নেই। পাড়াপড়শি কেউ কেউ বলল, মহিলা মানুষ নয়। কিন্তু দিদার আভিজাত্য শোক প্রকাশের ধরণ পর্যন্ত বদলে দিয়েছিল। আর সেই কারণে, বাবা মা আর ওবাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারল না। দিদা দাদুর ইচ্ছেই সত্যি হল। ছেলে ফ্ল্যাটগুলো ভাড়াটেদের কাছেই বেচে দিলো। আসলে বাড়িঘরের চেয়েও বড় সম্পদ দাদু ও দিদার ছিল। সেই সম্পদ অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে আমাদের নামে লিখেছিল তারা। সে দলিলে কোনো সরকারি সীলমোহরের দরকার পড়েনি।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১৫) । অনিন্দিতা মণ্ডল


এক সোনালি আলোয় ভরা সময়। দিদা সন্ধ্যের হলুদ আলোয় বসে আছে খাটে পা মুড়ে। খাটের পাশের টেবিলে কালো কফির মগ। হাতে চারমিনার। আমার ভেতর ঘরে ঢোকা হয় না। দিদা আলোয় মেলে ধরে, “দেখ ছবিটা। বাবার সঙ্গে আমি।” দিদার চোখে চোখ রাখি। দেখতে পাই অকালে মা হারানো এক শিশু। যার বাবা শ্রীমান অপূর্ব চন্দ। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার ‘অমিত রায়’ যার আদলে আঁকা। সেই অপূর্ব চন্দ, যিনি সুধীন দত্তের জামাইবাবু, যার কথার তুবড়িতে ‘পরিচয়ের আড্ডা’ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। সেই অপূর্ব চন্দ যিনি রবির আলোয় সমুজ্জ্বল এক মানুষ। দিদার নাম অলকা। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। ছবিতে সেই শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক অসহায় পিতা। জিজ্ঞেস করে ফেলি—তোমার বাবা আর একবার বিয়ে করেননি কেন? তোমার দাদু দিদার কি খুব খারাপ লাগত? দিদা হাসে, “জানিনা। নানু দাগো তো খুব মুক্তমনের মানুষ ছিল। ওদের কি খারাপ লাগত? মনে হয় না। আসলে বাবা নিজেই আবার বিয়ের কথা ভাবেনি। বাবার মন এতদিকে এত ব্যস্ত থাকত যে আবার বিয়ের চিন্তা করতেই পারেনি।” তাহলে ওঁর চোখে এত দুঃখ কেন? জিজ্ঞেস করে ফেলি। আমার কথায় বেদনা ফুটে ওঠে। দিদার ফিল্টারলেস সিগারেটের ধোঁয়া হলুদ আলোর আবছায়াকে আরও আচ্ছন্ন করে। দিদা বলে, “বাবা যে আমাদের যথেষ্ট সময় দিতে পারত না, সে ব্যাপারে একটা অপরাধবোধ কাজ করত নিশ্চয়”। আমার মনে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দিদা তো তার বাবাকে বড্ড ভালোবাসে! বাবার সময় কম। তিনি কৃতী মানুষ। তাই ওই মাঝেমধ্যে শ্বশুরবাড়ি এসে কোলে করে সন্তানদের আদর দেওয়া আর দুঃখবিলাসের ছবি ক্যামেরায় ধরে রাখা, এইটুকুই তাঁর পক্ষে অনেক! পরিবারের বাকি মানুষও এভাবেই দেখেছেন। কিন্তু দিদার কি একটুও রাগ হয় না?

আমার চিন্তাকে সরিয়ে দিয়ে দিদা বলে, মানুষের অনেকগুলো মুখ থাকে। তুই হয়ত একটা মুখকেই ধরছিস। কিন্তু তা তো নয়। পিকাসোর ছবি দেখেছিস? কিউবিজম। মুখকে ভেঙেচুরে অজস্র ডাইমেন্সানে মেলে ধরা। একই সঙ্গে একটা মানুষের নানা ব্যক্তিত্ব থাকে। খুব কম জনই এই নানা অস্তিত্বের আপোষ করতে পারে। আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি। কজনের এমন বাবা হয় বল?  

আমার মনে পড়ে। বলি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বইটা দেখলে? এবারের বুকফেয়ারে কিনেছি। উনি নাকি খুব এমন বাউন্ডুলে। থেকে থেকেই কোথায় উধাও হয়ে যান কেউ জানতে পারে না। তারপর যখন ফিরে আসেন, সঙ্গে থাকে নতুন কবিতার পাতা। দিদা হাসে, “ঠিক যতটা উদাসীন হলে কবি হওয়া যায়, বাবা ততটা উদাসীন ছিলেন না”।

টিউব লাইটের সাদা আলো দিদা পছন্দ করে না। চোখে ভীষণ পাওয়ার। আতস কাঁচ দিয়ে পড়ে ছোট লেখা। তবু আলোর রং হলুদ। দিদা বলে, ফরাসীরাই প্রকৃত সভ্য। ইনহিবিশান বস্তুটি ওদের কুষ্টিতে নেই। সেই এক একটি লেখা, কালজয়ী লেখা পড়ায় দিদা। ইংরিজিতে অনুবাদ করা ফরাসী সাহিত্য। তখন জানতে পারিনি। দিদার বাবার মতোই দিদাও এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে। রক্তের উত্তরাধিকারের চেয়ে অনেক জোরালো সেই চেতনার উত্তরাধিকার। দাদু স্নেহের সঙ্গে ইয়াঙ্গনে বয়ে চলা ইরাবতীর জল ধরে রেখেছিল শুধু। সে জলে বাঙালির বর্মাস্মৃতি, আফিমের নেশা আর বর্মী মেয়ের গল্প ছিল। সাহিত্যের লেশ মাত্র ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ছিল, কিন্তু যুদ্ধোত্তর সাহিত্য ছিল না।

আমি আজও হলুদ আলো ভালোবাসি। অবচেতনে আর কী কী রয়ে গেছে তা আর জানা হয়নি। উত্তরপুরুষ হয়ত পেয়ে যাবে সেই সব সম্পদ।    

“মা তোমার মায়ের জন্য মন কেমন করে?” মা হাসে। “করে তো। মায়ের জন্য করে, পাঞ্চেতের দিনগুলোর জন্য করে, বড় মেসোমশাইয়ের জন্য করে, আমার জমজ বোন তৃপ্তির জন্য করে”। আমি অবাক। তৃপ্তি কে? সে কোথা থেকে এলো? নাকি, মা যেমন ভাইকে খেপায় যে তার মা পাহাড়ে থাকে, মা তাকে কুড়িয়ে এনেছে, আর ভাই সকলকে গোল গোল চোখ করে বলে, আমার মা পাগারে থাকে, সেইরকম? আর কেউ না বুঝুক, আমি তো মায়ের চোখ দেখচারুলেই বুঝতে পারি মা ভাইকে বানিয়ে বানিয়ে বলছে। মা আমার দিকে চায়, “সত্যি রে। তৃপ্তি আমার জমজ বোন। যখন আমাদের আট বছর বয়স তখন দুজনের টাইফয়েড হল। আমার বাঁ চোখটা জখম হল। আর তৃপ্তি তো চলেই গেল। কী হল জানিস? তখন তো ও রোগের ওষুধ ছিল না। আমার জ্বর ছাড়ল। সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এইবার তৃপ্তিরও জ্বর ছাড়বে। জমজ কিনা। জ্বর ছাড়ল একদিন সকালে। আমরা খুব দুর্বল। চিঁ চিঁ করে আওয়াজ বেরোচ্ছে। হঠাৎ তৃপ্তির গা ঠাণ্ডা হতে শুরু করল। বাবা ওকে কোলে নিয়ে বসেছিল। মেজদা দৌড়ে ডাক্তার ডাকতে গেল। তৃপ্তি ওর খুব প্রিয় ছিল। ডাক্তার এসে বলল, ও আর নেই। ডেথ সার্টিফিকেট একটু পরে এসে লিখে দিচ্ছে। সকলে ভেঙে পড়েছে। বাবা স্থির হয়ে বসে আছে। ওর শরীরটা বাবার কোলে। হঠাৎ ও চোখ মেলল। বলল—কী হয়েছে? তোমরা কাঁদছ কেন? বাবা তাড়াতাড়ি করে ইশারা করল সকলকে। ও আরও বলল, আমার খুব শাক দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। মা একটিও কথা না বলে রাঁধতে গেল শাক ভাত। এ ঘটনা সকাল আটটার। এগারোটা বাজলে শাক ভাত মুখে দিয়ে তৃপ্তি পাড়ি দিলো। অবশ্য মা তার আগে ওকে বাবার কোল থেকে সরিয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে শুইয়ে দিয়েছে”।

আমার জানা ছিল না এমন কষ্টের কথা। দাদি কি করে সহ্য করেছিল? দাদিকে কখনও জোরে কথা বলতেও শুনিনি। মা বলেছিল, দাদি নাকি টের পেত কেউ চলে যাচ্ছে।

এরকম অনুভূতি মানুষকে প্রস্তুত হতে সময় দেয়। দেয় কি? জানতে পারি না। প্রতিটি মৃত্যুই আমাকে শোক দেয়। মানুষের চলে যাওয়া আমাকে শূন্যতায় ঠেলে দেয়। তাই মৃতের সঙ্গে কথা বলি। তারা তখন আমার কাছে অতি জীবন্ত। আমার পরের সেই ভাইটিও তো এমন করেই স্টেশনে নেমে গিয়েছে। বাবা মা যাবার আগেই। বাবার বিশ্বাস ছিল, ওর সঙ্গে একদিন দেখা হবে।

ভাই যেদিন যায়, অনেকদিন পর সেদিন আমার জেঠু কে মনে পড়ল। মনে পড়ল, ভাই একা নয়। দাদু দিদা জেঠু সবাই আছে। জেঠু এখনও থাকতে পারত তো! ভাইয়ের জন্য কাঁদতে গিয়ে কত কত শোক যে ছেয়ে ফেলল আমায়! কত অপরাধবোধ যে ঢেকে দিল মন! আরও কিছুক্ষণ তো সঙ্গে থাকতে পারতাম। রইলাম না।  

মায়ের সঙ্গে মায়ের জমজ বোন, যে জন্মেছে একসঙ্গে কিন্তু চলে গেল অকালে, সেই মৃত্যুর জন্য কি মায়ের মনে কোনো অপরাধবোধ ছিল? জানা হয়নি আমার। কিন্তু মনে হয়েছে, নিজের অজস্র দুর্ভাগ্যকে হাসিমুখে মেনে নেওয়ার মধ্যে মায়ের এই প্রায়শ্চিত্তের প্রবণতা ছিল।

 মৃত্যু যখন পরিচিত ধরণে দেখা দেয় না, বন্ধুর মতো, একান্ত আপনজনের মতো ঢুকে আসে ভেতরে, তখনই আঘাত বেশি লাগে। কেমন স্থবির হয়ে যায় অন্তর। অনুভূতিহীন। সাড়া পাইনা কিছুতে।

তখন কলেজের দ্বিতীয় বছর। গত তিনটি বছর ধরে আমাদের সহপাঠিনী ছিল রাজশ্রী। এখন আর নেই। আমরা কেউ কথা বলছি না। কয়েকজন মিলে কলেজের দেবদারু গাছের নীচে অন্ধকারে হাত ধরাধরি করে বসে আছি। রাজশ্রী আত্মহত্যা করেছে। রক্ষণশীল মাড়োয়ারি বাড়ির মেয়ে। সৎ-মা ভীষণভাবে বিয়ের চেষ্টা করছিল ওর। প্রথমে পালিয়েছিল কাশী রামকৃষ্ণ মিশনে। ওরা বাড়িতে খবর দেন। বাড়িতে ফিরিয়ে আনার কয়েকদিন পরই ও আত্মহত্যা করে। নরম স্বভাবের অন্তর্মুখী মেয়েটি এ কাজ কেন করল? আমরা বন্ধুরা ভেবে পাই না। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। এক একবার নিজেদের দিকে চাইছি। কেন ওকে জিজ্ঞেস করলাম না। কিছু কি করতে পারতাম? ভীষণ লজ্জা। এই আমরা তোর বন্ধু রাজশ্রী? ছিঃ!

মধুচ্ছন্দা বলেছে। ওর বিয়ের ইচ্ছে একেবারেই ছিল না। ভালো ছাত্রী। ইচ্ছে ছিল পড়াশুনো শেষ করে সন্ন্যাসী হবে। সংসার ভালো লাগে না। বাবা মা বুঝলেন না। বিয়ে তো দিতেই হবে। রাজশ্রীর বাবা একদিন কলেজে এলেন। আমাদের সামনে খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ মেলে কলেজের চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখলেন। হয়ত খুঁজতে চাইছিলেন মেয়ের স্পর্শ। তারপর চলে গেলেন। একটি কথাও বিনিময় হল না।

কিন্তু আমার কেন বারবার মনে পড়ছে যে রাজশ্রীর বাড়ির থেকে দুটো স্টপেজ পেরলেই আমার জাদুকরের ঠিকানা? ছিল। আর নেই। সেই জাদুকরের সঙ্গে আমার তো কোনো ছবিও নেই! ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা তার কণ্ঠস্বর শুনি মাঝে মাঝে, আর আমারও মরে যেতে ইচ্ছে করে। শব্দের মধ্যে ভাসতে ভাসতে চলে যেতে ইচ্ছে করে সেই চরকা কাটা বুড়ির কাছে। সে নিশ্চয় পৌঁছে দেবে জাদুকরের কাছে। আমি রাজশ্রীকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ ভুলে যাই। ভুলে যাই, স্যার ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলেন—তোমরা তো ওর বন্ধু, সবসময় একসঙ্গে থাকতে, তোমরা জানতে পারোনি? ও নিজেকে শেষ করতে চাইছে? বরং হঠাৎ রাজশ্রীকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলি। এক অমোঘ আকর্ষণ আমাকে টানতে থাকে। ও নিশ্চয় এখন জাদুকরের প্রতিবেশী।

ভুলোকাকা যেসব অদেখা ভাড়াটে বাড়ির কথা বলত সেই সব বাড়ির বাসিন্দারাও তো ওর অদেখা। পূর্ব পূর্ব পুরুষ। মৃত্যুর পারে ওরা কোন বাড়িতে থাকেন? ভুলোকাকা নিশ্চয় দেখতে পেত। তাই ওরকম সুন্দর করে বর্ণনা দিতো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। মনে মনে দেখতে যাই সেই অনন্ত বাড়ির সারি। আমার প্রিয়জন, আমার না-দেখা পূর্বজ, সবাই যে বাড়িতে এখন ভাড়াটে। সোনার কেল্লার মুকুলের মতো হয়ত কোনোদিন তারা ফিরবে। অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে চেয়ে বলবে, ওই নদীর ধারে আমার বাসা ছিল। বন্যায় ভেসে গেছিলাম। আমি অপেক্ষায় থাকি।    

 

জীবনে কখনও ভাবিনি রাতে শুয়ে বিছানায় কান পাতলে রেলগাড়ির শব্দ শুনতে পাবো না।

আজ কতদিন ঘুমের মধ্যে সেই হুইসেল শুনতে পাই না। এমন নিস্তব্ধ রাত ভয় ধরায়। ঘুমিয়ে যদি ভালোবাসার শব্দ না পাই তবে তো নির্ঘুম রাত কাটবে। স্বপ্ন দেখব কী করে?

মাঝে যে এতোগুলো বছর কেটেছে, মনে হয় যেন বিভ্রম। আমার শৈশবই তো এখনও সীমানা পার হয়নি! তাহলে? কী করে এত দূর এলাম!

গতকাল রাতে লম্বা বারান্দায় হাটছি। সামনে গঙ্গার ধার খা খা করছে। মনে হলো গঙ্গা এই মাত্র নেমেছে হিমালয় ছেড়ে। এর আগে ওর সঙ্গে দেখা হয়নি পৃথিবীর। জীবনের এত উৎসব ও জানে না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে থাকলাম। ছলছলে জলে একটা নৌকা পর্যন্ত নেই।

ওপারে আলো ঝিলমিল করছে। অনেক রাতেও ওগুলো নেভে না। কে জানে কখন নেভে। কেউ কি আর জানতে পারে আলো কখন নেভে?

আগে এই পার থেকে ওপারের আলোর পিছনে তারা জ্বলার মতো মিটমিট করে আলো ছুটে যেতো। দূর পাল্লার রেলগাড়ির আলো।

হঠাৎ মনে হলো আলো ছুটছে না? শব্দও পেলাম মনে হলো!

আমি আলোর দিকে চেয়ে রইলাম।

অন্ধকার ভেদ করে আলো ছুটে আসছে।

এ আলোর তো বাস্তবে অস্তিত্ব নেই! স্বপ্নসীমানায় সে ভেসে ওঠে। ঠিক যেমন রাঙা চক্ষু বড় রুই অতল জলের তলা থেকে ঘাই মারে। স্থির জলে তরঙ্গ ওঠে। বৃত্তাকার। সেই আলো আমাকে জানিয়ে দেয়, এ বিশ্ব কখনও সৃষ্টি হয়নি, কখনও ধ্বংসও হবে না। এই বেঁচে থাকা এক মায়া, ইলিউশান। নিরালোক জীবনের পারে যে অনন্ত যে সীমাহীন অস্তিত্ব আলো তাই বয়ে আনে।  নিজের অজান্তে আমি শান্তি পাই। মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে।

তবু স্বপ্নে ডুবে যেতে যেতে চেতনার গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনি প্রিয় আলো আর প্রিয় শব্দ।

       সেই আলো আর শব্দের জগতে আমি অজস্র বাড়ি দেখতে পাই। কোনোটা একটা নড়বড়ে সাঁকোর পাশে, এঁটেল মাটির ওপরে মেটে ঘর। সে ঘরের জানলা খোলে ধানগাছের গোড়া বরাবর। কোনোটা খাড়া পাহাড়ের ঢালে খুঁটির ওপরে টলোমলো। ঝড় বা ভূমিকম্প এলে কেঁপে কেঁপে ওঠে। কোনোটা আবার নোনা জলের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে থাকে বালির পাড়ে। কখনও জলের ওপরে ভেসে থাকা নৌকোয়, কখনও বা ছুটন্ত গাড়ির কামরায় আমার বাসা।  আমি এক এক বাড়িতে এক এক প্রহর কাটাই। থামি না। কারণ স্থবিরতাই মৃত্যু। জীবন অনন্ত গতিময়। যতই তা মায়া দিয়ে গড়া হোক। 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত