| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম ঘটি বাঙাল ঝগড়া থেকে নয় । গৌতম রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 চল, এখান থেকে নৌকো করে স্টিমার ঘাট
সেখান থেকে রেল স্টেশন—
কী মজা, আজ প্রথম ট্রেনে চাপবি,
ট্রেনে করে চেকপোস্ট, সেখান থেকে—
ছোট ছেলেটা ঘুম মোছা চোখে জিজ্ঞেস করলে,
সেখান থেকে কোথায় বাবা?
কোথায় আবার। আমাদের নিজের দেশে।

(‌অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘উদ্বাস্তু’ কবিতার অংশ)‌

‘‌On a humid afternoon in July 28, 1920 Mohun Bagan was scheduled to clash with Jorabagan in a Coochbehar Cup tie. The latter took the field minus their star halfback Sailesh Bose, who was dropped for some unknown reason…‌‌‌‌’. অনুবাদের কারণে যাতে ভাব না বদলায়,‌ তাই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষপূর্তির আপডেট করা অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে ক্লাবের জন্মকথার শুরুটি হুবহু তুলে দেওয়া হল। সবাই দেখে নিতে পারেন— এতে কোথাও লেখা নেই শৈলেশ বোস ‘বাঙাল’ বলে জোড়াবাগান ফুটবল ক্লাব থেকে বাদ পড়েছিলেন। এবং সেজন্যেই ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট, পূর্ববঙ্গ আগত ময়মনসিংহের নগরপুরের জমিদার, কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী সুরেশচন্দ্র চৌধুরী ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন। তাই কিন্তু গবেষণালব্ধ ফল বলে প্রচার করা হয়েছে। সদস্য সংখ্যার বিচারে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক ক্লাবটির শতবর্ষপূর্তিতে গোটা পূথিবীতে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি অনুরাগীর মনে উদার কলকাতা ফুটবল নিয়ে ভুল, সঙ্কীর্ণ বিদ্বেষ প্রসূত ধারণা তৈরির প্রয়াস করা হয়েছে। বিশিষ্ট ক্রীড়া গবেষক ‘পণ্ডিত মশাই’ ও সুখরঞ্জন ঘোষ বলছেন, হ্যাঁ বাঙাল, ঢাকা বিক্রমপুরের যে শৈলেশ বোস জোড়াবাগান ক্লাব থেকে বাদ পড়েন তিনি ফুটবলার নন, ক্রিকেটার। এই ক্রিকেট ক্লাবের কমিটি যাই থাক, চিরকালের মহাপরিচালক ভাগ্যকুলের রায়েরা। তাঁরাও তো বাঙাল। পঙ্কজ রায় এই ক্লাবেই বল পেটাতেন। খেলোয়াড়ের বাদ পড়া এমনকী প্রতিভাবান যোগ্য খেলোয়াড়ের বাদ পড়া, সে তো খেলার মাাঠের চিরকালীন দীর্ঘশ্বাস। একে জাতি ঘৃণায় রূপান্তরিত করে উদার এই ক্লাবটির সৃষ্টির কারণ হিসেবে দেখানো দুঃখের ব্যাপার। আরও যা ঐতিহাসিক ভুল হয়ে গেল তা হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠাতা বাবু সুরেশচন্দ্র চৌধুরী যে আসলে একজন মস্ত বড় স্বাধীনতা সংগ্রামী, ক্লাব সমর্থক গবেষকরা, কর্তারা শতবর্ষে কেউ তা মনেই করলেন না!  ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠার সময়টা মনে রাখতে হবে— ১৯২০।


আরো পড়ুন: গর্বের রঙ যেখানে লাল হলুদ । মৈনাক দাস


১৯০৫–এ বঙ্গভঙ্গ রদ। সেই রাগে ব্রিটিশ বাঙালিকে ভীরু–কাপুরুষ আলপটকা বলার জবাবে চতুর্দিকে ব্যায়াম সমিতি— মোহনবাগান খেলার মাঠে ব্রিটিশকে হারিয়ে দিয়েছে। ওই একই দেশভক্তির আবহে তার মাত্র ৯ বছর বাদে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম। মোহনবাগানের সৃষ্টিকর্তা শ্যামপুকুরের বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বোস কি কখনও দাবি করেছেন তিনি আসলে খেলার মাঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম করলেন। করেননি। তা হলে, জোড়াবাগনের বাবু সুরেশচন্দ্র চৌধুরী কেন তা দাবি করবেন। সে দাবি তো করবেন ক্লাবের সদস্য ও কর্তারা। করেছেন কি? কিন্তু সে সব জানানোর মানুষ এখনও আছেন। বয়সের কারণে কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্ট হলেও তাঁর নাতি দেবেশ চৌধুরি মনে করতে পারেন, সুরেশবাবুকে বাগে আনতে তাঁকে ব্রিটিশ শাসক রায়বাহাদুর খেতাব দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জাতীয় সংগ্রামের আবহে তিনি তা নিতে চাননি। সব সময় বলতেন, শুধু মোহনবাগানকে হারালে চলবে না, সাহেবদের হারাতে হবে। সেজন্য খোঁজ নাও সাহেব খেলোয়াড়রা কোন বলে খেলে, কোন জার্সি গায়ে দেয়, কোন জুতো পরে, কী খায়। দরকার হলে জাহাজে চড়িয়ে সেসব নিয়ে এসো। শেষে চৌরঙ্গির সাহেব কোম্পানি তা আমদানি করে জোগান দেয়। নবতিপর দেবেশবাবুর এসব কথা মনে পড়ে চোখে জল এসে যায়। বলেন, খেলোয়াড়দের পুত্রস্নেহে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়ে খাওয়াতেন। সে সন্তান ঘটি না বাঙাল তার খবর রাখতেন না। মোহনবাগানিরাও তা রাখতেন না। মোহনবাগানের যে টিম সাহেবদের হারায় তার আট জনই ছিলেন বাঙাল। গোষ্ঠ পাল তো নিজেই ফরিদপুরের মানুষ। এটি কিছু বাড়তি উদারতার ব্যাপার নয়, সেদিন ঘটি–বাঙালে রেষারেষি ছিল না। বহু পরে দেশভাগ উদ্বাস্তু স্রোতের জটিলতায়, এক শ্রেণির জমি, বাড়ির মালিক শহুরে লোকের অনুদারতা, অভব্যতায় যার জন্ম। তাই ১৮৮৯–এ প্রতিষ্ঠার পর সে দিনের মোহনবাগানও শুরুতে কিছু ঘটিদের ক্লাব ছিল না। ছিল শ্যামবাজারের ক্লাব। শ্যামবাজারের ঘটি, বাঙাল দুই ছিল মোহনবাগানি। হ্যাঁ, শুধু ‘শ্যামবাজারের শশীবাবুরা’ নন, প্রচুর বনেদি বাঙালও চিরদিন শ্যামবাজার, বাগবাজার, দর্জিপাড়ায় থাকতেন।

 

ষাটের দশকের মাঝ বরাবর পাড়ায় ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব হাজির হলে ঘটি ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে বুক চাপড়ে বলতে শুনেছি— ‘আমি বাঙাল রে, আমি বাঙাল।’‌ আর, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জোড়াবাগান কুমোরটুলির ধনী বৃত্তিজীবী, জমিদার–ব্যবসায়ী বাঙালিরা সব অর্জিত সম্পদ আর আদি ঢাকেশ্বরীর আসল বিগ্রহটি বুকে নিয়ে দেশের রাজধানীতে ‘ঢাকাই পট্টি’ বসান। গাঁয়ের শ্রেষ্ঠ বীর দঁরতেগারা তো প্যারিস শহরেই যাবে। এঁরা দুর্ভাগ্যের কারণে কারও বাড়া ভাতে এসে বসেননি। বরং ভাত বেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আবার কারও রেষারেষি! তাই, সে ঘোর দ্বন্দ্বের সময়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবেও তার প্রশ্রয় ছিল না। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের একেবারে প্রথম দিকের সদস্য জোড়াবাগানের বাবু ভূপতি ভূষণ পাইনের ছেলেরা এখনও বেঁচে। তাঁরা জানান, পাইনবাবু মাত্র তিনজন ঝাঁকা মুটে নিয়ে বাজার যেতেন। কারণ, ক্লাবের প্রাণপুরুষ জে সি গুহ বাড়িতে আসবেন, খেলোয়াড়রা আসবে, আরও কত লোক—‘টিম হবে’। জে সিও অভিজাত বাঙাল। ক্লাবে জীবনের সবটুকু দেওয়ার জন্য চৌরঙ্গির চাঁদনি চকে আমদানি কৃত ক্যামেরার অত বড় ব্যবসা, অধ্যাপক স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক সবই গেছে। কট্টর বাঙাল, কিন্তু ওঁর মন পড়ে আছে কালোয়াতি গানবাজনা আর বাঘ– সিংহের ব্যবসাওলা বনেদি ঘটিবাড়ির ব্যর্থ ফুটবলার কিন্তু অদ্ভুত ফুটবল মস্তিষ্কের অধিকারী অমল দত্তকে বাঙাল ক্লাবের কোচ বানানোর জন্য। সব ব্যাপারেই সাহেবদের খুব নিষ্ঠা। কলকাতার মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল, ঘটি–বাঙাল রেষারেষি নিয়ে ইউরোপিয়ান গবেষকদের মধ্যে অগ্রগণ্য স্কলার পল ডেমি নিখুঁত ভাবে আমাদের জানিয়েছেন— ১৯২৫–এর প্রথম ডার্বি থেকে ক্নাব রেষারেষি ছিলই। সে তো মোহনবাগানের সঙ্গে এরিয়ান ক্লাবেরও ছিল। কিন্তু, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু স্রোতে কলকাতার এক শ্রেণির মানুষের শহুরে সংস্কৃতির মিছে উচ্চমন্যতা এবং উত্তর কলকাতা ও ভবানীপুরের দস্তুর মতো বাড়িওলা ঠিকানাদারের অসহায় ঠিকানাহীন উদ্বাস্তুর প্রতি অবজ্ঞায় তীব্র রেষারেষির সৃষ্টি হয়। ক্লাব রেষারেষিতে যা প্রতিফলিত হয়। গ্রাম ঘৃণাকারী এঁদেরই তো হাওড়ার গ্রামীণ ঘটি লেখক শরৎচন্দ্র নাম দেন ‘দর্জিপাড়ার নতুন দা’। এঁদের আমরাও দেখেছি। পূর্ববঙ্গ আগত যে বিশিষ্ট উদ্বাস্তু মানুষটিকে উনি ভাড়া দিয়েছেন তাঁর পরিচয় দিলে নিজেই সম্মানিত হতেন। কিন্তু পরিচয় না দিয়ে বলছেন— ‘আমার ভাড়াইট্টা’ (ভাড়াটে)। আর র‌্যাগিং —‘বাঙাল মনুষ্য নয়’। তাই ফিলিস্তিনি কায়দায় বিশ্বনাথ হল ‘বাঙাল বিশে’।

 

সে ঘৃণায় কত প্রেমের ঘুড়ি নিষ্ঠুর ভাবে ভোকাট্টা হতে ঘৃণার জবাবে এক অপরাজেয় পালোয়ানের উদ্ভব হল। তার নাম দুর্দান্ত প্রেম। তার কাছে সব ঘৃণাই নস্যি। ‘রেফিউজি ভাড়াইট্টা’ যারা নাকি ‘ওরা’ তাই থাকে ‘ওধারে’, তাঁদের মেয়ের (সুচিত্রা সেন) চোখে কী একটা আবিষ্কার করে ঘটি বাড়িওলার তরুণ ছেলেটি (উত্তমকুমার) ভাড়াটের ‘ভাড়াটে’ হয়ে গেল! (ওরা থাকে ওধারে) উত্তম–সুচিত্রার প্রেমের সিনেমা এই দম্ভের গরলে অমৃতের মিশেল দেয়। হতশ্রী পূর্ববঙ্গীয় কলোনির শিক্ষিত অসহায় পরিবারের অবিবাহিত, অভাবের সংসার চালানো মেয়েরা, লোভী দাম্ভিক ঘটি জমিদারকে হাঁটু মুড়ে প্রেম ভিক্ষা করতে শেখায় (আলো আমার আলো)। শিক্ষা, সংগ্রাম আর ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যে কলোনির মেয়েরাই হয়ে ওঠেন সে দ্বন্দ্বের সময়ের সব বাঙালির হিরোইন। ভবানীপুরের খাস ঘটি উত্তমকুমার ও পাবনার সত্যি বাঙাল সুচিত্রা সেন যে প্রেমের রোল মডেল হয়ে ওঠেন। মনে রাখতে ভুল না হয়— এই ঘটি–বাঙাল মিলনের সব সাহিত্য, সিনেমার লেখক, প্রযোজক, পরিচালক সবাই কিন্তু জাঁদরেল ঘটি। একটাই যা লস— আমাদের সে ঘটি দর্জিপাড়ার পাড়ার বহু বন্ধু বাঙাল মেয়ের প্রেমে মজে মোহনবাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গল হয়ে গেল! এটিই নাকি ছিল সে মেয়েদের প্রেমের শর্ত!‌‌

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত