| 28 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

মলয়ালম অনুবাদ গল্প: আমার বাবা একটা চোর ছিল । ই সন্তোষ কুমার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ই সন্তোষ কুমার

লেখক পরিচিতি- ই সন্তোষ কুমার মালয়ালম ভাষার এই প্রজন্মের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর বেশি। সেরা গল্প সংগ্রহের জন্যে এবং উপন্যাস অন্ধাকরানঝি –র জন্যে দুবার পেয়েছেন কেরালা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার যথাক্রমে ২০০৬ আর ২০১২ সালে। এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ- আইল্যান্ড অফ লস্ট শ্যাডোজ ২০১৫ সালের ক্রসওয়ার্ড পুস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছিল। তাঁর দুটি গল্প থেকে মালয়ালম সিনেমা হয়েছে। তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি, তামিল, হিন্দি এবং জার্মান ভাষায়। বাংলায় অনুবাদ এই প্রথম।


ছেলেবেলায় কখনো ছিপ আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছ? প্রথম বার বঁড়শিতে মাছ গাঁথার কথা মনে আছে? আজো কি মনে পড়ে না সেই শুখনো কাঠিটা, যা এতক্ষণ জলের ওপর মরা লাশের মতো পড়ে ছিল, কেমন ব্যস্ত হয়ে জলের গভীরে ঝাঁপ দিয়েছিল? আর সেইসঙ্গে অন্যপ্রান্তে সেই প্রাণান্তকর চেষ্টা বঁড়শি থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য।
এইসময় মাছেরা নিজেদের জীবনের শেষ লড়াইটা লড়ে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই মরণপণ লড়াইটা তারা হেরে যায়।
কিছু স্মৃতি থাকে সেইরকম। তারা রয়ে যায়, ম্লান হয় না। আমার কাছে তা যেন ঠিক গতকাল ঘটেছিল- মাটি খুড়ে তোলা, কেঁচো গুলো আলাদা করে ফেলা, যেগুলো নগ্ন শরীরের মতো জড়ামড়ি করে ছিল, তাদের একটা পাতার ওপর রাখা, ছিপের সুতোর শেষ প্রান্তে বঁড়শি টাকে আটকে দেওয়া, তারপর তাকে একটা শক্ত কাঠির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া, তারপর ফাতনাটাকে ভাসিয়ে দেওয়া…।
কীভাবে আমি সেসব ভুলতে পারি?
সেদিন যে মাছটা ধরেছিলাম, খুবই ছোট। সেটার একটা চোখ বেরিয়ে এসেছিল। মনে হয় বঁড়শি চোখটা ফুটো করে দিয়েছিল। দিনের আলোয় সেই চোখটা যেন খাঁজকাটা সবুজ রঙের মতো ঝলমল করছিল। রক্ত শুকিয়ে গিয়ে চোখের গর্তটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল। যখন বঁড়শি থেকে খুলে দেওয়া হয়েছিল, তখন মাছটা ছটফট করে লাফ দিয়েছিল। জীবনে ফিরে আসার জন্যে এক আগ্রাসী নাচ। আমাদের বস্তির পাশের ঘরগুলোর ছেলেরা খালি টিনে কাঠি দিয়ে বাজিয়ে একটা হুল্লোড় করছিল, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছোট্ট মাছটার নকল করছিল।এমন আনন্দ করছিল যেন ট্রফি জিতেছে।কিন্তু ততক্ষণে আমার মাছ ধরার উত্তেজনা থিতিয়ে গেছে। অর্ধেক খুলে আসা চোখ থেকে শীর্ণ লাল নদীর মতো ছোট্ট শিরা আমাকে বিষণ্ণ করে তুলল। টেলিফোনের কর্মীদের ফেলে যাওয়া তার আর হাবিজাবি থেকে আমি একটা বাতিল কাচের জার পেয়ে গেলাম। এর ধারগুলো ছিল ভাঙ্গা। এতে জল ভরে আমি মাছটাকে তাতে ভাসিয়ে দিলাম। জারের গভীরতার একটা আন্দাজ নিয়ে ছোট্ট মাছটা ওপরের স্তরে ভাসতে লাগল আর সেখানেই থাকল কাঁচে ঠোঁট ঠেকিয়ে। আমার মনে হল ও কিছু শোনার চেষ্টা করছে। দুপুরের রোদ পড়ে জারের জল ছিল উসুমকুসুম।
এটা ছিল সন্ত দিবসের উৎসবের আগের দিন। আমার স্পষ্ট মনে আছে। মা খুব সকালে উঠে গির্জায় গিয়েছিল পরের দিনের উৎসবের জন্যে যে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কাজ করতে। সব বড়রা, যারা বস্তির ঘরে থাকত, সেখানে কাজ পেয়েছিল। একেবারে শেষ ঘরটায় যে থাকত, এক চোখ কানা আছু, সে শুধু ঘরে ছিল।সে কখনো কোথায় যেত না। যেখানে তার বাঁ চোখ থাকার কথা, সেখানে একটা ছোট গর্ত। একটা কেরোসিনের কুপি নিয়ে বসে গত বিশু উৎসবের বেঁচে যাওয়া বাজিগুলো সে ফাটাচ্ছিল।একটা কাপড়ের থলি থেকে বাজিগুলো বার করে বেশ খানিকটা সময় অন্তর অন্তর দিয়ে ফাটাচ্ছিল আর পুরো সময়টাই পাগলা কুত্তার মতো হাঁপাচ্ছিল। দুটো আওয়াজের মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধান কেমন অসহ্য লাগছিল। যেন আসন্ন বিস্ফোরণের আতঙ্ক বাতাসে থম মেরে আছে। কিন্তু আছু এসব খেয়ালই করছিল না। যেহেতু তার একটাই চোখ ছিল, তাই আমার মনে হত, যখন সে কোন একদিকে তাকাচ্ছে, সে আসলে কিছু তাক করছে। যখন কাচের জার হাতে উঠোন দিয়ে যাচ্ছিলাম, সতর্ক ছিলাম যাতে ওর চোখে চোখ না পড়ে।যখনি আমি জারে থাকা মাছটার দিকে তাকাচ্ছিলাম, আমার আছুর একটা চোখের কথা মনে হচ্ছিল। আমি কখনো ওকে হাসতে দেখিনি, যেমন মাছটাকেও দেখিনি।
ঘরের দুপাল্লার দরজা খুলে আমি জারটাকে এক কোণে রেখে দিলাম। জলের ওপরের স্তরে মাছটা স্থির হয়ে আছে। ওর কানকো একটু একটু নড়ছে। কানকোর ঠিক নিচে, যেখানে বড়শি বিঁধেছিল একটা লাল ক্ষত হয়ে গেছে।
আমি পাতায় রাখা বাকি কেঁচোগুলো থেঁতো করে জারে রাখলাম। কিন্তু মাছটা প্রায় নড়ছিলই না।দুম! আছুর ফাটান বাজি আমাকে চমকে দিল।
হ্যাঁ, কীভাবেই বা আমি ভুলতে পারি? এটা ছিল সেই রাত, যে রাতে দীর্ঘ দিন পর বাবা বাড়ি ফিরে এসেছিল।
অন্ধকার গাঢ় হচ্ছিল।
সারা দিনের কাজের শেষে হা ক্লান্ত মা ঘরের এক কোণে শুয়ে ছিল। তখনো রাতের খাওয়া হয়নি। সবেধন নীলমণি বাল্বটি গোটা ঘরের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না।অন্ধকারের নড়বার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি নোংরা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম, হেরো মানুষের ছায়ার মতো। কাচের জারের দিকে তাকাতেই চাইছিলাম না।
কেউ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। বারবার দিচ্ছে দেখে আমি বারান্দায় গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা শীর্ণ লম্বা লোকটাকে চিনতে আমার একটুও সময় লাগল না, আমার বাবা। গোঁফ আর কপালের দুটো দাগ বাদ দিলে বাবা আর আমি একইরকম দেখতে। কিন্তু বাবার চোখ দুটো গর্তে বসে গেছে।চুল উসকোখুসকো। ‘বাড়ছিস না দেখছি’ সামনের ভাঙ্গা দাঁত বার করে সে হাসল। আমার মনে হল বাবার আওয়াজ খুব শুখনো আর সুরহীন, যেন অন্য কোন শরীর থেকে আসছে। আমি উত্তর দিলাম না। পাশের কোন ঘরে কেউ কেশে জোরে কফ ফেলল। বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঘর মদের গন্ধে ভরে গেল।
আমার বাবা ছিল একজন চোর। সে কথা স্বীকার করতে আমার কোন অসুবিধে নেই। আমাদের সব পড়শিরাই জানে। আমি যখনি খোলা জায়গায়, যেখানে টেলিফোনের লোকেরা বাতিল জজ্ঞাল ফেলত, খেলতে যেতাম, তখন নদীর ধারে গরু চরাতে আসত যে ছেলেরা, তারা এই নিয়ে আমাকে খেপাত। কিন্তু আমি তাদের পাত্তা দিতাম না। আমি ভাবতাম, তারা অন্য কাউকে নিয়ে কথা বলছে।আমার বাবাকে নিয়ে যখনি কেউ কথা বলত, আমার কিছুই মনে হত না। বাবা অনেক দিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল, আর সে আমার জীবনের কোন অংশই ছিল না।
বাবার গলা পেয়ে মা ঘরের সামনের দিকটায় এল।ঘরের ছায়াচ্ছন্ন আলোয় তার ক্লান্ত মুখের ভাব আমার কাছে স্পষ্ট হল না। যাই হোক, তার মুখকে ঠিক শোকার্ত বলা যায় না।
‘ছাড়া পেলে?’ মা জানতে চাইল
চোখ টিপে বাবা বলল ‘না’
‘তাহলে?’
‘চারদিন হাসপাতালে ছিলাম’ সে বল ‘সেখান থেকে পালিয়েছি’
‘তুমি তোমার মেয়াদটা পুরো শেষ করতে পারতে’
মা গলার স্বর চড়াল। ‘ওরা যদি তোমাকে এখন পায়, তোমাকে কি ছেড়ে দেবে?’
বাবা মার গলার আওয়াজ নামাতে বলল ‘ তার মানে আর দুবছর জেল’
‘ওরা তোমাকে খুঁজতে এখানে আসবে না কি?’
‘তাতে কী? আমি তো ভোরেই চলে যাব’
‘জেলে ফিরবে?’
‘না, আমি জংগলে একটা কাজ জোগাড় করেছি, কাঠচেরাই’
‘আমি জানি তুমি কাজ করে সংসার চালাতে পারবে না’ মা কখনো বাবাকে বিশ্বাস করত না। ‘পুলিশ তোমাকে যা মার মেরেছে, আর কি তোমার শরীরে কোন হাড় আস্ত আছে?’
‘তুমি একটু ধৈর্য ধরে দেখো। ওই পথ আমি ছেড়ে দিয়েছি’
‘কিন্তু যেখানেই যাও, পুলিশ ঠিক খুঁজে খুঁজে আসবে, তাই না?’
‘যদি তারা আমাকে খুঁজে পায়, তবে তো?’ বাবা বলল ‘শেষবার আমাকে ধরতে পারল কারণ কেউ একজন খবর দিয়েছিল। কাউকে বোলো না আমি এখানে আছি’ তারপর কী যেন ভেবে আমার দিকে ঘুরে বলল ‘তুই কি কাউকে বলবি?’
আমি কোন উত্তর দিলাম না। ‘ও কি কথা বলে না নাকি?’ আমার দিকে কটমট করে চেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল বাবা।
আমাকে খাবার দিতে ব্যস্ত মা মনে হল না কথাটা আদৌ শুনতে পেয়েছে।
থালার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আমি চুপচাপ খেয়ে নিলাম। আড়চোখে বাবাকে দেখলাম। সে মেঝেতে ঝুঁকে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার বাজে লাগল। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে চাইছিলাম যে ভাত থালার চারদিকে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল।
ঠিক তখনই বাবার নজর ঘরের কোণে রাখা কাচের জারের দিকে পড়ল। ‘ওটা কী?’
মা তাকাল কিন্তু কোন উত্তর দিল না।
‘ওটা কী?’ খানিক বাদে আমাকে জিজ্ঞেস করল বাবা। তখনো সে নিচু গলায় কথা বলছিল।
একটু ইতস্তত করে আমি বললাম ‘মাছ’
‘মাছ?’ বাবা হাত বাড়িয়ে জারটা নিল। মাছটা সত্যিই জলে মড়ার মতো ভাসছিল। একটু ফুলেও ছিল মনে হল। ওর চোখের জ্বলজ্বলে ভাবটা উবে গেছে।
‘এই ছোট্ট মাছটা তুমি কোথায় পেলে?’ বাবা যখন হাসত, তার সামনের ভাঙ্গা দাঁতটা স্পষ্ট দেখা যেত
‘নদীতে ধরেছি’ আমি বললাম।মাছটা সকাল থেকে আমার সঙ্গে ছিল। মরে গেছে বলে আমার মন খারাপ করছিল।
‘নদীতে মাছ আছে?’ বাবা মাকে জিজ্ঞেস করল।
‘কী করে জানব?’ মা রেগে গেল। ‘আমি যদি এইসবেই সময় কাটাই, তাহলে আর বাড়িতে খাবার কিছু থাকবে না’
একটুখানির জন্যে বাবা চুপ করে গেল। তারপর সে আস্তে আস্তে মেঝে থেকে উঠল। কাছের কোন ঘরে শুঁটকি মাছ ভাজা হচ্ছে। বাবা দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে সেই তীব্র গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করল।
‘আমার একটা কাজ আছে। বাড়িতে কি একটু তার পাওয়া যাবে?’ মাকে জিজ্ঞেস করল বাবা।
মা কোন উত্তর না দিয়ে আমার থালা নিয়ে ভেতরে গেল।
বাইরে থেকে বাজির শব্দ আসছিল।
বাবা বিরক্ত গলায় বলল ‘রাতের এই সময়ে কে বাজি ফাটাচ্ছে?’
‘আছু’ আমি আস্তে আস্তে বললাম
‘আছু? এই আছুটা কে? ও, সেই কানা ছেলেটা? সে এখনো মরেনি? যদি ও আরেকটা বাজি ফাটায়, আমি ওর ঘেঁটি ছিঁড়ে দেব, বলে দিস’
আমি আছুকে ভয় পেতাম, আর বাবাকে এরকম বলতে শুনে অবাক হলাম, যেন সে আছুর ব্যাপারে কিছুই জানে না।
‘আছু, আচ্ছা, ঠিক আছে। ওর কাছে তার থাকবে’ বাবা একটু ভাবল। তারপর বলল ‘যা, ওর কাছ থেকে তার নিয়ে আয়’ তারপর আমার কানে ফিসফিস করে বলল ‘তুই বলতে পারিস আমার জন্য চাইছিস। খুব শয়তান ছেলে, কিন্তু ক্ষতিকর নয়। ও কাউকে বলবে না’
আমি ভয়ে ভয়ে আছুর দরজায় ধাক্কা দিলাম।
ও দরজা খুলতেই কেরোসিনের কুপি আর বারুদের গন্ধ আমার নাকে এল। বাজি প্রায় সব শেষ। খালি থলিটা একটা ভিজে জন্তুর মতো মেঝেতে পড়ে।
আছু ওর এক চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাল, যেন তাক করছে। সে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। বাবা আমাকে যেমন বলেছে, সেই মতো আমি ওর কাছে তার চাইলাম।
‘ও, মাথুকুট্টি এসেছে বুঝি?’ অবাক না হয়ে সে জিজ্ঞেস করল আর ভেতরে গিয়ে তক্ষুনি তারের বান্ডিল নিয়ে ফিরে এল।
‘এমন কিছু নেই যা আচুর কাছে পাওয়া যাবে না’ বাবা খুশি হয়ে বলল। ‘ওর সত্যিই দুটো চোখের দরকার নেই।’
‘তুমি কি এত রাতে মাছ ধরতে যাচ্ছ?’ মার রাগ গোপন ছিল না।
‘তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও। আমি শিগগির ফিরে আসছি’ তারপর বাবা আমার দিকে ফিরে বলল ‘নদীর ওপরে মেলামুরি-দের একটা পাম্প হাউস আছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ’ আমি মাথা নাড়লাম।
‘মেলামুরি পাপ্পাচান রোজ ওর নারকেল গাছে জল দেয়, তাই না?’
আমি আবার ঘাড় নাড়লাম।
রোজ মেলামুরি পাপ্পাচান তাঁর নারকেল আর সুপারি গাছে জল দেবার জন্যে পাম্প চালায় আর সেই শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
‘এখনো আমি গাছ ভর্তি নারকেল দেখলে স্থির থাকতে পারি না। এটা আজো আমার একটা রোগ’ নিজের মনে আরো কীসব বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বাবা।
বাবা বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে, যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে, আছু দুটো বাজি ফাটাল। শব্দের দমকে ঘরের দেওয়ালগুলো কাঁপছিল। আমার মনে হল জারের মধ্যে ভাসা মরা মাছের কানকো অব্দি নড়ে উঠল।
‘চলে গেল, রাক্ষসটা’ পরেরদিন মা শাপশাপান্ত করছিল। ‘ওর জন্য বসে থাকাই আমার উচিত হয়নি। নির্ঘাত কোথাও চুরি করতে গেছে’
‘হে ভগবান, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, আমাকে কি উপোষ করিয়ে রাখবে বলে কাল এসেছিল শয়তানটা?’ হতাশ গলায় মা বলেই চলল। জারের মাছটাও ছুঁড়ে ফেলে দিল। আমার তখন মনে পড়ল ছিপ আর বঁড়শি কাল আমি নদীর ধারে ফেলে এসেছি।
সন্ত দিবস ছিল, একের পর এক শোভাযাত্রা গির্জা থেকে নদীর তীর ধরে যাচ্ছিল। সাদা শার্ট আর লাল টুপি পরা ব্যান্ড পার্টি শোভাযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল।সিনেমা হলে বাজা জনপ্রিয় গানের সুর বাজাচ্ছিল ওরা। কলোনির ফচকে ছোড়াগুলো গানের সঙ্গে নাচছিল, ছন্দের পরোয়া না করে।বড় বাচ্চারা শোভাযাত্রার আগে আগে চলছিল, নানান রঙের ছাতা ধরে। যখন শোভাযাত্রা আমাদের বস্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন কয়েকজন ছেলে হাতে বাজি নিয়ে পরপর ফাটাতে শুরু করল। একটার পর একটা, মনে হচ্ছিল বাজির শব্দ আর আলো থামবেই না। আমি জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম আছু ওর ঘর থেকে দেখছে বাজিগুলো হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে।সব বাজি ফাটানো হয়ে গেলে অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য নেমে এল। বাতাস ঘন সাদা ধোঁয়ায় ভরে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে একটা ছোট্ট ছেলে নৈঃশব্দ্য ভেঙে খুব আস্তে একটা হর্ন বাজাল।
বিভিন্ন জায়গা থেকে গির্জায় আরো অনেক শোভাযাত্রা আসবে। মা জোর করা সত্ত্বেও আমি গির্জায় গেলাম না।
পরের দিন দুজন পুলিশ বস্তির সব ঘরে ছানবিন করল। ওরা আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। ওদের একজন গুটিয়ে রাখা মাদুরে লাঠি দিয়ে খোঁচা মেরে দেখল। যতক্ষণ না তারা চলে গেল, ততক্ষণ আছু ওদের সেয়ানার মতো অনুসরণ করে চলল।
সন্ত দিবস উৎসবের তিনদিনের মাথায় নদীতে স্ক্রু পাইন ঝোপের মধ্যে বাবার লাশ পাওয়া গেল। লোকজন লাশটা তীরে নিয়ে এল। ভেজা তীরে একটা বড় আটকে পড়া মাছের মতো শরীরটা পড়ে ছিল। বোধহয় বেশি জল গিলে ফেলায় শরীরটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছিল। পোড়া তারের গোছা গলায় সাপের মতো পেঁচিয়ে ছিল। স্ক্রু পাইনের কাঁটায় ছড়ে যাওয়া পায়ের দাগগুলোয় পচা মাংসের রঙ ধরেছিল।
আমি বাবার কাছে যাইনি। আমার ভয় হচ্ছিল নদীর মাছ হয়তো তার চোখ খুবলে খেয়ে নিয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত