| 29 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

আমার কাছে কবিতা—কবিতাই, সিনেমা—সিনেমাই

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
• আপনার নতুন ছবি উড়োজাহাজ আসলে শেষ পর্যন্ত একটা স্বপ্নের কথা বলে। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার ছবি উড়োজাহাজ। এই স্বপ্ন দেখার জন্যেও তো সাহস লাগে। এখনও এই স্বপ্ন দেখার সাহসটা কোথা থেকে পাচ্ছেন?‌
•• এখনও পাচ্ছি মানে তুমি বোধহয় বয়সকে বোঝাচ্ছ?‌
• শুধু বয়সটার কথা বলছি না। আপনার কিছুটা শারীরীক অসুস্থতা তৈরি হয়েছে। সেটাকে অগ্রাহ্য তো করছেন?‌
•• দেখো, বয়সের কাছে হার মানলে মুস্কিল। বয়স-‌জনিত কিছু ব্যাধি তো আছেই। সেগুলো যে খুব সুখকর তাও নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় হল মনের জোর। আমি দমে যাই না। হার স্বীকার করি না। সিনেমা আমার প্রাণ। আমি সিনেমা করতেই ভালবাসি। এবং স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসি।
• উড়োজাহাজ যেন অনেক বেশি করে স্বপ্ন দেখাল, দমে না যাওয়ার কথা বলল। আপনার চালিকা শক্তি কী?‌
•• দেখো, চারপাশের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। দমিয়ে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। তবুও স্বপ্ন দেখি। আর, আমার চালিকা শক্তি হল ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তিই আমাকে চালায়।
• আপনি বললেন সিনেমা আপনার প্রাণ। তাহলে কবিতা আপনার কাছে কী?‌
•• কবিতা আমার কাছে প্রাণেরই আর একটা দিক। কবিতা ছাড়াও আমি বাঁচতে পারি না। এখনও লিখছি। ভীষণভাবেই লিখছি। বিশেষভাবে লিটল ম্যাগাজিনগুলোতেই আমি লিখি। আমার কবিতা সমগ্রও প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে, যার জন্য আমি রবীন্দ্র পুরস্কারও পেয়েছি।
• আপনি লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখেন। আর, লিটল ম্যাগাজিন তো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চিহ্ন নিয়েই এগোয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, লিটল ম্যাগাজিন হল চেন বাঁধা হাতির সামনে স্বাধীন পিঁপড়ে। আপনি কি সিনেমায় এবং কবিতায় ভেতর থেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী?‌
•• প্রতিষ্ঠান যখন মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করে, মানুষের স্বপ্নেরও বিরুদ্ধাচরণ করে, তখন, হ্যাঁ, অবশ্যই আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী। চিরকালই ছিলাম, এখনও আছি। থাকবও।
• আপনার উড়োজাহাজ-‌এও অনেক চরিত্র আসে, যাদের আধিদৈবিক বলা যায়, যারা এখন আর এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয়, তারাও কিন্তু কিছু-‌না-‌কিছু প্রতিষ্ঠানের বা সিস্টেমের শিকার হয়েই পৃথিবী থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। যে ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, যে শুধু বেঁচে থাকতে ভালবেসেছিল, তারা কিন্তু সকলেই কোনও-‌না-‌কোনও প্রতিষ্ঠান দ্বারাই লাঞ্ছিত হয়েছে।
•• একজ্যাক্টলি। আমি আর একটু স্পষ্ট করে বলি?‌ বিশেষ করে এই সময়, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যাঁরা ব্যাবস্থা চালাচ্ছেন, তাঁরা প্রতি মুহূর্তে মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। মানুষের বেঁচে থাকার বিরুদ্ধাচরণ করছেন। এখানে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, একজন সচেতন মানুষ, যে-‌ই হোন না কেন, তিনি এর বিরোধিতা করতে বাধ্য। আমি আমার ‘‌উড়োজাহাজ’‌-‌এ সেই বিরোধিতা, সেই প্রতিবাদ করেছি।
• ছবির ওই সব চরিত্রগুলো, যারা পৃথিবী থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, তারা যেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কথাই বলছে।
•• হ্যাঁ, তারা তো আমারই কথা বলছে। এই ছবির গল্প, কনসেপ্ট, চিত্রনাট্য, সংলাপ সবই তো আমার।
• ওই চরিত্রগুলো, যারা প্রেমের কথা বলছে, থালা ভর্তি ভাতের স্বপ্নের কথা বলছে.‌.‌.‌
•• হ্যাঁ, বেঁচে থাকার কথা বলছে, কিন্তু বাঁচতে পারছে না।
• এই কথাগুলোকেই পরিচালক, কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কথা বলে মনে হচ্ছে।
•• হ্যাঁ, ঠিক। ঠিকই। একদম ঠিক।
• মনে হয়, আপনি আরও কথা বলতে চান। অনেক কথা বাকি আছে।
•• হ্যাঁ, অনেক কথা বাকি আছে। অনেক কথা বলতে চাই। কিন্তু সেইসব কথা খুঁজে পেতেও সময় লাগে। তাই আমি খুব তাড়াতাড়ি ছবিও করতে পারি না। একটা ভাবনাকে নিজের মধ্যে পূর্ণ রূপ দিতে  তো সময় লাগে। কিন্তু আমি বলতে চাই।
• আপনি সিনেমায় যেমন স্বপ্ন, প্রতিবাদের কথা বলেন, বাস্তবতা  থেকে বেরিয়ে যান পরাবাস্তবের দিকে, আপনার কবিতাতেও তার প্রচুর চিহ্ন আছে। আপনার ‘‌থাপ্পড়’‌ কবিতায় যেমন আপনি লিখেছেন, ‘‌যারা প্রতিবাদ করে, যারা টুঁটি চেপে/‌ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিতে চায় ব্যবস্থাকে,/‌ যারা কিছুতেই মানতে চায় না/‌ শান্ত হয়ে গেছে সবকিছু.‌.‌.‌’‌, এই সব লেখার পরে, আসলে একটা সুররিয়ালিজমের দিকে চলে যাচ্ছে আপনার কবিতা, আপনি লিখছেন, ‘‌আয়নার ভেতর থেকে অনবরত/‌ হাজার-‌হাজার হাত ছিটকে এসে/‌ থাপ্পড়, থাপ্পড় মারছে গালে।’‌ আপনার ‘‌উড়োজাহাজ’‌ দেখার পর এই কবিতাটার কথা বিশেষ করে খুব মনে পড়ছিল। কোথাও কি একটা আন্তর্নিহিত সম্পর্ক আছে আপনার কবিতা এবং সিনেমার মধ্যে?‌
•• দেখো, আমি সিনেমা এবং কবিতা, দুটোর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে কোথাও কোথাও অবশ্যই দুটো দুটোরই পরিপূরক হয়ে ওঠে। যদিও আমার কাছে কবিতা—কবিতাই, সিনেমা—সিনেমাই।
• কিন্তু এই যে রিয়েলিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়া?‌
•• হ্যাঁ, এই রিয়েলিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়া যেমন আমার কবিতায় আছে, তেমনই আমার সিনেমাতেও কাজ করে।
• এই রিয়েলিটিকে উত্তীর্ন হয়ে যাওয়া.‌.‌.‌
•• রিয়েলিটিকে এক্সটেন্ড করা।
• হ্যাঁ, এটা আপনার বহু ছবিতেই আছে।
•• দেখো, এটাই আমার সিগনেচার টিউন।
• বাস্তব দিয়ে সবকিছুর সমাধান বা মোকাবিলা সম্ভব নয় বলেই কি আপনি পরাবাস্তবের দিকে চলে যান?‌‌
•• না। সেটা নয়। এটা একটা বিশেষ দেখার ভঙ্গী। এটা একটা অনুভূতির ব্যাপার, যে অনুভূতির গভীর থেকে এই ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে। এটা তৈরি করা নয়। এটা তৈরি করা যায়ও না। এটা নিজের ওপর আরোপিত করা যায় না।
• আপনার ছবিতে উড়োজাহাজ  তৈরি করা নিয়ে বাচ্চু মণ্ডলের প্রবল স্বপ্ন ও ইচ্ছেকে সমাজ প্রথমে হাস্যকর ভাবে, তারপর প্রশাসন তার ওপর অত্যাচার করে। বাচ্চু মণ্ডলের বন্ধু হয়ে ওঠে যে সব চরিত্র, তারা কেউ বেঁচে নেই। তাদের ইচ্ছে, ভালবাসা বা স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তারাও কোনও-‌না-‌কোনও প্রতিষ্ঠানের নিষ্ঠুরতার শিকার। তা সত্ত্বেও, আপনি, আঘাতে জর্জরিত বাচ্চুর স্বপ্নকে হারতে দেন না। মনে হয়, এত কিছু সত্ত্বেও আপনি অপরাজিত একটা সত্ত্বাকে দেখাতে চান। খুব পজিটিভ কিছু।
•• অবশ্যই পজিটিভ। আমি পজিটিভিটিতে বিশ্বাস করি। নেগেটিভিটিতে বিশ্বাস করি না। আমি নিজেও খুব পজিটিভ মানুষ। ফলে আমার ছবি কখনও নেগেটিভিটিকে তুলে ধরে না। তবে, চারপাশে, সমাজে অনেক নেগেটিভ ব্যাপার তো আছে। আমার উড়োজাহাজ-‌এর বাচ্চু মণ্ডল যে স্বপ্নটা দেখছে, সেটা সামান্য একটা স্বপ্ন। পাগলের মতো সে স্বপ্নটা দেখছে। আমাদের এই ‘‌ব্যবস্থা’‌ বা সিস্টেম তার স্বপ্নটাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।
• বাস্তব বা সিস্টেম তাকে ভেঙেচুরে দিতে চাইলেও, আপনি তার উড়ানটাকেই তো চিহ্নিত করতে চাইলেন?‌
•• অবশ্যই। তাই-‌ই। এটা কিন্তু আরোপিত নয়। এভাবেই আমি কাজ করি। কবিতা লিখি। এভাবেই সিনেমা আমার কাছে আসে। কিন্তু স্বপ্ন সবসময় জেতে না। কিন্তু এখানে এমন একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বাচ্চুকে যেতে হয়েছে, যে, তার প্রতিরোধ করা, প্রতিবাদ করা ছাড়া বাচচুর উপায় ছিল না। ফলে শেষ দৃশ্যে যেটা আমরা দেখি, সেটা বাচ্চুর স্বপ্ন পূরণ করা শুধু নয়, সেটা বাচ্চুর একটা প্রতিবাদ।
• এই ছবির ক্ষেত্রে সিনেমাটোগ্রাফিও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
•• হ্যাঁ, অবশ্যই। অসীম বোস ক্যামেরা করেছেন।
• মিউজিকও কিন্তু এই ছবির ভেতরের সুরটাকে ধরেছে খুব সুন্দরভাবে। আপনার মেয়ে অলকানন্দাই তো ছবির মিউজিক করেছেন।‌
•• হ্যাঁ। এই ছবির মিউজিক করাটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ, ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে সেই মিউজিককে মেশানোটা যেন জোর করে করা বলে মনে না হয়, এটা মাথায় রাখতে হয়েছে। হ্যাঁ, অলকানন্দার কাজ আমার এবং সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছে।
• আর, অভিনয়ে আপনার বাচ্চু মণ্ডল তো মাতিয়ে দিয়েছেন। এটা তো চন্দন রায় সান্যালেরই ছবি?‌
•• (‌হাসতে হাসতে)‌ খুব ভাল কাজ করেছে চন্দন। খুব ভাল অভিনেতা।
• সোহিনী (‌দাশগুপ্ত)‌ তো ছবি তৈরির সময় অনেক কিছু সামলান?‌
•• সোহিনী তো অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর।
• এখানে আপনার ছবির মুক্তি নিয়ে কেন সংশয় তৈরি হয়?‌
•• সংশয় কিছু নয়। আমার ১৬টা ছবির মধ্যে দুটো ছবি রিলিজ করেনি। ‘‌আনোয়ার কা আজব কিস্‌সা’‌ আর  ‘‌আমি ইয়াসিন ও আমার মধুবালা’‌।
• প্রযোজকদের জন্যেই কি ছবি দুটো মুক্তি পেল না?‌
•• ছবির মালিকানা তো প্রযোজকেরই। আমি তো চাইবই আমার ছবি এখানকার দর্শকরা দেখুন। যতই আমার ছবি জাতীয় পুরস্কার পাক কিংবা বিদেশের ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হোক না কেন, এখানকার দর্শক তো দেখতে চান আমার ছবি। তাঁদের কাছে ছবি না পৌঁছলে তো বাঙালি পরিচালক হিসেবে আমি কষ্ট পাবোই।
• আপনার আগের ছবি ‘‌টোপ’‌ তো ভালভাবেই রিলিজ হয়েছিল। উড়োজাহাজ ও তাই।
•• হ্যাঁ। উড়োজাহাজ ভালভাবে মুক্তির ব্যাপারে প্রযোজক অ্যামি ঘোষের সঙ্গে আমার দুই মেয়ে রাজেশ্বরী ও অলকানন্দা যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে ছবি মুক্তিটা আমার কাছে খুব জরুরি বলে মনে হয়। আমি তো বাংলায় ছবি তৈরি করি। যতই সিনেমার ভাষা আন্তর্জাতিক হোক না কেন, ঘরের লোককে ছবি দেখাতে না পারলে কষ্ট পাই।
এখন, ঘরের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে তাঁর উড়োজাহাজ। বাচ্চু মণ্ডলের স্বপ্নও তার উড়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলার দর্শক। আশা করা যায়, এই স্বপ্ন তাঁদেরও স্পর্শ করবে।
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত