| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

শঙ্খ ঘোষের কবিতায় সমাজ সচেতনতা । অমিত গোস্বামী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
গণতন্ত্রে যে কবিকে সব রাজনৈতিক দল সব সময় সমীহ করে চলে তার নাম শঙ্খ ঘোষ- এক অবিসংবাদী প্রতিবাদের নাম। যার লেখা নিয়ে বলার মতো যোগ্যতাই আমার নেই। লিখছি তার কারণ কিছু ব্যতিক্রমী কবি আছেন যাদের কবিতা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। সমাজে যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার আগ্রাসী থাবা বাড়ায়, মদমত্ত শক্তির অহংকারী পদচারণ পিষ্ট করে প্রকৃত গণতন্ত্র- তখনই পরশুরামের কুঠারের মতো নেমে আসে তার কবিতার অমোঘ লাইন। আর সে লাইন মানুষকে লড়াইয়ের শক্তি জোগায়। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় সমকাল যতটা প্রতিভাত হয় ততটা খুব কম জনের লেখাতেই আসে। বিপন্নতায়, অস্থিরতায় যখন তার কবিতার লাইন ভেতরের বারুদটা ছাপোষা মানসিকতাকে ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চায়।
 
১৯৫২ সালে সদ্য তরুণ এক কবির লেখা একটা কবিতা নাড়িয়ে দিয়েছিল আপামর কাব্যপ্রেমীকে। সম্ভবত দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল সেটা কবির। কবির নাম- ‘শঙ্খ ঘোষ’ আর কবিতার নাম ‘যমুনাবতী’। কিছু লাইন দেখা যাক-
‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে,
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে!
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী-
দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দিই!
হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়
হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাত দিই হায়’
 
কী অসামান্য কবিতা। এক কিশোরীর মৃত্যু এখানে উপজীব্য। সেই কিশোরী যে মারা যায় পুলিশের গুলিতে এক ভুখা মিছিলে গিয়ে। ভাতের জন্য মৃত্যু, যার ভাতের সন্ধান তাকে এনে দেয় গরম বস্তু তবে ভাতের বদলে সেটা সিসার বুলেট। সব সুখ-স্বপ্ন বারুদের কাছে, মৃত্যু এসে হাত ধরে। এখানে নিভন্ত চুল্লিকে করে তুলেছেন এক কিশোরীর দহনে দাউদাউ চিতা। আবার সেই কবিই পরিণত বয়সে যমুনাবতীর চল্লিশ বছর পর লিখলেন আরেক অমোঘ কবিতা ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে’।
 
‘তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে!
স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধ্বসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল
সমাজবিরোধী।
ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসীপাতা
উল্টেও পারে না খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছু জানে না বুলেটরা।
দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দ্যাখে মাঝে মাঝে।
পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।’
 
কী দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায় প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে এখানে। আক্রমণ এখানে শানিত কিরিচের মতো চিরে ফেলে, সরাসরি। তিন রাউন্ড গুলিতে তেইশজনের মৃত্যু! কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয় সেটায় শঙ্খ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ’- একেবারে নগ্ন করে দেয়া রাজনীতির মুখোশ খুলে। কারণ ’৪৭-এর আগে না বরং অব্যবহিত পরেও স্বাধীন পুলিশের, স্বাধীন বুলেট, স্বাধীন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনি, করেও না, করবেও না।
 
 
 
 
আবার,
‘ভয়াবহ শব্দধূমে ভরে গেছে পৌষের বাতাস
আর সেই অবসরে কোনও কোনও পিশাচ স্বাধীন
রাজপথ থেকে নারী তুলে নিয়ে চলে যায় ট্রাকে।’
 
গণতন্ত্রের আসল রূপ ফুটে উঠেছে এই লাইন দুটিতে। মোসাহেবি কর, বাঁচো। এ যেন- আমিই সব। আমি এখানে যে কেউ হতে পারে। কোনো দল, মাফিয়া, সংস্থা-কর্ণধার অথবা বাড়ির গার্জেন। আমাদের নিজের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য। আমরা যা ভাবি তাই যথার্থ আর বাকিরা ভুল! মতে না মিললেই সে শত্রু, আমরা হয়ে যাই পরমত অসহিষ্ণু। সে যদি সহমত হয় তাহলে তাকেই করে নিই সর্বক্ষণের সঙ্গী আর সেটা সে নির্গুণ হলেও। বর্তমান সময়ে ঠিক এই মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাই চারদিকে।
 
‘ধূম লেগেছে হৃদ্ কমলে’ বই থেকে দুটি লাইন এই রকম-
তোমার স্বাচ্ছন্দ্য দেখি, দূর থেকে
রঞ্জনেরা খুন হলে তুমি বলো, ‘মরেনি ও,
আমার ভিতরে বেঁচে আছে।’
 
কেমন এই স্বাচ্ছন্দ্য যেটা দূর থেকে দেখি? আসলে এই স্বাচ্ছন্দ্য মধ্যবিত্ত মানসিকতার, ছাপোষা মনোভাবের। তাই কোনো প্রতিবাদে গর্জে না উঠেই- ‘মরেনি সে, আমার ভিতরে বেঁচে আছে’ বলে দায় সারা যায়।
ইদানীং ‘ সালোয়াজুড়ুম’ শব্দটি শুনতে শুনতে আমার আরওয়ালের কথাই মনে পড়ে যায়। এভাবেই বোধহয় ভারতবর্ষের ‘প্রাইভেট আর্মি’ মান্যতা পেয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে গুজরাট দাঙ্গার পরে লেখা সেই লাইনগুলো মনে পড়ছে-
‘নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।
যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসে না কোন ক‚টতর্ক নিয়ে,
ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন বলে দেয় দিন
যদি বলি রাত, বলে রাত’
নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিলেন সব ছলচাতুরী এক মুহূর্তে। নারায়ণী সেনা কারা? এটা রূপক। এরা এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্ধ কর্মী। যাদের না আছে বিবেক, না মনুষ্যত্ব। ধ্বংসের জন্য, এমনকি এদের কোনো অজুহাতও লাগে না। এখানে নারায়ণী সেনা শব্দের কী সুচতুর প্রয়োগ! নারায়ণের নিজস্ব সেনাই নারায়ণী সেনা আর নারায়ণ শব্দটা নির্দেশ করে ধর্মের ধ্বজাধারী এক ক‚ট শক্তিকে যে নিজে বসে থাকে রাজাসনে আর তার তল্পিবাহকরা মেতে ওঠে ধ্বংসলীলায়।
 
চারদিকে অরাজকতা, সন্ত্রাস, অত্যাচার চলছে আর রাজনীতিকরা বসে আছেন ঠাণ্ডা ঘরে। তাদের গায়ে নেই ঘামের এতটুকু দাগ। সব ঠিক আছে, রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যারা প্রতিবাদ করবেন তাদের জন্য উপহার- ‘সর্বনাশ’! গৃহপালিত চতুষ্পদের মতো চুপ থাকো, ভালো থাকো : এটাই গণতন্ত্রের দান।
‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা ‘বিকল্প’। যেখানে লেখা হয়েছে-
‘নিশান বদল হলো হঠাৎ সকালে
ধ্বনি শুধু থেকে গেল, থেকে গেল বাণী
আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি আজও
একই মত থেকে যায় গ্রাম রাজধানী’
নির্বাক হয়ে যেতে হয় পড়লে। সাম্প্রতিকের থেকেও সাম্প্রতিক হয়ে থাকে এই অমর লাইন। সত্যিই তো কিছুই পাল্টায় না। আলো আছে যার, থাকে তার। যে তিমিরে থাকে, সে তো আরো অন্ধকারেই ডুবে যায়। রাজা আসে, রাজা যায়; আমরা জাবর কেটেই দিনগত পাপক্ষয় করি।
 
কোনো রাজনৈতিক রং তার গায়ে লাগেনি কোনো কালেই। সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে সারা রাজ্যের বিশৃঙ্খলা তাকেও বিচলিত করেছে। তার জেরেই কলম তুলে নিয়েছেন তিনি। তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে প্রতিবাদ। তিনি লিখেছেন- ‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/রাস্তাজুড়ে খড়্গ হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’।
 
কবিতাটিতে তিনি আরো লিখেছেন- ‘সবাই শুধু মিথ্যে রটায় পথগুলি সব দেদার খোলা যার খুশি আয় বিরুদ্ধতায় যথার্থ এই বীরভ‚মি উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে পেয়েছি শেষ তীরভ‚মি দেখ খুলে তোর তিন নয়ন রাস্তাজুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন সবাই আমায় কর তোয়াজ ছড়িয়ে যাবে দিগি¦দিকে মুক্ত গণতন্ত্র আজ।’
 
‘মুক্ত উন্নয়ন’ নামের কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে দেবেশ রায় সম্পাদিত সেতুবন্ধন পত্রিকায়। তার পর থেকেই ফেসবুকে ভাইরাল হয় কবিতাটি। সকলেই মনে করছেন পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে শাসক দলের ‘বাড়বাড়ন্ত’কে ব্যঙ্গ করেছেন কবি।
 
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বিরোধীদের নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে একেবারে সাম্প্রতিক জেহাদ। এভাবেই আপাত শান্ত, আদ্যন্ত ভদ্রলোক এই কবির কলমে ভরা থাকে প্রতিবাদের বারুদ। যিনি তার লেখনীকে ব্যবহার করেন এক অনিবার্যতায়, সেই এক এবং অনন্য কবি শঙ্খ ঘোষ। আমরা যাকে পাই প্রেমে ও অপ্রেমে। বিক্ষুব্ধ শানিত তলোয়ারে।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
কৃতজ্ঞতা: ভোরেরকাগজ
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত