| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: ফেল । শিবানী ভট্টাচার্য দে

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট
একটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি । চাকরির পরীক্ষা। সঙ্গে অসিত ও প্রতুল, তবে ওরাও যে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, আমি আগে জানতাম না। শুনেছিলাম ওরা চাকরি পেয়ে গেছে, এই পরীক্ষা দিতে আসবে ভাবিনি।
আমি ভেবেছিলাম পরীক্ষাটার খোঁজ শুধু আমিই পেয়েছি। আমার বাবা অফিসের বড়বাবু হবার সুবাদে অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই অফিসের ইংরাজি কাগজখানা বাড়িতে নিয়ে আসে, বিশেষ করে যে কাগজটাতে সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন থাকে। তেমন চাকরির খবর থাকলে বাবা আমাকে অ্যাপ্লাই করতে বলে, এবং সেই সঙ্গে কাউকে, কোনো বন্ধুকে যেন না বলি, সেটাও শিখিয়ে দেয়। কেন বলে আমিও বুঝি, তাই কাউকে বলিনা। আমি ছাত্র হিসেবে খারাপ না, অন্তত আমাদের শহরের মানে, চাকরি আমার পাওয়া উচিত। ওরাও খারাপ না, কিন্তু ওরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই আমি দরখাস্ত করার পর বাবা কাগজখানা নিয়ে অফিসে রেখে দিত একদম গুদামে, পুরোনো কাগজ রাখার জায়গায়। সেখান থেকে আর কে এনে পড়বে। আমার বন্ধুদের বাবারা বেশিরভাগই ইংরাজি পড়ে বুঝতে পারে না; যদিও তারাও ওই একই অফিসে চাকরি করে, ছোট পোস্টে আছে, তারা বাংলা কাগজটাই বেশি পড়ে। এককালের রিফ্যুজি তো, তখন চাকরি পেতে কোয়ালিফিকেশনের ছাড় ছিল অনেক। 
পি ইউ পাশ করার পর আঠারো পেরোতেই বাবার তাড়নায় এমপ্লয়মেণ্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছিলাম, বিএ পড়া এবং চাকরির খোঁজ একই সঙ্গে চলছিল, যদিও চাকরির খোঁজ আমার তরফ থেকে তত আন্তরিক ছিল না, বাবাই দেখত। বাবা চাইত ছেলেরা চাকরি করবে, আর মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে। আমার এক দাদা, এক ভাই, দিদি এবং বোন আছে, দাদা তৃতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করার পর তাকে বাবা আই টি আই-এ ঢুকিয়ে দিয়েছিল, ইলেক্ট্রিশিয়ানের কোর্স করে সে বছরদুয়েক হল পি ডব্লিউ ডি অফিসে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রির কাজ পেয়েছে। দিদি মাধ্যমিক পাশ, সাধারণ মানের ছাত্রী ছিল, বিয়ের খরচা আছে বলে বাবা আর পড়াল না, কেরানির চাকরি এবং জাতপাত কোষ্ঠী ইত্যাদি মিলিয়ে দেখে যোগ্য বিবেচনায় পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছে। দিদি ফরসা, গৃহকর্মনিপুণা। নাচ গানের কোনো পাট নেই বাড়িতে। আমার ভাই কলেজে, বোন স্কুলে পড়ে। সাধারণ মানের ছেলেমেয়েকে ট্যুইশনে ঠেলেঠুলে পড়িয়ে মোটা ডিগ্রি পাইয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য চাকরির পরীক্ষা ঘষটে অপেক্ষাতে বাবা একেবারেই অরাজি।
আমাদের স্কুল এমন কিছু নামকরা নয়, ছোট শহরের সাধারণ স্কুল। কিছু ছাত্রছাত্রী মাঝারিমানের ফল করে, খুব ভাল ফল করা কম, স্ট্যাণ্ড করা ছাত্র ক’বছরের পর হয়তো একটা আসে। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে স্কুলে আমি একটু উপরের র‍্যাঙ্কে পরীক্ষা পাশ করে এসেছি বরাবর। তাই বাবার আশা আমি একটু ভাল চাকরি পেতে পারি। আমিও নিজেকে ভাল কিছু পাবার দাবিদার বলে মনে করি। কিছু ভাল মাইনের চাকরির খবর বেরোলেই বাবা দরখাস্ত করতে বলে। এবারে যখন পি এস সির চাকরির খবর বেরোলো, বাবা সন্তর্পনে কাগজখানা এনেছিল, আমিও যথারীতি দরখাস্ত করেছিলাম বন্ধুদের না জানিয়ে। তারপর দেখা হয়েছে মাঝেমাঝে, কিন্তু আমি সে প্রসংগ তুলিনি ভুলেও। কিন্তু যেদিন পরীক্ষা, সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখি ওরা, মানে অসিত ও প্রতুল যাচ্ছে একই সঙ্গে।
আমাদের বাড়ি খুব বেশি দূরত্বে নয়, একসময় আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম, একসঙ্গে খেলতাম, তিনজনে সব কথা শেয়ার করতাম। পড়াশোনায় ও তিনজন কাছাকাছি। ক্লাসে ওরা ফার্স্ট সেকেণ্ড হয়, উল্টে পাল্টে। আমি শুধু তিনে থাকি। প্রতুল একবার চার ও হয়েছিল, সেবারই বাইরে থেকে এসে কস্তুরী ফার্স্ট হয়েছিল। কিন্তু আমি তিন নং থেকে নড়িনি। 
কস্তুরী আসার পর ক্লাসে স্যারেরা যখন প্রশ্ন জিগ্যেস করতেন তখন সেই বেশি জবাব দিত। সব কিছু্র জবাব যেন ওর ঠোটস্থ। প্রতুলের খুব রাগ হত, অসিত এবং আমার ও। এতদিন কোনো মেয়ে আমাদের এই কলোনির স্কুলে এই পর্যায়ে পৌছোয় নি। অদিতিও না, সে পাঁচের উপরে ওঠেনি। কস্তুরী বেশ ইংলিশ ও হিন্দিতে কথাও বলতে পারে। এই মেয়ে এখানে না এলেও পারত। কিন্তু তার মিলিটারিতে চাকরি করা বাবা সেই কাশ্মীর সীমান্তে ট্রান্সফার হয়ে গেছেন, পরিবারকে আমাদের শহরে নিজের মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই কস্তুরী আমাদের এখানে পড়তে এসেছিল।
মাধ্যমিকের পর আমরা নিজের শহরেরই কলেজে পি ইউ-তে গেলাম। আমাদের কলেজ তখনো শহরের একমাত্র কলেজ, কলাবিভাগের বিষয়ই বেশি, স্নাতকে অনার্স ও পড়া যায়, কমার্স ও সায়েন্স আছে শুধু পাসকোর্সের। আমরা সবাই কলাবিভাগেই ভর্তি হলাম। কস্তুরীই শুধু সায়েন্সে ভর্তি হয়েছিল। এখন আমরা অনেকটা স্বাধীন, ক্লাসের রুটিন স্কুলের মত ধারাবাহিক নয়, মধ্যে মধ্যে অফ পিরিয়ড থাকে, মধ্যে মধ্যে ক্লাসরুম বদল করতে হয়। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা কম হয়, নতুন বন্ধুও কিছু জুটেছে। তবে স্কুলের চাইতে অনেক বেশি মেয়েদের বিষয়ে আমাদের ইন্টারেস্ট হয়েছে। কিন্তু কোনো মেয়েই আমার কাছে ঘেঁষত না। আমি পাঁচফুট চার, রোগা, শ্যামলা; ফ্যাশন এখানে কেউই তেমন করে না, ছেলেমেয়ে সবাই সাধারণ জামাকাপড় পরে, আমিও ওরকমই। তবু আমার মনে হয় আমি বেশ স্মার্ট, অনেক বিষয়ে ভাসা ভাসা হলেও কথা বলতে পারি; চটজলদি কথার পিঠে কথা বলে চমক দিতে পারি। সেই আমি আগে থেকে কথা বললেও তারা দায়সারা একটা কথা বলে অন্যদিকে চলে যায়, নয়তো একেবারেই কিছু বলে না। মনে মনে ভাবতাম, ভাল একটা চাকরি যখন হবে ওরকম দু একটাকে কিনে নিতে পারব। এমন কি কস্তুরী, অদিতি, যারা স্কুল থেকে আমাদের সঙ্গে আছে, তারাও কথা বলত খুব কম। কস্তুরীর বাড়ি ও আমাদের বাড়ির দিকেই ছিল, অদিতি শহরের প্রান্ত থেকে আসত। কস্তুরী সায়েন্স নিয়ে যেন আরো ব্যস্ত হয়ে গেছে, কথার জবাব ও দেয় না অনেক সময়, পাশ কাটিয়ে চলে যায়। 
স্নাতক স্তরের পড়াশোনায় কিছু বিষয়ের অমিল ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে। আমি পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স নিয়েছিলাম। পি ইউএর ফাইন্যালে মার্কস ভাল হয় নি, অল্পের জন্য প্রথম বিভাগ ছেড়ে গেল। প্রতুল ইকোনমিক্‌সে অনার্স নিল, সে পি ইউতে ইকোনমিক্সে আশি শতাংশ পেয়েছিল। অসিত ম্যাথে লেটার, সে ম্যাথে অনার্স নিল। ওরা দুজনে পি ইউতে প্রথম বিভাগ পেয়েছে, বেশি প্রস্পেক্টিভ সাব্‌জেক্টে অনার্স পেয়েছে, যদিও আমরা স্কুলে প্রায় সমান ছিলাম, দু-চার মার্কসের ফারাক। আমি ভাবলাম পি ইউতে একটু খারাপ হয়েছে তো কি, গ্র্যাজুয়েশনে পুষিয়ে নেব। আমার পল সায়েন্সে অনার্স আছে, চাপ কম ওদের চাইতে, অনার্স অবশ্যই পাব। স্নাতক হবার পর আমি পি এস সির পরীক্ষা দেব। বাবার চাপে দু একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম বটে, সিরিয়াস ছিলাম না, কাজে লাগে নি। আমি চাই না বিএ পাশ করার আগে কোনো চাকরি পাই, তা হলে কেরানিগিরির বেশি কিছু পাব না। আমাকে ভাল কিছু পেতে হবেই। কিন্তু আমার এইসব আকাঙ্ক্ষার কথা ওদের বলি নি। পরে সারপ্রাইজ দেব। ওদের যেমন এখন কারো কারো এমন কি মেয়েবন্ধুও হয়েছিল জেনেছিলাম, সেসব কথা কি আর আমাকে বলে? আমরা পুরোনো বন্ধু হলেও এখন আর সব কথা শেয়ার করি না। দেখা কম হত বললে ভুল হবে, আসলে এড়িয়ে যেতাম। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ-এ চাকরির কোনো নোটিশ পড়ল কিনা দেখতে যখন যেতাম, কিছু দেখতে পেলে সবার অলক্ষ্যে ডিসপ্লে বোর্ডের উপরের তারের জালের ফাঁক দিয়ে কাঠি ঢুকিয়ে নোটিসটাকে ছিঁড়ে ফেলতাম, যাতে আমার পরে আর কেউ দেখতে না পায়। আমি জানি না আর কেউ এমন করত কি না।

স্নাতক হবার পর ও যদিও ইন্টারভিউ দিয়েছি ক’টা, এখনো কিছু হয়নি। শুনেছিলাম ওরা এম এ করেছে। এবং হালের নোটিশটি ওরাও কোনোক্রমে পেয়ে গেছে, তাই পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে আমার একই সঙ্গে। তাদের চোখেমুখে আমি যাচ্ছি বলে কোনো বিস্ময় নেই, বরং আমিই বিস্ময়ের ভাব কাটাতে পারছি না, যদিও প্রকাশ করিনি। আমরা আমাদের পরীক্ষার সেন্টার এম আর ইনস্টিটিউটে গেলাম। বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেছি, এখনো বন্ধ আছে হলটা। নোটিশে ছিল ন’টায় পৌঁছোতে হবে, এখন শুনছি দশটায় হল খুলবে। এদিকে এখনো ন’টা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।


প্রতুল বলল, ‘রাস্তার ওধারে ওই চায়ের দোকানটাতে বসি। ওখানে বসবার জায়গা আছে।’ ‘হ্যাঁ, চল, পরে লোকজন এসে গেলে নিরিবিলি পাব না।’ অসিত বলল। তিনজনই সাইকেল ঘোরালাম, রাস্তার অন্যদিকে যাবার জন্য। কিন্তু চায়ের দোকান কোথায়? আমাদের নিজের শহর, সব অলিগলি চেনা। রাস্তা পেরোবার আগে দোকানটাকে দেখেছি, খোলা, এবং দুখানা কাঠের বেঞ্চি সামনে সমকোণে পাতা। রাস্তা পার হবার সময় একটু ট্রাফিকের দিকে নজর রাখছিলাম, ওধারে পেরিয়ে দেখলাম, কোথায় দোকানটা? আরেকটু এগোলাম, খুঁজলাম, খানিকটা পিছিয়ে আবার খুঁজলাম, দুচারটে ঘুমটি দোকানের মত, কোনোটা খোলা, কোনোটা এখনো বন্ধ, কিন্তু কোনো চায়ের দোকানই নেই। 
‘আশ্চর্য, দেখলাম দোকানটা, কোথায় গেল এখন?’ অসিত বলল।
প্রতুল বলল, ‘এই তো এখানেই মনে হল দোকানটা ছিল।’
আমি বললাম, ‘আমার মনে হয়েছিল তোরা দোকানটা পাবি না।’
‘তুই পাবি ভেবেছিলি নাকি?’ প্রতুল বলল।
‘তুই তো সব কিছুই আগে পাস।’ অসিত বলল।
‘চল, ফিরে যাই।’
বলতে বলতে আমরা আবার রাস্তা ধরে ফিরে আসছি। কিন্তু এম আর ইনস্টিটিউট আর আসে না। এই তো রাস্তার এপারেই ছিল। আমরা কি চায়ের দোকান খুঁজতে অনেকটা এগিয়ে বা পিছিয়ে গিয়েছিলাম? এরই মধ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। তিনজনেই। সব কিছুই অচেনা লাগছে। এই চেনা জায়গাটা কী করে চিনতে পারছি না বুঝতে পারছি না! রাস্তায় কোনো লোককে পাচ্ছিনা যে জিগ্যেস করব। এদিকে দশটা বাজবার আর বেশি বাকি নেই।
‘ওই তো দেওয়াল’, আমার প্রাণে যেন বল এল। মনে পড়ল বাড়িটার পেছনের তিনদিক দেওয়াল ঘেরা ছিল, আগে দেখেছিলাম। সামনের দিকে একটু বেশি উঁচু, সেই দেওয়ালে গেট। দেওয়াল তো এম আর ইনস্টিটিউটেরই , কিন্তু এটা কোনদিকের দেওয়াল? এর মধ্যে দেওয়ালের চারদিক মনে হল ঘুরে ফেললাম, ঢুকবার দরজা কোথায়? ও, ওই তো গেট। কিন্তু বন্ধ। খুলে দেবার কাউকে দেখছি না। দশটা বেজে গেছে। ভেতরে লোক আছে, বোঝা যাচ্ছে। দেরি হয়ে গেছে আমাদের ।
আমরা দেওয়াল বেয়ে উঠতে চেষ্টা করলাম। পারছি না। হঠাৎ দেখি, প্রতুলের বাবা। এবং দেওয়ালের যেখানে আমি উঠবার চেষ্টা করছিলাম, সেখানে একটা ছোট সিঁড়ি লাগানো। আগে কেন সিঁড়িটা দেখতে পেলাম না?
প্রতুলের বাবা আমাদের দিকে তাকাল না। প্রতুলের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে চলে গেল, যেন প্রতুল ছোট ছেলে। ওরা গেল, সিঁড়িটাও নিয়ে চলে গেল। পরীক্ষা ভোগে গেল, আমি হতাশ হয়ে বন্ধ গেটের পাশে রাস্তার ধারে বসে পড়লাম। অসিত বলল, চল, ওদিকে মেলা হচ্ছে। আমি উঠলাম। অসিতের সঙ্গে ওদিকে চললাম। ওদিকে যে এত বড় মাঠ আছে তা জানতাম না এতদিন, আশ্চর্য। 
ওখানে নানা ধরনের মেলা লেগেছে। একধারে বইমেলা। ঢুকলাম সেখানে। আরে, সেখানে কস্তুরী বসে আছে, একটা মঞ্চের উপর চেয়ারে । কস্তুরী শুনেছিলাম আজকাল লেখালেখি করে। দুখানা বই বেরিয়েছে। এবারে আরেকখানা — ঘোষণা হচ্ছে — অধ্যাপিকা কস্তুরী ঘোষের কবিতার সংকলন ‘মনকুঁড়ি’র উন্মোচন হবে। সুন্দর নাম বইয়ের, মনকুঁড়ি। কস্তুরী বেশ নামি নামি লেখকদের সঙ্গে মঞ্চে বসে আছে, কিছু আলোচনায় মগ্ন। তার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে-ই মধ্যমণি। 
আমি মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম, সে সামনের দিকে তাকাল, কিন্তু আমায় দেখল কিনা বুঝতে পারলাম না। ও মেয়ের বরাবরই অহংকার ছিল। সুন্দরী, ইংরেজি- হিন্দিতে ঝরঝরে কথা বলতে পারা, পরীক্ষায় ছেলেদের টক্কর দেওয়া মেয়ে। কথা বলতে চেষ্টা করতাম, পাত্তা দিত না। মিলিটারির বেটি। এক এক দিন খুব রাগ হত। মনে হত বড্ড গুমোর। তবুও চোখ ফেরাতে পারতাম না। মাঝে মাঝে ওর যাতায়াতের রাস্তায় অনর্থক যেতাম, ওর পাশে দুচার কদম হাঁটতাম। আমার পড়াশুনো লাটে উঠছিল বুঝছিলাম, তবুও। 
পি ইউ পড়বার সময় কয়েকদিন দেখেছিলাম, কস্তুরী একটা শর্টকাট সরু গলি ধরে সে টিউশন পড়তে যায়, সেই রাস্তা ধরেই বাড়ি ফেরে। একদিন সন্ধ্যায় সে রাস্তায় একটা গাছের আড়ালে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম সে আসছে। তার ছোট অথচ উঁচু বুক দুটো শাড়ির আঁচলের উপর দিয়ে ফুটে উঠছে। কোঁকড়া চুল কপালের আধখানা ঢেকে আছে, ফরসা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হালকা শরীর নিয়ে বেশ তাড়াতাড়ি সে বাড়ির পথে চলছিল। গলিতে আর কেউ নেই, এই গলি আসলে অনেকগুলো বাড়ির সারির পেছনের পথ, তাই নির্জন। কস্তুরীর সামনে পথ আগলে আমি দাঁড়ালাম। বললাম, ‘শোন কস্তুরী।’
‘কি?’
‘তুই আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে যাস কেন?’ 
‘বাজে বকিস না সন্দীপ। রাস্তা ছাড়।’
‘একটু আমার সঙ্গে একটু চল। কথা বলি।’
কস্তুরী বলল, ‘আমার তাড়া আছে। রাস্তা ছাড়।’ সে আমার বাড়ানো হাত ঠেলে যেতে উদ্যত হল। আমি অতর্কিতে তাকে বাঁ হাতে জড়িয়ে তার বুকে ডান হাতে চাপ দিলাম। সে আমাকে ঠেলে দৌড়ে চলে গেল। 
তারপর থেকে সে আর এই রাস্তায় আসে নি, বোধ হয় টিউশন ছেড়ে দিয়েছিল। কদিন পর পরীক্ষা হয়ে গেল, পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিল। আমার একটু খারাপ লেগেছিল, ও ফার্স্ট ডিভিশন পাবার মেয়ে, বোধ হয় আমি তার ক্ষতি করে দিলাম। কেন, এত গুমোর কেন তার? তাই তো তাকে একটু শিক্ষা দিয়েছিলাম সেদিন।
সে আমাদের শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেল স্নাতকের পাঠ নিতে। শুনেছিলাম সে সায়েন্স ছেড়ে বাংলায় অনার্স নিয়েছিল, তারপর বাংলায়ই এম এ করেছিল ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে। তার পরই কলেজ শিক্ষকের চাকরি, তারপর চাকরি করতে করতেই ডক্টরেট করছে শুনেছি। এর পর আর জানিনা, বিয়ে করেছে কি না খবর পাইনি।
সেদিনের পর দেখাও হয়নি আর। এতদিন পর এই আজ দেখছি।
কিন্তু সে আমাকে দেখল না, আজও না। আমাকে বিদ্রূপ করেই যেন অসিত বলল, ‘চিনতে পেরেছিস? কস্তুরী।’ আমি বুকভর্তি জ্বালা নিয়ে অন্যদিকে গেলাম।   
ওই তো ওদিকের মঞ্চে অদিতি গান করছে। এই অদিতি পি ইউতে কলাবিভাগে স্ট্যাণ্ড করেছিল। বি এ পড়ার সময় সে হল অসিতের বান্ধবী। কস্তুরী চলে যাবার পর আমি একটু চেষ্টা করেছিলাম অদিতির কাছে ঘেঁষতে। কিন্তু সেও আমার দিকে তাকাত না। শেষপর্যন্ত অসিতই তাকে জয় করল। অসিতের সঙ্গেও তাই আমি মেলামেশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। 
অদিতি এখন মাথায় একটা মুকুটের মত অলংকার পরেছে, সুন্দরী, উজ্জ্বল বেশভূষা। একটা একটা গান করছে, লোকে বাহ বাহ করছে। তুমুল হাততালি পড়ছে। কখন থেকে যে সে এত ভাল গান গাইতে আরম্ভ করল! কলেজের ফেস্টে তেমন শুনিনি। আসলে আমি ও আমার মত কিছু ছেলে ছিলাম যারা ফেস্টে মেয়েদের দেখতেই ভালবাসতাম, গেটে ভিড় করতাম, যদি কাছে থেকে দেখা যায়, একটু ছোঁয়া পাওয়া যায় । কালচারালে তত উৎসাহী ছিলাম না, গান বাজনা বুঝতাম না। অডিয়েন্সে থাকতাম, হুল্লোড় করতাম ফেস্টের কটা দিন। তারপর আবার গতানুগতিক। তাই বোধহয় মেয়েরা কেউ কাছে ঘেঁষত না।
অদিতিও আমায় দেখল না। অসিত মঞ্চের একেবারে সামনে গিয়ে বসল। অদিতি তার দিকে সামান্য হেসে একটা কিছু ইঙ্গিত করল। কিছুক্ষণ পর ওর গান শেষ হয়ে গেলে সে উঠে অসিতের দিকে চোখের ইশারা করে মঞ্চের পেছনের দিকে চলে গেল। অসিত ও স্টেজের পেছনে গেল, আমি আর দেখতে পেলাম না।
মাঠ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, আমি একটা চেয়ারে অনর্থক বসে রইলাম। কেউ একজন আমাকে ঠেলছে। আমি চমকে উঠলাম। সে বলল, সে চেয়ার গোছাতে এসেছে। চোখ খুলে দেখি, কোথায় কি, এক ভবঘুরে আমাকে ঠেলছে। নিজেকে দেখলাম, আমি সন্দীপ বসু, পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়, ডিএম অফিসের কেরানি, যে বাবার অবসরের একবছর আগেই মৃত্যুর জন্য অফিসের অনুকম্পায় কেরানির চাকরিটা পেয়েছিল কারণ স্নাতকে অনার্স পাওয়া থেকে কোনো চাকরির পরীক্ষা কিছুতেই যে সফল হয়নি, বিয়ে আরেক ছাপোষা ঘরের মেয়ের সঙ্গে হয়েছিল, এবং ঘরের নিত্য বায়না এড়াতে সন্ধ্যেয় যাকে পার্কের বেঞ্চিতে খানিক বিশ্রাম নিতে হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত