| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

রবির বৌঠান কাদম্বরী: মৃত্যুঞ্জয়ী কাদম্বরী দেবী । কাঞ্চন রানী দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
মাটিতে লুটিয়ে পড়া শুকনো ঝরাপাতা বৃষ্টির হাজার ফোটায়ও আর প্রাণ ফিরে পায় না। ধূলিকণা, বৃষ্টি একাকার হয়ে পাতাগুলোকে কাদার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে সাহায্য করলেও তার সজীব-সতেজ জীবন হয়ে যায় অতীত। কিন্তু কিছু চঞ্চল জীবন শুকনো পাতার মতো অকালে ঝরে গিয়েও কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় না। কখনো আলোচনার কখনোবা সমালোচনার চরিত্র হয়ে তারা থেকে যায় বিদগ্ধজনের মানসে।
 
 
কাদম্বরী দেবী ইহজগৎ ছেড়ে গেছেন ১৩৬ বছর আগে। কিন্তু তার প্রসঙ্গে এখনো এতো বেশি আলোচনা হয় যেন তার চিতার আগুন এখনও জ্বলছে। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের প্রসঙ্গ এলে রবীন্দ্রনাথের পরপরই সমধিক উচ্চারিত নাম কাদম্বরী দেবী। কোনো সাহিত্যিক, গবেষক না হয়েও অদৃশ্যভাবে তিনি যেন রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্যের সর্বত্র বিরাজমান।
 
 
রবীন্দ্র সাহিত্যের সমালোচনা দুঃসাধ্য ও দুঃসাহসী হওয়ায় অনেকেই রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী সম্পর্ক (তুলনামূলক সহজ) নিয়েই গবেষণায় ব্যস্ত। জীবদ্দশায় কে কার উপর কতটা প্রভাব ফেলেছিলেন সেটিই মূলত আলোচিত হয়। তাহলে কি কাদম্বরী দেবীর নিজস্ব সত্ত্বা ততটা শক্তিশালী নয়? যা নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা হতে পারে।
 
 
 
আফিম খেয়ে তিনি নিজেকে হত্যা করেছিলেন অর্থাৎ আত্মহননের পথে হেঁটেছিলেন। এখনো পৃথিবীতে প্রতিদিন অগণিত মানুষ নিজেকে হত্যা করেন। এরপর প্রথমেই যে প্রশ্ন উঠে সেটি হলো। এটি আত্মহত্যা, নাকি হত্যা? নাকি আত্মহত্যায় তাকে প্ররোচনা করা হয়েছে? আধুনিককালে আত্মহত্যার প্ররোচনায় অসংখ্য মামলাও হয়। যিনি আত্মাহুতি দেন শুধু তিনিই জানেন প্রকৃত কারণ। তারপরও নিকটজন, সমাজ, পরিবার জানার চেষ্টা করে কেন তিনি এই পথে হাঁটলেন।
 
 
সবাই মৃত্যুর আগে মৃত্যুবার্তা বা সুইসাইড নোট লিখে যান না। কেউ আবার লিখে যান ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’। এটিই বা কতটুকু সত্য? হয়তো তিনি মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে কোনো সত্যকে আড়াল করে প্রকৃত দোষীকে বাঁচিয়ে যান। কোনো ব্যক্তিবর্গ দায়ী হলে আইনী পদ্ধতিতে তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু অপরাধী যদি হয় এই সমাজ, সংসার, সংস্কার, প্রথা- তাহলে কিভাবে শাস্তি কার্যকর হবে?
 
কাদম্বরী দেবী মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোট লিখেছিলেন বটে, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির বাইরের আর কেউ তা পাঠের সুযোগ পায়নি। আত্মহত্যা যে কোনো পরিবারের জন্যই অসম্মানের ডালি নিয়ে আসে। ঠাকুরবাড়ির ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। অন্যদিকে গবেষণার মাধ্যমে লব্ধ দীর্ঘ মৃত্যুবার্তা (অনেকেই নিজের মতো করে লিখেছেন) পাঠকরা অনেকেই পড়েছেন। সেটির সঙ্গে বাস্তবে লিখিত সুইসাইড নোটের কতটা তফাৎ- তা বিশ্লেষণ করতে আরো অনেক গবেষণা প্রয়োজন।
 
 
বাদ দেয়া যাক এসব গবেষণার চক্র। ফিরে যাই আবার কাদম্বরীর গল্পে। যার আয়ুষ্কাল মাত্র পঁচিশ বছর। তন্মধ্যে আট বছর কেটেছে হাড়কাটা গলিতে আর বাকি সময় ঠাকুর পরিবার তথা শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের পর কাদম্বরী দেবীর নতুন ঠিকানা হলো ঠাকুরবাড়ি। এক্ষেত্রে কাদম্বরীর বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি না বলে ঠাকুরবাড়ি বললেই পাঠকরা দ্রুত বুঝতে পারবেন।

 আজ হোক আর প্রায় সার্ধশত বছর আগেই হোক- বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি আসার প্রথা একইরকম। বর্তমান যুগে ২৫ বছর বয়সে অনেকেরই শ্বশুরবাড়ি পদার্পণ করা হয় না। কিন্তু কাদম্বরী দেবী ঐ বয়সেই হাড়কাটা গলি, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, বহির্মহল, পরপার সবকিছু মাতিয়ে রবীন্দ্র জীবনেও আলোড়ন তুলেছিলেন, যা আজও আলোচনার তরতাজা বিষয়।
 
 
এই হাড়কাটা গলি ঠাকুরবাড়ির অদূরেই। ১৮৬৮ সালে ৫ জুলাই জন্মদিনে বিয়ে হয়ে কাদম্বরী এলেন ঠাকুরবাড়িতে। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে ‘নতুন’ নামে পরিচিত থাকায় তিনিও কাদম্বরীর চেয়ে নতুনের বউ, নতুনদার বউ বা নতুন বউঠান- এরকম আখ্যা পেলেন। নামে কী আসে যায়? নাম মানুষকে বড় করে না বরং মানুষই নামকে বড় করে। কাদম্বরী দেবী তো তার নামের জন্য বিখ্যাত নন। তিনিই তার নামকে বিখ্যাত করেছেন।
 
ন’বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ঠাকুরবাড়ির বউ হলেন। অত বড় বাড়ির বউ হওয়ার পর নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি, প্রথা সব কিছু মানিয়ে নেয়া স্বভাবতই সহজ ব্যাপার ছিল না। তার ঘর ছিল তিনতলায়। তিনতলা বা উপর তলায় থাকলেই কি মানুষ সুখী হয়? সুখতো একতলাতেও থাকতে পারে, কখনো তলাবিহীন ঘরও হতে পারে সুখের আশ্রম। তিনি কি চিরকালই সুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন? তার মানসিক অবস্থা কখন বিপর্যস্ত হলো? কখন কোন্ পরিস্থিতিতে তিনি আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত নিলেন? এর জন্য কি একক কোনো কারণ আছে, নাকি অনেকগুলো কারণ মিশ্রিত? এই প্রশ্নগুলোই বারবার ঘুরে ফিরে আসে।
 
 
রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী দেবীর বয়সের ব্যবধান মাত্র দুই বছর। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের পরে বালিকা বধুটির খেলার সাথী হয়ে উঠলেন তিনি। মা-বাবার চৌদ্দতম সন্তান রবীন্দ্রনাথ মাতৃহীনা হয়েছিলেন চৌদ্দ বছর বয়সে। বনেদি প্রথা হিসেবে ঠাকুরবাড়ির শিশুরা ধাত্রী সাহচর্যেই বেড়ে উঠতেন। মায়ের মৃত্যুর খবর নিয়ে দাসী যখন রবির কামরায় এসেছিলেন, তখন দাসীকে ঘর থেকে বের করে দেন কাদম্বরী, যাতে কিশোর মনে আঘাত তীব্র না হয়। তাই কিশোর বয়সে মাতৃহীনা রবীন্দ্রনাথের মন, মননে কাদম্বরী দারুণ প্রভাব ফেললেন। রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন আর কাদম্বরী হয়ে উঠলেন প্রধান সমালোচক!
 
বলতে গেলে তার বেড়ে ওঠা ঠাকুরবাড়িতেই। তিনি কোনো অভিজাত বংশের মেয়ে না হওয়ায় ঠিক সাদরে তার বরণ হয়নি। যা তিনি পদে পদে উপলব্ধি করেছেন। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পাশে তিনি সাদা চোখেই বেমানান। ঠাকুরবাড়ির প্রচেষ্টা, পরিবারের রীতিনীতির জালে পড়ে তিনিও একদিন যোগ্য হয়ে উঠলেন ঠিকই, কিন্তু তার অজানা কষ্ট দূর করার মতো অকৃত্রিম বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ ছিল না। রবির জীবনে তার প্রভাব বা তার জীবনে রবির প্রভাব, আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। বরং আমরা দৃষ্টি ফেরাবো কাদম্বরীর মনোজগতে।
 
 
গাঙ্গুলী পরিবার আর ঠাকুর পরিবারের অবস্থান সমপর্যায়ের না হওয়ায় বাপের বাড়ির সঙ্গে কাদম্বরীর কোন যোগাযোগের তথ্য কোথাও দেখা যায় না। মেয়েরা যখন শ্বশুরবাড়ির নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়ে তখন গুরুত্বপূর্ণ ঘুলঘুলি থাকে তার বাপের বাড়ি। বাবা শ্যাম গাঙ্গুলীর মর্যাদা ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার (বাজার-সদাই করার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী) মাত্র। আর মাতৃহীনা হয়েছিলেন আগেই, তাই এককূল তার ছিলই না বলা চলে। ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের জন্যও শক্ত নিয়ম ছিল। তাদের উপরও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হতো, যদিও বহির্জগতের অনেক কিছুই ছিল উন্মুক্ত। যেখানে নাটক মঞ্চায়ন, জাহাজ পার্টি সবই ছিল সম্ভবপর। কিন্তু সব বউদের ভাগ্যে সেটা জোটেনি। কারণ, সবাই তো আর জ্ঞানদানন্দিনীর মতো সাহসী বা প্রভাবশালী ছিলেন না।
 
বাবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার জন্য যে কাদম্বরীকে অহরহ খোটা শুনতে হতো, তো সহজেই অনুমেয়। এছাড়া মানসিক যন্ত্রণা ও নিঃসঙ্গতার একটি বড় কারণ ছিল তিনি নিঃসন্তান। যে কোন মানুষই তার সন্তানকে নিয়ে শত বিপদের মুখেও বেঁচে থাকার শক্তি খুঁজে পায়। কাদম্বরীর সে সুযোগ ছিল না। তার উপর অন্যদের কটুকথা তার সন্তানহীনতার কষ্টটাকে আরো তীব্র করে দেয়।
 
রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী দেবীর পারিবারিক সম্পর্ক ছিল দেবর-বৌদি। তবে এই স্বীকৃত সম্পর্কের বাইরেও তাদের গোপন প্রেম-প্রণয় নিয়ে সরস আলোচনা আছে। যদিও তার অকাট্য প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেননি। তবে একথা অনস্বীকার্য, অধিকাংশ বিখ্যাত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যে কেউ কেউ নীরবে নিভৃতে অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সেই অনুপ্রেরণার মূল উৎস ছিলেন কাদম্বরী দেবী।
 
ঠাকুরবাড়িতে এভাবেই ১৭ বছর কেটে যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাস পরই কাদম্বরী আত্মহত্যা করায় তার মৃত্যু ও রবির বিয়ের সঙ্গে একটা যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন কেউ কেউ। এখানেই প্রশ্ন আসে- তিনি যদি শুধু রবির বিয়ের কারণেই আত্মহত্যা করেন, তাহলে ৪ মাস অপেক্ষা করলেন কেন? তাছাড়া রবির বিয়ের আগেও কেনইবা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন? মূলত, অতিযোগ্য স্বামীর বহিরাঙ্গনের ব্যস্ততা, সন্তানহীনতার যন্ত্রণা, অন্দর মহলের কটুকথা, বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ অজানা অনেক কারণ ও অভিমান কাদম্বরীর আগামীর পথে বিস্তীর্ণ কাটা বিছিয়ে দিয়েছিল। যে পথে পা বাড়ালেই শুধু রক্ত ঝরে!
 
যখন কেউ আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন মনে করেন না, যখন মনে হয় তিনি আর কারো জীবনে অপরিহার্য নন; তখনই হয়তো নিজেকে শেষ করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ঘোড়া প্রেমিক স্বামীর বদান্যতায় ঘোড়ার পিঠে চড়ার সৌভাগ্য হলেও জীবনকে ঘোড়ার মতো দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে নিতে পারেননি কাদম্বরী দেবী। কারণ, লাগাম যে নিয়তির হাতে! মাত্র ২৫ বছর বয়সে যখন শারীরিক-মানসিক বিকাশ অনেকটাই পরিপূর্ণতা পেতে শুরু করে, ঠিক তখনই এই শ্যামবর্ণের মেয়েটি তার সব চাপা কষ্টকে পরাস্ত করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেও যেন মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠলেন। তার অকাল মৃত্যু অসময়ে জীবনকে কেড়ে নিলেও রবীন্দ্রসাহিত্য বা ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস থেকে তাকে সরিয়ে দিতে পারেনি। তবে জন্ম তারিখেই বিয়ে হওয়া মেয়েটি চৈত্রের তাপদাহ পেরিয়ে ঝড়ো বৈশাখের হাতে জীবনকে সঁপে দিয়ে ইহজগতের জরাজীর্ণতা থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন বৈকি।
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত