| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১১) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“উত্তমের ব্যাকগ্রাউণ্ডটা একটু বল তো।”  

       “উত্তম? মানে আমাদের কলেজের উত্তম? ঠিক কি জানতে চাইছ কুশলদা?”

       “ব্যাকগ্রাউণ্ড। ব্যাকগ্রাউণ্ড বলতে তুই যা বুঝিস ঠিক সেটুকুই বল।”

       কুশল ব্যানার্জি কথা বলার সময় ভুরু কুঁচকে রাখেন। যে কেউ দেখলে ভয় পাবে। শুভ্রাংশু অবশ্য ভয় পেল না। ও জানে, আদতে প্রাথমিক অস্বস্তি সরিয়ে কথা বলতে শুরু করলেই কুশল ব্যানার্জি অনর্গল কথা বলে যাওয়া একজন আদ্যন্ত ভালো মানুষ। তুখোড় ছাত্রনেতা। খুব বেশি বয়স নয়। ছাত্র সংগঠন থেকে খুব দ্রুত যুব সংগঠনে পদোন্নতি হয়েছে। শুধু পদোন্নতি নয়, পদমর্যাদা বেড়েছে। দলের যুব সংগঠনে এই মুহূর্তে কুশল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার দায়িত্বে। কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র। কাজেই প্রতি মুহূর্তে কলেজের ছাত্রছাত্রী, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। ইউনিয়ন রুমে প্রায়ই চলে আসে। কলেজের যে কোনও অনুষ্ঠানের খবর আগেই পৌঁছয় কুশলের কাছে। কলেজের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ থেকে প্রিন্সিপাল সকলের কাছেই স্বচ্ছন্দ এবং গ্রহণযোগ্য। সবার কাছে সমান আদরণীয় হওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব কুশলের না হলেও তার চেহারায় একটা স্পষ্টবক্তা সৎ মানুষের লক্ষণ রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়, নীতি আর আদর্শের জন্য মাটি কামড়ে লড়াই করবে। সকলেই সম্ভ্রমপুর্ণ দূরত্বে রাখে। এদের সঙ্গে অবশ্য গলাগলি বন্ধুত্ব হওয়া মুশকিল।     

       কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি সুমিত চৌধুরী, কালচারাল সেক্রেটারি শুভ্রাংশু চ্যাটার্জি, ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট অনল গুপ্ত আর ভাইস প্রেসিডেন্ট অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী আজ সন্ধেবেলায় এলসিতে এসেছে। এলসিতেই কুশলের সঙ্গে মুখোমুখি। সকলে মিলে পার্টি অফিসের বাইরে লাগোয়া চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েছিল। ওখানেই প্রশ্নটা করে কুশল।

       “তেমন ডিটেলে কিছু জানি না কুশলদা। নবপল্লির দিকে থাকে। বাবা পার্টির সমর্থক।”

       “সমর্থক? মানে ভোট দেন?”

       “না, শুধু ভোট দেন না। অ্যাক্টিভ কর্মী।”

       “সেটা বলবি তো। সমর্থক, ভোটার আর ক্যাডারের মধ্যে এখনও বেসিক পার্থক্যটা বুঝিসনি?”

       শুভ্রাংশু থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। সে সত্যিই এত ভেবে কথার উত্তর শুরু করেনি। কুশলদার সঙ্গে কথা বলার সময় চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হয়।

       “আর কেউ জানিস কিছু?”

       প্রশ্ন এবার সুমিত, অনল, অনিরুদ্ধর দিকে। সুমিত আর অনল কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি আর প্রেসিডেন্ট। তারা শুভ্রাংশুর তুলনায় সপ্রতিভ। আত্মবিশ্বাসী।

       “উত্তমের বাবা শিবপদ চক্রবর্তী। নবপল্লীতে অত্যন্ত সুনাম। স্টেট ট্রান্সপোর্টের ইউনিয়নে যুক্ত। জঙ্গি নেতা ছিলেন বলে শুনেছি। মিছিলে মিটিঙে খুব রেগুলার। ভীষণ অ্যাকটিভ।” সুমিতের কথা শেষ না হতেই অনল বলে, “যদ্দূর জানি, ওর বাবা এখন আর তেমন অ্যাকটিভলি কাজ করেন না। চাকরিতে রিটায়ারমেন্টের খুব বেশিদিন বাকি নেই। কাজের জায়গাতেও অনিয়মিত।”

       কুশল সকলের দিকে একবার তাকায়।

       “নবপল্লীর কলোনীতে ওদের বাড়ি বললি না? কলেজের আর কেউ ওই পাড়ায় থাকে? আর একটু খোঁজ লাগাস তো।”   

       “কেন কুশলদা? সিরিয়াস কিছু?” অনল প্রশ্ন করে।

       “নাঃ, সেরকম সিরিয়াস কিছু নয়। ওর একটা ডায়েরি পড়ে গিয়েছিল সেদিন। একটি ছেলে এসে পার্টি অফিসে দিয়ে গেছে। আমাদের কলেজের নাম লেখা। তার মধ্যে একগাদা নোটস।”

       “নোটস? মানে ক্লাস নোটস? উত্তম আবার ক্লাস করে কখন?”

       শুভ্রাংশু হেসে ফেলে।

       কুশল ব্যানার্জিও হাসেন, সব কথার বিস্তারিত উত্তর দেওয়ার মানে হয় না। প্রয়োজন নেই। উত্তমের ডায়েরিতে রাশিয়া থেকে চীন, বোফর্স থেকে জনতা দল, খাদ্য আন্দোলন থেকে নকশাল মুভমেন্ট–  বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টুকরো টুকরো নোট নেওয়া আছে। বোঝাই যাচ্ছে খবরের কাগজ থেকে নেওয়া। কিছু বইপত্রের নাম রয়েছে। রেফারেন্স করতে চাওয়ার চেষ্টা স্পষ্ট। শেষের পাতায় বেশ কিছু ফোন নম্বর।

       উত্তমকে ডেকে ডায়েরিটা ফেরত দেওয়ার আগে পুরোটা উল্টেপালটে দেখা হয়েছে একবার। কুশল নিজেও দেখেছে এক ঝলক। জাস্ট চোখ বুলিয়ে যাওয়া। বেশ পড়াশুনো করতে চাওয়া ছেলে বলেই মনে হয়। কলেজ থেকে মাঝেমধ্যে দুপুরে এসে বসে। সন্ধের দিকে নিয়মিত। একটু চুপচাপ। কিন্তু অনেকেই বলেছে, উত্তমকে যতটা শান্ত বা নির্বিরোধী মনে হয়, ও ততটা ঠাণ্ডা নয়। ইউনিয়ন রুমে প্রায়ই তর্কে জড়িয়ে পড়ে। জয়দীপের সঙ্গে তো প্রায়ই সমস্যা। টুকটাক আঁচ বাইরেও যায়। জয়দীপের বয়স কম, কিন্তু বুদ্ধির দৌড় বেশি। সে প্রকাশ্যে মানস প্রামাণিকের বিরোধিতা করতে শুরু করেছে। উত্তমের মতো গাঁট কিছু ছেলেকে একজোট করতে না পারলে খুব মুশকিল। গ্রাসরুট লেভেল থেকে প্রতিরোধ করতে হবে। 


আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১০) । শ্যামলী আচার্য


       যে তলিয়ে গিয়ে পড়াশুনো করছে, যে পড়েশুনে এসে তর্ক করছে আর যে অল্পেই মাথা গরম করছে, তাদের নিয়ে পরে খুব মুশকিল হয়। ওর কলেজের ইউনিয়নের মধ্যেই উত্তমকে আগে বুঝে নিতে হবে। সেভাবেই ভাবা হয়েছে। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউণ্ড, পাড়া কালচার এসব ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করে।        

লোকাল কমিটির এই অফিসঘরটা বড় রাস্তার ওপরেই। বছর চারেক আগে নতুন ঝাঁ-চকচকে দোতলা তৈরি হলেও এই বছরের গোড়াতেই আবার একবার রঙ হয়েছে। প্লাস্টিকের নতুন চেয়ার এসেছে আরও গোটা পঁচিশেক। টকটকে লাল। হাতল-ওলা। দোতলায় হলঘর। একটানা লম্বাটে। ছ’টা সিলিং ফ্যান। চারটে টিউবের আলোয় সাদা দেওয়ালগুলো আরও ঝকঝক করে। ঘরের এক প্রান্তে দেওয়ালে একটা বিরাট বোর্ড। সেখানে লেখার ব্যবস্থা আছে। পাশে চক-ডাস্টার রয়েছে। একদম আধুনিক ক্লাসরুম। ডানদিকের দেওয়ালে নোটিসবোর্ড। কোথায় কখন পার্টির কী কর্মসূচী। বাঁদিকে বিভিন্ন কাগজের কাটিং, ছবি। পার্টির মুখপত্র একদিকের দেওয়ালে সাঁটানো। প্রতিদিনের কাগজ বদলে দেওয়া হয় নিয়ম করে।

       একতলার ঘরটা অগোছালো, এলোমেলো। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র। তিনটে বড় বড় টেবিলে স্তূপাকৃতি ফাইল। দুটো বড় আলমারি। লোহার। দুটোই সবসময় হাট করে খোলা। সকালে তালা খোলা থেকে রাতে দরজা বন্ধ হওয়া অবধি সকলে আলমারিদুটোকে খোলাই দেখে। ভেতরে ঠাসা কাগজ, ফাইল, বই। আলমারির পাশে তিনটে লোহার র‍্যাক। তার মধ্যে কিছু বইপত্র আছে। পার্টির বই। সেদিকে একটা ছোট কেরোসিন কাঠের চেয়ার আর টেবিল নিয়ে ইন্দুদা বসেন। ওনার চোখ এড়িয়ে র‍্যাকের বইতে হাত দেবার উপায় নেই।      

       সুমিত শুভ্রাংশু অনল অনিরুদ্ধ একে একে গিয়ে ঢুকল অফিসে।

       ভেতরে অনেকেই আছেন।

       “ওপরে চল। আজ রজদ্দা আছেন, ওখানেই বসব।”  

       একতলার ঘরের ভেতরে এক পাশ দিয়েই ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। অনেকেই নিচে ছড়িয়েছিটিয়ে। কাগজ পড়ছেন। কেউ লিখছেন কিছু। কাউকে তেমন লক্ষ্য না করেই দোতলায় উঠল ওরা।

       বোর্ডে কিছু একটা মুছছেন কেউ। বোঝাই যাচ্ছে, আজ নিছক আলোচনা নয়। রীতিমতো ক্লাস।

       কুশল একবার তাকিয়ে দেখে তার কলেজের জুনিয়র চারজনের দিকে। কলেজের ইউনিয়ন এদের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। অতগুলো ছেলেমেয়ের ভোট। কলেজের ইমেজ নিয়েই তারা বাড়ি ফেরে। পাঁড় কংগ্রেসি বাড়ির মেয়ে গিয়ে কাস্তে হাতুড়িতে ছাপ দেয় তো কলেজের জন্য। এরা যেমন ভাবে নিজেদের প্রোজেক্ট করবে, তেমন ভাবেই স্ট্রং বেস তৈরি হবে। বিষয়টা এখন তো শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার নয়। রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার। একটাও ছাপ বাইরে যাওয়া যাবে না।

       কেন্দ্রীয় সরকারকে হটিয়ে একটা বন্ধু সরকার আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রের বঞ্চনা জাতীয় ঝামেলা সরিয়ে এর ফায়দা তোলাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। আগে পার্টি লাইন। তারপর বিরোধীদের থামানোর জন্য পালটা যুক্তি। একই সঙ্গে এই নতুন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা। অকংগ্রেসি দলগুলো বামপন্থীদের সমর্থন ছাড়া পুরোটা লড়তে পারবে না। তিন-চারটে রাজ্যে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। ভোটের দিন ঘোষণার আগে থেকেই গ্রাউণ্ড ওয়ার্ক তৈরি করে নিতে হবে। 

       শুরুটা আপাতত কলেজগুলোর ইউনিয়ন রুম দিয়েই হোক। ক্যাম্পেন একদিনে হয় না। স্লো বাট স্টেডি।

       রজদ্দা চেঁচিয়ে বলেন, “ভিপি’র কালকের মিটিঙের মিনিটস আছে কারও কাছে? ওর লাস্ট প্রেস কনফারেন্সটা ডিটেলে লিখেছিল কেউ? থাকলে ওটা নিয়ে ওপরে আয়।” 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত