| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১৮) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

“দর্শন কাকে বলে? কোনও ধারণা আছে তোমাদের? মাইণ্ড ইট, আমি কিন্তু বইয়ের ডেফিনিশন চাইছি না। আমি একদম ধারণা চাইছি, আই মীন, কনসেপশন, তোমাদের যা মনে হয়, তোমরা যেভাবে এই বিষয়টাকে দেখছ। টেক্সট বুকের কথা বলবে না। প্লিজ।”   

       পাসের ক্লাসে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। গ্যালারির মতো ক্লাস-রুম। ক্লাসে দু’একটি হাত উঠল। অল্পবয়সী প্রফেসর তাকালেন তাদের দিকে। চোখে প্রশ্ন।

       “স্যার, দর্শন তো একটা সংস্কৃত শব্দ, দৃশ ধাতু থেকে দর্শন শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ হল দেখা। আর এই যে কোনও বস্তুর প্রকৃত সত্তাকে সঠিকভাবে দেখা মানেই দর্শন।”

       মৃদু হাসলেন অধ্যাপক।

       “বেশ। আর কেউ?”

       লাস্ট বেঞ্চ থেকে একটি গলা ভেসে এল।

       “স্যার, আমার কাছে দর্শন কোনও স্থির বিষয় নয়। দর্শন গতিময়, যেমন যেমন সময় বদলাবে, ঠিক তেমনভাবে বদলে যাবে দর্শন। কোনও দার্শনিক মতবাদ মানেই সেটা সেই দার্শনিকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে, তিনি কোন সমাজে রয়েছেন, কোন আর্থিক পরিস্থিতিতে, সেই সময়কার রাজনীতি…”

অনেকক্ষণ ধরে বলছে ছেলেটি। চুপ করে শুনছেন অধ্যাপক, মাথা নাড়াচ্ছেন, মুখে প্রশ্রয়ের হাসি না বিদ্রূপ বোঝা মুশকিল। মিষ্টু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অমিত্রজিত উঠে দাঁড়িয়ে বলছে। অমিত্রজিত সান্যাল। ওর পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স সম্ভবত। ঠিক জানে না মিষ্টু। ফিলজফি ক্লাস-এ এই প্রথম দেখল। চমৎকার গান গায়। ক্যান্টিনে বসে গান করে গিটার নিয়ে। কম কথা বলে। গানই গায় বেশি। আইপিটিএ’র গান। সলিল চৌধুরীর গান। কলেজে কে যেন বলছিল, ও নিজে গান লেখে, সুর দেয়। সেগুলোও গায় মাঝেমধ্যে। ওর গানের জন্যই ওকে চেনে অনেকে। মিষ্টু ক্যান্টিনে যায় না বলে ওর গান সেভাবে শোনা হয়নি। চেনে, জানে, ওই পর্যন্তই।         

       মিষ্টু হাত তোলেনি, চুপচাপ শুনছিল। আগ বাড়িয়ে কথা বলা ওর কোনওকালেই ধাতে নেই। তার ওপর আবার ফিলজফির ক্লাস। পাস সাবজেক্ট। তার অনার্স ইতিহাস। সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রয়েছে। আরেকটা সাবজেক্টে অনেকেই সোশিওলজি নিয়েছে। মিষ্টু নিয়েছে ফিলজফি। ইলেভেন-টুয়েলভেও স্কুলে তার একই কম্বিনেশন ছিল। সে আর বদলায়নি।

তিন স্টেশন দূরের পথ পেরিয়ে মিষ্টু প্রেসিডেন্সি কলেজে আসে। কলকাতা তো বটেই, শিক্ষাজগতে প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম বললেই শ্রোতার অভিব্যক্তির মধ্যে একটা সমীহ থাকে। সেরা ছাত্র-ছাত্রীদের জায়গা। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের ভালো রেজাল্ট তাকে সাহায্য করেছে অনেকটাই। সেই সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষা। প্রেসিডেন্সির অ্যাডমিশন টেস্ট, নিজস্ব নম্বর মিলিয়ে খুব সহজে সে চান্স পেয়েছে এখানে। পাড়ায় সে বরাবর গুড গার্ল। পাড়ার স্কুলেও। মিষ্টু প্রচুর নম্বর পাবে, খুব ভালো রেজাল্ট করবে, এমন বিশ্বাস তার স্কুলের দিদিমণিদের বরাবরই ছিল। তাঁরাই কেউ কেউ বলেছিলেন, বড় স্বপ্ন দেখো জয়িতা। এরপর প্রেসিডেন্সিতে পড়তে যাও। তুমি ঠিক চান্স পাবে। দেখবে একটা অনেক বড় জগত খুলে যাবে তোমার চোখের সামনে। দারুণ সব প্রফেসর পড়াবেন সেখানে। জীবন তো শুধু নম্বরের মধ্যে ঘুরপাক খায় না। তার বাইরেও একটা বড় শিক্ষার ময়দান খোলা পড়ে থাকে। সেটুকুর জন্য একটা বড় ইন্সটিটিউশনে তোমাকে যেতেই হবে। কী আর এমন দূর…। শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে হেঁটে চলে যাবে। পড়তে ভালো লাগবে, বড় লাইব্রেরি, চারপাশে অনেক ভালো ছাত্র-ছাত্রী, নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস পাবে।  

সত্যিই অসাধারণ পড়ান এক-একজন। নতুন দিগন্ত খুলে যায় তার চোখের সামনে। নিজেকে এইটুকু সময় তার বড় ভাগ্যবতী মনে হয়।    

       আজ এই ভদ্রলোক নতুন এসেছেন তাদের ক্লাসে পড়াতে। খুবই কম বয়স। হয়ত এখানে এটাই প্রথম চাকরি। এসে অবধি কী যে বলছেন! ভালো লাগছে না। কে যেন ফিসফিস করে বলল, “প্রথম দিন তো, নিজে কী বলবে রেডি হয়ে আসেনি। যা তা বলে সময় কাটাচ্ছে।” খুক খুক করে হাসল কেউ। বিরাট ঘরে গুঞ্জন চলে একটা। পাসের ক্লাসে সবাই সব শোনে না। অন্যমনস্ক থাকে। চুপচাপ নিজের কাজ করে। ভাবলেশহীন মুখে লেকচার শোনে। লেকচার ভালো না লাগলে ক্লাস বাঙ্ক করে। ক্লাস কেটে ক্যান্টিন অনার্সে অনেকেই চোস্ত। ক্যান্টিন ছাড়িয়ে উলটো দিকের ফুটপাথে কফি হাউসের চৌম্বকশক্তি আরও জোরে টেনে ধরে কাউকে কাউকে। তারা কবিতা লেখে, তারা গান গায়, তারা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করে, লিটল ম্যাগাজিনের লেখা পড়ে কাটাছেঁড়া করে। রাজনীতি থেকে সমাজনীতি ঘুরপাক খায় সেখানে। মিষ্টু কফি হাউসে যায়নি কখনও। ওর ক্লাসে অনেকেই গেছে। মিষ্টু কখনও ক্যান্টিনেও যেতে চায় না। সময় নষ্ট। ওই সময়টা ও লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে। প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট পেরিয়ে উঠে যাওয়া উঁচু সিঁড়ি, বড় দালান, কারুকাজ করা রেলিং, পুরনো পিলারে গাঁথা স্থাপত্যে ও পড়ার বইয়ের গন্ধ পায়। অচেনা বই। সমুদ্রের গন্ধ। খোলা হাওয়ার ঝাপটা। পড়তে হবে। অনেক পড়তে হবে। বাড়িতে সময় নেই। বাড়িতে বই নেই। মিষ্টুর কোনও টিউটর নেই। ওকে একাই পড়তে হবে। আর অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১৭) । শ্যামলী আচার্য


প্রফেসররা অনেকেই এই ক্লাস না করার বিষয়টাকে পাত্তা দেন না। কেউ কেউ তাঁদের লেকচারে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। তাদের ক্লাস-এ উপচে পড়ে ভিড়। কেউ আবার ইন্টার-অ্যাকশনে বিশ্বাস করেন না। একটানা বলে চলে যান। সরস করে বলতে পারেন না। লেকচারও শুকনো, ছাত্র-ছাত্রীদের চোখমুখও। কারও প্রবণতা একের পর এক প্রশ্ন করার। এই নতুন ভদ্রলোক এই ঘরানার। প্রথমদিনেই প্রশ্নে ঢুকে গেছেন। আরে বাবা, আমরাই যদি সব বলব, তা’ তুমি বলবে কী?    

       “দর্শন আসলে বরাবর কিছু মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে আসছে। হেগেল যেমন দার্শনিক, কার্ল মার্ক্সও তাই… তাঁদের নিজেদের মতবাদের মধ্যে ফারাক থাকতে পারে, বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তাহলেও তাঁদের যে আলোচ্য বিষয়, তাঁদের যে ফোকাল পয়েন্ট, তাঁদের যে পদ্ধতি, তার মধ্যে কিন্তু বেশ সিমিলারিটি রয়েছে। অনেক মিল। কী রকম? এরা দুজনেই কিছু মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং সেই আলোচনা যেমন যৌক্তিক, তেমনই সর্বজনীন। খুব সহজভাবে বললে জ্ঞান অর্জনের যে কোনও শাখাই দর্শন, আর যারা জ্ঞান অর্জন করছেন, সে তিনি যে শাখারই হোন না কেন, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথস, আইন, মেডিসিন, এগ্রিকালচার…”

       ভদ্রলোক ক্লাসে ঢুকে তার নিজের নাম বলেছিলেন? কী জানি! মনে পড়ছে না মিষ্টুর। ও বারে বারে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। আগের দিন একেসি’র ক্লাস হয়নি। আজ এই নতুন ভদ্রলোক পড়াতে এলেন। ইনি কোন পেপারটা পড়াবেন ভালো বুঝতে পারছে না সে। অনেকক্ষণ ধরে কীসব বলছে অমিত্রজিত। আবার কে একজন উঠল। সে’ও বলছে। বলেই চলেছে। খুব বিরক্ত লাগতে শুরু করল মিষ্টুর। কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। কত কষ্ট করে সে কলেজে আসে এক-একদিন। মায়ের জ্বর গেল আগের সপ্তাহে। টানা এক  সপ্তাহ শয্যাশায়ী। জ্বর থেকে উঠেও ভীষণ দুর্বল। মাথা টলছে। বাবার শরীর খারাপ তো নিত্যকার ঘটনা। একটা সপ্তাহ ধরে বাড়ি থেকে আসার আগে সকলের জন্য রান্না করে নিজে তেমন করে মুখে দিয়ে আসতে পারত না মিষ্টু। একটা কেক খেয়ে কাটিয়ে দিতে হত সারাদিন। হাতে এর বেশি আর পয়সা কোথায়? কলেজ শেষ হলে কোনওদিন বাস ধরে, কোনওদিন ট্রেনে করে গিয়ে টিউশনি। সেখানে এক কাপ চা দেয়। দুটো ব্রিটানিয়া বিস্কুটের লোভে চাটুকু খেয়ে নেয় মিষ্টু। সারাদিনের অভুক্ত শরীরে দুধ-চায়ের গলা অবধি অম্ল স্বাদ নিয়ে সে ঘরে ফেরে।

মিষ্টুর অনার্স ইতিহাসে হলেও স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েদের সে বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল সবই পড়ায়। সায়েন্স সাবজেক্ট যারা পড়ায়, তাদের মাইনে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি। মিষ্টুর কপালে সায়েন্সের স্টুডেন্ট আসবে কোত্থেকে? ইতিহাস পড়া ছাত্রীকে কেউ ক্লাস টেনের ফিজিক্যাল সায়েন্স বা লাইফ সায়েন্স পড়ানোর ভরসাই করবে না। পড়াতে পারলেও পড়াতে দেবে না। অথচ মিষ্টু জানে, এখনও ক্লাস নাইন টেন অবধি যে কোনও বিষয় তার আয়ত্তে। এমনকি অঙ্কও।     

সায়েন্সে তুখোড় হওয়া সত্ত্বেও সে হায়ার সেকেণ্ডারিতে বিজ্ঞান নেয়নি। নিয়ে কী হবে? ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিঙে চান্স পেলেও পড়তে পারবে না। বিজ্ঞানের বইয়ের দাম বেশি। টিউটর লাগবে। একা একা খুব ভালো নম্বর পাওয়া কষ্টকর। তার চেয়ে প্রথম থেকেই আর্টস পড়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। স্কুলের টিচাররা খুব বারণ করেছিলেন। অঙ্কের রাবেয়াদি তো বলেছিলেন, আমি বই কিনে দেব জয়িতা, তুমি পড়ো। বড়দিও ডেকে পাঠিয়েছিলেন নিজের ঘরে।

“জয়িতা, তুমি নাকি সায়েন্সের ফর্ম ফীল আপ করোনি।”

মিষ্টু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কী বলবে ও? কো বলার আছে ওর? সিএসটিসির কর্মচারী ওর বাবা শিবপদ, কয়েক বছর আগে অবধি সরকারি বাসের রুটে কণ্ডাক্টর তিনি, পাড়ায় উপকারী মানুষ, বাস সংগঠনের রাজ্যস্তরে একটু নাম-ডাক পরিচিতি আছে। এই পরিচয় নিয়ে, অতটুকু আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে তারা দুটি ভাই-বোন আকাশের চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখেইনি কখনও। শুধু মন্ত্র জপ করে গেছে একটাই, খুব চটপট নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের পড়ার খরচ, হাতখরচ আর চাওয়া যাবে না বাবার কাছ থেকে। সেই রাস্তায় এগোতে গেলে শুধু নম্বর চাই। ভালো নম্বর। ঝকঝকে মার্কশিট।

“আমি আর্টস পড়ব দিদি। আপনি আমাকে পারমিশন দিন।”

জয়িতার চোখের দিকে তাকিয়ে বড়দি বলেছিলেন, “রেকর্ড নম্বর পেয়ে দেখাও জয়িতা। যে দুঃখ থেকে সায়েন্স ছেড়ে দিলে, সেই দুঃখকে আগুনের মতো জ্বালিয়ে নাও। তারপর দেখিয়ে দাও আর্টসেও দারুণ রেজাল্ট করা যায়। কী পারবে না?”

জয়িতা, তার বাবা-মায়ের আদরের মিষ্টুর চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।

ভেজা কয়লাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে না, কিন্তু তার ধোঁয়াতেও চোখ জ্বলে বইকি।

স্কুলকে সে রেকর্ড নম্বর ফেরত দিতে পেরেছিল।      

       মফঃস্বল-ঘেঁষা যে অঞ্চলে তার বসবাস, সেখানে বছর দশেক আগেও মানুষ গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন বোধ করত না। ছেলেপুলেরা স্কুলে তো সব পড়ছেই, মাস্টাররা যা পড়াবে, স্কুলেই বুঝেশুনে আসবে। বাড়িতে বাবা-জেঠা-দাদু থাকলে তারাই পড়া ধরবেন, আর একটু বুঝিয়ে দেবেন, উঁচু ক্লাসে পড়া বড় দাদা বা ছোট কাকা থাকলে আরও ভাল। বারে বারে পড়। দুলে দুলে মুখস্থ করো। স্কুলে পড়া ধরবে। না পারলে দাঁড়িয়ে থাকো হাই বেঞ্চির ওপরে। দস্যিপনা করলে ক্লাসের বাইরে নিলডাউন। কান ধরে ওঠবোস। বই কেনার ঝক্কিও থাকত না। একজনের বই দিয়েই পাশ করে যেত পর পর বাড়ির বাচ্চারা। ইংরেজি গ্রামারে একটাই পি কে দে সরকার কিংবা অঙ্কে কে সি নাগ যথেষ্ট। তিন-চার হাত ঘোরার পর সেটা বেশ মলিন, কালি-কলম-পেনসিলের দাগে লাঞ্ছিত, অনেকবার নাম লিখেছে অনেকে। বইয়ের কোনা দুমড়ে গেছে, পাতা আলগা হয়ে গেছে বাঁধাই থেকে। তখন তাকে আবার আঠা দিয়ে জুড়ে, সেলাই করে, মলাট দিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হত। কিন্তু নতুন বই কেনার কথা কেউ ভাবত না। যতদিন পারা যায়… বাড়ির বই দিয়ে নিতান্ত না চললে আত্মীয়পরিজন বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীরা আছে কী করতে? তাদের বাড়িতে ছেলেপুলেরা পাশ করার আগে থেকে বলে রাখো। পরীক্ষা শেষ হলেই বই নিয়ে চলে এসো সময়মতো। তখন সব বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর বড় জোর অঙ্ক আর ইংরেজির। অধিকাংশ সময়ে স্কুলের মাস্টারমশাই অবসরে নিজের বাড়িতে ডেকে নিতেন।    

       সময়টা বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এখন ক্রমশ টিউশন নির্ভর হয়ে যাচ্ছে পড়াশোনা। শিবপদ টিউটর রাখেননি। তাঁর সামর্থ্য ছিল না। উত্তমের মাথা তত ভালো নয়। তবু সে তার মতো করে চেষ্টা করেছে। যা নম্বর পেয়েছে, তাতে অঞ্চলের কলেজে সে যেভাবে নিজের যোগ্যতায় চান্স পেয়েছে, তাতেই সকলে সন্তুষ্ট। উত্তমের কাছে বাড়িতে কেউ মারাত্মক কিছু প্রত্যাশা করে না। শিবপদ মনে মনে স্বপ্ন দেখেন ছেলেটা একদিন রাইটার্স বিল্ডিঙে যাবে, হাতে ফোলিও ব্যাগ। ক্লার্কশিপ পরীক্ষা দিয়ে লালবাড়িতে চাকরি পাওয়া খুব সহজ কথা নয়। হলই বা কেরানির কাজ, তার জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

       মিষ্টু জানে বাবা কী স্বপ্ন দেখেন, মা কী আশা করেন, ঠাকুমার দীর্ঘশ্বাস কী নিয়ে।  

       “ইউ দেয়ার। সেকেণ্ড বেঞ্চ। ঘুম পাচ্ছে নাকি ম্যাডাম? এই সকালেই ঘুম ঘুম ভাব!”

       মিষ্টুকে পাশ থেকে খোঁচা মারে কেউ। “অ্যাই জয়িতা, স্যার ডাকছেন তোকে।”

       মিষ্টু হকচকিয়ে যায়। সে কি ঘুমোচ্ছে নাকি! সে তো আনমনা হয়ে ভাবছিল কীসব হাবিজাবি।

       “তাহলে ম্যাডাম, দর্শন মানে আপনার কাছে দেখা নয়, ঘুমোনো! বা হয়তো ঘুমিয়ে দেখা। গ্রেট। কী নাম আপনার ম্যাডাম?”

       মিষ্টু কুঁকড়ে যেতে থাকে।

       কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “জয়িতা”, আর ওই একটা শব্দ বলতে গিয়েই বোঝে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার।   

       “ফিলজফি পাস সাবজেক্ট তো বুঝতে পারছি। তা’ রোল নম্বর কত?”

       “ফিফটি সিক্স।”

       মিষ্টু কোনওদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারে সমস্ত ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ঘুরে তাকেই দেখছে। তার ক্রমাগত মনে হয় ক্লাসের মেঝেটা দু’ফাঁক হয়ে গিয়ে তাকে লজ্জা থেকে রেহাই দিক। তার জীবনে এইরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম।     

 

 

 

          

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত