ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১৫) । জয়তী রায় মুনিয়া
গুজব অপরাধের একটি স্তর
গুজব এমন এক বস্তু, যাকে দেখা যায় না। যেন, শক্তিশেল। যেমন: কান নিয়েছে চিলে। বাংলা প্রবাদবাক্য। কবি শামসুর রহমানের পন্ডশ্রম কবিতাটা এই প্রসঙ্গে পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। কান নিয়েছে চিলে, কানে হাত না দিয়ে দৌড়ে গেল চিলের পিছনে।
কতখানি ব্যঙ্গ লুকিয়ে আছে মানুষের ভাবনা চিন্তার দুর্বলতার উপরে — চিল কান নিয়ে গেছে শুনেই সকলে চিলের পিছনে ছুটছে। কেউ আর কানে হাত দিয়ে দেখল না। আমরা কেন দেখি না কানে হাত দিয়ে অর্থাৎ কেন আমরা খবরের সত্যতা বিচার করি না? কারণ, মনে মনে আমরা প্রায় সকলেই গুজব ছড়াতে পছন্দ করি। কথা দিয়ে ধর্ষণ ভয়ঙ্কর সাংঘাতিক হতে পারে, গুজব তার মধ্যে একটি।
আরো পড়ুন: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১৪) । জয়তী রায় মুনিয়া
সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে কত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে, ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে, এরা প্রত্যেকেই কখনো না কখনো মানুষের ব্যাঙ্গের শিকার। একজনের থেকে আরেকজন … গণ ধর্ষণ যাকে বলে।
গুজব! ভয়ঙ্কর পরিণতির প্রথম ধাপ। যে করছে, পরিকল্পিত ভাবে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য করছে, ফাঁদে পা দিচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ লোক। বহু দাঙ্গা বহু যুদ্ধ বহু রক্তপাতের কারণ এই গুজব। যুগে যুগে প্রমাণিত সত্য… অথচ নির্বোধ মানব এখনো কানে হাত দিয়ে দেখে না! অদ্ভুত!
গুজবের পাখা আছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সন্দেহ সৃষ্টি করে। সম্পর্ক নষ্ট করে। ভীতির উদ্রেক করে। ডিপ্রেসন ঘিরে ধরে গুজবের শিকারকে। মানসিক রোগী অথবা আত্মহত্যা… মুক্তি কোথায়?
ফেসবুকের ব্যবহারকারী ২৩০ কোটির বেশি। প্রবল শক্তিমান মাধ্যম। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মূল হাতিয়ার। গুজব ছড়ায় দাবানলের মত। ফেসবুক থেকে ছড়ালে আমরা উত্তেজিত হয়ে টপাটপ শেয়ার করে ফেলি। কারণ? আমাদেরও ভালো লাগে। যে বলল , সে ঠিক বলল না ভুল -+ জরুরি না, জরুরি হল খবর ছড়িয়ে দেওয়া।
চিলে কান নিয়ে গেছে … বলার সঙ্গে সঙ্গে কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে কত কান্ড হচ্ছে, অথচ, কানে হাত দিয়ে কেউ দেখছে না। গুজব রটনাকারী মজা দেখছে তখন। উড়ো ফোন আসত সেটাও একধরণের গুজব। আতঙ্ক ছড়িয়ে যেত সব জায়গায়। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ব্যাহত হয়ে যেত নিমেষে।
গুজব রটনা করা ক্রাইম বইকি। মানুষের ক্ষতি করলেই সেটা ক্রাইম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কিন্তু, যাদের বিচার ক্ষমতা নেই, যারা বিশ্বাস করছে গুজবে, ক্রাইম কি তারা করছে না? যখন রক্তে লাল হয়ে যায় দেশ, তখন হয়ত ভাবে , কি ভুল করেছিলাম।
গুজব রটনা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। বিশ্বাস করার আগে একবার ভাবতে হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী বক্তব্যর রঙ বদল ঘটে। কোনো একদিন কি বলা হয়েছিল , সেটা সেই সময় আর চরিত্রের নিজেদের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। সেটা নিয়ে গুজব রটনায় বিশ্বাস করার আগে দেখে নিতে হয়, রটনার পিছনে কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই তো?
চিল কান নিয়েছে … যেইমাত্র এমন গুজব শুনবেন কানে হাত দেবেন। স্বামী স্ত্রী কন্যা … পরিবারে যার নামেই হোক, বিশ্বাস করার আগে যাচাই করুন। দেখেছি, মায়ের নামে মিথ্যা বলে ছেলেকে আলাদা করে দিতে। বউকে আগুনে পুড়িযেছে ওই গুজব। মিথ্যা রটনায় ঘর ভেঙেছে, মন ভেঙেছে , সম্পর্ক ভেঙেছে।
নিজের মনের উপর সংযম রাখুন। বুদ্ধির উপর আস্থা রাখুন। রটনা করা মানুষের স্বভাব। কিছু করার আগে এক মিনিট ভাবুন। কান কি নিল চিলে? দেখি তো? কান আছে যথাস্থানে।
বন্ধুরা, বাক্য নিয়ে বেশ কয়েকটি পর্ব আমি লিখব। কারণ, জীবনে বাক্যের সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। একদম শেষে গিয়ে জানাবো, বাক – সংযম ও মৌন থাকার প্রয়োজনীয়তা।

জন্ম কলকাতায় হলেও কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে হয় দেশ বিদেশে। কখনো আমেরিকা তো কখনো থাইল্যান্ড কিংবা লন্ডন। আদতে নিজেকে ভ্রামণিক বলতেই ভালবাসেন। মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করা যদি পেশা হয় তাহলে নেশা হলো নানান বিষয়ে লেখালেখি। গল্প,প্রবন্ধ ও পৌরাণিক চরিত্র কথনের আঙিনায় অবাধে বিচরণ করেন তিনি। রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্র বিশ্লেষণে বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন অল্প সময়েই। পেশার চাপ সামলেও কলকাতার বহু নামী পত্রিকায় লেখেন নিয়মিত। এছাড়াও লেখেন নানান ওয়েব পত্রিকায়। প্রকাশিত বই “সুপ্রভাত বন্ধুরা”, “ব্রহ্মকমল”, “দ্রৌপদী” ও “ছয় নারী যুগান্তকারী”। শেষোক্ত বইটি ২০১৯ এর বইমেলায় পত্রভারতীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়ে অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দেশ পত্রিকার অনুগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম দশজনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। টার্মিনাসের তরফে পেয়েছেন পুরস্কার। আমন্ত্রিত অতিথিরূপে সম্মাননা পেয়েছেন ত্রিপুরায় দুই বাংলার সাহিত্য শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন স্কুলে মহাভারত নিয়ে বক্তব্য রাখার ডাক পড়ে মাঝে মাঝেই।
কাজ করেন মূলত মানুষের মন নিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জীবনের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অনুপ্রেরণা দেয় প্রতিনিয়ত।