| 23 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: গুটি বসন্ত । যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

এ শালার দারুন একটা সময় বঠে! যেদিকে তাকাও সেদিকেই গাছে গাছে কচি সবুজ পাতার রাশি চোখে পড়বে। নরম, কচি কচি পাতায় যেন গর্জন তেল ঢেলে দিয়েছে কেউ। শিরিশ গাছের ফুলে ফুলে যৌবনের রোঁয়া। কোনো শিরিষ ফুল গোলাপি রঙা, কোনো গাছে হালকা হলদেটে রঙের। এ লাইনে দু-একটা পলাশ গাছও, আহ্লাদে লাল হয়ে আছে। তবে কচি সবুজ পাতার সঙ্গে ফুলের রঙ বেশ মানানসই হয়ে শিরিষগাছ গুলো একেবারে তাক লাগানো। পুকুরের পাড় থেকেও ফুলের বাস পাওয়া যাচ্ছে। পুকুরের জল ছুঁয়ে মাঝে মাঝে ছুটে আাসা ভিজে বাতাস গায়ে এসে লাগলে যেন আম্মার পানি ছাঁকা ভাত তোলার হাতখানা।

সেসব যাই হোক না কেন, থেকে থেকেই যে মতলেবের মাঝে মাঝেই গা-বমি ভাব আর বমি হওয়া সেটাই যা তাকে মুষড়ে রাখে। বলা নেই কওয়া নেই বমি করে। শরীর আর মন নিয়ে এই যে মানুষটা হাঁটে চলে নড়ে চড়ে বেড়ায়– কিছুই যেন তার হজম হয় না। ওটুকু বাদ দিলে বাকি সব চলে যায় এক রকম। এই যেমন এখন পুকুর পাড় থেকে পুবের দিকে নিরালা ঝোপঝাড়ে বসে অসময়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বসেছে এ সময়য়েও সে বেশ চারদিকে তাকিয়ে রস পাচ্ছে।

ছোটবেলায় যদি এইভাবে দেখার লজর পেত তাহলে মতলেব মিঞা বসন্তকালের রচনা লিখতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতো না পুন্ডরীকাক্ষ বাবুর কাছে। এখন তার দেখার চোখ বেড়েছে বৈকি! তাই আন্দাজ পায়, কী পুলক মাইরি চতুর্দিকে! পাখির পুরোনো আর চেনা ডাকগুলোও যেন নতুন আর বেশি বেশি মিষ্টি লাগছে।আর শালার ওই কোকিল! ডেকে ডেকে মাথা ধরিয়ে দিলে! রাত আড়াইটের সময় তোদের পিরীত পায়? কী কালোয়াতি– কু-উ-উ, কু-উ -উ… কু কু কু কু, কু-উ-উ করে নাগাড়ে এমন ডাকান ডাকবেওই জোড়া কোকিলে যে ঘুম ভাঙবেই ভাঙবে। একজন ডাকবে তো পরেই অন্য জন সাড়া দেবে। আর একটা হলো ওই নচ্ছার পাপিয়া, সে তো দিন নাই রাত নাই ডেকেই চলেছে ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আলিয়েও যায় না ভাই!

তার দোকানে বসে চা খেতে খেতে নূরভাই বলছিল পাখিটার আর একটা নাম নাকি চোখ গেল। হিন্দিতে, নাকি বাংলায় কে জানে, বলে পিউ কাঁহা। সে যাই হোক গে, মরুক গে! এদের অত্যেচারে সে যে ঘুমুতে পারছে না এই দিন কতক, তার কী হবে? গা পিত্তি জ্বলে যায় একেবারে! ডাক ছাড়বে, চোখ গেল চোখ গেল –। নাগাড়ে ডাকবে, আশমান পাক দিয়ে দিয়ে চোপ্পর রাত। রাতে ঘুম ভেঙে মনে মনে গাল পাড়বে, নিকুচি করেছে তোর বসন্ত কালের! শুধু কি তাই? ঘুম ভাঙলেই সারাদিনে কোথায় কী ঘটেছে, কার কাছ থেকে দেশ বিদেশের কী খবর জানল, না জানল, বা টিভিতে দেখল– সবই তো খুন রাহাজানি ধর্ষন ধাপ্পাবাজি লোভের পাপ…। সেসব মাথায় সার দিয়ে পিঁপড়ের মতো চলে ফিরে বেড়াবে। আর ওই-! গা-বমি ভাব– ! বমি তো তার প্রায় দিনই হয়।আনন্দের, আশার ঘটনা তেমন শোনা যায় কই? যেমন ধরো, সেই গেলো বছরের আগের বছর, গেলো বছর তো স্কুল-কলেজে পরীক্ষাই হলো না। মহামারী কত কিছুই মেরে দিয়ে গেলো। তবে ভোট-ফোট হয়েছিল। ছাত্র-সমাজের কথা অবশ্য কেউ ভাবেনি। গদি, ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা আগে, না পড়াশুনা আগে? পড়াশুনা করলেই কী, না করলেই বা কী? চা চপ কারণবারি খেয়ে জগাই মাধাই হয়ে নেত্য করবে ছেলেরা। সবাই কি দিগগজ হবে? বাকিদের সাট্টিফিকেট তোরঙ্গে রেখে ছাতা ধরানোর জন্যে। তো এমন একটা অলাভজনক ব্যাপারের জন্যে ভোট-ফোট বন্ধ করা চলে না বোধহয়। এই চিন্তা-ভাবনাগুলো অবশ্য চা-দোকানের খদ্দেরদের ভাবনা ধার করে পাওয়া।

সে যাই হোক, তো প্রতি বছরই অবশ্য ফলাফল বেরোলে দেখা যায় কিছু গেঁয়ো গরীব ঘরের ছেলেমেয়ে তাক লাগানো ফল করেছে। এমন ধারা খবর শুনলে বুক ফুলে ওঠে তার। ভাবে, খুব আনন্দের ব্যাপার এটা। একটা আশা আছে বটে। একবার লড়াইটা লড়ে নেবার কথাও তলে তলে রয়ে যায় যেন। ভালো থাকার অধিকার হারু পানু চানুদেরও আছে। এই যেমন, যারা ভাবে মুচির ছেলে হলেই তাকে গাছতলায় ছেঁড়া ছাতার নীচে বসে বাপের মতো জুতো সেলাই করতে হবে তারা ভুল ভাবছে। একই সঙ্গে দলিত, বা পদদলিত মেয়েদের নিয়ম করে ধর্ষণ করা হবে, আর অন্যদিকে ডিজিটাল ভারত হবে তা কীকরে হয় মাইরি?

মতলেব খবর শুনতে ভালোওবাসে। যতই না ভালো খবর না মিলুক, না জেনে থাকাও যায় না। নিজে সে কাগজ কেনে না। তার পড়ার সময় কই? তাই চা তৈরি করতে করতে সে কাগজ পড়া শোনে। গত সপ্তাহের শনিবার, দোকানে বসে শক্তি সাঁপুই খবরের কাগজ পড়ছিলেন।– উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করা ছাত্রী ঘরে বসে বিড়ি পাকাচ্ছে। প্রথমেবাপের কাজ চলে যায়, তারপর বাপটার অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা, শেষে ভবলীলা সাঙ্গ করা। শুনেই ওর বুকের ভেতরটা কেমন হাঁচোড়পাঁচোড় করতে লাগল। সেদিন ওর বমি হলো দুবার।খুব গা ঘিনঘিন করে তার। চিকিচ্ছের আশমান ছোঁয়া খরচ করবার সামর্থ্য না থাকায় মানুষ মরে যায় পৃথিবীতে। সেই খবরের উল্টোপাতায় ঠিক ওই জায়গাটাতেই দামী দামী খাবারের ছবি। সে অবশ্য হতেই পারে। সে পেলে সেও খেতো। তবু কেন কে জানে ত্যাখন নিজেকে কেমন তার গরু বলে মনে হলো।কিংবা জলহস্তি। অমনি একই সঙ্গে তার কেমন গা গুলিয়ে উঠল। গা-বমি ভাবটা থেকে গেলো। কী যে কষ্ট হয় ত্যাখন-! বমিটা হলো সন্ধ্যেবেলা। এমন দমক মারা বমি, যেন জন্মের শোধ সব নাড়িভুঁড়ি উগড়ে পেটের খোলটার ভেতর এত দিনের সব খাবার বের করে ফাঁকা করে দেবে। তাতে একটু হালকা লাগছিল তার। নিজের উপর নিজের বিরক্তও লাগে। কোনো মানে হয়?

কোথায় যেন রাজনৈতিক কারণে বাড়িশুদ্ধ লোক পুড়ে মরে। কোথায় যেন মন্দিরের ভেতর একটা বাচ্চা মেয়েকে– উফ! কাকা, খবরের কাগজটা এবার বন্ধ করো। বলে সে।চেপে রাখার চেষ্টা করেও একটু পর বমি করে ফেলে! দুদিন ধরে বমি বন্ধ হয় না। দোকান খুলতে পর্যন্ত পারল না। ফতিমাকে বলে বলে ঘরের দেয়ালে টাঙানো আয়নাটা খুলে রাখা করল সেবার। নিজের মুখ দেখবে কীকরে? তাকাতে পারবে না সে আয়নায়।

অদ্ভূত রোগ তার। এমন একটা জোয়ান মদ্দ লোক, না হয় একটা পা সামান্য খোঁড়া, তার কিনা হজমে গন্ডগোল? বমি হওয়া? অথচ স্বাস্থ্য যে খারাপ তাও নয়।

তো যাই হোক, এই কদিন, মানে কোকিল আর পাপিয়ার অত্যেচারে আর কি– ঘুম য্যাখন ভেঙেই গেল, আর এতই য্যাখন পুলক বাতাসে বাতাসে-  সেই পুলকে তুমি যদি ফতিমাকে গা ধরে নাড়া দিয়েছ, কি ঘুসকে ঘুসকে বেশি কাছে গিয়ে ইচ্ছা করে বুকে আলগা করে হাত লাগ্যে দিয়েছ তাহলেই তোমার পিরীতের নিকুচি করে ছাড়বে তোমার ফতিমা বিবি। অমন পুলকের মাথায় ঝাড়ু!

এই হাওয়ার ওপারে, ওই মাঠের ওপারের দিকে চোখ পাতলে বুঝা যায় এটুকুনিই সব লয়। মাঠের বুকের তলে ফাটলে ফাটলে বিষ নিঃশ্বাসনিয়ে ফোঁসফোঁস করে অজস্র সাপ  হিলহিলিয়ে ছুটে যাচ্ছে যেন চরাচরময়।দিগন্তের দিকে মাঠ পেইরে গ্রামগুলোর গায়ে গায়ে কুয়াশার মতোন পরত। গলা টিপে দম ফতুর করে ছাড়বে কেউ, বা কিছু। ওপরে নিকোন চোকন, ভেতরে খড়ের বোজোন–দুগ্গা পিতিমের যেমন। এই বসন্ত যেমন।পাল্টে যায় সব। পাল্টানোর নক্সা তৈরিই থাকে। তারপর কী, তারওপর কী – সবের নক্সা।

মতলেব পুকুরে নেমে কোমড় তান্নিক জলে ডুবিয়ে নেয়। ধুয়েধায়ে উঠে আসে। ঘাটের কাঁড়িতে দাঁড়িয়ে খোঁড়া পা-টা সামলে লাঠিটাও ধুয়ে নেয়। পুকুর থেকে উঠে আসবার সময় একটা শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।উত্তর ধারে জলের গায়ে একটা দৃশ্য চোখে পড়ে। একটা কাঁকড়া দাঁড়া দিয়ে একটা পাখির গলা চেপে ধরেছে।শব্দটা পাখিটার গলা থেকে  আসছে। কী কষ্ট! মুক্তি পাবার চেষ্টায় ডানা ঝটপট করছে, তবে কাঁকড়ার দাঁড়ার চাপ একটুনও আলগা হচ্ছে না। এই বয়েসে এসে মতলেব মিঞার দেখার চোখ সত্যিই বেড়েছে! সে যেন দেখতে পায়, একটা বিরাট বেলে কাঁকড়া সাঁড়াশির মতো দাঁড়া বাগিয়ে চলে বেড়াচ্ছে…!

মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পুকুর পাড়ে উঠে আসেমতলেব। খদ্দের এলে নিশ্চয় ফিরে যাবে।একটা চা বিস্কুট পাঁউরুটির দোকান তার। বিড়ি সিগারেট, জর্দা দোক্তা খৈনিও রাখে।ভালো চা করে বলে খদ্দের মন্দ হয় না।অতিব্যাস্ত এই আরামবাগ-বর্ধমান রোডের ধারে বাস স্টপেজ থেকে কয়েক কদম তফাতে দোকানটা। মোটর সাইকেল চার চাকাওলারা যারা জানে তারা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে যায়। পুকুরের পশিচম পাড়ে একটা কাঠগোলা হয়েছে ইদানীং। মনে মনে হাসে সে। এদিকে গাছে গাছে এত সাজগোজ, ওদিকে সব সাজানো গোছানো কচুকাটা চকচকে মৃতদেহ। এই হয়, এই হয়! গলা ফাট্যে শ্লোগানও চলবে, আবার ঘরে অন্য মূর্তি।

বাস রাস্তা ধরে আরও খানিক দক্ষিণে গেলে একটা ফ্লাই অ্যাস থেকে ইট তৈরির ফ্যাক্টারি। বুদ্ধিটা ফতিমাই দিয়েছিল। বলেছিল, তুমি মুড়ি ঘুগনিও রাখো ক্যান্যা! লেবাররা ঠিক জুটবে দেখো। দুখানা ফ্যাক্টারি -!

– আরে! সেখেনে তো চায়ের দোকান আছে!অত দূর থেকে এখানে চা খেতে আসবে নাকি লোকেরা?

-থাকলিই বা! টিফিন পাওয়া গেলে দেখবে ঠিক এখেনে আসবে।

-অত হুজ্জুতি আমি একা সামলাতে পারবুনি। তুই তাহলে দোকানে আয়! দুজনে মিলে দোকান সামলাবো।

-ছিঃ! ও আমার দ্বারা হবেনি কো! মেয়েমানুষ হয়ে অত বাইরের লোকের সামনে আসা– ব্যবসা করা সম্ভব নাকি?

– নিজেই নিজেকে মেয়েমানুষ বললে আর কী করার আছে বল? আরে বাবা, চারদিকে তাকিয়ে দ্যাক দিকিনি, জগৎটা কোথায় পৌঁছেছে? তুই তো ঘরে থেকে বেরিয়ে দুপা গিয়ে নিজের দোকান ঘর সামলাবি। এতে দোষ কী?

খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েও অনেক পাখি বাইরে বেরোতে পারে না। সে কি খাঁচার নিশ্চিন্ততাছেড়ে অজানার দিকে যেতে ভয় পায় বলে? নাকি উড়তে ভুলে যায় বলে?মতলেব মিঞা ঠিক বুঝতে পারে না ফতিমার মনোভাব। ফতিমা দোকানে না এলেও ওর ভাবনা মতো দোকানে সে ঘুগনি মুড়ি রাখতে শুরু করেছে ফতিমাই বাড়িতে তৈরি করে দেয়। কোনোদিন আলুর দম রাখে ঘুগনির বদলে। রান্নাটা ফতিমা খারাপ করে না।তবু প্রথম ক’দিন ঘুগনি আলুর দম নিজেরাই বেশি খেয়েছে।

ভাবতে ভাবতে সে ঘাট থেকে উঠে পায়ে চলা সরু রাস্তাটা ধরে। দোকানের পিছন দিকে একটা ফাটল দেখে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। এখনও প্লাস্টার করে উঠতে পারেনি সে।তবু নতুন গাঁথনি কীকরে ফেটে যায়? মনে মনে গাল দেয় সে। দোকানে এসে তাজ্জব।অনেক খদ্দের এসে পড়েছে এক সঙ্গে।

কাঠগোলায় অনেক মাল এসেচে। মাল মানে মোটা মোটা লাশ।কাটা গুঁড়ি। লরী থেকে নামবে। এখনও আনলোড হয়নি। নতুন সব লোকেরাই এসে মুড়ি ঘুগনি খাচ্ছে।বোরখা আর হিজাবে ফতিমা খদ্দের সামলাচ্ছে! খুব খুশির সঙ্গে তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে ফতিমাকে।ফতিমার মুখে গাম্ভীর্যের আড়ালে লাজুক লাজুক হাসিটা টের পাচ্ছিল মতলেব। তবে মোটেই তাকাচ্ছে না মতলেবের দিকে।লেবার আর লরীর কুলিদের মুড়ি ঘুগনি বেশ পাকা হাতে সামলাতে থাকে।

এই সময় একটা টাটা সুমো এসে দাঁড়াল। আট জনের চা।অন্য খদ্দের তো ছিলই। বিড়ি এক তাড়া, দাদা! সিগারেট দাও তো একটা! কিংবা একটা খৈনি। ওদিকে মুড়ি পার্টির কারও কারও খাওয়া হয়ে গেলে কেউ চা অর্ডার দিলো। কেউ টিফিনের দাম দিতে চায়। তাদের বিল কতো হয়েছে বৌএর সঙ্গে জেনে টাকা নেওয়া, বা খুচরো ফেরত। মতলেবের হিজিগিজি লাগে খোঁড়া পায়ে জলদ আনতে গিয়ে। চারচাকার লোকগুলোর জন্যে একই সঙ্গে চা বানানো, চা দেওয়া, চায়ের কাপ ধোওয়া। ওদের কারও লাল চা, কারু দুধ চা। আটজনের মধ্যে একজনের আবার দুধ চিনি ছাড়া লিকার।

বলে সে, হবে দাদা। একটু দাঁড়ান।দুধ-চা হয়ে গেলে কেটলিটা ফতিমাকে একবার মেজে দিতে বলে। নাহলে দুধের গন্ধ থাকবে। আর একটা ছোট কেটলি আছে, সেটা তেলি কার চাকরা যেতো, কিন্তু সেটাও জোড়া।

ফতিমা কেটলি নিয়ে একপাশে সরে গিয়ে মাজতে থাকে। হঠাৎ এই ব্যাস্ততার সময় একজন দুশো টাকা দিয়ে ফেরত না নিয়েই চলে যায়। হতে পারে সে দুশোর নোটকে কুড়ি টাকা ভেবেছিল। নোটবন্দী থেকে মুক্তি পেতে দেখা গেলো নোটগুলো ধাঁধাঁ লাগিয়ে দিচ্ছে।নতুন নোট বাজারে আসার পর তার নিজেরই এক এক সময় ভুল হয়েছে। হতে পারে লোকটা দুশো টাকার নোটকে কুড়ির বলে ভুল করেছে। তাই ফেরত না নিয়ে চলে গেছে।লোকটার বিল হয়েছিল সাতাশ টাকা। সে খুচরো সাত টাকাও দিয়েছিল। মতলেব একশ আশি টাকার খুচড়ো খুঁজতে গিয়ে বিরক্তই হয়েছিল।–এ কীরে বাবা! সাতাশ টাকার বিলে যদি সবাই বড়ো নোট  দেয়, সে কোত্থেকে এত খুচড়ো পাবে? অথচ-! লোকটাকে দেখতে পেল না কোথাও। বোধহয় কাঠগোলার লোক, নাহলে ফ্লাই অ্যাশের। মরুক গে, ভালোই তো হয়েছে! খোঁজ করতে এলে ত্যাখন দেখা যাবে।তার কপালটা আজ বেশ যাচ্ছে কিন্তু! তবু মনটা কেমনযেনকরেউঠল, ঠিক বুঝতে পারল না।

তারপর খদ্দেরের টানে ব্যাপারটা মন থেকে মুছে গেলো। ভীড়টা কমে গেলো ধীরে ধীরে। ফতিমারও বাড়িতে রান্না করার আছে।

ফতিমা যাবার আগে ও জিগ্যেস করল, তুই হঠাৎ দোকানে চলে এলি যে?

  – তা কী করব? ঘরের জানলা থেকে দোকানে ভীড় দেখে মনে হলো তুমি একা পারবে না।

কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াইতাই সে চলে এসেছিল মতলেবকে সাহায্য করতে। দ্বিধা তার ছিলই। জড়তাও।এসে দ্যাখে মতলেব দোকানেই নেই। তখন সব দ্বিধাই তার চলে যায়। ফতিমা তাকে প্রথম দিনের দোকানদানি করার পুলকে অনেক কথাই বলছিল, কিন্তু সে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে, কিছু শোনে না। এরপর ফতিমা তাকে দোকানেই মুড়ি ঘুগনি একটা থালায় খেতে দিয়ে দুপুরের রান্না সারতে চলে যায়। দুপুরে দোকান বন্ধ থাকে, তবে সব ধোয়ামোছা  গোছানো সেরে তবে মতলেবের বাড়ি ফেরা।

হাতধুয়ে মুড়ির থালা নিয়ে বসে মতলেব তাকিয়ে থাকে দূর-দিগন্তের দিকে, যেখানে কুয়াশার ভেতর থেকে সাপের বিষ নিঃশ্বাসের মতো হিলহিল করে ছুটে যাচ্ছে গরম বাতাস। ফতিমা আজ দোকানে আসায় সে খুব খুশি, কিন্তু মনটা তার বড্ড ভার লাগছে। এক খাবল মুড়ি মুখে তুলে আর খেতে ইচ্ছে করে না। মনে হলো তার হাতে নোংরা লেগে আছে। মনে হলো পেটের খোলের ভেতর রাজ্যের না-হজম হওয়া খাবার কতদিন জমে।এরকম একটা অস্বস্তি। একটা অজানা জায়গায় চুলকানি পাবার মতো অস্বস্তি, ঠিক জায়গাটা ধরতে না পারলে চুলকে যেমন আরাম হয় না। জন্মের শোধ সব নাড়ি-ভুঁড়ি উগড়ে ফেলে দিতে পারলেকি মুক্তি মিলত? তবু আজ তার বমি তো হয়ই না, গা-বমিও পায় না। খাবারটা নিয়ে তবু নাড়াচাড়া করতে থাকে। বেঞ্চের একপাশে নূরুদ্দিন মাস্টার বা শক্তি সাঁপুই এর ফেলে যাওয়া দৈনিক খবরের কাগজটা ডাঁইকরা আবর্জনা,পুঁজ-রক্ত মেখে নির্বাক পড়ে থাকে অদূরে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত