| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বিক্রমপুর চৌধুরীবাড়ী । শকুন্তলা চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

বিক্রমপুর মহাকালী চৌধুরীবাড়ী। অবিভক্ত বাংলার অনেক জমিদারবাড়ীর একটি। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে সেই বংশের ইতিহাস আজ তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে, যদিও আভিজাত্য এবং ঐতিহ্যের নিরিখে খুব নগণ্য ছিল না সেই জমিদারবাড়ী। আর যার সঙ্গে জড়িত ছিল চৌধুরীবাড়ীর গৌরবগাথা, সে এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে — “চৌধুরীবাড়ী মঠ”।

 

ইরাবতীর “ঐতিহ্য” সংখ্যার জন্য, এটি একটি বিশেষ প্রতিবেদন। আর সেই প্রতিবেদনের তাগিদেই মহাকালী চৌধুরীবাড়ী এবং চৌধুরীবাড়ী মঠ, যা কিনা আজ একটি লুপ্তপ্রায় ইতিহাস, তার উৎস খুঁজতে সময়ের পাতা ধরে এই উজান বাওয়া। অধিকাংশ তথ্যই পারিবারিক সূত্রে পাওয়া, কিছু পাওয়া কাগজ এবং ইন্টারনেট ঘেঁটে। বলা বাহুল্য যে এখানে পরিবেশিত সব তথ্য প্রমাণসাপেক্ষ নয়, কারণ তৎকালীন পূর্ব-বাংলার ইতিহাসে নথিপত্রের বিশেষ অভাব ছিল।

 

বিক্রমপুর চৌধুরীবাড়ীর ইতিহাস মানেই চৌধুরীবংশের ইতিহাস — বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের কেওয়াড় গ্রামকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত ছিল যাদের জমিদারী, প্রায় দুই শতক ধরে। মুন্সীগঞ্জ, যার আদিনাম ছিল বিক্রমপুর, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। যে সময়ের কথা বলছি, তখনও বাংলা ভাগ হয়নি। অবিভক্ত বাংলার বহু জমিদারির একটি ছিল মুন্সীগঞ্জের মহাকালী চৌধুরীদের। এই হিন্দু ব্রাহ্মণ চৌধুরীদের আদিনিবাস ছিল ময়মনসিংহ।আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে, সেই বংশের একটি শাখা ময়মনসিংহ থেকে মুন্সীগঞ্জে অর্থাৎ বিক্রমপুরে এসে বসবাস করতে শুরু করেন।

 

ঢাকা বিক্রমপুর তখন বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। শোনা যায় সেখানে বল্লাল সেনের একটি দুর্গ তথা প্রাসাদ ছিল, যেখানে তিনি প্রায়ই এসে থাকতেন। মতান্তরে, সেনবংশ কিছুদিন মুন্সীগঞ্জকে তাদের রাজধানী হিসাবেও ব্যবহার করেছিল। পাল বংশ এবং সেন বংশের রাজত্ব শেষ হলেও হিন্দু জমিদারেরা তখনও, অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগেও, যথেষ্ট প্রতাপশালী। তাঁদের মধ্যে শতকরা ৯৫ শতাংশই ছিলেন বংশানুক্রমে ক্ষত্রিয় বা কায়স্থ জমিদার, ব্রাহ্মণ জমিদারের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজ-প্রদত্ত ব্রহ্মোত্তর জমি থেকে ব্রাহ্মণ জমিদারদের জমিদারির গোড়াপত্তন হত — কেউ কেউ বলেন যে চৌধুরীবংশেও তাই ঘটেছিল। আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে, বা অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায়, কোনো রাজা (বা বৃহৎ জমিদার) খুশী হয়ে কৌলিক পেশায় নিযুক্ত এই বংশের এক ব্রাহ্মণকে বেশ কিছু জমি দান করেন। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন যে ভাওয়াল এস্টেটের অন্তর্গত এই জমিদারী তৈরী হয়েছিল ভাওয়ালেরই এক জমিদারের বদান্যতায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে।


আরো পড়ুন: বাংলার ঐতিহ্য নৌকা বাইচ । স্বরূপ ভট্টাচার্য


১৭০৪ খৃষ্টাব্দে, খাজনা আদায়ের আইন পরিবর্তনের সময়, মুর্শিদকুলি খাঁ বহু দেওয়ানকে জমিদার পদে উন্নীত করে দেন। ভাওয়ালের রায় পরিবারও এইসময় দেওয়ান থেকে জমিদার হন, এবং ভবিষ্যতে প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়ে ‘রাজা’ উপাধি প্রাপ্ত হন — ভাওয়ালের ‘রাজা’রা রায় বা রায়চৌধুরী পরিবার হিসাবে ইতিহাসের পাতায় খ্যাত। এই পরিবারের রমেন্দ্রনারায়ণ রায়কে কেন্দ্র করে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলার কথা তো সর্বজনবিদিত। রায় পরিবারের কুশধ্বজ রায় প্রথম দেওয়ানীর কাজ নিয়ে ভাওয়ালে এসেছিলেন, বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে। সেই গ্রাম ছিলো কেওয়াড় গ্রামের ঠিক পাশেই। শোনা যায় চৌধুরী এবং রায়, এই দুই ব্রাহ্মণ পরিবারে ঘনিষ্ঠতা ছিল — কুশধ্বজ রায়, বলরাম রায়েদের সাহচর্যেই কেওয়াড়ের চৌধুরী জমিদারবাড়ীর পত্তন। পরবর্তীকালে চৌধুরী বংশের উত্তরসূরীরা সেই জমিদারীকে বাড়িয়ে তোলেন, এবং বর্ধিষ্ণু জমিদার হিসাবে খ্যাতি প্রাপ্ত হন।

 

এই বংশের সর্বাধিক উন্নতি হয় শ্রীঅযোধ্যা নারায়ণ চৌধুরীর (জন্ম আনুমানিক ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দ) আমলে। জমিদারি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের সুবিধার জন্যে পুকুর কাটা, রাস্তা তৈরী করা, দোল-দুর্গোৎসব পালাপার্বণে গ্রামবাসীদের জন্যে যাত্রাপালা ও আহারাদির বন্দোবস্তো করা ইত্যাদি বহু সৎকাজে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪) শেষে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তখন একটু একটু করে ভারতবর্ষে তাদের জাল বিছোতে শুরু করেছে, কিন্তু ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ পল্লী বাংলায় তার ছাপ বিশেষ পড়েনি বললেই চলে।

শ্রীঅযোধ্যা নারায়ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, শ্রীগঙ্গানারায়ণ চৌধুরী (জন্ম আনুমানিক ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দ), জমিদারী আরও বাড়িয়ে তোলেন এবং চৌধুরী পরিবারের থাকার জন্য কেওয়াড়ে একটি চারমহলা বাড়ী নির্মাণ করেন — বিক্রমপুর চৌধুরীবাড়ী। এই বাড়ী নির্মাণের সময়ে, এবং তার আগে পরে, কেওয়াড় গ্রামের মাটির তলা থেকে চৌধুরীরা বহু মূর্তি পান যেগুলি বর্তমানে ঢাকা মিউজিয়ামে আছে। বেশীরভাগ মূর্তির সঙ্গেই বৌদ্ধধর্মের যোগ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বৌদ্ধধর্মের গুরু শ্রী অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এই মুন্সীগঞ্জেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ৯৮০ খৃষ্টাব্দে। মুন্সীগঞ্জে প্রাচীন বৌদ্ধস্তূপ এবং যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে, তার থেকে মনে করা যায় যে অঞ্চলটি বহুদিন থেকেই জ্ঞানচর্চার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এবং একসময়ে সেখানে বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

গঙ্গানারায়ণের পর, জমিদারির ভার পড়ে তাঁর পুত্র শ্রীকেবলকৃষ্ণ চৌধুরীর (জন্ম আনুমানিক ১৮১৮ খৃষ্টাব্দ) ওপর। গ্রামের লোকেদের জন্য তিনি বিরাট একটি দীঘি কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কথিত আছে যে দীঘি তৈরী করার সময় তিনি স্বপ্নে দেবতাকে প্রত্যক্ষ করেন। এরপর খননের সময় মাটির তলা থেকে যখন দেবমূর্তি উঠল, সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল চৌধুরীবাড়ীর মন্দিরে। যতদিন অবধি চৌধুরী বংশ মুন্সীগঞ্জে ছিল, চৌধুরীবাড়ীর মন্দিরে বিগ্রহের নিত্যপূজা হত।

দেশবিভাগের সময়ে, দুর্যোগের রাতে, বিশালায়তন বিগ্রহ সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেননি বলে শ্রীসুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী মহাশয়ের, অর্থাৎ আমার স্বামীর ঠাকুর্দার, মনে বিশেষ আক্ষেপ ছিল। পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার বেশ কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী, শ্রীমতি সরযূবালাদেবী, স্বপ্নে দেখেন যে বিগ্রহ বিশ্বনাথধামে (অর্থাৎ কাশীতে) রয়েছেন। এই বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ সংবাদ জানা না থাকলেও, চৌধুরীবংশের বিশ্বাস যে তাঁদের অতি জাগ্রত কুলদেবতা কঠিন সময়ে তাঁদের বংশের মূলধারাটিকে রক্ষা করেছিলেন এবং তিনি আজও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বংশের ঐতিহ্যবাহী, গৃহে স্থাপিত, সৌভাগ্যলক্ষ্মীর মূর্তিটি সরযূবালাদেবী সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন — মা লক্ষ্মীর নিত্যপূজা চৌধুরীবাড়ীতে আজও অব্যাহত আছে।

কেবলকৃষ্ণ অত্যন্ত ধার্মিক এবং প্রজাবৎসল ছিলেন। গ্রামের লোকেদের জন্যে তিনি পোস্টাপিস এবং পাঠশালা তৈরী করেন — সেই সবকিছুর খরচ চলত জমিদারির পয়সায়। তিনি একটি হাটও তৈরী করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে ‘চৌধুরী বাজার’ নামে পরিচিতি পায়। তিনি দীর্ঘজীবি হলে হয়তো আরও অনেক কিছু করতে পারতেন কিন্তু পঞ্চাশ বৎসর পূর্তির আগেই অকস্মাৎ কোনো অসুখে তাঁর দেহাবসান হয় বলে শোনা যায়।
তাঁর পুত্র শ্রী উমানাথ চৌধুরী মহাশয় (জন্ম আনুমানিক ১৮৪০ খৃষ্টাব্দ) ছিলেন খুব উদারমনা এবং আধুনিকমনস্ক। সেইসময় গ্রামবাংলায় ম্যালেরিয়া, কলেরা ইত্যাদি নানা রোগের প্রাদুর্ভাব হতো এবং প্রায় বিনা চিকিৎসায় বহু লোক প্রতিছর মারা যেত। শ্রী উমানাথ চৌধুরী গ্রামে পরিষ্কার পানীয় জলের বন্দোবস্ত করা ছাড়াও, রোগের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল করার কথা ভেবেছিলেন। নানা কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, কিন্তু একটি চিকিৎসক পরিবারকে তিনি গ্রামে এনে বসিয়েছিলেন গ্রামবাসীদের চিকিৎসার জন্য। বংশানুক্রমে সেই পাল পরিবারটি গ্রামের চিকিৎসক হিসাবে ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন। এই পাল পরিবার এবং চৌধুরী পরিবার ছিলেন প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

শ্রী উমানাথ চৌধুরী আরেকটি কাজ করেছিলেন। তাঁর পিতা শ্রীকেবলকৃষ্ণ চৌধুরীর স্মরণে, চৌধুরীবাড়ীর মন্দির সংলগ্ন জমিতে তিনি একটি সুউচ্চ বিশাল মঠ নির্মাণ করেছিলেন — আনুমানিক ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে। এই মঠটি তৈরী করতে তিনি বহু অর্থ এবং সময় ব্যয় করেছিলেন বলে শোনা যায়। এটি বৃটিশ নক্সায় তৈরী একটি পঞ্চরত্ন মঠ — যার চারপাশে চারটি ছোট মঠ এবং মাঝখানে একটি বড়ো মঠ ছিল। মঠের দেওয়ালে টেরাকোটার কাজ করার জন্য সুদূর বিষ্ণুপুর থেকে কারিগর নিয়ে আসা হয়েছিল। মঠটির স্থাপত্য এবং কারুকার্য ছিল অতুলনীয়। বহুদূর থেকে এই মঠটির চূড়া দেখা যেত।
আমার শাশুড়ী-মা, শ্রীমতি রমা চৌধুরী, বলেছিলেন যে তিনি যখন বিয়ের পর (১৯৪৪ খৃষ্টাব্দ) আমার শ্বশুরমহাশয় শ্রী হীরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর সঙ্গে মুন্সীগঞ্জের মহাকালী চৌধুরীবাড়ীতে প্রথম আসেন, তখনও পর্যন্ত চৌধুরীবাড়ীর মঠের চূড়া দেখে জাহাজের নাবিকরা দিক্ নির্ণয় করত — প্রায় একশো ফুটের ওপর উঁচু এই মঠটিকে পদ্মা এবং মেঘনা দুই নদী থেকেই পরিষ্কার দেখা যেত।

উমানাথ চৌধুরীর আমলে মহাকালী চৌধুরীবাড়ী ভরে ওঠে আত্মীয়-কুটুম্ব, শাখা-প্রশাখায়। মূল বাড়ীটি, যেটি পরে উত্তরের বাড়ী বলে পরিচিতি পায়, ছাড়াও আরও তিনটি বাড়ী নির্মিত হয় চৌধুরীবাড়ীর ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে — দক্ষিণের বাড়ী, পূবের বাড়ী এবং পশ্চিমের বাড়ী। চৌধুরীবাড়িতে ছিল তিনটি পুকুর, যাতে স্নান করা ছাড়াও মাছ চাষ হতো। ধান এবং চাষের জমি থেকে আসতো সমস্ত পরিবারের সম্বৎসরের চাল, ডাল ও অন্যান্য ভোজ্য। চৌধুরীবাড়ীতে প্রতিদিন তখন অন্তত একশো লোকের পাত পড়ত, কারুর কারুর মতে আরও বেশী।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,চৌধুরীবাড়ী
চৌধুরীবাড়ী মঠ – কেওয়াড়, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা।  চিত্রঋণ: “Save The Heritage of Bangladesh”

শ্রী উমানাথ চৌধুরীর পুত্রদের আমল থেকে জমিদারি মন্দার দিকে যেতে শুরু করে — আয়ের চেয়ে তখন ব্যয় বেশী দাঁড়িয়ে গেছে মহাকালী চৌধুরীবাড়ীর। বৃটিশ শোষণের ফল ততদিনে গ্রামবাংলায় পড়তে শুরু করেছে। প্রজাদের ক্ষমতা নেই খাজনা দেওয়ার, এদিকে জমিদারির চাল কমানো দায় — দোল, দুর্গোৎসব, পালা-পার্বণ সবই চলছে আগের নিয়মে। চৌধুরীবাড়ীর পাঠশালা এখন স্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছে — ছাত্রসংখ্যা প্রচুর। পোস্টঅফিসেরও ব্যস্ততা বেড়েছে। কোথাও থেকে হাত গোটানোর উপায় নেই!

শ্রী উমানাথ চৌধুরীর পুত্র, শ্রী জানকীলাল চৌধুরী (জন্ম ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দ) ছিলেন আমার শ্বশুরমহাশয় শ্রী হীরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর পিতামহ। শ্রী হীরেন্দ্রনাথের পিতা, শ্রী সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী (জন্ম ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ) ছিলেন জানকীলালের জ্যেষ্ঠ পুত্র। সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন চৌধুরীবাড়ীর প্রথম ‘জমিদার’, যিনি পড়তি জমিদারির আয়ের ওপর নির্ভর না করে ঢাকা শহরে গিয়েছিলেন চাকরি করতে। দেশবিভাগের আগে পর্যন্ত, ঢাকা শহরের আদালতে তিনি সম্মানের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।

আমার স্বামীর মুখে শুনেছি যে তিনি অত্যন্ত ধীর-স্থির বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, কেউ কোনোদিন তাঁকে ঠুনকো অহঙ্কার বা অনাবশ্যক আবেগ প্রকাশ করতে দেখেনি। ‘চৌধুরীবাড়ীর জমিদার চাকরি করবে কেন’ — এইরকম কোনো ভাবনা তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তাঁর এই সুচিন্তিত এবং বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন পদক্ষেপ হয়তো পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরদের সাহায্য করেছে সাহসের সঙ্গে নতুন দেশে গিয়ে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে।

সুরেন্দ্রনাথের দুই কন্যা এবং তিনপুত্র জীবিত ছিলেন — দু’টি পুত্র অল্পবয়সেই মারা যান। দেশবিভাগের আগেই কন্যাদের ভারতবর্ষে বিবাহ হয়েছিলো, যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি এবং উড়িষ্যার কটকে। সুরেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন আমার শ্বশুরমশাই শ্রী হীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী (জন্ম ১৯১৭ খৃষ্টাব্দ), যিনি দেশভাগের কিছু আগেই (১৯৪০ খৃষ্টাব্দে) ভারতবর্ষে চলে আসেন এবং চাকরিসূত্রে প্রথমে উত্তরপ্রদেশের কানপুরে, এবং পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের বার্ণপুর শহরে নিজেকে এবং পরিবারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। অবসর নেওয়ার পর আসানসোল শহরে তিনি একটি বাড়ী বানান এবং সেই বাড়ীতেই ২০০৭ খৃষ্টাব্দে তিনি পরলোকগত হন।

সুরেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়পুত্র ছিলেন শ্রী চুনীলাল চৌধুরী (জন্ম ১৯২২ খৃষ্টাব্দ)। চুনীলাল কম বয়স থেকেই আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন ছিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি চৌধুরীবাড়ীর মঠের ভেতর গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন, খুঁজে বার করে তাঁকে বাড়ী নিয়ে আসতে হত। ইনিও দেশভাগের আগেই, ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে ভারতবর্ষে চলে আসেন। অল্প কিছুদিন চাকরি করার পরে তিনি শ্রী অরবিন্দ দেবের ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে পণ্ডিচেরীর আশ্রমে চলে যান। সাধক হিসাবে সেখানেই সারাজীবন কাটিয়ে ২০১৪ খৃষ্টাব্দে তিনি পরলোকগত হন।
সুরেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠপুত্র শ্রী ভানুলাল চৌধুরী (জন্ম ১৯২৬ খৃষ্টাব্দ)। তাঁর স্বাস্থ্য কোনদিনই খুব ভালো ছিল না, ফলে তাঁর মা সর্বক্ষণ তাঁকে সাবধানে আগলে রাখতেন। ভানুলাল দেশবিভাগের পর, পিতা-মাতার সঙ্গে, পৈত্রিকবাড়ী ছেড়ে চিরদিনের মতো ভারতবর্ষে চলে আসেন ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে।

চৌধুরীবংশের উত্তরের বাড়ীর মূলশাখাটি এইভাবেই মুন্সীগঞ্জচ্যুত হয়, এবং অবশেষে একত্রিত হয় বার্ণপুরে। বড়ছেলে হীরেন্দ্রনাথ তখন বার্ণপুরের ‘আয়রন এ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানী’তে কর্মরত। চুনীলালও তখন বার্ণপুরের সরকারী ব্যাঙ্কে কাজ করছেন। ভানুলাল অবশ্য কিছুদিন পরেই স্বাধীন ভারতবর্ষের সরকারী চাকরি নিয়ে বার্ণপুর ছেড়ে যান। নানা জায়গায় বদলি হওয়ার পর, তিনি চাকরিজীবন শেষ করেন মধ্যপ্রদেশের (বর্তমান ছত্তিশগড়) বিলাসপুরে। সেখানেই একটি বাড়ী নির্মাণ করে স্ত্রী শ্রীমতি মায়া চৌধুরীর সঙ্গে শেষজীবন যাপন করেন — ২০০০ খৃষ্টাব্দে তিনি পরলোকগত হন। ভানুলালের কোনো সন্তান ছিলো না, হীরেন্দ্রনাথের পুত্রদের তিনি নিজের পুত্রের মতো স্নেহ করতেন।

হীরেন্দ্রনাথের তিনপুত্র। জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রী সোমেন চৌধুরী, যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ উচ্চশিক্ষা লাভ করে বর্তমানে নিজ পরিবারসহ কানাডায় সুপ্রতিষ্ঠিত। মধ্যমপুত্র শ্রী সোমেশ চৌধুরী বার্ণপুরেই কাজ করেছেন এবং বর্তমানে আসানসোলের পৈত্রিকবাড়ীতে সপরিবারে বসবাস করছেন। কনিষ্ঠপুত্র, আমার স্বামী, শ্রী সৌমিত্র চৌধুরী ইঞ্জিনিয়ারিং-এ উচ্চশিক্ষা লাভ করে বর্তমানে নিজ পরিবারসহ আমেরিকাতে সুপ্রতিষ্ঠিত।
চৌধুরীবাড়ীর মূলশাখাটি মুন্সীগঞ্জ ছেড়ে গেলেও, ঐ বংশের কিছু পরিবার কিন্তু ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত। বলা বাহুল্য, সময়ের সঙ্গে তাঁদের আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ক্রমশ তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন — ১৯৫০এর দশকে অনেকেই ভারতবর্ষে চলে আসেন। আমার শ্বশুরমহাশয় এরকম অনেক আত্মীয়কে বার্ণপুরে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন।

মুন্সীগঞ্জের আদি বাড়ীতে তখনও একজন-দু’জন থেকে গিয়েছিলেন, বা বলা যায় দেশবিভাগের দুর্যোগ কাটার পর আবার সেখানে ফিরে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্রী কেদারেশ্বর চৌধুরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি বহুলোককে চৌধুরীবাড়ীতে আশ্রয় দেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি — তাঁকে এবং চৌধুরীবাড়ীতে আশ্রয় নেওয়া বহুলোককে ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে পাকসেনারা হত্যা করে। সংবাদপত্রে সেই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর, বাংলাদেশে থেকে যাওয়া চৌধুরীবাড়ীর আর কোনো আত্মীয়-পরিজনের সংবাদ সীমান্ত পার হয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছয়নি।

“সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া / দেশে দেশে মোর দেশ আছে আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া” — চৌধুরীবাড়ীর মূলশাখার উত্তরসূরীদের কাছে এটা আপ্তবাক্য। কোনো গ্রাম, কোনো জেলা, কোনো শহর, কোনো দেশ তাদের চলার গতিকে স্তব্ধ করতে পারেনি — তারা চিরকালের ‘অভিবাসী’…..চলেছে এক পটভূমিকা থেকে অন্য পটভূমিকায়, এক শতক থেকে আরেক শতকে, বংশপরম্পরায়। হয়তো বা বংশানুক্রমিক এই যাত্রার বৈচিত্র্যের মধ্যে থেকেই তারা পেয়েছে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার শক্তি ও রসদ। সময় বদলেছে, দেশ বদলেছে — বিবর্তনের তালে পা মিলিয়ে বদলেছে তারা নিজেরাও। তবু রয়ে গেছে ঐতিহ্যের প্রতি এক শর্তহীন আনুগত্য এবং শিকড়ের প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য নাড়ীর টান। চৌধুরীবংশের উত্তরসূরীদের কাছে মুন্সীগঞ্জ এখন ইতিহাস, যেখানে তাদের ঐতিহ্যের ধ্বজাধারী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় “চৌধুরীবাড়ী মঠ”। আশা এই, যে হয়তো কোনদিন বাংলাদেশ সরকার বহু-ইতিহাসের-সাক্ষী এই মঠটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবেন।

One thought on “বিক্রমপুর চৌধুরীবাড়ী । শকুন্তলা চৌধুরী

  1. অনেক কিছু জান তে পারলাম আর ভাল লাগছে এই ভেবে যে ওই প রিবারেরই এক জনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
    এই বিষয়ে একটা বই লিখলে কেমন হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত