| 16 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: ছাপার অযোগ্য ॥ মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

সেই মানুষ অশ্রাব্য গালাগাল দিতে দিতে চোখ উলটিয়ে শ্লেষ্মাথুতু ছুড়ে দেয়। ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রেশ। নিজের গায়ে। তারপর বাসের ভেতর হড়হড় বমি। তার সঙ্গে আসা দু-জন মানুষ। একজন খুব দ্রুত পাশের জানালা খুলে দিতে চেষ্টা করে। খোলে না। হুড়োহুড়ি চলতে থাকে। ততক্ষণে বিবমিষার গন্ধে বাসের পেছন দিক থকথকে হয়ে গেছে। কয়েকজন যাত্রী নড়েচড়ে ওঠে। কেউ উঠে দাঁড়ায়। সুপারভাইজার ও ড্রাইভারকে বকতে শুরু করে।

‘কি মিয়া পয়সা দিয়া এ কোন্ ঝামেলা?’

সেদিকে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। নির্বিকার নিশ্চুপ। মানুষ আবার মুখ খোলে। মাঝারি গড়ন। গাঁট্টাগোট্টা। গালে সপ্তাহখানেকের ঘন-দাড়ি। বাঁ-গালে বড় জড়ুল। কালচে লাল। তার কোনো হুঁশ-জ্ঞান নেই। তখনো অদৃশ্য কাউকে চিৎকার দিয়ে গালি বর্ষণ করে চলে।

‘ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য। কুত্তার বাচ্চা। হারামির পয়দা। আমারে কই লই যাইতাছোস? কই? কই বে মাতারি? শালা তোর মায়ের…। ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য।’

সুপারভাইজারের চোখ-মুখ চুপসে আমশি। কী করবে বুঝতে পারে না। সংকুচিত-কিংকর্তব্যমিুঢ়। মুখে কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ। সেই দু-জন, অসহায়-বিব্রত চেহারা; নির্বাক বসে থাকে। একজন এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে বাইরে তাকায়। হাসান দেখে। অবশেষে জানালা খুলেছে। পেরেছে। সেখানে ওই মানুষকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তার তন্দ্রা-ঘুমঘোর-জুলজুল দৃষ্টি। আচ্ছন্ন দোলায়মান।

গোয়ালহাট স্টপেজে প্রায় সকল যাত্রী নেমে গেল। বাস অনেক ফাঁকা। হাসান নেমে যাবে কি না ক্ষণেক ভেবে চুপচাপ বসে থাকে। হাতে সময় কম। সুপারভাইজার তার দিকে কয়েকবার তাকায়। কী ভাবে সে? নেমে যাবে? হাসান সেই মনোযোগ ভ্রুক্ষেপ করে না। অনায়াসে পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনে। দু-চারটি আছে। আলগোছে একটি জ্বালিয়ে নেয়। নীল-ফ্যাকাশে-সাদা ধোঁয়া। আয়েশে ছড়িয়ে পড়ে। বাসের ভেতর দু-দেয়ালে লেখা ‘ধুমপান নিষেধ’। কে দেখে! প্রচ- উপেক্ষা। হাসান পেছনে না তাকিয়েও শোনে। গালাগাল চলছে। আদিম কোনো অচেনা ভাষায়। চূড়ান্ত অশ্লীল শব্দমালা। খিস্তি-খেউর। ছাপার অযোগ্য।

সামনে ডানদিকের সিটে একজোড়া মানুষ। তরুণ-তরুণী। কাপল্। বোধহয় অল্প-কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। মেয়েটির পরনে রক্তলাল শাড়ি। ঘোমটা ঢাকা-আধঢাকা মুখছবি। অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নমায়া। সোনার চুড়ি দু-হাতে। মেঘ-সাদা শাঁখা চকচকে উজ্জ্বল। তার লাজ-লাজ দৃষ্টি কোনো স্বপ্ন তেপান্তরের আবাহন জানায়। হাসানের বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। তার কোনো সঙ্গী হবে না। সারাজীবন একা একা পার হয়ে যাবে। নিঃসঙ্গ একাকী। তার মন-উন্মন অস্থির। কোন্ অচিন বেদনার নিশ্চুপ ঝড় তোলে। ঘরকুনো মানুষ। নিজের চার-দেয়াল ছেড়ে দূরে কোথাও বেরোলে মন অকারণ বিষণ্ন-উদাস। ট্রেন বা বাসের ছন্দময় ঝংকার বুক ভারী করে দেয়। আজ অস্থির-বিষণ্ন মেঘছায়া। কখনো কখনো জীবন-বেঁচে থাকা-অস্তিত্বের সকল মুহূর্ত অহেতুক অসার-অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। হতাশার বিষকাঁটা ছড়িয়ে দেয় অস্বস্তির জ্বালা। সে একজন অপাঙ্ক্তেয় ব্যক্তি। জগৎ সংসারে হতভাগ্য। পরাজিত মানুষের জীবনযাপন।

ড্রাইভার কাগজে মোড়ানো ছোট পুঁটলি থেকে পান বের করে মুখে দেয়। জরদার মাতাল সৌরভ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কর্কশ চেহারা রুক্ষ্ম-কঠিন। সুপারভাইজারকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, –

‘কতদূর যাবে বে?’

‘ফুলবাড়ি!’

‘কত দিছে।’

‘পঞ্চাশ টাকা।’

‘কেন অ্যাম্বুলেন্সে যেতে পারল না? এখন সব পেসেঞ্জার নামে গেল। তেলের পয়সা হবে বে?’

‘চলেন…চলেন। ফুলবাড়ি গেলে যাত্রী হবে।’

‘ওখানে আগে গাড়ি ধুবি। টাইম তো গেছে। শালা পাগল-ছাগল যাত্রী তোলে।’

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হেলপার ঠাস ঠাস করে বাসে দুটো বাড়ি মারে। সামনে স্পিডব্রেকার। বেখাপ উঁচু। বাস বড় ঝাঁকুনি দিয়ে পেরোয়। ধীরে ধীরে গতি ওঠে। হাসান সিগারেটের শেষাংশ জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দেয়। এখন বাসে মানুষজন কম। শেষের দিকে তিন সারি সিট ফাঁকা। এবার সিটে দু-পা তুলে নিজেকে ছড়িয়ে বসা যায়। সে তেমন করে না। প্যান্টের ইস্তিরির ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে। সতর্ক মন। তারপর বাইরে দূরের গাছপালা, ফসলের ক্ষেত আর মানুষজন দেখা। বাস হালকা। অনেক দ্রুত গতি। সেইসঙ্গে মুহুর্মুহু ঝাঁকুনি। ওদিকে সেই মানুষের মুখ চলছে। অবিরাম।

আকস্মিক কি হল! মন-ভাবনার অনুরণন। সে-ই হয়তো একমাত্র বেমানান যাত্রী। ভোর-ভোর সকালে অনেক সময় নিয়ে শেভ করেছে। বাটারফ্লাই গোঁফে মিলিমিটার ভারসাম্য। চেহারায় সাবান ঘষে ঘষে যতটুকু সম্ভব উজ্জ্বলতার চেষ্টা। ইস্তিরি করা পোশাক। বাঁ-হাতে আকাশ-নীল রং ফাইল ফোল্ডার। জীবনের অনেক হিসাবনিকাশ সংরক্ষিত। অন্যদিকে বাসের বেশিরভাগ যাত্রী গ্রামীণ জনপদের সাধারণ কৃষক। দিনমজুর মানুষ। অভাব-হতাশার বেশভূষা। যুবক-মধ্যবয়সি-বৃদ্ধ। তাদের পরিশ্রম-ক্লান্ত বিষাদ চেহারা। শরীরে বিকট গন্ধ। কারও অবাক দৃষ্টি। হাসানের অস্বস্তি লাগে। সে লাজুক মানুষ। কারও চোখের উপর চোখ রাখতে পারে না। মানুষজনের কৌতূহল-বিস্মিত দৃষ্টিতে বিব্রত। নিজেকে তার ক্লাউন মনে হতে থাকে।

সে আরেকটি সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়। জানালা দিয়ে বাইরে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে। পেছন থেকে দুর্বোধ্য উচ্চকণ্ঠের খিস্তি ভেসে আসে। বাস সে-সবের মধ্য দিয়ে লক্ষ্মীতলায় এসে থামে। ডানদিকের সারিতে বসে থাকা দম্পতি নেমে যায়। যেতে থাকে। হাসানের দৃষ্টি চকিতে নড়ে ওঠে। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আঁচল ঠিকমতো টেনে নেয়। হাসানের বিস্ময়-মুগ্ধ দৃষ্টি। চোখে চোখ। আশ্চর্য! সিঁথিতে সুন্দর করে দেয়া সিঁদুর-রেখায় অপূর্ব উজ্জ্বল মুখছবি। কত দিনের চেনা চেনা মায়াময়। কেন এমন হয়? কোথায় দেখেছে? কোনো অলস স্বপ্নদোলা রাতঘুম-ঘুমঘোর? কোনো কবিতার পঙ্ক্তিতে ডুবে থাকা বিমুগ্ধ প্রান্তর ছায়া? তার বুকে আবার বিষণ্ন-ঢেউ আছড়ে পড়ে। সে কোনো নামহীন মরে যাওয়া এক নদী। প্রলম্বিত প্রান্তরের মতো ধু-ধু বালুচর আকাশ দিগন্ত ছুঁয়ে যায়। তার কোনো কেউ নেই। একা, নিঃসঙ্গ; শূন্য আকাশে ভেসে বেড়ানো বেদনার কোনো চিল। ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে…তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে…।’ মন খারাপ হতে শুরু করে। দৃষ্টিতে বিষাদ-মেঘছায়া। সে কোথাও নিমগ্ন হতে চায়। দূরের সবুজ-ধূসর ক্ষেত। গ্রাম। মাথা উঁচু তালগাছ। আকাশের পাখি। মাঠের গরু-ছাগল। কৃষক-শ্রমজীবী মানুষজন। কতগুলো ছেলে খেলায় ব্যস্ত। সামনে চকচকে পিচকালো রাস্তা। দু-ধারে চেনা-অচেনা গাছ। ঝোপঝাড়। পুকুর-ডোবা-কাদা। বাতাস দোলা মৃদু ছায়া।

আজ বাজারের দিন। রাস্তা ঘেঁষে পশ্চিমে গো-মাংসের কতগুলো দোকান। মাটিতে নীল প্লাস্টিক-পলিথিন বিছিয়ে সাজানো পণ্য-পসরা। রক্ত-মাংস-দা-ছুরি। আমগাছের নিচু শাখায় মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। চুইয়ে পড়ছে রক্ত…টুপ টুপ টুপ। হাসান আঁতকে ওঠে। কি বীভৎস! সে ভেজিটারিয়ান নয়…রাক্ষস। মাংস খায়। হায় কত দিন তেমন করে খাওয়া হয় না। অপ্রস্তুত অস্থিরতার গুড়গুড় অনুভূতি জাগে। বাস আবার চলতে শুরু করে। সে এবার গাল-ভরতি ধোঁয়া ছেড়ে সামনে তাকায়। এখনো অনেক পথ চলার বাকি। কখন পৌঁছবে কে জানে!

সেই মানুষ শেষের সিটে ঝিমোয়। হাসান এবার আরও একবার দেখে নেয়। বয়স কত হতে পারে? ত্রিশ-বত্রিশ। তাকে যখন হাউজিং মোড়ে প্রায় ধরাধরি করে ওঠানো হয়, কেউ কেউ আপত্তি তোলে। তার মুখ দিয়ে গলগলিয়ে লালা পড়ে। পিচকিরির মতো চিরিক শব্দে এদিক-ওদিক থুতু ছিটোয়। মুখে ছাপার অযোগ্য বীভৎস গালাগাল।

‘শালা বানচোত্ আমারে কী করলি? কই লইবি বে খানকির পুত্? তর বইনের…ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য…।’

সেই মানুষ তন্দ্রাঘোর ঘুমোয়। আবার জেগে ওঠে। অস্ফুট বিড়বিড় গালাগাল শোনা যায়। কখনো চুপ-নিশ্চুপ…কখনো সরব। আকস্মিক ‘থুহ্-থুহ্’ শব্দ-হুঙ্কার। একদলা শ্লেষ্মা তীব্র বেগে উপরে উড়ে যায়। যুবক সামনের সিটে ও’হারা জিনস্ প্যান্ট পরে বসে আছে। আমবাগান স্টপেজে উঠেছিল। চোখে মার্কারি-কোটেড-সানগ্লাস। কলেজে পা-রাখা কোনো ছাত্র। চোখে-মুখে স্কুল পেরোনোর নতুন অহম। বিশ্বজয়ের ভাব-প্রকাশ। তার বাহারি চুলে গোলা আছড়ে পড়ে। সেই দু-জন মানুষের একজন মহা ব্যস্ত ব্যাকুল। প্রায় ছুটে দাঁড়ায়। ‘ভাই মাফ করেন…মাফ করেন ভাই…পাগল মানুষ’ বলতে বলতে চুল মুছে দিতে শুরু করে। হাসান অভিব্যক্তিহীন দর্শক। চোখ-মুখে কোনো আনন্দ নেই। কৌতুক নেই। হৃদয়-বিদারক কোনো বেদনা-মায়া নেই। নিজের মধ্যে অদ্ভুত আড়ষ্ট-উপলব্ধি জাগিয়ে রাখে। চিন্তা-দুশ্চিন্তা। একটি ভালো কাজে রওয়ানা দিয়েছে। সারারাত নির্ঘুম জেগে থাকা। কতগুলো বইয়ে ডুবে ডুবে লাইনের পর লাইন তথ্য মুখস্থ। এখনো চোখের কোনে সমান্তরাল লাইনের প্রতিচ্ছবি তথ্য-মিছিল। এরমধ্যে ভোর থেকে প্রস্তুতি। অনেক সময় নিয়ে নিজেকে তৈরি। অথচ বাসে উঠে কি সব উৎকট ঝামেলা! এখন যদি মাথা কিংবা গায়ে শ্লেষ্মাগোলা হামলে পড়ে? তার সারাশরীর আশঙ্কা-ঘৃণায় রি রি করে ওঠে।

সুপারভাইজার কারও আপত্তিতে কান দেয়নি। তাদের ব্যবসা করতে হয়। সেন্টিমেন্ট দেখে দিন চলে না। হাসান চুপ করে থাকে। কোনো শব্দ উচ্চারণ করে না। সবকিছুতে ইন্টারফেয়ার করা স্বভাব বিরুদ্ধ। প্রচণ্ড অনীহা। নিজেকে ইচ্ছে করেই নিষ্ক্রিয় রাখে। আসলে সে ক্রমাগত নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। কোনোকিছু ভালো লাগে না। তখন কি যে হল…সেই দু-জনের কেউ একজন সামনে দাঁড়ালে জিজ্ঞেস করে বসে, –

‘কি ব্যাপার…মৃগীরোগী?’

‘না ভাই, সে বেক্ডি ইতিহাস। হের বউ ঘর করব না…ব্যাডায় ছাড়ে না। শ্বশুরবাড়ি গেছিল বউ আনতি। কি যে খাওয়াইছে কে জানে! দেখেন কি অবস্থা! কয়দিন কোন খবর না পাইয়া শুধু খোঁজ আর খোঁজ। আইজকা পাইছি। রাস্তায় পইড়া আছিল।’

এত ইতিহাস শোনার আগ্রহ নেই। কেউ একজন কেন এত বলে যায় কে জানে। হাসানের আশ্চর্য সরল চোখ-মুখ, ভ্যাবলাকান্ত মুখছবি; নাকি সকলের কাছে কৈফিয়ত-ব্যাখ্যা? কে জানে!

‘এখন মামলা করবেন?’

‘হে ব্যাডায় ঠিক না অইলে কী করুম? ভাগনা হয়। বেক্ডি শোনার দরকার। ডাক্তারের সাট্টিফিকেট অবশ্য লইছি।’

‘দুনিয়া বড় হারামি জায়গা। কার ভেতর কোন্ শয়তান বসে আছে বোঝা মুশকিল।’

হাসান নিজের কথায় চমকে ওঠে। সহসা সচকিত দু-চোখের দৃষ্টি জানালা গলিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। ক্ষেতের মধ্যখানে ইটভাটা। সারি বেঁধে সাজানো কাঁচা ইট রোদে শুকোয়। আজ মেঘলা-রোদ আকাশ। আলোছায়ার হালকা খেলা। ভেজা ভেজা বাতাস মৃদু-স্থবির। বৃষ্টি নেমে আসবে? তখন বাস খানিক কাত হয়ে বেজাই-মোড় পেরিয়ে যায়। ইউক্যালিপটাসের সবুজ শীতল ছায়া। কোন্ অচেনা তেপান্তর থেকে অকারণ শূন্য হাহাকার ভেসে আসে। মন-উন্মন বিষাদ ঢেউ। জলের তরঙ্গে স্বপ্নসাধের প্রজাপতিগুলো ভেসে ভেসে কোনো কুল পায় না। কোথায় বসতে পারে? তার দু-চোখ বন্ধ…তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমঘোর। আসলে কিছু নয়। কিছু হয় না। তারপর আবার দূর-দিগন্তে দৃষ্টি রেখে কল্পনায় হিসাবের যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ। কোনো নকশি বা জলছবি আঁকা। এবার সফল হলে অন্তত একটি ফ্রেমে জীবন সাজানো যাবে। এই বেঁচে থাকা আর ভালো লাগে না।

কিছুক্ষণ পর সামনে মুখ ঘুরে বসে। সামান্যতম স্বস্তি নেই। বাস গতিতে চলে, সময় বোধকরি মন্থর; অথবা সময়ের সঙ্গে গতিহীন গতি। যথাসময় পৌঁছতে পারবে তো? মাথায় অদ্ভুত কোনো অস্থিরতা শুঁয়োপোকা হয়ে হেঁটে বেড়ায়। জেগে ওঠে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা বিছুটি দংশন।

গত সন্ধেয় তমাল আসে। চোখে-মুখে সুখবার্তা। অস্থির-চঞ্চল। হাসান জবাবে শুকনো-কাঠ হাসি ছাড়া কি দিতে পারে? চরম সত্য এই, তার বুকে মাৎসর্যের যন্ত্রণা ঢেউ খেলে যায়। বন্ধুর সুখবরে খুশি হতে পারে না। নিজের যত সীমাবদ্ধ আশপাশ ভ্রুকুটি করতে থাকে। হাজার ভাবনা-চিন্তা-দুশ্চিন্তা চক্রজাল। সারারাত নিজেকে গালাগাল দেয়। সকলে পারে, সে কেন পারে না? সময় অদ্ভুত বিবর্ণ কপিশ-অন্ধকার। রাতে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর-মন, দু-চোখের পাতা তবু এক হয় না।

‘তা হলে কাল সন্ধেয় আসিস্। তিন বছরের কন্ট্রাক্ট। রিনিউ হতে পারে। আর কবে দেখা হবে, কি হবে না কে জানে।’

‘জার্মানিতে তুই কী করবি? বেতন কত রে?’

‘একটা মিনারেল ওয়াটার কোম্পানির কাজ। প্যাকেজিং সেকশন। বেতন চল্লিশ হাজার টাকা। ওভারটাইম আছে। থাকা-খাওয়া ফ্রি।’

‘ভালোই তো! এত কষ্ট করে পড়ালেখা করলি।’

‘ও তো ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট। মাল না থাকলে যার কোনো দাম নাই। যাক তুই আসিস্। বুধবার ফ্লাইট। আরও ক-জনকে বলতে হবে। যাই রে!’

তমাল যেমন ঝড়ের মতো আসে, হোন্ডার ধোঁয়া উড়িয়ে পাড়া কাঁপিয়ে চলে যায়। তখনো নীল-ধূসর ধোঁয়া বাতাসে মিশে ফিকে হয়নি, হাসান বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বের করে দেয়। বন্ধু বড়ই ভাগ্যবান। ডিগ্রি পাশ করার পর মটরবাইক পেয়েছে। অর্থশালী পরিবারের সন্তান। হাসান এম.এ পড়ার ইচ্ছের কথা বলে দেখে অক্ষমতার হতাশায় আঁকা ফ্যাকাশে মুখছবি। বাবার জন্য দুঃখ হয়। তখনই ভেবে নেয় এমন আবদার কোনোদিন করবে না। এই জগৎ সংসারে সবাই ভাগ্যবান নয়। অবোধ মনকে অচেনা প্রবোধ। কোনোদিন সুযোগ এলে প্রাইভেটে মাস্টার্স করে নেবে। আগে একটি চাকরি হোক।

আজ ইন্টারভিউ। বিশেষ ব্যস্ততায় চলে যাবে দিন। সারাদিনের কাজের ছক তৈরী করে রেখেছে। বিকেলের মধ্যে ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যাবে। তারপর বাস ধরে ফিরে আসা। পনেরো মিনিট পর পর বাস। বাড়িতে ফাইলপত্র রেখে ফ্রেশ হবে। সন্ধেয় টিউশনি। রাতে তমালের বাড়ি। ফেয়ারওয়েলের দাওয়াত। ভালো খাওয়া-দাওয়া আছে। ইম্প্রুভড। সে কত মাস তেমন কিছু খায় না!

বাস ছুটে চলে। মন-ভাবনার উথালপাথাল। একটু ভালো খাবারের লোভ। সহসা চমকে ওঠে। নিজেকে আর কত ছোট করবে সে? তিক্ত দৈন্যতায় ভরে তুলবে মনের সকল দরজা-জানালা-আঙিনা? সে কি ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে উঠছে? বাবা-ভাইবোনের কথা ভাবে না? তারাও তো অনেকদিন ভালো-মন্দ খেতে পায় না। ইত্যাদি বিষাদ ভাবনায় ক্লেদ জমা হয়। খারাপ লাগে। অজান্তে পকেটে হাত। সিগারেটের খালি প্যাকেট। সেটিও কেমন উপহাসের সুযোগ পেয়ে যায়। রাঙ্গামাটি-বিডিআর ক্যাম্প স্টপেজে বাস এসে থামে। এক-দুই মিনিটের বিরতি। দৃষ্টির সামনে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। হাতছানি দিয়ে ডাকে। হাসান কি নেমে যাবে? সিগারেট নিতে পারে একটি-দুটি। কিন্তু টিউশনির সামান্য কয়েকটি টাকা। শেষ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে? এই সকল শখ, না কি অধিকারহীন বিলাসিতা; ছেড়ে দেয়াই ভালো।

সামনের স্টপেজে মোটামুটি ভিড় হয়ে গেল। দু-একজন রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কথকতা কলরোল। বিবিধ চিৎকার। তার ফাঁকে ভেসে আসে খিস্তি-খেউর। ঝিমোনো-শ্লথ। হাসান এরমধ্যে নাম জেনে যায়। সুলতান। সুলতান মুলতানি বুলি ঝেড়ে চলে। তার মামা মাঝে মধ্যে তোয়ালে চেপে ধরে। মুছে দেয়। গোঙানির শব্দ বড় অসহ্য।

‘শালারা আমারে মারলি ক্যান? মাদারচোদ্। ওই মামা…মামা আমারে কী খাওয়াইছে? ক্যামুন করতাছে…ক্যামুন ক্যামুন রে…! ওই ধাগড়ির পুত্! মামা…মামারে…ছাইড়া দে…দে ছাইড়া শেষ কইরা দিমু। শালারা আমার…ছিঁড়তে আইছে। মা মাগো কই? আমার মা কই…মা কই…ই…ই?’

এরপর প্রচণ্ড গমকে কান্না। থুতু ছেটানোর শব্দ। তোয়ালে চেপে ধরার গোঙানি-আর্তনাদ। বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ক-জন যাত্রীর মন্তব্য-মতামত। পাগলটিকে বাসে করে কেন নিয়ে যাচ্ছে? অ্যাম্বুলেন্স ছিল না? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? হেমায়েতপুর না কি বাড়ি? ইত্যাদি। তখন মৃদু ধাক্কা দিয়ে বাস চলতে শুরু করে।

হাসানের আজ বিশেষ দিন। আজ থেকে চাকরির আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাবে। বিকেল চারটা বাজলে আঠাশ বছরের আঙিনা স্পর্শ। আগামীকাল জন্ম তারিখ। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মদিন পালন হয় না। কে কখন মায়ের পেট থেকে বের হয়ে চিৎকার করে কাঁদে, কারও সুখ; কারও অসুখ। কোথাও আনন্দ…কোথাও চিন্তা-দুশ্চিন্তা। তার কপালে দুর্ভাবনার বলিরেখা। সামনের দিনগুলোয় কী আছে কে জানে। মন-উন্মন ভাবনা ব্যাকুল। কখনো নিজেকে শাসন। এত টেনশন করে কেন? আজ থেকে হয়তো তেমন ভাবনার ইতি ঘটবে। আজ সম্ভাবনার দিন। শেষ ইন্টারভিউ। যে স্কুলে আবেদন করেছে হয়ে যেতে পারে। আহা তাই সত্য হোক! সে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছে। গভর্র্র্নিং বডির দু-একজন প্রভাবশালী সদস্যের আগ্রহ-আশ্বাস। আশা দিয়েছেন। হাসানের মন আনন্দ-প্রত্যাশায় ভেসে বেড়ানো সোনালি ডানার চিল। হায় চিল! না না চিল নয়, রংধনু বর্ণিল ঘুড়ি। আকাশের দূর-দিগন্তে ভেসে যায়। আনন্দ আর আনন্দ। অনেক উঁচু থেকে দেখে যায় স্বপ্ন-প্রাসাদ। তার ঘরে ঘরে আলোর ঝালর। রং-বেরং জানালা-দরজা। আঙিনায় ফুলের বাগান। শত শত ফুল ফুটে আছে। সুগন্ধ মৌতাত বাতাসের ঢেউ। সে ছাদের এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। কার্নিশ স্পর্শ করে দু-একটি গাছের শাখা ভালবেসে মমতায় নতজানু। চারপাশে শুকনো পাতার মৃদু ভীরু ঝংকার। সন্ধেয় আলোকিত উজ্জ্বল পশ্চিমের দিঘি। হাজার পদ্মের হাতে হাত রেখে চাঁদের মিলনমালা। তখন সে জিজ্ঞেস করে, –

‘তোমার চাকরি হবে তো? সিওর?’

‘চেষ্টা তো করছি। দেখা যাক।’

‘এমন এক চাকরি যেখানে কোনো ক্ষমতা নেই। তেমন টাকা নেই। অনিয়মিত বেতন। তার জন্য এত যোগাযোগ?’

হাসান দৃষ্টি ফেরায়। সেই জলপরি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোন্ মানবী? চিনতে পারে কি পারে না, তার উজ্জ্বল দু-চোখ আলোছায়ায় ঝিকমিক হাসে। হেসে যায়। কে সে? অনুপমা মৈত্র নাকি মিলি? অথবা সেই মেয়ে, যে তার মুগ্ধ দৃষ্টির সমুখে অনুরাগের সবটুকু মায়া ছড়িয়ে বাস থেকে নেমে যায়। চলে যায়। হাসান কিছু জানে না। বোধহীন কোনো স্বপ্নের জগত বোঝে না। বাস ছুটে চলে। আকাশ দিগন্তে রোদ-মেঘের খেলা। মনের গভীরে কোন্ অলীক ধাঁধা, খেলা খেলে যায়; সব তার উর্বর কল্পনা। অবাস্তব স্বপ্ন-মায়াঘোর। সে মরীচিকার পেছনে কত আর দৌড়য়? একটি কাজ দরকার। কোনো এক চাকরি। সে যা-হোক, মাস গেলে কিছু টাকা; বাবার মলিন চেহারায় একচিলতে আনন্দ-হাসিরেখা দেখার সাধ। হাসানের কাঙাল মন অকারণ বিষাদে ডুবে যেতে থাকে। তার বাবা…বড় দুখি মানুষ।

সেই স্বপ্ন-প্রত্যাশার ভাবনায় সারারাত ঘুমোতে পারে না। নিশ্চুপ-নীরব আচ্ছন্ন মধ্যরাত। দূর-অতিদূর হতে ভেসে আসা বিষণ্ন কোনো সংগীত মন অস্থির করে তোলে। নিজেকে ব্যর্থ-অযোগ্য…নিঃসঙ্গ-একা মনে হয়। তখন কেন জানি বারবার আবার জেগে ওঠে সেই মুখ। এক বছরের জুনিয়র অনুপমা মৈত্র। চমৎকার কথা বলে। জলতরঙ্গ। সোনালি ফ্রেম চশমার কাচ থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে কোনো কবিতার লাইন। অদ্ভুত মোহন-মায়া কণ্ঠস্বর। দৃষ্টিতে তেপান্তর পুলক-আহ্বান। সেদিন ছিল কৃষ্ণচূড়া ফোটার হিমোষ্ণ সকাল। বই ফেরত দিতে দিতে বলে, –

‘আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।’

‘উঁ…মানে! হঠাৎ এ কথা?’

‘ন্…না, হঠাতই তো! সেদিন নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মাউথঅর্গান কি দারুণ বাজিয়েছেন!’

‘তাই বলুন আমি না, মাউথঅর্গান।’

‘সেটাই কি শুধু!…আচ্ছা আপনি হিন্দু মিথোলজি পড়েছেন? রাধাকৃষ্ণের গল্প?’

‘না।’

‘পড়বেন? আমার কাছে আছে।’

‘সময়ের বড় অভাব।…আচ্ছা দেবেন পড়ে দেখব।’

‘চলি।’

অনুপমার চোখে-মুখে হতাশা না কি ম্লান আকাশ। হাসান পরে ভেবে নেয়, এরকম জবাব না দিলেই পারত। মিথ্যের জন্য কিছুক্ষণ অনুশোচনা। একসময় মাউথঅর্গান শখ ছিল। এখন স্মৃতি। সেই স্মৃতি কখনো সুখের…কখনো দুঃখ জাগানিয়া। যেমন অনুপমার আবেগময় প্রেমপত্রের কথা। হাসান সেই চিঠির কথা মনে রেখেছে। প্রতিটি লাইন জ্বলজ্বল ভাসে। মুক্তোর মতো ছোট ছোট অক্ষর। কমা-সেমিকোলন-দাঁড়ি। বইয়ের ভাঁজে গোলাপের শুকনো সুবাস। আকাশ হালকা নীল কাগজের বুকে জেগে থাকে কোনো কবিতা। হাসানের দুর্ভাগ্য। কোনো মেয়ের কাছে আসার আহ্বানে ভয় পায়। অনুপমা একদিন বই ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করে। হাসান ‘কেন ঠিক থাকবে না’ বলে অন্যপাশে সরে আসে। এরপর অনুপমা কথা বলেনি। তাকে মাকাল-ভিতু বা অন্যকিছু ভেবে নিয়ে থাকবে। হাসান নিজেকে গালাগাল করে। অনুপমা তার জীবন বদলে দিতে পারত। সে তাকে যেভাবে বুঝে নেয়, চিনিয়ে দেয়; হাসান সত্যি সত্যি দুর্বল-ভীরু আর বোকা। এমন মানুষেরা জীবনে কিছু করতে পারে না।

রাতে বারবার সেই মুখছবি ভেসে ওঠে। দেয়ালের আলোছায়ায় জলছবি হয়ে কথা কয়। অদ্ভুত মোহন-বাঁশি সুর। আকাশ দিগন্ত থেকে ভেসে আসা কোনো বিষাদ গান। তার কাঁধ ছড়ানো ঝাঁকড়া চুল। দেবীর মতো পানপাতা মুখ। উজ্জ্বল দুটো চোখ। গোলাপি ঠোঁট। সোনালি ফ্রেম চশমা। সে চোখের দৃষ্টি কিছু বলতে চায়। হাসান বোঝে। সাহস হয় না। অনুপমা সারারাত খুব জ্বালাতন করে যায়। তারপর অন্য গল্প। ভিন্ন রূপকথা। হাসান বিএ পাশ করে। একদিন মা বলে, –

‘এবার হাসানের বিয়ে দেব। মেয়ে আমার পছন্দ করা আছে। মিলি। দু-জনকে বেশ মানাবে।’

কোথায় সেই স্বপ্ন-সেই সাধ! পাশের বাড়ির মেয়ে মিলি। মায়ের সঙ্গে খুব ভাব। মাঝে মধ্যে বাসায় এসে বসে। দু-জনে গল্প করে। কত কথা…কী কথা কে জানে। আনন্দ-হাসির বিচ্ছুরণ। কলতান। মায়ের চোখে উজ্জ্বল আলোকতরঙ্গ। আঙিনায় ছড়িয়ে যায়। এককোনায় জবার ঝাড়। জেসমিনের সুবাস। সেখানে দুটো বুলবুলি অস্থির-চঞ্চল। পাতার ফাঁকে ফাঁকে এ-ডাল থেকে ও-ডালে নেচে যায়। মিলির বড় বড় চোখ। অপাঙ্গে লুকোচুরি দৃষ্টি। তার সঙ্গে কখনো দু-একটি কথা হয়। হাসানের সারাদিন আনন্দ-উচ্ছল। সেই মিলি। মায়ের কথায় হাসানের মনে রং ধরেছিল বইকি! মিলি কোনো কোনো রাতে স্বপ্নে এসে ঘোরাফেরা করে। ছায়াছবির নায়িকা হয়ে গান শোনায়। সহসা সুরে সুরে সেই মুখছবি আর মিলি থাকে না, উজ্জ্বল সোনালি ফ্রেম চশমায় অনুপমা হাসে; নাকি কোনো জলপরি। হাসান বিহ্বল-বিবশ দিশাহীন। জলপরি জিজ্ঞেস করে, –

‘আপনি রাধাকৃষ্ণ পড়েছেন? আমার কাছে আছে। পড়বেন?’

‘পড়ব।’

হাসান ভোর-সকালে ঘুম থেকে জেগে বুকে শূন্যতার কারণ খোঁজে। হদিশ পায় না। তখন খাতা খুলে একের পর এক স্কেচ আঁকার চেষ্টা। কেন আঁকে? অকারণ। এভাবে দিন চলে যায়। কোনো ছবি ঠিকমতো হয় না। আসলে সে আঁকতে পারে না। জলরং শুকিয়ে গেছে। মন-ভাবনায় কোনো রংধনু নেই। অবশেষে কোথায় সব হারিয়ে গেল। বাবা রিটায়ার করেছে। মা টুপ করে মরে গেল একদিন। তার কোনো স্বপ্ন-আশা-প্রত্যাশা পূরণ হলো না। হাসানের দু-চোখ কখনো বিষাদ-কাজল। কী করে সে? অনেক দায়িত্ব। বৃদ্ধ বাবা। ছোট দুটি ভাইবোন। জীবনের মিঠেল স্বপ্নসাধ, আকাশ-দিগন্তের সোনালি চিল ভেসে যাওয়া আর ছবি আঁকার সুযোগ নেই। সে-সব দিন কোথায়? এখন জীবন অস্তিত্বের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এক-একটি দিন টিকে থাকার সংগ্রাম-যুদ্ধ। কখনো মন বিষণ্ন দুপুরে খেই খুঁজে পায় না। মৌন-উদাস বিকেল শেষে খুঁজে ফেরে অস্তিত্ব। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? কোন্ আলোর প্রতিসরণে নিজের ছায়া। কোথাও নেই। অস্তিত্বহীন। অস্তিত্বের পলায়ন। এরমধ্যে যুদ্ধ-সংগ্রাম। কত আবেদন লেখে। অনেক কষ্টে জোগাড় হয় আবেদন শর্তের বিবিধ দাবি। ব্যাংক ড্রাফট। পোস্টাল অর্ডার। ট্রেজারি চালান। আকুল দৃষ্টির কোনায় কোনায় খেলা করে কোনো রংধনু স্বপ্ন। এতকিছুর মধ্যে কোনো কোনো নির্ঘুম রাত প্রলম্বিত দীর্ঘ পথ হেঁটে যায়। যেতে থাকে। আলোছায়া দেয়ালে ভেসে ওঠে স্বপ্নময়ীর মুখছবি। জলপরির ব্যাকুল দৃষ্টি মায়া। অনুপমা মৈত্র। কোথায় সে? হাসান জানে না। মিলি আকতার? সে এখন জননী। দেখতে দেখতে পাঁচ-ছয় বছর পেরিয়ে গেল। কোনো ক্যাপটেনের ঘর-সংসার সামলায়। মিলির দু-চোখে খুশির ঝিলিক। কখনো সুখের আঁচল উড়িয়ে শহরে আসে। কিছুদিন থেকে যায়। কোনোদিন রাস্তায় দেখা হয়। হাসানের বুকে পুরোনো দিনের আবেগ হোঁচট খেয়ে চমকে ওঠে। জেগে থাকে না। তার সবকিছু শরতের মেঘের মতো হারিয়ে গেছে। কোথাও কোনো বরিষন নেই। কাশফুলের নরম স্পর্শ পাওয়া হলো না। মনে পড়ে যেদিন মিলির বিয়ে হয়ে যায়, বুকে অর্বাচীন কোনো দেবদাস গুমরে মরে। অকারণ মন-উন্মন বিষাদ। মিলির সঙ্গে তেমন কোনো কথা নয়, প্রেম নয়; হাসানের চেহারা মলিন-বিধুর। নিশ্চুপ বিষাদের উতল সানাই। দিন চলে যায়। হাসান একসময় ভেবে নেয়, আহা সেও ভালো…মিলি সুখী হোক। এভাবে নিজের স্বপ্নসাধের মৃত্যুতে নিজেকে করুণা। স্বপ্ন দেখতে নেই। কখনো তবু দু-চোখের পাতায় স্বপ্ন আসে। নিষিদ্ধ গোলাপের মতো একান্ত আপন। ভোরের আলোয় অনটন-অক্ষমতার ক্লিষ্ট পীড়নে যার অপমৃত্য।

গতরাতে এমন ভাবনা বুকে ঢেউ তোলে। রংধনু বর্ণিল স্বপ্ন-দৃশ্য-কথনে মুখর মন। একটি কাজ পেলে প্রথম মাসের বেতনে বাবার, ভাইবোনের জামা-কাপড় নেবে। সেই পুরোনো ফ্যাকাশে-জীর্ণ পোশাক দেখতে দেখতে দৃষ্টি ক্লান্ত। একটু ভালো খাবার। এলোমেলো খাঁ-খাঁ পরিবারে এসে দাঁড়াবে স্বস্তি-শান্তি। আঙিনার উত্তরে নিমগাছ, তার শাখায় শাখায় ফুটবে নিমফুল; কিংবা অনাদরে পড়ে থাকা জবা-জেসমিনের ঝাড়ে চড়–ই-দোয়েল-বুলবুলি আবার নেচে বেড়াবে। তারপর একদিন, হয়তো একদিন নিজের সঙ্গী খুঁজে নেয়ার সুযোগ। অনুপমা কিংবা মিলির মতো মায়াবী মুখছবি। জলপরির মতো দৃষ্টি ব্যাকুল, ম্যান্ডোলিন সুর; তার বউ। অনেক আদর-ভালবাসা-সুখময় দিনকাল। মায়ের বড় সাধ ছিল। হাসানের মন-ভাবনায় স্বপ্নদোলা। একজন সঙ্গী, যাকে মন খুলে বলা যায় দুঃখ-বেদনা আনন্দ-সুখের ইতিকথা; বুকে জড়িয়ে ভেসে ওঠে আকাশ-দিগন্ত সুখের দেশে। কোনো নাম-না-জানা রূপকথা আনন্দের দীর্ঘ তেপান্তর। তার ধারেকাছে হ্রদ বা সাগরের জলতরঙ্গ মৃদু বাতাস। অথবা সেই দিঘি, সেখানে শত শত লাল-গোলাপি-সাদা পদ্ম ধরে রাখে সম্মোহনী আবাহন। মনের পাঁপড়ি মেলে জোছনায় সকল মলিনতা ধুয়ে নেয়া যায়।

পাগল, যদি সে পাগলই হয়, চিৎকার করে গালাগাল দেয় অজানা কাউকে। বাসের কোনায় কোনায় বিবমিষার ঘনিভুত শুকনো গন্ধ। দুর্গন্ধ। লোকজনের ভিড়। পেছনের দিক থেকে মুহুর্মুহু চিৎকার ভেসে আসে।

‘শালারা আমারে কি খাওয়াইলি? বানচোত্ এইহানে থাম! থাম কইতাছি…কইতাছি থাম। মাদারচোদ্…রোক্ রোক রোককে হি হি হি! থুত্ থু ওয়াক থু! আমার ভাল্লাগে না। মুতব। মুতব…শালা পাবলিকের মুখে মুতব! হারামির বাচ্চা আমারে মারিস ক্যান শালা। শালা…তোর মাকে…!

প্রচণ্ড কড়া ধমক। তারপর সহসা স্থির-নিশ্চুপ নীরব সময়কাল। বাতাস কেটে যাওয়া বাসের শব্দগতি। সেখানে কোনো গোপন বৈঠকের কিছু বিড়বিড় কথোপকথন মেঘের মতো জমে ওঠে।

‘সুলতান চুপ। চুপ কর…চুপ কর বাপ।’

‘আমার বউ কই? বউ আইনা দে। আমি ওরে…। ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য।’

সুলতানের মুখে তোয়ালে চেপে ধরে ওর মামা। হালকা গোঙানি ভেসে ভেসে গুমট প্রতিধ্বনি তোলে। হাসান চঞ্চল অস্থির। অস্বস্তির কাঁটা মনে ছড়িয়ে আছে। কোথায় বাসে বসে নোটবুক খুলে মন্ত্রীদের নাম মুখস্থ করবে। চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইলের দেশে বাহাত্তর মন্ত্রী। নাম দফতর কিছু মনে থাকে না। এলোমেলো হয়ে যায়। চেষ্টা চলে। আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু…কি ফ্যাসাদ! অন্য বাসে এলেও পারত। অথবা যখন গোয়ালহাটে প্রায় সকলেই নেমে যায়, সে কেন বসে থাকল? এখন মনে ‘কু’ ডাকে। ব্যর্থতার আশঙ্কা। অচেনা খচ খচ দংশন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতে দেখে অশুভ দৃশ্য। পথের মধ্যখানে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে পড়ে আছে রুস্তম। নির্বোধ কুকুর। কে যে নাম দিয়েছে রুস্তম, কেউ জানে কিনা জানে না; জানা নেই। সকলের দিকে করুণ চোখে তাকায়। কাঙাল মন। অনেককিছুর প্রত্যাশা। মানুষের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্বাস। আশপাশে দোকানের বারান্দায় পড়ে থাকে। অবহেলার ক্ষুদ্র জীবন…শ্বাসপ্রশ্বাস। ভোর-সকালে সেই প্রাণের করুণ দৃশ্য। হাসানের খারাপ লাগে। পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে পড়েছে। পিচকালো রাস্তায় রক্তের দাগ। বিষাদ দৃষ্টির মানচিত্র। কয়েকটি মাছি ভন ভন করে। এই নির্দয় পরিণতি দেখে যাত্রা নাস্তি ভেবে নেয় এমন কুসংস্কার নেই হাসানের, তবু মনে হয় দিন ভালো যাবে না; কোথাও কোনো অমঙ্গল ওত পেতে অপেক্ষায় বসে আছে। আজ জীবনের একটি দিন। তার প্রমাণ বুঝি উটকো ঝঞ্ঝাট।

আসলেই কি তেমন ঘটনা? শ্বশুরবাড়িতে বিষ প্রয়োগ নাকি অন্যকোনো বিষয়? এমনও হতে পারে, সঙ্গের ওই দু-জন কিড্ন্যাপার। সুলতানকে ড্রাগ পুশ করে কোথাও নিয়ে চলেছে। অপহরণ। তারপর মুক্তিপণ। হত্যা। আজকাল এ-সব ঘটনা অনেক ঘটে। খবরের কাগজে গুম-অপহরণ-হত্যার কাহিনি। এও কি তেমনকিছু? কে জানে! কী হতে পারে? হতে দাও। হাসানের দৃষ্টি আবার বাইরে চলে যায়। সামনে স’ মিল। বিশাল সাইনবোর্ড। বাস মার্কেট পেরিয়ে এগিয়ে যায়। দোকানের সারি। মানুষজনের ভিড়।

হাসান বাস থেকে নেমে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। অল্পবয়সি এক কিশোর রিকশায় ডাকে। তখন শোনা যায় সুলতান আসলে একজন চোর। ছিনতাইকারি। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর গণপিটুনি আর পুলিশি থার্ড ডিগ্রিতে ওই দশা। অনেক কায়দা করে ছাড়িয়েছে। অভুক্ত দু-দিন প্রায়।

হাসান শিহরে ওঠে। অনেক আগে কৈশোরবেলায় চোর পেটানো দৃশ্য ভেসে ওঠে। পাবলিকের মার! মানুষজন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। দুপুরের বাতাসে নির্দয়-নিষ্ঠুর কোলাহলো উল্লাস। ব্যস্ত আমোদ-বিনোদন। মানুষ এমনভাবে মারতে পারে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তারপর মনকে প্রবোধ, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়। এখন বিশ্বাস, মানুষ অমৃতের সন্তান; অন্যায়-অপরাধ করতে পারে না। সমাজের বিবিধ সিস্টেম অপরাধী হতে বাধ্য করে। সুলতানের বিষয় সাধারণ। ব্যতিক্রম কিছু নয়। সমাজ-অপরাধ-বিচার ইত্যাদি বিষয় ভাবনায় কিছুক্ষণ গুঞ্জন তোলে। আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়। সে সুযোগ দিতে নারাজ। আশপাশে নিবিড় দৃষ্টি রেখে সব ঝেড়ে ফেলে দিতে চায়। আপনমনে শ্রাগ। রিকশায় উঠে বসে। হাতে পর্যাপ্ত সময়। সবে নয়টা চুয়ান্ন। এতক্ষণে ইলিয়াছুর হয়তো এসে গেছে।


আরো পড়ুন: গল্প: থুতুর বাদশা । কামরুন নাহার শীলা


উপজেলা চত্বরের পুবে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় রেস্তোরাঁ। সেখানে ইলিয়াছুরের থাকার কথা। দশটায়। ইন্টারভিউ সাড়ে দশ থেকে। এখনো চারপাশ প্রায় জনশূন্য। কয়েকজন মানুষ। নিরিবিলি নিশ্চুপ-নীরব। উপজেলায় যা কখনো দেখা যায় না। রেস্তোরাঁয় উঁকি দিয়ে হতাশ। ইলিয়াছুর আসেনি। হাসান কি এখানে অপেক্ষা করবে? সে ভেতরে বসে না। বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উপজেলা ভবনের দোতলায় ওঠে। দক্ষিণে রেলিং-এর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। একটি জামগাছ। হাত বাড়ালে কোমল স্পর্শ। সে পাতার উপর হাত রাখে। ধুলো জমে আছে। তার কী হয়? আঙুলে ঘষে ঘষে যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার করে। অবিমিশ্র আত্মতৃপ্তি। কি ঝকঝকে সবুজ পাতা! প্রাণময় মসৃণ। আজ এই পাতার মতো জীবনের সকল ধুলো-ময়লা দূর হবে। তার উজ্জ্বল স্বচ্ছ-মসৃণ জীবন। সে অলীক কোনো স্বপ্ন নিয়ে দূরের বিস্তৃত দৃশ্যে তাকিয়ে থাকে। নানা রঙের গাছগাছালি আকাশ দিগন্তে মিশে গেছে। সবুজ ক্ষেত। তার মধ্যখানে ইটের ভাটা। বর্ণিল পোশাকে মানুষজন। সকলে কাজে ব্যস্ত। পৃথিবীর সময় মানুষের জীবনযাপন ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। কর্মচঞ্চল অস্তিত্বের পুথিপাঠ। বেঁচে থাকার অধিকার।

আকস্মিক আকাশে এলোমেলো ভেসে বেড়ানো মেঘ স্থির জমে ওঠে। বায়ুকোণ থেকে ঈশানে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। আলোছায়া অন্ধকারে ঢেকে ফেলে চারপাশ। সকল দৃশ্যছবি ধূসর-কালো রঙে বদলাতে থাকে। প্রগাঢ় রাত অন্ধকার। হাসান কী করে? এককোণে নিশ্চুপ-স্থির। প্রকৃতি বড় অদ্ভুত। তখন কোত্থেকে কোনো আশঙ্কার শুঁয়োপোকা উঠে আসে মাথায়। নিষ্ঠুর নির্দ্ধিধায় হেঁটে বেড়াতে শুরু করে। শেষে ইন্টারভিউ বাতিল বা স্থগিত হবে না তো? হাসানের দু-চোখে খড়কুটো আঁকড়ে ধরা ব্যাকুল দৃষ্টি। রেস্তোরাঁর সামনে কতিপয় মানুষের অন্ধকার ছায়ামুখ। স্পষ্ট বোঝা যায় না। ইলিয়াছুর এখনো এল না। কোথায় আছে সে? তাকে যে খুব দরকার।

এরপর আরও ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে যায়। আকাশে গভীর ধূসর-কালো রূপ-আকার হালকা তখন। বৃষ্টি তেমন হয় না। বড় বড় ফোঁটায় ঝাপটা ঢেউ। একঝলক দমকা বাতাস। তারপর নিশ্চুপ-নিথর সময়ে আবার চঞ্চল জীবনপ্রবাহ। উপজেলা চত্বরে মানুষজন আসে। গম্ গম্ কলরোল। হাসান সামনে এগোয়। পশ্চিমের কোনো রুম থেকে মোটাসোটা এক মহিলা মেঝে কাঁপিয়ে নিচে নেমে যায়। হাইহিলের খট খট বিকট শব্দ-তরঙ্গ। পিএ গোছের হয়তো কেউ। তার পেছন দিক ছন্দে ছন্দে বেঢপ কেঁপে যায়। হাসান তাকিয়ে থাকে। সহসা চমকে ওঠে। নিজের বিচিত্র এই রূপ কখনো বুঝে উঠেনি। তার মধ্যে কোনো বিতৃষ্ণা জমে উঠতে শুরু করেছে? অসূয়াকাতর-হতাশ দৃষ্টিভঙ্গি খেলা?

অবশেষে ইলিয়াছুর আসে। চোখ-মুখ নির্বিকার-গম্ভীর। সেই চঞ্চল হাসিখুশি মানুষ অনেক অচেনা। কোনো খটকা হোঁচট তুলে সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসান কী ভাবে? কোনো সমস্যা? দেখা যাক। তারা দু-জন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে।

‘কখন এসেছিস? নাশতা?’

‘না। খেয়ে বেরিয়েছি। চা খেতে পারি। তারপর সব ঠিক আছে তো নাকি?’

‘ঠিক বলতে, আচ্ছা বলছি; চা নে।’

‘তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো ফ্যাকড়া হয়েছে!’

‘তাই তো রে ঠিক ধরেছিস। আরে এক ক্যান্ডিডেট নিজেকে সেট করে ফেলেছে। সরকারি পার্টি করে। টাকার জোরও কম না। শুনলাম দু-লাখ ডনেশন দিয়েছে।’

‘তা হলে তো পলিটিক্স না করে ভুল হয়ে গেল। টাকাও তো নেই। কেন যে দরখাস্ত করলাম! তিনশ টাকা ব্যাংক ড্রাফট। অহেতুক খরচ।…লোক দেখানো ইন্টারভিউ?’

‘ঠিক তাই, এসব হলো ফরমালিটি। চিন্তা করে দেখ, স্কুলের শিক্ষকতা; সেখানেও এমপি-মন্ত্রী নাক গলাচ্ছে। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’

ইলিয়াছুর চা শেষে পকেট থেকে বাদাম বের করে। পট পট শব্দে বাদাম ভাঙে। অস্থির চঞ্চল। এরমধ্যে জোরে বাতাস বইতে শুরু করে। আশেপাশে হয়তো ভালো বৃষ্টি হয়। এদিকেও ছিটেফোঁটা ঝরে পড়ে। ভেজা ভেজা বাতাস। হাসানের মধ্যে অস্থির অক্ষমতার তা-ব ঝড়। দু-লাখ কেন, দশ হাজার টাকা জোগাড় করাও অসম্ভব। তার মুখছবি বিমর্ষ কালো। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। নিজেকে পুনরায় অনাবশ্যক অপাঙ্ক্তেয় ভেবে ভেবে ক্লান্তি আসে। এখন কী করবে? চলে যাবে? তার কাঁধ নিচে ঝুলে পড়ে।

‘তা হলে ইন্টারভিউ দিয়ে কী হবে? দেব না? শুধু শুধু প্রস্তুতি নিলাম। বাসভাড়াও খরচ হল।’

‘দিবি না কেন? এসেছিস যখন ফেস কর। অভিজ্ঞতা হবে। বলা যায় না নম্বরে হয়ে যেতে পারিস।’

‘তুই আবার এসব সাজানো নাটকে অভিনয় করতে বলছিস?’

এতকিছুর পরও নাটকে অভিনয় করতে হয়। ইন্টারভিউ বোর্ডে উদ্ভট সব প্রশ্নের ফুলঝুড়ি। সে নিশ্চিত যে-সব প্রশ্ন করা হয়, তার নব্বই শতাংশের উত্তর প্রশ্নকর্তা নিজেই জানে না। সে তখন মজা করে।

‘ডাব না খেলে কী হয়?

‘নারিকেল।’

‘কেন জলশূন্যতা দূর করা যায় না?’

‘সে-ক্ষেত্রে স্যালাইন নেয়া যেতে পারে।’

‘এক ব্যাগ বাজার আর এক বোতল পানি মিলিয়ে কী হয়?’

‘সেরেফ পাগলামি।’

‘আপনি না হাঁটলে কী করতেন?’

‘দৌড়াতাম।’

‘শিক্ষক হয়ে আপনার প্রথম কাজ?’

‘ছাত্রছাত্রি কালেকশন ও ক্লাস নেয়া।’

‘মাদার মাদার হু কুইন মাউন্টেন ডু। কোন্ টেন্স?’

‘স্ট্রেঞ্জ টেন্স।’

সে যখন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিট ইন্টারভিউ শেষে বের হয়ে আসে, ফুরফুরে মেজাজ; নিজেকে রাস্তায় আছড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। পারছে না আর। এতক্ষণ নিজের সঙ্গে পরিহাস…স্যাডিস্ট উপভোগ। সে কী করে? তার মন-ভাবনায় ধীরে ধীরে অসম্ভব ক্লান্তি নামে। স্থবির অবসাদ। সারাদিনের প্রস্তুতি, আশা-প্রত্যাশা-স্বপ্নদোলা; সব মিথ্যে। মায়া মরীচিকা। কোত্থেকে দৃষ্টিসীমায় ভেসে ওঠে হতাশার অন্ধকার কালো সুড়ঙ্গ-গহ্বর। কপিশ গভীর স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের সীমা-পরিসীমা। পৃথিবীতে কোনো আলোকরেখা নেই। আশা-ভরসা-ভালবাসা-জীবন নেই। কোথায় যাবে সে? নিজেকে তার রুস্তম মনে হতে থাকে। পথের ধারে শুয়ে বসে থাকা করুণা-কাঙাল দৃষ্টি। সক্ষম সুখী মানুষের চোখে চোখ রেখে কোনো দুর্লভ প্রত্যাশা। হাসানের দু-চোখ ভিজে ওঠে। কুকুরের দাসত্ব জীবন।

শেষ-দুপুরের সূর্য তির্যক হেলে পড়ে। বৃষ্টি শেষের আলোয় সবকিছু চকচকে উজ্জ্বল। গাছের ধুসর ছায়া দীর্ঘ লম্বা। হাসান বালুময় মাঠের মধ্যে নিজেকে খোঁজে। পরাজিত মানুষের প্রাগৈতিহাসিক বৃদ্ধ ছায়া। কাঁধ ঝুলে গেছে। ন্যুব্জ আকার-অবয়ব। এই কি সে? ভেঙে পড়া ক্লান্ত শ্লথ অস্তিত্ব প্রাণ। কোথায় চলেছে…নাকি পিছিয়ে যায়? তার বুকে অদ্ভুত বিষণ্ন ঢেউ খেলা করে। কিছু হবে না। কিছু হবে না। বিকেলের বাস কখন? মন অকারণ ব্যস্ত হতে চায়। সন্ধেয় টিউশনি আছে। মাথা খারাপ করা গবেট ছাত্র। পড়াতে হয়। সক্ষম পরিবারের ভাগ্যবান সন্তান। এরাই একদিন চাকরি পাবে। বড় বড় পদে বসে জাতির সিদ্ধান্ত নেবে। উপরতলার মানুষ চিরকাল উপরে থাকে। নিচতলার আরও নিচে নেমে যায়। এই-ই নিয়ম। সে মাঝে মধ্যে পড়াতে পড়াতে ক্লান্ত-অবসন্ন। বিরক্ত। নিজের উপর। ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। মাস গেলে কিছু পয়সা মেলে। তার দুর্ভাগ্য। রুপোর বাটি আর সোনার চামচ নিয়ে জন্মায়নি। সহসা সুলতানের কথা মনে আসে। কেন জানি মায়া হয়। সেটি নিজের জন্য নাকি সেই মানুষের, কে জানে! হাসান এখন নির্বিকার হতে পারছে। কেউ যদি তাকেও বোধশক্তিহীন পাগল করে দিত! কোনো চিন্তা-ভাবনা-দায়িত্ব থাকে না। সে আকস্মিক বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো প্রচ- গালাগাল দিয়ে বসে। কেন…কার উদ্দেশ্যে কেউ জানে অথবা জানে না। তখন প্রায় নিরিবিলি-নির্জন রাস্তার একপাশে জড়সড় কুণ্ডলিত এক নেড়িকুকুর চোখ মেলে তাকায়। ছাপার অযোগ্য এমন উৎকট শব্দ হয়তো কখনো শোনেনি…নাকি অন্যকিছু দেখে যায়।

জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকা মৃত কোনো রুস্তম?          

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত