| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১২) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

       আকাশে একটুকরো মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এল দমকা হাওয়া। কী তার গতি। কী মারাত্মক তার গর্জন। ঝড় উঠল। বিশাখা ছুটে যান বাইরে। একফালি বারান্দায় সামান্য কিছু জামাকাপড়। সেগুলো আধভেজা বা শুকনো। অধিকাংশ ভেজা জামাকাপড়ই বাইরে মেলে দেওয়া থাকে। দেড় কাঠার সামান্য বেশি জমিতে ঘর তোলার সময় সামনে জায়গা কিছুটা ছাড়া ছিল। একটা উঠোনের মতো খোলা জায়গা। হাতকয়েক আয়তন। তবু খোলা তো। অনঙ্গবালার একটি তুলসীমঞ্চের সাধ অন্তত পূরণ করা গেছে। সামান্য দু’চারটে ফুলগাছ। একটি হৃষ্টপুষ্ট রক্তজবা আর কুচি টগরফুলের গাছ নিত্যপূজার প্রয়োজন মেটায়। একটি অপরাজিতার লতা বেয়ে উঠেছে একপাশে। বাড়ির পিছনে পেঁপেগাছ আর কুমড়োলতার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। দেশের বাড়ির মতো লঙ্কা লেবু কলোনীর একচিলতে জমিতে ফলানো যায় না বলে অনঙ্গবালার আজও দুঃখ উথলে ওঠে। ওইসব জিনিস কি কেউ বাজার থেকে কিনে খায়? উঠোনের বাকিটা জামাকাপড় মেলা, বিকেলের অবসরে আকাশটুকুর দিকে তাকানোর ফাঁক। বারান্দার গ্রিলের রেলিঙের সঙ্গে নারকেলের দড়ি অন্যদিকে একটা বাঁশের ছোট খুঁটিতে টানা দিয়ে বাঁধা।

দুটো বিছানার চাদর কাচা হয়েছে আজ। রাস্তার কলে অনেক বেলা অবধি জল ছিল। তেমন ভিড়ও ছিল না। কী ভেবে বিশাখা চাদর দুটো ভিজিয়েছিলেন। বার সাবানটা অনেক্ষণ ঘষতে হয়। ফেনা হয় না তেমন। কিন্তু ঘষলে পরিষ্কার হয়। একটু বেলা হয়েছে কাচতে। সব পুরোপুরি শুকোয়নি। এই ঝড়ের পরে বৃষ্টি নামলে আরও ভিজবে। উন্মাদ হাওয়ার সঙ্গে উড়তে থাকা বালি ছাই কাগজ শুকনো পাতা কাঠিকুঠির মধ্যে দিয়েই বিশাখা ছুটে গিয়ে তুলে আনেন সব।  

       এর মধ্যেই ঘরে ধুলো ঢুকছে। সব জানলা দরজা চটপট বন্ধ করতে হয় একা হাতে।  

       বাইরে নিজেদের টিউবওয়েল আছে একটা। রান্না, খাবার জল, স্নানের জল তোলা হয়। কাচাকুচিও হয় টুকটাক। রোজকার জলের প্রয়োজনের তো শেষ নেই। পাঁচটি প্রাণী। সকালে উত্তমের দায়িত্ব জল তুলে বাথরুমের বড় চৌবাচ্চা আর সমস্ত বালতি ভর্তি করা। শিবপদ এখন আর অত পারেন না। হাঁফাতে থাকেন। তাছাড়া চিরকাল সংগঠনের কাজ সামলে গভীর রাতে ফিরেছেন। সকালে বাজার-হাট-দোকানের দায়িত্ব ছাড়া আর তেমন কিছু কাজ তাকে কোনওদিন দেওয়া হয়নি। বিশাখা নিজে সব করতেন। শাশুড়ি প্রচুর সাহায্য করতেন তখন। রান্নাবান্না, ঘরদুয়ার ঝাড়ামোছা গোছানো। এখন উত্তম বড় হতে ছেলেকেই জল তোলার ভার দেওয়া হয়েছে। যদিও আজকাল সে ভোরে ওঠে না, উঠলেও খবরের কাগজ মুখে করে বসে থাকে… তা’ও জল তোলার কথা তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নিয়মিত। সেই সময় মিষ্টু রান্নার জল তুলে তরিতরকারি কেটে বেছে অনেকটা কাজ গুছিয়ে দেয়। দুপুরে কলেজ, সন্ধের পর টিউশনি, তার আগে বাড়িতে যতটা করে যাওয়া যায়। এর মধ্যে নিজের পড়াশুনোও তো আছে।

একটু বেলায় বাড়ি ফাঁকা। শিবপদর অফিসের ভাত-টিফিন, ছেলেমেয়ের কলেজের ভাত বেড়ে দেওয়ার পরে আর তেমন কাজ কোথায়? অনঙ্গ তো আজকাল খেতেই চান না তেমন কিছু। অধিকাংশ দিন আলোচালে আলু-কুমড়ো দিয়ে ফুটিয়ে দিতে বলেন। কটা দিন আগেও নিজেই ডাল-তরকারি রাঁধতেন। নিরামিষ রান্নায় দিব্যি উৎসাহ ছিল। পিঠে-পায়েসের দিনে উদ্যোগী হতেন। এখন ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ছেলের একার আয়ে পাঁচজনের সংসার। উত্তমও তার বাপের ধারা পেয়েছে। সারাদিন টই টই। সে লিখেপড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালে সংসারে সুরাহা হয়। বরং হাল ধরেছে ওই মেয়ে। বুঝদার মেয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই টিউশনি খুঁজেছে। পড়ায় অনেককে। রাত করে ফেরে। তার নিজের পড়ার খরচ, টুকটাক সাধ-আহ্লাদ মিটিয়ে কখনও ঠাকুমার, কখনও মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসে।

একটা আদ্দির ব্লাউজ এনে দিল একদিন। সাদা ধবধবে।

“এই নাও ঠাম্মা। এটা তোমার। দেখো কাপড়টা খুব পাতলা। আরাম হবে খুব।”  

“কী দরকার ছিল রে? আছে তো কত।”  

অনঙ্গবালার মৃদু অনুযোগ আরও মৃদু স্বরে এড়িয়ে যায় মিষ্টু। “সেগুলো সব ছেঁড়া। আমি দেখেছি।”

“দূর পাগলী। সব কটা ভালো। একটু পিঠের দিকে ফেঁসেছে হয়ত। গরমে কী আরাম লাগে বল!”

“এটাতেও আরাম লাগবে, দেখো।”

“এত দাম দিয়ে খামোখা এটা না কিনলে হত না? আমি কি চেয়েছি?” অনঙ্গবালা এবার প্রতিবাদ করতে চান। মিষ্টু, তাঁর নাতনী, সে এবার হাসে। বুদ্ধিমতী মেয়েরা এইসব প্রশ্নে চমৎকার উত্তর দিতে জানে। মিষ্টু বলে, “দাম কীসের? সেল চলছে তো! রেলগেটের ধারে ছায়া স্টোর্সের সামনে টাল করে রেখেছে। দেখোগে যাও। কী ভিড়!”

“হ্যাঁ রে, শুধু আমার জন্যেই আনলি? মায়ের জন্য নিলি না একখানা? সে তো মুখ ফুটে চাইবে না কিচ্ছু…”

“কে বলল নিইনি? একটা লাল নিলাম। হাতাটা একটু মেরে নিলে আমার গায়েও হয়ে যাবে।”

অনঙ্গবালা ভারি নিশ্চিন্ত হন। একা একটা নতুন ব্লাউজ পরতে তাঁর কী যে অপরাধবোধ হচ্ছিল। যাক দুটো ব্লাউজে তিনজনের চাহিদা মিটবে। কম কথা নাকি! নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “পরের বার তিনখান নিস। তাহলে আর ভাগাভাগি করতে হবে না। কী বলিস!”


আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১১) । শ্যামলী আচার্য


সংসারে কত কিছু যে ভাগাভাগি হয়। সুখ দুঃখ হাসি কান্না। ভাবের দিনে অভাবটুকুও ভাগ হয়ে যায়। শিবপদ’র ভাগে গাদার মাছ, উত্তমের পেটি। ল্যাজা মিষ্টু আর বিশাখার সমান ভাগ। মুড়ো আর কাঁটা মিলেমিশে যায় চচ্চড়িতে। সেদিন সকলে সমান। গোটা ডিম ভাগ হয় সমান সমান। পাতলা সুতো দিয়ে নিখুঁত দুটি টুকরো। সাদা রিঙের মধ্যে কমলা-হলদে সূর্য। খেতে বসে হাসাহাসি। আলু আর ডিমের মধ্যে টানাটানি। আমি গত সপ্তাহে খেয়েছি, আজ তুমি নাও। সমবন্টন। সংগঠন আর সংসারে তত্ত্বের উপযুক্ত প্রয়োগ।         

বেলা হলে অনঙ্গ আর বিশাখা ভাগাভাগি করে স্নান সারেন তোলা জলে। আবার বিকেলে একচোট জল গুছিয়ে রাখা। এতদিন এভাবেই চলছিল। খুব সম্প্রতি পৌরসভা জলের একটা লাইন দিয়েছে পাড়ার মধ্যে। তার পর থেকে টিউবওয়েল পাম্প করে জল তোলার চাপ কমেছে খানিকটা। ঘরের কাছেই লাইন হওয়ায় টুক করে বালতি ভরে আনা যায়। আজ গলির পাশে কলে গিয়ে বসে চাদরদুটো কেচে আনলেন বিশাখা। এসব অভ্যেস থাকা ভালো। ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়ছে বলে তিনি এমন কিছু জাতে ওঠেননি। বাবুয়ানি তাকে মানায় না। দিনের শেষে সেই তো তাকে কণ্ডাকটর শিবুদা’র বউ বলেই সকলে চেনে। অবশ্য শুধু চেনে বললে ভুল হবে। খুবই শ্রদ্ধা সম্মান করে। তার কারণ বিপাশার ব্যবহার। শিবপদ যেমন জনসংযোগ করেছেন হইহই করে, বিশাখা তেমন নম্র হয়ে মিশে থেকেছেন সকলের সঙ্গে। কলোনীর প্রত্যেকের আপদে বিপদে একডাকে দৌড়ে যাওয়া, চুপচাপ উপকার করে আসা, কোনও উচ্চকিত আত্মম্ভরিতা নেই, হাঁক-ডাক নেই।  

বিয়ের পরে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়েছিল। অনঙ্গবালার জন্য আবার খুব দ্রুত সব কিছু সহজ হয়ে গিয়েছিল। এমন এক-একজন মানুষ থাকেন বলেই পৃথিবীতে রঙ রস গন্ধ অমলিন থাকে।

বিপাশার কাছে অনঙ্গবালা এক আশ্চর্য আবিষ্কার।

শিবপদর সঙ্গে বিপাশার বিয়েও হয় কেমন অদ্ভূত যোগাযোগে।

       মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ মানেই টাইপ রাইটিং শেখার শুরু। সকাল ছটায় ওঠা আর তারপর সাতটা  থেকে টাইপ শেখার ক্লাস। ছেলেমেয়ে সকলে একসঙ্গে নয়। মেয়েদের যদি সাতটা থেকে আটটা অবধি ক্লাস থাকে, তাহলে ছেলেদের আটটা থেকে ন’টা। পুরনো আমলের বাড়ির দোতলার দুটি ঘরে একের পর এক টেবিল। কালো কালো টাইপ মেশিন চলছে খটাখট শব্দে। একজন ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাঁকে দাদা বা কাকা যা খুশি বলে ডাকা যায়। বয়স বোঝা মুশকিল। বিশাখা অবশ্য বাবার সঙ্গে গিয়ে ভর্তি হবার সময় ঠিক করেছিল ‘স্যার’ বলেই ডাকবে। তার থেকে অনেকটাই বড় তো! ঘটিহাতা ফুলছাপ লম্বা ঘেরের ফ্রক পরা মেয়েটির মতো আরও অনেকেই আসে সকালে। শাড়ি পরা, স্কার্ট পরা, কোটফ্রক পরা। কারও মাথার চুলে রাতের বাঁধা বেড়াবিনুনি রয়েই গেছে। মাথার সামনে চুলটুকু শুধু আঁচড়ে নিয়েছে। কেউ চুল খুলে আবার বেঁধে নিয়েছে। কারও দুটি ক্লিপ দিয়ে আঁটা কানের পাশে। ঘাড় অবধি ছাঁটা চুল। বোঝাই যায় সম্পন্ন পরিবার। চুল বাঁধার স্টাইল দেখে, জামার কাটিং দেখে আর্থিক অবস্থান বোঝা খুব কঠিন নয়। বিশাখা সকলকেই মন দিয়ে লক্ষ্য করে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বয়সে তেমন কোনও মাপকাঠি খুঁজে পায়নি বিশাখা। সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিত কে কোথায় বসেছে। পাড়ার মধ্যে পরিচিত কোনও মুখ আছে কি না। অনেকেই তো ক্লাস ছেড়ে দিত। কেউ মাসখানেক, কেউ মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর।  

       বিশাখা ক্লাসের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় প্রতিদিন ভাবত, ওই মেশিনটায় এবার কে এসে বসবে? টাইপ মেশিনের কালো রোল ঘুরিয়ে হিজিবিজি টাইপ করা কাগজ জমা দিয়ে বেরোনোর সময় ওর ঘাড় নিচের দিকে। বাইরে ছেলেদের জটলা। এর পরের ঘন্টায় ছেলেদের ক্লাস। 

এই ক্লাসেই শিবপদ আসত। খুব গম্ভীর। ভীষণ শান্ত। ঘড়িতে ঠিক আটটা বাজত তখন। দরজার বাইরে দাঁড়াত চুপচাপ।

বিশাখা ওকেই একমাত্র দেখেছিল। কারণ, বিশাখার ছেড়ে যাওয়া টাইপ মেশিনটা পরের এক ঘন্টা থাকত শিবপদর জিম্মায়।        

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত