| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: দুই জোড়া জুতার গল্প । মনিষা দাশ গুপ্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

এখন টাকার জন্য হিসাব করতে হয়না। কোনো কিছুর অভাব নেই। একটি চাহিদা কম পড়লেই ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। এক্ষুনি লাগবে! মেয়ের জুতা ছিঁড়ে গেছে,তৎক্ষণাৎ জুতার দোকানে। জুতা দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ে তিন যুগ আগের একই রঙের সেই ডিজাইন। যার স্মৃতি আজও আমি ভুলতে পারিনি। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে বললাম, এইটা নেব আমি। 

মেয়ে আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে কিছু হয়তো ভাবছে। অন্য দিকে অতীত আমায় হাত ধরে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেছে। যেখানে আমি ও আমরা, কিছু বাঙালী পরিবার,পাহাড়ি,মদেশিয়ান  চা শ্রমিকদের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ছিলাম সুদিনের অপেক্ষায়। চারিদিকে বুভুক্ষু মুখ তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকতো কখন রিলিফের বিস্কুট পাবে বা অন্য খাবার।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সব হারানো দলের লোক আমরা সবাই। বলতে গেলে শূন্য থেকে শুরু মাত্র। ডাল আর সজনে পাতার বড়া অথবা শাক লতা পাতা দিয়ে রিলিফের মোটা চালের ভাত জুটে যায়। তখনকার সময়ে সকলের মাঝে প্রাণ ছিল। আনন্দের কমতি কোথাও ছিল না। একটি অলিখিত বন্ধন ছিল সবার মাঝে। যা বুঝিয়ে দিত মানুষ মানুষের জন্য। 

আবার নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে সবাই নেমেছে। ক্ষুদ্র পরিসরে বসবাসরত পাহাড়িদের ভীড়ে বড় হয়ে ওঠা। চা বাগানের অলি গলি নখ দর্পনে। মনের পর্দায় আজও প্রতিটি অলিগলি হেলেদুলে ঘুরে বেড়ায়। তার বর্ণনা দিতে গেলে শুরু হবে, শেষ হবে না। 

উঁচু নীচু টিলা গুলো অসমান হলেও, চা গাছগুলো  সমান ভাবে ঢেউ খেলে গেছে। ছায়া বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখি আর আর ভাবি, এত নিঁখুত করে ওরা কীভাবে কলম করে! আবার ভাবি ছোট বড় টিলা গুলোর কোল ছুঁয়ে যে ঝরনা বয়ে চলেছে, তার শুরু কোথায়!

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, বৃক্ষ সারির ফাঁকে ফাঁকে আকাশের কোলে মেঘের খেলা। মাটির উপর ঘাসের বুকে অতি সন্তর্পণে নগ্ন পা ফেলে চলি, শুধু মাত্র একটি ঘাস ফড়িং ধরার জন্য। আবার অবাক চোখে প্রজাপতির পাখা দেখা।

কখনো কখনো থমকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখা চা পাতা তোলার দৃশ্য। চা শ্রমিকদের বিরতিহীন চা পাতা তোলার সময় তাদের হাতের কাঁচের চুড়ি গুলো রিনিঝিনি বাজে তখন মনের কোথায় যেন অজানা একটি পাহাড়ি সুর দাপিয়ে বেড়ায়। সাথে মাদলের তাল।

মাঝে মধ্যে চা গাছের ফাঁক ফোকরে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে দৃষ্টি আটকে যেত চা গাছের আড়াল থেকে দেখা দুটো পায়ে। সাদা মোজা ও বুট জুতাতে। ধীরে ধীরে মাথা তোলে চা গাছ ভেদ করে উঁকি মেরে দেখি। ওমা, এতো সাহেবের (ম্যানেজার) পা! ঠিক এমন সময় লাখুয়ার ডাক,ও বুচিয়া, ঠাকরাইন তুকে খুঁজছে। বরো বাজেক। ঘন্টা পড়ে গেল। ছিনান নাই করবিক? 

চা গাছের টিলাগুলো নম্বর দিয়ে চিহ্নিত। বাসা ও চা ফ্যাক্টরির নিকটতম টিলায় ছিলাম। লাখুয়ার ডাক শুনে দৌড়ে কোয়ার্টারের সামনে এসে দাঁড়ানো। দুপুর বারোটার ঘন্টা ঢং ঢং করে বেজে ওঠার সাথে সাথে বড়ো বড়ো টুকরি মাথায় নিয়ে চা শ্রমিকরা সারি বদ্ধ হয়ে চা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তোলা চা পাতা ওজন করার জন্য।

সামনের টেবিলের উপর একটি ওজন মেশিন। সর্দার দুজন দুই দিক থেকে বড় টুকরি মাথা থেকে নামিয়ে ওজন মেশিনে বসায়, উচ্চস্বরে নাম ধরে বলে,সাবিত্রী পচ্ছিস কেজি। লকখী তিরিশ কেজি, জলেশ্বরী আটঠাইশ, গঙ্গা পয়তিরিশ।

টেবিলের সামনে নড়বড়ে একটি চেয়ারে বসে বড় টিলাবাবু সকলের নামের পাশে কেজির হিসাব লিখে রাখে। আমার দৃষ্টি সবার নগ্ন পায়ের সাথে টিলা বাবুর পায়ে কাপড়ের জুতা মোজার তফাৎ খোঁজে। মোজার মধ্যে অনেক চোর কাটা বিঁধে আছে। অতি সাধারণ। অথচ আমার চোখে অনেক কিছু।

আর দশটা ছেলে মেয়ের মত আমিও স্কুলে যাই নগ্ন পায়ে। অবশ্য পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখার সময় কারো হতেই নেই। নগ্ন পা, হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা মাখা পা গুলো দেখতে খারাপ লাগে না। চা বাগানে শ্রেণী হীন স্কুলে সবাই একই দলের। কারো পায়েই জুতা নেই। তাই জুতা নিয়ে বাড়াবাড়িও নেই।

অথচ আমার মনে জুতা নিয়ে সবসময় একটা খটকা লেগেই ছিল। বেশির ভাগ লোকের পায়ে কোনো জুতা নেই। মাত্র হাতে গোনা ক’জন জুতা পড়ে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করলে উত্তর আসতো,বড় হও, লেখা পড়া শিখ, তুমিও জুতা পড়তে পারবে। কবে বড় হব,কবে জুতা পাব এই ভাবনা সব সময় মাথায় কিলবিল করে।

নগ্ন পায়ে যখন খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াই,সবুজের সমারোহ খুব নিঃশব্দে মন ছুঁয়ে যায়। ঘাসের বুকে পা ফেলে যখন চলি,তখন নগ্ন পায়ে মোলায়েম কোনো সবুজ কার্পেটের মত অনুভূত হয় সবুজ ঘাসের স্পর্শ। তখন আর জুতার জন্য আফসোস থাকে না।

ঘাস ফুলে যখন ফড়িং উড়ে বেড়ায়, তার পিছু ছুটে চলা পথে খেয়াল থাকেনা কাঁটার ঘায়ে পায়ের পাতা রক্তাক্ত। উপুর কাঁটা তুলতে গিয়ে নজর পড়ে চা পাতা তুলতে যাওয়া চা শ্রমিক মহিলাদের পায়ের দিকে। আহা রে, না জানি কত কাঁটা বিঁধে ওদের নগ্ন পায়ে। সারিবদ্ধ চা শ্রমিকদের পিছনে মাথায় ছাতা, হাতে একটি মজবুত লাঠি নিয়ে টিলাবাবুরা হেলেদুলে হেঁটে চলে। আমার দৃষ্টি সব সময় তাদের পায়ের জুতা মোজার দিকে। কবে যে অমন এক জোড়া পাব!

শীতের দিনে একজোড়া চটি কখনো কখনো মিলে বৈকি। ওটাও না থাকার মত। কতবার জোড়া তালি দেয়া হয়েছে। তার কোনো হিসাব নেই। তবুও আমার কাছে ছেঁড়া চটি দু’খানা অনেক দামি। খুব যত্ন করেই রাখি। ঐ দিন হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে যায়। ঠাকুরদা বাঁশের বেড়া থেকে চিকন তার খুলে স্যান্ডেলটা জোরা তালি দিয়ে  ঠিক করে দেয়। ওতেই মহাখুশি। 

পিঠাপিঠি দুইজন। আমি ও আমার ভাই। এই দুই ভাই বোনের  দুই জোড়া জুতা ও খেলনা গুলো মা যক্ষের ধনের মত যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। প্রথম মা হবার  স্মৃতি হিসাবে। তখন কি জানতেন অভাব এসে চারিদিকে এমনভাবে গ্রাস করবে! অভাবের মানে কি তখনো আমার বোধগম্য নয়। আমার কাছে অভাব টা অন্য শব্দ গুলোর মত একটি শব্দ মাত্র। 

পরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া ছোট ভাইবোন দুটো কে শীতের দিনে ঐ দুই জুতা পড়ানো হতো। সর্ব কনিষ্ঠ জন কাঁথা কাপড় মুড়িয়ে ঠাকুরদার কোলে বসে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কি দেখে কে জানে? আমার কাছে মনে হতো আমার মতই ওরও নজর জুতার দিকে।

চা বাগানের শ্রমিকদের পায়ে জুতা না থাকলেও টিলাবাবুরা যখন হাফপ্যান্ট ও জুতা মোজা পড়ে কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, আমার দৃষ্টি ও চিন্তায় থাকে কবে এই রকম জুতা হবে! আদৌ জুতা হবে কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু স্বপ্ন ছিল টিলা বাবু হব। এটাই একমাত্র জীবনের লক্ষ্য। টিলা বাবু হলেই জুতা মোজা থাকবে।

আমার দুই ফিতার স্যান্ডেলটা আমার কাছে মহা মূল্যবান। যদি ছিঁড়ে যায় এই ভেবে খালি পায়ে স্কুলে যাই। বাসায় ফিরে স্নান করি। তারপর হাতে পায়ে ভালো করে সরিষার তেল মেখে ঐ স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে গর্বিত হাসি মুখ নিয়ে বিছানায় উঠে বসি। হোম ওয়ার্ক করতে করতে স্যান্ডেল দুটোর প্রতি লক্ষ রাখি। মেজ ভাইটা যেন সুযোগ পেয়ে পায়ে না দেয় !

বাবাকেও দেখতম তাঁর দুই জোড়া জুতার অনেক যত্ন করতেন। এখনো মনে পড়ে কালো একজোড়া প্লাস্টিকের জুতা ধুয়ে মুছে রোদে শুঁকিয়ে যত্ন করে রেখে দিতেন। এই জুতা জোড়া ছিল বৃষ্টির দিনে পড়ার জন্য। 

ব্যাংকে বা অফিসের কাজে অথবা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার সময় অন্য একজোড়া সু ছিল বাবার বড় আদরের। শুনেছি বাবার বিয়ের সময়ের ঐ জুতা জোড়া  কিনেছেন। ওটার যত্ন একটু বেশি ছিল। কালি দিয়ে ব্রাশ করে চকচকে করে তোলে। আবাক হয়ে দেখি। কিন্তু ঠাকুরদার পায়ের খরম দুটো একটুও ভাল লাগে না। কেমন যেন খট খট একটা শব্দ হয়।

আশেপাশের সমবয়সীদের একই অবস্থা। শুধু মাঝে মাঝে নজরে পড়ে ম্যনেজারের বাচ্চা গুলো বাটার জুতা পরে গট গট করে হাঁটে। জানি, কিন্তু বুঝে ওঠার বয়স হয়নি তখনও, তবুও জিজ্ঞেস করি, জুতার কি অনেক বেশি দাম বাবা? অনেক টাকা লাগে বুঝি? 

বাবা কিছু বলার আগেই মায়ের উত্তর চলে আসত। হাসি মুখে, খোশ মেজাজে বলত, “এবার তোমার বাবা পূজোর বোনাস পেলে তোমাদের সবাইকে নতুন জুতা কিনে দেবো।” আর জামা? তাও হয়ে যাবে। মায়ের উত্তরে সন্তুষ্ট। জামা নিয়ে আমার এতো মাথাব্যথা ছিল না। জামা হলে হবে না হলে নেই, জুতা হবে! এতেই খুশি।

এমনি করে আমার বাল্যকাল কাটে। আশে পাশে স্কুলের অভাবে পড়াশুনার জন্য চলে আসি শহরে। পিসির বাড়ি। ভর্তি হই সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। জীবনের প্রথম স্কুলের নির্দিষ্ট পোশাক মিলে। সাথে বাটার সাদা কাপড়ের জুতা ও সাদা মোজা। সবসময় পায়ে দেবার জন্য বাটার একজোড়া স্যান্ডেল।

বাবাকে বলতে শুনেছি। মাকে বলছেন, শহরে পড়াতে অনেক খরচ গো। একটাকে হাই স্কুলে ভর্তি করতে সব মিলিয়ে একশ তিরিশ টাকা লেগেছে। আমি কি পারবো সবগুলো ছেলে মেয়েকে পড়াতে! মা বলেন, সময়ই ঠিক করে দেবে। কষ্ট হবে, কিন্তু হয়ে যাবে।

এখনো মনে পরে,আমি সারারাত জামা কাপড় জুতা মোজা, সব কিছু নিয়ে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। আনন্দের চেয়ে বিস্ময় ছিল বেশি। আর কল্পনায় শুধু একটাই ছবি ছিল আমরা সব ভাইবোন শহরের ছাত্রছাত্রীদের মত জুতা পায়ে স্কুলে যাবো। 

প্রথম দিকে স্কুল আমার ভালো লাগেনি। বাঁধা ধরা নিয়মনীতি গুলো শাস্তি মনে হতে থাকে। কান্নাকাটি করে মাঝে মধ্যেই মায়ের কাছে চলে যাই। সময়ের স্রোতে বয়স আরো এক বছর বাড়ে। নিজের ভাবনার ভীড় থেকে কচি মনে কনিষ্ঠ ভাই ও বোনের প্রতি টান অনুভব করি।

ভাইবোনের উষ্ণ সান্নিধ্য অন্তর জুড়ে থেকে যেত। ফিরে এসে স্কুলে যাই। যখন টিফিন হাতে নিতাম মনে হতো গ্রামের স্কুলে তো টিফিন দেওয়া হয় না। কষ্ট  হতো। ছুটিতে গিয়ে নতুন করে দেখা। ছোট ভাই-বোন গুলো নগ্ন পায়ে দুই মাইল হেঁটে স্কুলে যায়।

 

শহরে ফিরে সেকি কান্না। জুতাও স্কুলের ইউনিফর্ম পরিধানের আনন্দ কোথায় গিয়ে যেন ফিকে হয়ে যায়। অথচ ওরা কত খুশি। গায়ের মেঠো পথ ধরে নগ্ন পায়ে পাঠশালায় যায়। মনের আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। আমার আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আমি কেমন যেন বেমানান হয়ে গেলাম।


আরো পড়ুন: গল্প: ফেল । শিবানী ভট্টাচার্য দে


ভাই বোনদের সাথে আমার একটা দূরত্ব আমার নজরে পড়ে। ছুটিতে বাসায় গেলে দেখতাম, ভাইবোন গুলো জিজ্ঞেস করতো, দিদি তোমার জুতা একটু পরে দেখি! হাত দিয়ে দেখি! আগে কখনোই অনুমতি নিত না। আমার খারাপ লাগত। ওরা ভাবে আমার আসবাবপত্র ধরলে আমি বোধ হয় কষ্ট পাই। 

ঐ বছর পূজার ছুটিতে চা বাগানে গেলাম। বাগানের অন্য এক স্টাফের বাচ্চারা শহরে থাকে। তারা সবাই পূজার ছুটিতে চা বাগানে আসে। অষ্টমী পূজার দিন আমার সমবয়সী স্টাফের মেয়েটি  হাই হিল পায়ে দিয়ে মন্ডপে আসে। চা শ্রমিকের বাচ্চা কাচ্চা সহ সকলে মেয়েটিকে ঘিরে ধরে। সবাই নজর হাইহিলের দিকে। আমার মেজ বোন জিজ্ঞেস করলো, দিদি তোমারও এত উঁচু জুতা আছে! আমি বলি, না।

টিফিনের জন্য প্রতিদিন এক টাকা মিলে। পিসেমশাই দিতেন। চেষ্টা করি এক টাকা থেকে কিছু পয়সা জমানোর, কিন্তু কেন যেন জমাতে পারি না। কখনো আচার, কখনো চানাচুর মাখা কিনে খাওয়া হয়ে যায়। তাই সবমময় দশ পয়সা বাঁচলেও একটি মাটির ব্যংকে রেখে দিতাম। পঁচিশ পয়সা দিয়ে মাটির ব্যাংকটি মেলা থেকে কিনে ছিলাম।

বাটার জুতার দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় ছোটদের জুতার দাম জিজ্ঞেস করে যেতাম। দাম শুনে মন খারাপ হয়ে যেত। তবু আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি গ্রীষ্মের ছুটির পূর্বে জমা হয়ে যাবে দুই জোড়া জুতার মূল্য। তখন জুতা কিনে চা বাগানে যাব। ছোট ভাই বোন দুজনের সুন্দর দু’ জোড়া জুতা হবে!

একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি মাটির ব্যাংকটা খালি। ঝাঁকুনি দেই, কিন্তু বাজে না। পিসিকে বলি। কিন্তু কোনো ফল হয়না। উল্টো বকুনি দিয়ে বলে কে নিবে তোর জমানো টাকা। খুব কান্না পায়। রাতে বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদি। সকালে মন খারাপ করে স্কুলে চলে যাই। সারাদিন মন খুব খারাপ থাকে। স্কুল ছুটির আর মাত্র দুই দিন বাকি।

বিকেলে পাড়ার ছেলে মেয়েদের সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে  নজরে পড়ে আগাছার আড়ালে অনেক গুলো জুতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পিসির ছেলে মেয়ের ও অন্যদের পুরানো অনেক গুলো জুতা ফেলে দিয়েছে। কে ফেলেছে জানা নেই। খুশিতে মন ভরে ওঠে। সবগুলো জুতা বেছে বেছে দুইজোড়া জুতা অতি সন্তর্পণে সবার চোখের  আড়াল করে ইত্তেফাক পত্রিকায় পেঁচিয়ে আমার ব্যাগে রেখে দেই।

ছোট ভাই বোন জুতা পেয়ে মহাখুশি। একবার গুছিয়ে রাখে। একবার পায়ে দিয়ে দেখে। সমবয়সীদের দেখিয়ে বলে আমার দিদি এনেছে। আমিও খুব খুশি হই। ভাল লাগে ওদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে। আমার পায়ে তখন চল্লিশ টাকা দামের বাটার মুক্তা জুতা।

দিন পনের পর পিসি সাত দিনের জন্য বাচ্চাদের নিয়ে চা বাগানে আসেন। বাসায় আনন্দের বন্যা। বারান্দায় বসে সবাই গল্প করছিল। হঠাৎ পিসির নজরে পড়ে জুতা দুইজোড়ার উপর। জুতা গুলো হাতে নিয়ে পিসি জিজ্ঞেস করে এই জুতা কোথায় পেলে গো বৌদি ! 

ভয়ে আমার অন্তরাত্মা চোখের পলকেই শুকিয়ে যায়। মা পিসির হাতে চা দিয়ে বললেন, ওমা তুমি ভুলে গেলে! নীলার সাথে তুমিই তো পাঠিয়েছো, তোতন ও টুলুর জন্য।

মনে মনে বলি আমি চুরি করিনি। ফেলে দেওয়া আবর্জনার স্তূপ থেকে তুলে নিয়ে এসেছি। শুধু কাউকে জানাইনি। যদি মা এই কথা জানতে পারেন, আমাকে আস্ত রাখবেন না। ভিতরে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। জুতা গুলো হাত থেকে ফেলে পিসি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকায়।

শুষ্ক চোখ দুটো জ্বালা করছিল। পিসির চোখে চোখ পড়তেই  দ্রুত মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে থাকি। পিসি আমাকে কিছুই বলেননি। দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে সকলের অলক্ষ্যে পিসি ও আমার মাঝে অনেক কিছু বলা হয়ে য়ায়। সকলের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি।

পিসি চায়ের কাপে চুমুক দিতে শুরু করে। আমি এই সুযোগে তাড়াতাড়ি করে দুই জোড়া জুতা সবার চোখের আড়াল করে রাখার জন্য অন্য কক্ষে চলে যাই। কিন্তু মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারিনি। আড়ালে ডেকে সত্যিটা কি জেনে নেন। বলেন, “নীলা ভবিষ্যতে এমন কোনো কাজ করো না,যাতে নিজের কাছে নিজেকে ছোট হতে হয়।”

সেই মুহূর্তে তেরো বছরের এই আমি মায়ের চেহারায় প্রথম দেখি আহত এক সৈনিককে। যে ধ্বংস স্তূপের উপর বিজয় পতাকা গেঁড়ে বসে আছে সন্তানের আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত